প্রসবের লক্ষণ

প্রসবকালীন সময়ে কখন হাসপাতালে যেতে হবে তা নিয়ে কোনো সংশয় থাকলে আপনার ডাক্তার বা দক্ষ দাইকে জিজ্ঞেস করুন।

সন্তান জন্মদানের সময় যত ঘনিয়ে আসে, প্রসবের লক্ষণ নিয়ে মায়েদের চিন্তা-দুশ্চিন্তা তত বাড়তে থাকে। কখন পেটে টান অনুভব করলে সেটা প্রসববেদনা, যোনি দিয়ে নিঃসৃত স্রাব প্রসব শুরু হওয়ার লক্ষণ কি না—এমন নানান রকমের প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকে। তাই প্রসবের লক্ষণগুলো সম্পর্কে মায়েদের স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার যাতে প্রসবের সময়টা সুন্দরভাবে সামলানো সম্ভব হয়।

প্রসবের ধাপসমূহ

গর্ভের সন্তানকে জরায়ু থেকে যোনিপথ দিয়ে বের করে বাইরের জগতে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি হলো প্রসব। প্রসবকাল তিনটি ধাপে বিভক্ত। প্রতিটি ধাপেই আপনার মধ্যে বেশ কিছু শারীরিক লক্ষণ দেখা যাবে—

  • প্রথম ধাপে আপনার জরায়ুমুখ পাতলা হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এটি প্রসারিত হতে থাকে। যখন আপনার জরায়ুমুখ বাচ্চা প্রসবের জন্য পুরোপুরি প্রসারিত হয়ে যায় তখন এই ধাপটি শেষ হয়।
  • দ্বিতীয় ধাপে আপনার সন্তান জরায়ু থেকে জরায়ুমুখ দিয়ে যোনিপথে নেমে আসে এবং পর্যায়ক্রমে ভূমিষ্ঠ হয়। বাচ্চাকে বের হয়ে আসতে সহযোগিতা করতে এই পর্যায় পেটে চাপ তৈরি করে মায়ের কিছুটা ধাক্কা দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
  • তৃতীয় ধাপে আপনার জরায়ু থেকে গর্ভফুল আলাদা হয়ে বের হয়ে আসে। এই গর্ভফুলের মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় আপনার সন্তান আপনার থেকে অক্সিজেন ও পুষ্টি পেয়ে এসেছে। আবার সন্তানের বর্জ্য পদার্থগুলোও বের হয়েছে এই গর্ভফুলের মাধ্যমেই।

পড়ুন: প্রসবের ধাপসমূহ

প্রসবের সময় কাছে আসার কিছু প্রাথমিক লক্ষণ

প্রসব নিকটবর্তী হলে বিশেষ কিছু লক্ষণ মায়েরা খেয়াল করে থাকেন। তবে এই লক্ষণগুলো সবসময় প্রসবের লক্ষণ না হয়ে গর্ভাবস্থার শেষের দিকে স্বাভাবিকভাবেই দেখা দিতে পারে। এসব লক্ষণগুলো হলো—

১. গর্ভের সন্তান কিছুটা নিচে নামা: এটি আপনার প্রথম গর্ভাবস্থা হয়ে থাকলে প্রসবের কয়েক সপ্তাহ আগে আপনার মনে হতে পারে যে আপনার সন্তান গর্ভের কিছুটা নিচের দিকে অবস্থান করছে।

সন্তান তলপেটের দিকে নেমে যাওয়ার কারণে আপনার শ্বাস নেওয়া আগের চেয়ে সহজ হয়ে যেতে পারে। যদি গর্ভাবস্থায় আপনার বুকে অ্যাসিডিটির কারণে জ্বালাপোড়া থেকে থাকে সেটিও এসময় দূর হয়ে যেতে পারে। তবে এসময় আপনার মূত্রাশয়ের ওপর বাড়তি চাপ পড়ার কারণে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।

তবে দ্বিতীয় বা তার পরবর্তী গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে সন্তান নিচে নামার অনুভূতি সাধারণত প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরে হয়ে থাকে।

২. স্রাবের দলা নিঃসৃত হওয়া: যখন আপনার জরায়ুমুখ বড়ো হওয়া শুরু করে তখন যোনি দিয়ে একদলা স্রাব বের হতে পারে। এটি গর্ভাবস্থায় আপনার জরায়ুমুখে জমা হওয়া থাকে। সাধারণত এর অর্থ হলো আপনি প্রসব প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করছেন। তবে এটি প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কিছুটা সময় আগেও হতে পারে।

অনেকসময় স্রাব একটি দলায় একবারে বের না হয়ে, অল্প অল্প করে কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ জুড়ে বের হতে থাকতে পারে। তবে যদি এর সাথে প্রসবের অন্যান্য লক্ষণগুলো না থেকে থাকে তাহলে আপনার  চিকিৎসককে এই পর্যায়ে জানানোর দরকার পড়বে না।

