গর্ভধারণের পর পরই অনেকের স্তনে হালকা ব্যথা বা চাপ চাপ লাগতে পারে। এটি গর্ভাবস্থার খুবই কমন একটি লক্ষণ।[১] এ নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নেই। গর্ভাবস্থায় কিছু ঘরোয়া উপায় কাজে লাগিয়ে আপনি অনেকাংশেই স্তনের ব্যথা কমিয়ে আনতে পারবেন।
গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথার কারণ
গর্ভধারণের ফলে শরীরে বিভিন্ন হরমোনের পরিমাণ ওঠানামা করে। যেমন: ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন। পাশাপাশি শরীরে রক্ত সরবরাহ বেড়ে যায়।[২] এসব পরিবর্তনের প্রভাবে স্তন ও স্তনের বোঁটা স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। ফলে আপনার স্তনে ব্যথা হতে পারে।
এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার পুষ্টির চাহিদা পূরণের প্রস্তুতি হিসেবে গর্ভাবস্থায় আপনার স্তনে ফ্যাট বা চর্বি জমা হতে থাকে। পাশাপাশি স্তনের ভেতরে থাকা দুধ তৈরির নালিকাগুলো প্রশস্ত হতে থাকে। সব মিলিয়ে গর্ভাবস্থায় স্তনের আকার স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়।[৩][৪] একারণেও স্তনে ব্যথা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথা কেমন হয়?
স্তনে ব্যথার ধরন একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে। যেমন—
- স্তন ভারী অথবা চাপ চাপ লাগা
- টনটনে ব্যথা
- জ্বালাপোড়া
- খোঁচা খোঁচা বা শিরশিরে অনুভূতি[৫]
- ধারালো বা তীক্ষ্ণ ব্যথা
- পুরো স্তন জুড়ে ভোঁতা ধরনের ব্যথা
স্তনের বোঁটা থেকে শুরু করে স্তনের যেকোনো অংশে, এমনকি পুরো স্তনজুড়েও ব্যথা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় সাধারণত উভয় স্তনেই ব্যথা হয়। তবে যেকোনো একটি স্তনেও ব্যথা হতে পারে। উল্লেখ্য, স্তনের ব্যথা কখনো কখনো বগল, কাঁধ অথবা হাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তবে ব্যথার ধরন যেমনই হোক না কেন, সেটা যদি আপনার জন্য খুব বেশি অস্বস্তির কারণ না হয় এবং আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত না করে, তাহলে এই ব্যথা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।
ব্যথার ধরনের পাশাপাশি ব্যথার তীব্রতাও একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে। এসময়ে আপনার স্তন হাত দিয়ে স্পর্শ করলে হালকা ব্যথা লাগতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ব্রা পরলেই তীব্র ব্যথা শুরু হতে পারে। স্তনে হালকা অথবা তীব্র ব্যথা হওয়া—দুটোই স্বাভাবিক।
গর্ভাবস্থায় স্তনের এই স্পর্শকাতরতা বা ব্যথার কারণে অনেক দম্পতি এসময়ে সহবাস এড়িয়ে চলেন। তবে স্তনে ব্যথার ধরন ও তীব্রতা যদি আপনার জন্য অস্বস্তির কারণ না হয়, তাহলে গর্ভাবস্থায় সহবাস চালিয়ে যেতে কোনো বাধা নেই।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় সহবাস
গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথা কতদিন পর্যন্ত থাকে?
