গর্ভাবস্থায় কষা পায়খানা বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা খুবই কমন। গর্ভধারণের আগে আপনি এই সমস্যায় না ভুগে থাকলেও গর্ভধারণের পর আপনার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা শুরু হতে পারে। আর আপনার আগে থেকেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে গর্ভাবস্থায় তা বেড়েও যেতে পারে।
তবে গর্ভকালীন সময়ে সবাই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগেন না। গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য হলেও জীবনধারায় সহজ কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আপনি অনেকাংশেই কোষ্ঠকাঠিন্য সমাধান করতে পারেন। এতে আপনার গর্ভকালীন সময় কিছুটা হলেও সহজ হয়ে আসবে।
গর্ভাবস্থায় কখন কোষ্ঠকাঠিন্য হয়?
গর্ভধারণের একেবারে প্রথম দিকের সময় থেকেই কোষ্ঠকাঠিন্য শুরু হতে পারে। অনেকেরই পুরো গর্ভকালীন সময় জুড়েই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকতে পারে। এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার তিন মাস পর পর্যন্তও আপনি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগতে পারেন।[১]
কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে কি না তা কীভাবে বুঝবেন?
একবার কষা পায়খানা হলেই আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে গিয়েছে—এমনটা ভেবে দুশ্চিন্তা করবেন না। সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্য হলে—
- এক সপ্তাহে তিনবারের কম পায়খানা হয়
- পায়খানা শুকনো ও শক্ত হয়
- পায়খানার দলার আকৃতি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়
- পায়খানা করতে কষ্ট অথবা ব্যথা হয়
- পেট পরিষ্কার হচ্ছে না এমন মনে হয়
- পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা লাগা অথবা বমি বমি ভাব হয়
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা
এসব লক্ষণ থাকলে দ্রুত কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগলে পাইলস অথবা গেজ রোগ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়?
গর্ভাবস্থায় শরীরে কিছু হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, গর্ভকালীন সময়ে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে পরিপাক নালীতে খাবার তুলনামূলকভাবে বেশি সময় ধরে অবস্থান করে। অর্থাৎ খাবার হজম হয়ে মল তৈরি হতে বেশি সময় লাগে। যার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[২]
এ ছাড়াও গর্ভাবস্থার শেষের দিকে গর্ভের শিশু অনেকটা বড় হয়ে যাওয়ায়, গর্ভবতী নারীদের জরায়ুও আকারে বেড়ে যায় এবং এটি পরিপাক নালীতে বাইরে থেকে চাপ দেয়। ফলে গর্ভধারণের শেষের দিকে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে।[৩]
তবে হরমোনজনিত কারণ ছাড়াও আরও যেসব কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে অথবা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বাড়তে পারে সেগুলো হলো—
- পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশসমৃদ্ধ খাবার (যেমন: ফল ও শাকসবজি) না খেলে
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করলে
- সারাদিন শুয়ে-বসে থাকলে অথবা হাঁটাহাঁটি না করলে
- পায়খানার চাপ আসার পরেও সেটি আটকে রাখলে
- মানসিক চাপ, আতঙ্ক ও ডিপ্রেশনে থাকলে
- কোনো ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে
বিশেষ তথ্য
গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট সেবন করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে কখনো কখনো আয়রন ট্যাবলেট খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। সেক্ষেত্রে যেই ঔষধটি খেলে কষা পায়খানা হয় সেটির পরিবর্তে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে অন্য ধরনের আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই আয়রন ট্যাবলেট সেবন করা বন্ধ করবেন না।
গর্ভাবস্থায় পায়খানা কষা হলে করণীয় কী?
জীবনধারায় কিছু নিয়ম মেনে চললে সহজেই গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ ছাড়া আপনি ইতোমধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগতে থাকলে অথবা পায়খানা শক্ত হলে এসব পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করবেন। এতে করে ঘরে বসেই আপনি এই সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পেতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় কষা পায়খানার ঘরোয়া চিকিৎসা
কষা পায়খানা নিরাময়ের প্রথম ধাপ হলো আপনার খাওয়াদাওয়া ও শরীরচর্চার অভ্যাসে সহজ কিছু পরিবর্তন আনা। এজন্য—
- প্রতিদিনের খাবার তালিকায় ফাইবার বা আঁশসমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। যেমন: ফলমূল, শাকসবজি, ডাল, লাল চাল ও লাল আটার মতো গোটা শস্যদানা। এগুলো পায়খানা নরম করতে এবং নিয়মিত পায়খানা করতে সাহায্য করে।[৪]
- প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করবেন। পায়খানা নরম করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পান করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে সারাদিনে কমপক্ষে দুই লিটার পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
- গর্ভাবস্থায় শরীর সচল রাখা চালিয়ে যেতে হবে। দৈনিক কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে হাঁটাচলা দিয়েই শুরু করতে পারেন। হাঁটাচলা খাবার থেকে মল তৈরি হয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে। এভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য সমাধান করা যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে প্রতিদিনের খাবার তালিকায় কীভাবে ফাইবার যোগ করবেন?
