গর্ভধারণের ৪১তম সপ্তাহ

এ সপ্তাহের হাইলাইটস

ডেলিভারির তারিখ নিয়ে ঘাবড়ে যাবেন না 

ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ পার হয়ে গেলে ঘাবড়ে যাবেন না। সম্ভাব্য তারিখের কয়েকদিন আগে-পরে ডেলিভারি হওয়া স্বাভাবিক। তবে এ সপ্তাহে অবশ্যই ডাক্তার দেখাবেন। এ সপ্তাহ পার হয়ে আরও দেরি হতে থাকলে বিকল্প কী কী উপায়ে প্রসব শুরু করানো যেতে পারে, তা নিয়ে ডাক্তার আপনার সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

প্রসব বেদনা উঠলে রিল্যাক্স করার চেষ্টা করুন

প্রসববেদনা উঠলে ঘাবড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। দুশ্চিন্তা না করে নিজেকে যতটা সম্ভব রিল্যাক্সড রাখতে চেষ্টা করুন। পেটের প্রতিটা সংকোচনের সাথে শ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন। একেকটা সংকোচন যখন শেষের দিকে আসবে, তখন চোখদুটো বন্ধ করে রিল্যাক্স করার চেষ্টা করুন। পরবর্তী সংকোচন শুরু হওয়ার আগে শরীরকে একটু বিশ্রাম দিন।

এক পাশে কাত হয়ে ঘুমান

এ সপ্তাহেও ঘুমানোর সময়ে আপনার সুবিধামতো একদিকে কাত হয়ে ঘুমাবেন। কারণ চিৎ হয়ে ঘুমালে শিশুর ক্ষতি হতে পারে।[১][২] ঘুমের সময়ে সাপোর্ট দেয় এমন আরামদায়ক কয়েকটা বালিশ নিয়ে ঘুমাতে পারেন।

আয়রন-ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান

বিগত সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান। এগুলো গর্ভের শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[৩][৪] পাশাপাশি আপনাকে মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করতে পারে।[৫]

  • মাসে কত দিন? ১০ মাস ১ সপ্তাহ
  • কোন ট্রাইমেস্টার? তৃতীয় ত্রৈমাসিক
  • আর কত সপ্তাহ বাকি?

৪১ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি

Week-41
বড় কাঁঠাল
আপনার বাচ্চা এখন প্রায়
একটি একটি বড় কাঁঠাল
এর সমান
দৈর্ঘ্য
৫১.২ সেমি
ওজন
৩.৫-৪ কেজি

আপনার গর্ভের শিশুর ওজন এখন প্রায় ৩–৪ কেজি। যদিও সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় তবুও আপনি কল্পনা করে নিতে পারেন যে, আপনার গর্ভে ছোট্ট শিশু এখন প্রায় একটি বড় কাঁঠালের সমান লম্বা।

শিশুর ঘুমের রুটিন

গর্ভের ভেতরে আপনার শিশুর একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে ঘুমানোর এবং একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে জেগে থাকার রুটিন আছে।[৬] আপনি যখন ঘুমাতে যাচ্ছেন তখন হয়তো আপনার শিশু পুরোপুরি জেগে আছে। এমনকি সে হয়তো নড়াচড়া করতে ব্যস্ত।

ছেলে শিশুর শুক্রাশয় নিচে নেমেছে

আপনার গর্ভের শিশু ছেলে হয়ে থাকলে এখন সম্ভবত তার শুক্রাশয় নীচের দিকে নেমে গেছে।[৭] অর্থাৎ তার শুক্রাশয় এখন স্ক্রোটাম বা শুক্রথলিতে আছে। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে ছেলে শিশুদের শুক্রাশয় পেটের দিকে থাকে।[৮] পরবর্তীতে তা নীচে নেমে শুক্রথলির ভেতরে প্রবেশ করে।

ছোট্ট শিশু এখনো নিয়মিত নড়াচড়া করছে

আপনার গর্ভের শিশু এখন বেশ বড়সড় হয়ে গিয়েছে। তাই গর্ভের ভেতরে সে এখন অনেকটা চাপাচাপি করে শুয়ে আছে। তবুও তার নড়াচড়া কমে কিংবা বন্ধ হয়ে যাবে না।[৯]

শিশু তার নির্দিষ্ট ধরনে এখনো নিয়মিতভাবে নড়াচড়া করতে থাকবে। আপনার গর্ভের শিশুর নড়াচড়া স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে অথবা বন্ধ হয়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।[১০] কেননা এটি কোনো জটিলতার লক্ষণ হতে পারে।

নড়াচড়া কমেছে কি না সেটা বুঝতে কষ্ট হলে বাম কাত হয়ে ২ ঘন্টা শুয়ে থাকুন। এসময়ে ১০ বারের কম নড়াচড়া টের পেলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।[১১]