সাধারণত গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে, অর্থাৎ প্রথম তিন মাসের মধ্যে স্তনে ব্যথা বা চাপ লাগার সমস্যাটা দেখা দেয়। এমনকি গর্ভধারণের তৃতীয়-চতুর্থ সপ্তাহ থেকেই এমন ব্যথা শুরু হয়ে যেতে পারে। প্রথম তিন মাসের পরে কারও কারও ক্ষেত্রে এই ব্যথা কমে আসতে পারে।
গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে আপনার স্তন শিশুকে দুধপান করানোর জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে থাকে। তাই এসময়ে এসে আবার স্তনে ব্যথা শুরু হতে পারে।
এ ছাড়া শিশুর জন্মের পর তাকে দুধ খাওয়ানোর সময়টাতেও অনেকের স্তনে ব্যথা বা চাপ চাপ লাগতে পারে।[৬] বিশেষ করে স্তনের বোঁটায় ব্যথা হতে পারে। এটাও খুবই কমন। এ নিয়ে সাধারণত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এরপরে সাধারণত স্তনের ব্যথা চলে যায়।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
যদি আপনার স্তনে অস্বাভাবিক ব্যথা হয়, ব্যথা ক্রমেই বাড়তে থাকে কিংবা অনেকদিন ধরে ব্যথা হতে থাকে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ব্যথা ছাড়াও স্তনে অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ করলে দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে। অস্বাভাবিক পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- স্তনে অথবা বগলে চাকা বা দলার ন্যায় অনুভব করা
- স্তনের কোনো অংশ ফুলে যাওয়া
- স্তনে অস্বাভাবিক ব্যথা কিংবা জ্বালাপোড়া হওয়া
- স্তনের বোঁটা থেকে রক্ত, পুঁজ কিংবা কোনো অস্বাভাবিক তরল নিঃসৃত হওয়া
- স্তনের বোঁটা ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া
- স্তনের চামড়ায় চুলকানি হওয়া অথবা তা লালচে হয়ে যাওয়া
- স্তনের চামড়ায় টোল বা গর্তের মতো হওয়া
- স্তনের আকার-আকৃতিতে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ করা
এসব লক্ষণের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়তো স্বাভাবিক। তবে এগুলো স্তনের বিশেষ কোনো রোগ—এমনকি স্তন ক্যান্সারের লক্ষণও হতে পারে।[৭] তাই অবহেলা না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়াই শ্রেয়।[৮]
গর্ভাবস্থায় স্তনের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায় কী?
স্তনের ব্যথা ও চাপ চাপ লাগার অনুভূতি আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত না করলে এই ব্যথা নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই। গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথা কমানোর জন্য সাধারণত ঔষধ খাওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। কিছু ঘরোয়া উপায় মেনে চলার মাধ্যমেই এই ব্যথা অনেকাংশে কমানো যায়। যেমন—
- ভালো সাপোর্টযুক্ত আরামদায়ক ব্রা ব্যবহার করবেন। নিশ্চিত করতে হবে যে আপনি যেসব ব্রা ব্যবহার করছেন সেগুলো সঠিক সাইজের এবং খুব বেশি টাইট বা আঁটসাঁট না।
- রাতে ঘুমানোর সময়ে নরম সুতি কাপড়ের স্পোর্টস ব্রা বা হুক ছাড়া ব্রা ব্যবহার করতে পারেন। এতে শোয়ার সময়ে পাশ পরিবর্তন করলে যে ব্যথা হয় সেটি কমতে পারে।
- বরফ বা ঠান্ডা কিছু (যেমন: ফ্রোজেন মটরশুঁটি) একটা নরম ও মোটা সুতির গামছা কিংবা তোয়ালেতে জড়িয়ে স্তনে লাগাতে পারেন। এতে ব্যথা কমে গিয়ে আরাম লাগতে পারে। উল্লেখ্য, একটানা ২০ মিনিটের বেশি সময় ধরে বরফ না লাগানোই শ্রেয়।
- উষ্ণ বা কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন। এতেও কারও কারও ব্যথা উপশম হয়।
- গর্ভাবস্থায় আরামদায়ক ও ঢিলেঢালা কাপড় পরার চেষ্টা করবেন। এতে স্তনে চাপ কম পড়বে।
- বেশি বেশি ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার খাবেন এবং ক্যাফেইন জাতীয় খাবার ও পানীয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিবেন। কারও কারও ক্ষেত্রে এগুলো স্তনের ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।