জেনে নিন আমাদের সহজ ৫টি টিপস—
- ভাত ও রুটি খাওয়ার ক্ষেত্রে সাদা চাল ও আটার পরিবর্তে লাল চাল ও লাল আটা ব্যবহার করতে পারেন। এগুলোতে ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকে।
- প্রতিবেলার খাবারে ডাল রাখতে পারেন। ডালে যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার থাকে।
- প্রতিবেলার খাবারে কয়েক ধরনের সবজি রাখার চেষ্টা করুন।
- যেসব ফল অথবা সবজি খোসাসহ খাওয়া যায় সেগুলো খোসা না ফেলে খাওয়ার চেষ্টা করুন। কারণ খোসায় উচ্চ পরিমাণে ফাইবার থাকে। টমেটো, আপেল ও আলুর মতো খাবারগুলো খোসাসহ খেতে পারেন। তবে খাওয়ার আগে অবশ্যই ভালোমতো পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে।
- যেকোনো ফল বা সবজি গোটা বা আস্ত খেলে ভালো ফাইবার পাওয়া যায়। জুস বা ভর্তা বানিয়ে খেলে আঁশের পরিমাণ কমে যায়।
খাবার তালিকায় ফাইবারের পরিমাণ হুট করে না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। সেই সাথে দৈনিক কমপক্ষে দুই লিটার করে পানি পান করতে হবে।
এসব ছাড়াও আরও কিছু পরামর্শ মেনে চলতে হবে—
- একসাথে অনেক বেশি খাবার না খেয়ে ছোটো ছোটো ভাগ করে বার বার খাবার খাবেন।
- খাবার তালিকায় প্রক্রিয়াজাত খাবার (যেমন: নুডুলস ও পাস্তা), সাদা চালের ভাত ও রুটি না রাখার চেষ্টা করবেন
- পায়খানার চাপ আসলে তা আটকে রাখবেন না
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে একটু সময় নিয়ে পায়খানা করার চেষ্টা করবেন
- পায়খানার সময় লো কমোড বা প্যান ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন। হাই কমোড ব্যবহার করলে পায়ের নিচে ছোটো টুল বা পিঁড়ি দিয়ে পা একটু উঁচুতে রাখবেন। সম্ভব হলে হাঁটু ভাঁজ করে কোমরের চেয়ে ওপরে রাখার চেষ্টা করবেন
- মানসিক দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করবেন
উপরের পরামর্শগুলোতে কাজ না হলে সঠিক নিয়ম মেনে ইসবগুলের ভুসি খেতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার ঔষধ
ঘরোয়া চিকিৎসায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কোষ্ঠকাঠিন্যের ঔষধ খেতে পারেন। যেমন: ল্যাকটুলোজ সিরাপ। এই ঔষধটি গর্ভের শিশুর জন্য নিরাপদ বলে ধরা হয়।[৫]
এসব ঔষধে কাজ না হলে ডাক্তার ঘরোয়া চিকিৎসার পাশাপাশি আরও শক্তিশালী ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন ঔষধ আপনার শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই এই সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যান্য ঔষধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
এ ছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসার জন্য ক্যাস্টর অয়েল ও মিনারেল অয়েল খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন।[৬]
আরও পড়ুন
গর্ভধারণের আগে থেকেই আপনি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগলে গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই আরও সতর্ক থাকা দরকার। এসব পদ্ধতি অবলম্বন করেও কোষ্ঠকাঠিন্য না কমলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাবেন। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ঔষধ খাবেন না।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
কিছু ক্ষেত্রে আপনার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে। তখন দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। নাহলে কিছু মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
যখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি—
- ঘরোয়া সমাধানে অবস্থার উন্নতি না হলে
- অনেক সময় ধরে পেট ফাঁপা হয়ে থাকলে
- পায়খানার সাথে রক্তপাত হলে অথবা কালো পায়খানা হলে
- পায়খানা করার সময়ে অনেক ব্যথা হলে
- পায়ুপথের মুখে কোনো ফোলা বা গোটার মতো কিছু সৃষ্টি হলে
- সারাক্ষণ ক্লান্তিতে ভুগলে
- কোষ্ঠকাঠিন্যের সাথে পেট ব্যথা ও জ্বর আসলে
- কোনো ঔষধ সেবনের কারণে কোষ্ঠিকাঠিন্যের সমস্যা হলে
- রক্তশূন্যতায় ভুগলে
- হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই ওজন অনেকটা কমে গেলে
এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপে যাবেন। যেকোনো স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হলে বিষয়টি আপনার ডাক্তার অথবা মিডয়াইফকে জানাবেন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভাবস্থায় পায়খানার সাথে রক্ত গেলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সাধারণত পাইলস অথবা গেজ রোগে ভুগলে গর্ভকালীন সময়ে আপনার পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করবেন না। সময়মতো চিকিৎসা করলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগলে এসব রোগ হতে পারে, সেহেতু কোষ্ঠিকাঠিন্য প্রতিরোধে নিয়মিত শাকসবজি খাওয়ার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করার চেষ্টা করবেন।
গর্ভাবস্থায় এক সপ্তাহে তিনবারের কম পায়খানা হলে তা কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ। আপনি এই সমস্যায় ভুগলে নিয়ম মেনে ইসবগুলের ভুসি খেতে পারেন। পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে নিয়মিত শাকসবজি খাওয়ার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করার অভ্যাস করবেন।
এতেও সমস্যার সমাধান না হলে ডাক্তারের পরামর্শে ল্যাকটুলোজ সিরাপ সেবন করতে পারেন। তবে গর্ভকালীন সময়ে নিজে থেকে অন্য কোনো ঔষধ খাবেন না।