নড়াচড়া কমে যাওয়া মানেই যে খারাপ কিছু ঘটে গেছে, এমন না। তবে ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া প্রয়োজন।

৪১ সপ্তাহে মায়ের শরীর

গর্ভধারণের ৪১তম সপ্তাহ

ইতোমধ্যে সম্ভবত আপনার ডেলিভারি ডেট পার হয়ে গেছে। এখনো প্রসব বেদনা ওঠেনি দেখে ঘাবড়ে যাবেন না। সম্ভাব্য তারিখের কয়েকদিন আগে-পরে ডেলিভারি হওয়া স্বাভাবিক। নিয়মিত চেকআপ চালিয়ে যাবেন। এ সপ্তাহ পার হয়ে আরও দেরি হতে থাকলে বিকল্প কী কী উপায়ে প্রসব শুরু করানো যায়, তা নিয়ে ডাক্তার আপনার সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আপনিও সে অনুযায়ী মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারবেন।

ব্যথা উঠলে করণীয় 

প্রসব বেদনা ওঠা নিয়ে আপনার মনে নানান ধরনের ভীতি কাজ করতে পারে। যেহেতু লেবারের প্রথম ধাপ নতুন মায়েদের জন্য সাধারণত ৮–১২ ঘন্টা সময় ধরে চলে,[১২] তাই ব্যথা ওঠার পর রিল্যাক্সড থেকে শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে রাখা ভালো।

এসময়টাতে নিজেকে শান্ত করতে শ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন। পেটের প্রতিটা সংকোচনের সাথে সময় নিয়ে বড় করে শ্বাস নিন। একেকটা সংকোচন যখন শেষের দিকে আসবে, তখন চোখ দুটো বন্ধ করে রিল্যাক্স করার চেষ্টা করুন। পরবর্তী সংকোচন শুরু হওয়ার আগে শরীরকে একটু বিশ্রাম দিন।

পাশাপাশি এসময়ে হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। সেজন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখা এবং হাসপাতালের জন্য একটা ব্যাগ গুছিয়ে রাখা ভালো।

প্রাকৃতিক উপায়ে প্রসব শুরু করা

ঘরোয়া পদ্ধতিতে প্রসব শুরু করানো নিয়ে অনেক ধারণা প্রচলিত আছে। আপনি হয়তো শুনেছেন যে, ঝাল তরকারি খেলে অথবা খেজুর খেলে, স্তনের বোঁটা উত্তেজিত করলে, সহবাস করলে অথবা বেশি বেশি হাঁটলে প্রসব শুরু হয়। এগুলোর মধ্যে কোনোটা আপনার চেষ্টা করতে ইচ্ছে হতে পারে।

এসবের মধ্যে দুই-একটা ধারণার পক্ষে কিছু প্রমাণ আছে। যেমন, একটা ছোটো পরিসরের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখের আগের ৪ সপ্তাহে যারা নিয়মিত খেজুর খেয়েছেন, তাদের প্রাকৃতিকভাবে প্রসব শুরুর হার তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল।[১৩]

আরেকটা গবেষণায় দেখা গেছে যে গর্ভাবস্থার ৩৮তম সপ্তাহ থেকে যারা সপ্তাহে ৩ বার আধা ঘণ্টা করে হাঁটতেন, তাদের ক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে প্রসব শুরু করার প্রয়োজনীয়তা তুলনামূলকভাবে কম ছিল।[১৪]

এসব পদ্ধতির কার্যকারিতার পক্ষে এখনও যথেষ্ট প্রমাণ নেই।[১৫] তাই কোনো টোটকা চেষ্টা করে দেখতে চাইলে যেই অপশনটি আপনার জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত, কেবল সেটাই বেছে নিবেন।

পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ

এই বিশেষ ধরনের ব্যায়াম আপনার যোনিপথ ও মূত্রথলির আশেপাশের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে তোলে। ফলে সন্তান প্রসবের ধকল সামলানো সহজ হয়। প্রসবের পর হাঁচি, কাশির সাথে প্রস্রাব বের হয়ে যাওয়ার সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কমে। এখনো এই ব্যায়াম করা শুরু না করে থাকলে আজকে থেকেই শুরু করুন এবং প্রসবের পরেও ব্যায়ামটি চালিয়ে যাবেন।[১৬]