ব্রা এর সঠিক সাইজ বের করার পদ্ধতি
ব্রা এর যেই অংশ স্তনকে ঢেকে রাখে সেটি হলো ব্রা এর কাপ। আপনার জন্য সঠিক কাপ সাইজ হিসাব করতে প্রথমে স্তনের নিচের অংশ ইঞ্চি ফিতা দিয়ে মেপে নিন। এটিকে আন্ডার বাস্ট বলে। এরপর স্তনের সবচেয়ে বড় বা স্ফীত অংশ বরাবর ফিতা বসিয়ে আবার মাপুন। এটিকে বাস্ট বলে।
এবার বাস্ট এর মাপ থেকে আন্ডার বাস্ট এর মাপ বিয়োগ করে এদের মধ্যে পার্থক্য বের করুন।
পার্থক্য | কাপ সাইজ |
---|---|
১ ইঞ্চি | এ |
২ ইঞ্চি | বি |
৩ ইঞ্চি | সি |
৪ ইঞ্চি | ডি |
সম্ভব হলে অবশ্যই কেনার আগে দোকানে ট্রায়াল দিয়ে ব্রা ঠিকমতো ফিট হয় কি না সেটি দেখে নিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় পরার উপযোগী নার্সিং ব্রা অথবা হুক ছাড়া আরামদায়ক সুতির ব্রা এসময়ে বেশি আরামদায়ক হতে পারে। সম্ভব হলে ঘুমানোর সময়ে বিশেষ ‘স্লিপিং ব্রা’ ব্যবহার করুন। এ ছাড়া ব্যায়াম করার সময়ে ভালো সাপোর্টযুক্ত স্পোর্টস ব্রা ব্যবহার করবেন। এগুলো বাড়ন্ত স্তনকে সাপোর্ট দেওয়ার পাশাপাশি ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথার ঔষধ
ওপরের উপদেশগুলো মেনে চলার পরেও ব্যথা না কমলে প্যারাসিটামল সেবন করতে পারেন। এটি একটি ‘ওভার দা কাউন্টার’ ঔষধ, ফার্মেসি থেকে কিনে সাথে থাকা নির্দেশিকা অনুযায়ী সেবন করা নিরাপদ। এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।
অন্য যেকোনো ব্যথানাশক (যেমন: নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক) ট্যাবলেট, ক্রিম অথবা জেল ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিবেন। বিভিন্ন ব্যথানাশক ঔষধ আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।[৯]
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথা বা চাপ চাপ লাগা সাধারণত গুরুতর কোনো সমস্যা নয়। গর্ভাবস্থায় স্তনে স্বাভাবিক যে পরিবর্তনগুলো আসে তার জন্যই এই ব্যথা হয়ে থাকে। তবে খুব বেশি ব্যথা হলে অথবা ব্যথা নিয়ে দুশ্চিন্তা হলে আপনি ডাক্তার দেখিয়ে নিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় অনেকের স্তনে ব্যথা হয়, আবার অনেকের তেমন ব্যথা হয় না। এর কোনোটিই সাধারণত অস্বাভাবিক নয়। গর্ভাবস্থার লক্ষণগুলো একেকজনের ক্ষেত্রে একেকভাবে দেখা দিতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে এসময় স্তনে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না। তাদের ক্ষেত্রে তেমন ব্যথা না-ও হতে পারে। তবে গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথা না হওয়া নিয়ে আপনার যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে ডাক্তার দেখিয়ে নিন।
গর্ভাবস্থায় স্তনে ব্যথা ছাড়াও বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। যেমন—
– স্তনের আকার বড় হওয়া
– স্তনের শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠা
– স্তনের বোঁটা ও আশেপাশের চামড়ার রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া
– স্তনের বোঁটা থেকে দুধের ন্যায় হলুদাভ তরল বেরিয়ে আসা
এগুলো গর্ভাবস্থার স্বাভাবিক পরিবর্তন।[১০]
স্তনে ব্যথা হওয়া গর্ভাবস্থার অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে একটি।[১১] গর্ভধারণের পর পরই এই লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে মাসিক শুরু হওয়ার আগে আগে শরীরে হরমোনের তারতম্যের কারণেও স্তনে ব্যথা হতে পারে।[১২][১৩] তাই আপনার স্তনের ব্যথার কারণ সম্পর্কে ধারণা পেতে ঘরে বসেই প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে নিতে পারেন।
উল্লেখ্য, গর্ভাবস্থা ও মাসিক ছাড়াও অন্য কোনো কারণে স্তনে ব্যথা হতে পারে।