৩. ’শো’ বা রক্ত মিশ্রিত স্রাব দেখা যাওয়া: গর্ভাবস্থার শেষের দিকে যখন আপনার জরায়ুমুখ নরম ও পাতলা হতে শুরু করে তখন আপনার যোনি দিয়ে রক্ত মাখা স্রাব বের হতে পারে। একে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় ‘শো’। আগে বর্ণিত স্রাবের দলা বের হয়ে যাওয়ার পর এটি হতে পারে, আবার আলাদাভাবে শুধুমাত্র রক্ত মিশ্রিত স্রাব-ও নিঃসৃত হতে পারে।

এমন স্রাব লক্ষ করার বেশ কিছু দিন পরে প্রসব শুরু হতে পারে। তবে রক্তক্ষরণ যদি স্বাভাবিক মাসিকের রক্তপাতের চেয়ে ভারী হয়, যদি রক্ত মাখা নিঃসরণের সাথে আপনার পেটে ব্যথা থাকে, অথবা যদি রক্তক্ষরণ অনেক দিন ধরে হয়ে থাকে এবং না কমে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

৪. জরায়ুমুখ পাতলা ও প্রসারিত হয়ে যাওয়া: প্রসব প্রক্রিয়ার একদম শুরুর দিকে আপনার জরায়ুমুখ পাতলা ও খাটো হয়ে প্রসারিত হতে শুরু হতে পারে। তবে এর আরও কিছু সময় পর সক্রিয় প্রসব শুরু হতে পারে।

যদি আপনি গর্ভকালে অ্যান্টিন্যাটাল সেবা নিয়ে থাকেন, তাহলে আপনার চিকিৎসক আপনার জরায়ুমুখ পাতলা, নরম বা প্রসারিত হতে শুরু করেছে কি না তা বলতে পারবেন। 

৫. পেটে অনিয়মিত, মৃদু টান অনুভব করা: গর্ভকালে আপনি পেটে বা তলপেটে টান অনুভব করে থাকতে পারেন যেগুলো অনিয়মিত ভাবে আসে যায় এবং কখনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী হয় না। একে ‘ব্রেক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন’ বলা হয়।

গর্ভাবস্থার শেষের দিকে এই টানগুলো আরও ঘন ঘন হতে পারে। প্রকৃত প্রসববেদনা শুরু হওয়ার আগে এমন হতে পারে।

প্রসবকাল শুরু হওয়ার নিশ্চিত লক্ষণ

গর্ভাবস্থার ৩৮ থেকে ৪২ সপ্তাহের মাঝে সাধারণত প্রসব শুরু হয়ে থাকে। প্রাথমিক লক্ষণগুলো বুঝতে সমস্যা হয়ে থাকলেও প্রসবের কিছু নির্ভরযোগ্য লক্ষণ হলো—

১. পেটে তীব্র টান ও ব্যথা অনুভব করা: সক্রিয় প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে আপনি পেটে তীব্র টান ও ব্যথা অনুভব করবেন—যা নির্দিষ্ট সময় পর পর হতে থাকবে। ব্যথা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী হবে এবং তারপর কমে যাবে। কত সময় পর পর ব্যথা হচ্ছে এবং কত সময় ধরে ব্যথা হচ্ছে সেটি লক্ষ করুন।

প্রকৃত প্রসববেদনা তীব্র হবে, আপনি টানের মাঝে কথা বলতে পারবেন না এবং ব্যথায় আপনার চোখে পানিও চলে আসতে পারে।

২. কোমর ব্যথা: যদি পেটে টান অনুভব করার সাথে আপনার কোমর ব্যথা হতে থাকে এটি প্রসবের একটি বিশেষ লক্ষণ। পেটে এক টান থেকে পরবর্তী টানের মাঝেও কোমর ব্যথা থাকবে। এর অর্থ হলো আপনার সন্তান তখন নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে এবং আপনার কোমরে চাপ তৈরি করছে। তবে অনেকের মতে জরায়ুর সংকোচনের ফলে কোমরে এই ব্যথা তৈরি হয়।

৩. পানি ভাঙা: জরায়ুর ভেতরে আপনার সন্তান ‘আ্যমনিওটিক স্যাক’ নামের একটি থলের মধ্যে বেড়ে ওঠে। সেখানে ‘অ্যামনিওটিক ফ্লুইড’ নামের এক ধরনের তরলের মধ্যে সে ভাসমান থাকে। প্রসব শুরুর সময়ে এই থলিটি ছিঁড়ে বা ভেঙে গিয়ে আপনার যোনি দিয়ে এই পানি বের হয়ে আসে। একে আমরা সাধারণ ভাষায় ‘পানি ভাঙা’ বলি।