যেভাবে ব্যায়াম করবেন—

  • পায়খানার রাস্তা চাপ দিয়ে এমনভাবে বন্ধ করে রাখুন যেন বায়ু আটকানোর চেষ্টা করছেন। প্রস্রাবের রাস্তাতেও এমনভাবে চাপ দিন যেন প্রস্রাব আটকানোর চেষ্টা করছেন। একই সাথে যোনিপথকে চাপ দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
  • প্রথম কয়েকবার ব্যায়ামটা ধীরে ধীরে করার চেষ্টা করুন। ওপরের পদ্ধতিতে যতক্ষণ সম্ভব হয় চাপ দিয়ে ধরে রাখুন। প্রথমদিকে ৩ সেকেন্ড পর্যন্ত চাপ দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করুন। ধীরে ধীরে মাংসপেশিগুলো শক্তিশালী হতে থাকলে ১০ সেকেন্ড পর্যন্ত ধরে রাখার অভ্যাস করুন।
  • এরপর কয়েকবার ব্যায়ামটি দ্রুত করুন। চাপ দিয়ে ১ সেকেন্ড ধরে রেখে ছেড়ে দিন। এভাবে ১০ বার ব্যায়ামটি করুন।

এরকমভাবে ২০ বার চাপ দেওয়া এবং ছেড়ে দেওয়াকে এক সেট ব্যায়াম ধরা হয়। চেষ্টা করুন দিনে এভাবে অন্তত তিন সেট ব্যায়াম করতে। মনে রাখার সুবিধার জন্য প্রতিবেলা খাওয়ার আগে এক সেট ব্যায়াম করতে পারেন। বাথরুম ব্যবহার শেষেও এভাবে ব্যায়াম করতে পারেন। তবে পায়খানা-প্রস্রাব করার সময়ে এই ব্যায়ামটি করবেন না।

চেকআপ চালিয়ে যাওয়া

শেষ সপ্তাহগুলোতে সাধারণত প্রতি সপ্তাহে একবার করে চেকআপে যাওয়া জরুরি। চেকআপে আপনার ও শিশুর সুস্থতা বোঝার জন্য ডাক্তার বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করতে পারেন। ডেলিভারি হতে দেরি হলে কোন বিকল্প পদ্ধতি আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত, সেটাও ডাক্তার আলোচনা করবেন। তাই এখনো এ সপ্তাহের চেকআপ না করিয়ে থাকলে আজই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে চেকআপের ব্যবস্থা করুন।

অন্যান্য লক্ষণ

এ সপ্তাহে আপনার আরও যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—

এ ছাড়াও এ সপ্তাহে আপনার প্রথম দিকের সময়ের লক্ষণগুলো থাকতে পারে। যেমন—

এ সপ্তাহে বাবার করণীয়

নিয়মিত চেকআপ চালিয়ে যেতে হবে

এসময়ে শিশুর মায়ের সাথে চেকআপে যাওয়া আপনার জন্য বিশেষভাবে জরুরি। গর্ভের শিশু সুস্থ আছে কি না, চেকআপে গেলে তা ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখবেন। প্রসব হতে যদি দেরি হতে থাকে, প্রসব বেদনা ওঠানোর কোন উপায়টি শিশুর মায়ের জন্য ও গর্ভের শিশুর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত, সেটা নিয়েও ডাক্তার আলোচনা করবেন। এই আলোচনায় আপনিও অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করুন। তাহলে আগামী দিনগুলোর জন্য প্রস্তুতির ব্যাপারে আপনারও একটা ধারণা থাকবে।

শেষ দিকে মায়ের জন্য চেকআপে যাওয়া কষ্টকর হতে পারে। তাই চেকআপে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে আপনি সাহায্য করতে পারেন।

সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে কি না সেটা নিশ্চিত করুন

শিশুর ডেলিভারির আগে আপনারা যেসব প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন, তার সবকিছু করা হয়ে গিয়েছে কি না সেটা আরেকবার ভালোমতো হিসেব করে ফেলুন। এখন যেহেতু বাড়তি কিছু সময় হাতে এসেছে, এই সময়টাকে ভালো করে কাজে লাগান। যদি তাড়াহুড়ার জন্য আগে কোনো প্রস্তুতি আপনাদের লিস্ট থেকে বাদ পড়ে থাকে, এ সময়টুকু কাজে লাগিয়ে সেই কাজগুলো গুছিয়ে ফেলুন।

মাথা ঠাণ্ডা রেখে অপেক্ষা করুন

নতুন শিশুর জন্য অপেক্ষার প্রহর প্রায় শেষ হয়ে এসেছে! কিছুদিনের মধ্যেই আপনাদের ছোট্টমণি পৃথিবীর আলো দেখবে। গর্ভধারণের যাত্রা প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। তবে শিশু জন্মের পর তার সাথে আবার নতুন একটা যাত্রা অপেক্ষা করছে!

আপনাদের সন্তান এখন যেকোনো মুহূর্তে জন্মগ্রহণ করতে পারে! এই অনিশ্চয়তাকে চাপ হিসেবে না নিয়ে যতটা সম্ভব উপভোগ করুন। ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে দুশ্চিন্তা কমানো সহজ হতে পারে। সম্ভব হলে নিজের জন্য খানিকটা সময় বের করুন। মাথা থেকে দুশ্চিন্তা সরিয়ে পছন্দের কোনো কাজ করে সময় কাটান।