গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে যেসকল পরিবর্তন আসে তার একটি হচ্ছে শরীরের ফাটা দাগ বা স্ট্রেচ মার্ক। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না হলেও স্ট্রেচ মার্ক থেকে চুলকানি হতে পারে—যা বেশ অস্বস্তিকর। এ ছাড়া অনেকেই মনে করেন স্ট্রেচ মার্ক সৌন্দর্যহানির কারণ এবং এগুলো নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন।
স্ট্রেচ মার্ক হওয়ার কারণ
গর্ভকালীন সময়ে একজন মায়ের ওজন বৃদ্ধি পায়। একেকজন নারীর ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির পরিমাণ একেক রকম হতে পারে। স্বাভাবিকের তুলনায় ওজন বেশি বেড়ে গেলে আপনার শরীর তাড়াতাড়ি প্রসারিত হয়। তবে এই প্রসারণের সাথে তাল মিলিয়ে আপনার চামড়া বা ত্বক প্রসারিত হতে পারে না। ফলে ত্বকের মাঝের স্তরটিতে অতিরিক্ত টান পড়ে এবং এটি ফেটে যায়।
গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন স্ট্রেচ মার্ক হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে। এই পরিবর্তনের ফলে অনেকসময় আপনার ত্বকের কোলাজেন তন্তু দুর্বল হয়ে যায়।
কোলাজেন তন্তু হলো ত্বকের একটি উপাদান যা চামড়া বা ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা করে, অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত চামড়া প্রসারিত হওয়ার পর পুনরায় তাকে পূর্বের অবস্থায় ফেরত আসতে সহায়তা করে।
কিন্তু কোলাজেন তন্তু দুর্বল হয়ে গেলে তার এই ক্ষমতা কমে আসে, ফলে গর্ভাবস্থায় শরীর যখন প্রসারিত হতে শুরু করে এই তন্তু সহজেই ভেঙে যায় এবং স্ট্রেচ মার্ক বা ফাটা দাগ তৈরি হয়। তবে এই কারণটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এখনো মতানৈক্য আছে।
এ ছাড়া যাদের পরিবারে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে স্ট্রেচ মার্ক কমন অথবা যাদের গর্ভে যমজ বাচ্চা আছে কিংবা যাদের গর্ভকালে ‘পলিহাইড্রামনিওস’ এর সমস্যা দেখা দেয় তাদের গায়ে স্ট্রেচ মার্ক দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পলিহাইড্রামনিওস হলে গর্ভের শিশুর চারদিকে অতিরিক্ত তরল বা অ্যামনিওটিক ফ্লুইড জমে যায়।
প্রতিরোধের উপায়
স্ট্রেচ মার্ক পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য নয়। তবে কিছু সহজ নিয়ম মেনে চলে গর্ভাবস্থায় চামড়ায় অতিরিক্ত স্ট্রেচ মার্ক বা ফাটা দাগ পড়ার সম্ভাবনা কমানো যেতে পারে। যেমন—
এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ত্বকের নমনীয়তা বজায় রাখা। নমনীয়তা বজায় রাখতে ও ত্বককে মজবুত করতে কোলাজেন তন্তুর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খেতে হবে। যেমন: মাংস, মাছ, সবুজ শাকসবজি, আমড়া, পেয়ারা, কমলা। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল আমাদের শরীরে কোলাজেন তৈরিতে ভূমিকা রাখে।[১]
ত্বক শুষ্ক থাকলে ফাটার প্রবণতা বেশি থাকে। তাই ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার বা লোশন ব্যবহারের বিকল্প নেই। ক্রিমের পরিবর্তে অলিভ ওয়েল-ও ব্যবহার করা যাবে। সাধারণত শরীরের যেসকল অংশে চামড়া প্রসারিত হওয়ার কারণে ফাটা দাগ দেখা দেয় সেসব জায়গায় নিয়মিত লোশন বা তেল মালিশ করতে পারেন।
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করার অভ্যাস করতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান করলে ত্বক সতেজ থাকে। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। কাপ কিংবা গ্লাসের হিসাবে আপনাকে সারাদিনে মোট ৮–১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে।[২] তবে এই বিষয়ে কখনো যদি ডাক্তার কোনো বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাহলে সেটিই অনুসরণ করবেন।
নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরের রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো হয়, যা ত্বকের সুস্থতা নিশ্চিত করে। তাই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
স্ট্রেচ মার্ক প্রতিরোধের আরেকটি উপায় হচ্ছে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে এক্ষেত্রে কোনোভাবেই কম খেয়ে ওজন কম রাখার চেষ্টা করা যাবে না। বরং স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করতে হবে। প্রয়োজনে একজন চিকিৎসক অথবা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা
এই সমস্যার নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। চুলকানি ও অস্বস্তি দূর করার জন্য ত্বকে ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে ত্বক আর্দ্র রাখতে পারেন। বাজারে অনেক ক্রিম ও লোশন পাওয়া যায়, যেগুলো স্ট্রেচ মার্ক ভালো করার দাবি করে থাকে। তবে ক্লিনিক্যালি এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
লেজার থেরাপির মাধ্যমে দাগ হালকা করা গেলেও সাধারণত পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় না।
সাধারণত বাচ্চা হওয়ার পর নিজে থেকেই দাগ গুলো অনেকটা হালকা হয়ে আসে, তবে হয়তো কখনোই পুরোপুরি চলে যায় না।[৩]
যদি বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরেও স্ট্রেচ মার্ক হালকা না হয়, তাহলে একজন চর্ম বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
স্ট্রেচ মার্ক হচ্ছে সাধারণত গোলাপি অথবা বেগুনি-লাল রেখার মত একধরণের দাগ। তবে যাদের গায়ের রঙ অপেক্ষাকৃত গাঢ় তাদের ক্ষেত্রে আশেপাশের ত্বকের চেয়ে হালকা রঙের দাগ হতে পারে। পরের দিকে রঙ পরিবর্তন হয়ে ফ্যাকাশে সাদা অথবা রূপালি রঙ ধারণ করে।
স্ট্রেচ মার্ক সাধারণত পেটে বা স্তনেই বেশি দেখা দেয় । তবে এর পাশাপাশি উরুতে, কোমরে কিংবানিতম্বেও স্ট্রেচ মার্ক দেখা দিতে পারে।[৪]
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেচ মার্ক হওয়া বেশ কমন একটি ঘটনা। এসময়ে প্রায় ৯০% গর্ভবতী নারীর শরীরেই এমন পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।[৫]
সাধারণত গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে স্ট্রেচ মার্ক দেখা দেয়।[৬] তবে কারও কারও ক্ষেত্রে পেটের আকার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথেই স্ট্রেচ মার্ক দেখা দেওয়া শুরু হতে পারে।
স্ট্রেচ মার্ক মা ও গর্ভের শিশুর কোনো ক্ষতি করে না। স্ট্রেচ মার্ক বা ফাটা দাগ কোনো অসুখ বা অসুখের লক্ষণ নয় বরং গর্ভাবস্থায় শরীরের স্বাভাবিক পরিবর্তনের একটি অংশ। তাই এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।