যদি আপনার পানি ভেঙে যায় তবে প্রসববেদনা শুরু না হয়ে থাকে তবে একে বলা হয় ‘প্রিম্যাচুর রাপচার অফ মেমব্রেন’। পানি ভাঙার ৬ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি আপনার প্রসব প্রক্রিয়া শুরু না হয়ে থাকে তবে চিকিৎসক আপনাকে ঔষধ ব্যবহার করে প্রসব শুরু করার উপদেশ দিতে পারেন।

এর কারণ হলো, অ্যামনিওটিক ফ্লুইড আপনার সন্তানকে বিভিন্ন জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। পানি ভাঙার পর, তরল ছাড়া গর্ভের ভেতর সন্তান বেশি সময় থাকলে তার ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেজন্য চিকিৎসক আপনাকে ঔষধের সাহায্যে দ্রুত প্রসব প্রক্রিয়া শুরু করার পরামর্শ দিতে পারেন।

অন্যদিকে যদি আপনার পানি ৩৭ সপ্তাহের আগে ভাঙে এটি আপনার অকাল প্রসব, অর্থাৎ সময়ের আগেই সন্তান প্রসব হওয়ার একটি লক্ষণ হতে পারে। তাই ৩৭ সপ্তাহের আগে আপনার পানি ভাঙলে সাথে সাথে হাসপাতালে যান।

প্রিটার্ম লেবার বা সময়ের আগে প্রসব

সাধারণত ৩৭ থেকে ৪২ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতী মায়েরা প্রসব করে থাকেন। ৩৭ সপ্তাহের আগে যদি আপনার জরায়ুর নিয়মিত সংকোচন শুরু হয়ে আপনার জরায়ুমুখ প্রসারিত হয়ে যায় তাকে প্রিটার্ম লেবার বা অকাল প্রসব বলা হয়।

এই সংকোচন বা টানগুলো ‘ব্রেক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন’ না কি প্রকৃত প্রসববেদনা, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হতে পারে। বুঝার উপায় হলো, যদি টানগুলো অনিয়মিত ভাবে আসে যায় এবং কখনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী না হয়, তবে সেগুলো প্রকৃত প্রসববেদনা না।

প্রসববেদনার টান নিয়মিত সময় পর পর অনুভব করতে পারবেন এবং টান নির্দিষ্ট সময় জুড়ে থাকবে। সময়ের সাথে সাথে সন্তান প্রসবের আগ পর্যন্ত প্রসববেদনার তীব্রতা ও সময়কাল বাড়তে থাকবে।

তবে যদি ৩৭ সপ্তাহের আগে আপনার নিচের লক্ষণগুলো দেখা দেয় তবে আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন—

  • স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি স্রাব বের হওয়া
  • সাধারণের চেয়ে আলাদা স্রাব (যেমন: পানি পানি, আঠালো কিংবা রক্তমিশ্রিত স্রাব) বের হওয়া
  • যোনি দিয়ে রক্ত বের হওয়া বা অন্তর্বাসে ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে পাওয়া
  • পেটে ব্যথা, মাসিকের ব্যথার মতো মোচড় অনুভব করা। এক ঘন্টার ভেতর ব্যথাসহ বা ব্যথাহীন সংকোচন বা টান ৬ অথবা তার বেশিবার অনুভব হওয়া
  • তলপেটে বেশি চাপ অনুভব করা
  • কোমরে ব্যথা হওয়া
  • পানি ভাঙা

যদি আপনি প্রিটার্ম লেবারে থেকে থাকেন তাহলে আপনার গর্ভের সন্তানের ফুসফুসের বিকাশের জন্য কিছু ঔষধ দেওয়া হতে পারে। আপনার প্রসব প্রক্রিয়া আরও লম্বা করার জন্যও আপনাকে চিকিৎসক কিছু ঔষধ দিতে পারেন। আপনার সন্তানের সুস্থতার জন্য এই ঔষধগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কখন হাসপাতালে যেতে হবে

ঝুঁকিবিহীন গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে যখন আপনি ৩ থেকে ৫ মিনিট সময়ে একটি করে টান অনুভব করবেন এবং টানগুলো কষ্টদায়ক মনে হবে (প্রতিটি টান এক মিনিটের মত স্থায়ী হবে) তখন আপনাকে সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে যেতে হবে অথবা আপনার প্রসব পরিচালনা করার জন্য নির্ধারিত দক্ষ দাইকে খবর দিতে হবে।

তবে কখন আপনি হাসপাতালে যাবেন তা আপনার নিজস্ব অবস্থার উপর নির্ভর করবে। কিছু বিশেষ অবস্থায় হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বেশি হতে পারে। যেমন—

  • হাই-রিস্ক বা ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা হলে
  • প্রথম সন্তান হলে
  • সিজার অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা থাকলে

কখন হাসপাতালে যেতে হবে তা নিয়ে কোনো সংশয় থাকলে আপনার ডাক্তার বা দক্ষ দাইকে জিজ্ঞেস করুন।