গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন কারণে যোনিপথ বা মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। যোনিপথে রক্তপাত সবসময়ই কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ না হলেও এটি কখনো কখনো মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতার লক্ষণ হতে পারে।
অল্প কিংবা বেশি—যেই পরিমাণ রক্তপাতই হোক না কেন, দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যান।[১] স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ডাক্তারের চেম্বারের দূরত্ব বেশি হলেও যোনিপথে রক্তপাত হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করুন। এসময়ে সবচেয়ে আরামদায়ক যানবাহনটি বেছে নিতে চেষ্টা করবেন।
এসময়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কখনো কখনো এমন কিছু কারণে যোনিপথে রক্তপাত হয়, যা আপনার ও গর্ভের শিশুর জীবন বিপন্ন করতে পারে।
ডাক্তার আপনার সাথে কথা বলে এবং শারীরিক পরীক্ষা করে যোনিপথে রক্তপাতের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। এসময়ে তিনি মাসিকের রাস্তা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। প্রয়োজনে আলট্রাসনোগ্রাফি-সহ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। এগুলো রক্তপাতের কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
প্রথম তিন মাসে যোনিপথে রক্তপাতের কারণ
গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে যোনিপথে রক্তপাত হওয়া বেশ কমন। প্রতি ৪ জন গর্ভবতীর মধ্যে ১ জনের এসময়ে যোনিপথে রক্তপাত হয়।[২] অনেক ক্ষেত্রেই এটা গুরুতর সমস্যার কারণ নয়।
এসময়ে সাধারণত হালকা রক্তপাত হয়ে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ভারী রক্তপাতও হতে পারে—যা অধিক শঙ্কার কারণ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে যাদের যোনিপথ দিয়ে ভারী রক্তপাত হয়, তাদের গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি সাধারণের তুলনায় তিনগুণ বেশি।[৩]
গর্ভাবস্থার প্রথমদিকে যোনিপথে রক্তপাতের কিছু কারণ—
১. ইমপ্ল্যান্টেশন জনিত রক্তপাত
মায়ের পেটে ভ্রূণ বড় হতে হতে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে রূপ নেয়। এই ভ্রূণ যখন গর্ভাবস্থার শুরুতে জরায়ুতে প্রথমবারের মতো নিজের জায়গা করে নেয়, সেই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘ইমপ্ল্যান্টেশন’। ইমপ্ল্যান্টেশনের সময়ে যোনিপথে হালকা বা ছোপ ছোপ রক্তপাত হতে পারে।
যে সময়টায় আপনার মাসিক হওয়ার কথা, সাধারণত তার কাছাকাছি সময়ে এমন হালকা রক্তপাত হতে দেখা যায়। ফলে এটাকে অনেকে ভুলে মাসিকের রক্তপাত মনে করতে পারেন। এক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার উপায় হলো প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা।
উল্লেখ্য, সবার ক্ষেত্রেই ইমপ্ল্যান্টেশনের সময়ে রক্তপাত হয় না। এসময়ে রক্তপাত হওয়া কিংবা না হওয়া—দুটোই সাধারণত আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য নিরাপদ।
২. গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ
গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের শিশুর মৃত্যু হলে সেটিকে গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ বলে।[৪] গর্ভপাত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের মধ্যে ঘটে। দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব গর্ভপাত প্রতিরোধ করা যায় না। গর্ভপাতের অন্যতম লক্ষণ হলো যোনিপথে রক্তপাত হওয়া।
যোনিপথে রক্তপাতের পাশাপাশি গর্ভপাতের অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে—
- তলপেটে ব্যথা ও কামড়ানো বা খিঁচ ধরা
- যোনিপথ দিয়ে স্রাব জাতীয় তরল বের হওয়া
- যোনিপথ দিয়ে টিস্যু বা মাংসের মতো দলা অংশ বের হয়ে আসা
- গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণগুলো (যেমন: বমি বমি ভাব ও স্তনে ব্যথা) আর অনুভব না করা
গর্ভপাতের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখান।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা
৩. এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি
মায়ের ডিম্বাণু ও বাবার শুক্রাণুর মিলনের ফলে শিশুর ভ্রূণ সৃষ্টি হয়। এই ভ্রূণই বড় হতে হতে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে রূপ নেয়। স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সিতে ভ্রূণটি জরায়ুর ভেতরে জায়গা করে নেয়। তবে কোনো কারণে ভ্রূণটি জরায়ুর বাইরে (যেমন: ডিম্বনালীতে) স্থাপিত হলে সেই অবস্থাকে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলে।[৫]
বাইরে স্থাপিত হওয়ার ফলে ভ্রূণটি সাধারণত বড় ও পরিণত হতে পারে না। এই অবস্থাতেও যদি ভ্রূণটি বেড়ে উঠতে থাকে, তাহলে ডিম্বনালী অথবা অন্য অঙ্গ ফেটে গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই দেরি না করে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির সঠিক চিকিৎসা নেওয়া খুবই জরুরি।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণগুলো সাধারণত গর্ভধারণের ছয় সপ্তাহের দিকে প্রকাশ পায়, যার মধ্যে অন্যতম হলো যোনিপথে রক্তপাত হওয়া। এ ছাড়া অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- তলপেটের নিচের দিকে ব্যথা। এই ব্যথা যেকোনো একপাশে হতে পারে
- যোনিপথ দিয়ে বাদামী রঙের পানির মতো তরল বের হওয়া
- কাঁধের আগায় ব্যথা অনুভব করা
- প্রস্রাব-পায়খানা করার সময়ে অস্বস্তি হওয়া
এসব লক্ষণের মধ্যে যেকোনোটি দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যান।
৪. মোলার প্রেগন্যান্সি
মোলার প্রেগন্যান্সি খুব বিরল। এক্ষেত্রে গর্ভধারণের পরে গর্ভের শিশু ও গর্ভফুল বা অমরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে না। মোলার প্রেগন্যান্সি হলে গর্ভের শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
মোলার প্রেগন্যান্সির অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে—
- অতিরিক্ত বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া
- গর্ভকালের তুলনায় পেটের আকার বেশি বড় হওয়া
যোনিপথে রক্তপাত ছাড়াও গর্ভাবস্থায় এসব লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৫. জরায়ুমুখের পরিবর্তন: গর্ভকালীন হরমোনের তারতম্যের কারণে আপনার জরায়ুমুখে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হতে পারে। যেমন: জরায়ুমুখ নরম হয়ে যাওয়া এবং সেখানকার রক্তনালী ও রক্ত সরবরাহ বেড়ে যাওয়া। এসব কারণে কখনো কখনো যোনিপথে রক্ত যেতে পারে। যেমন, কারও কারও ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় সহবাসের পরে যোনিপথে হালকা রক্তপাত দেখা যায়।
সাধারণত গর্ভাবস্থায় সহবাস করা নিরাপদ হলেও গর্ভাবস্থায় মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হলে সহবাস থেকে বিরত থাকুন। যোনিপথে রক্তপাত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে আবারও নিরাপদে সহবাস করতে পারবেন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় সহবাস
উল্লেখ্য, সহবাস ছাড়াও গর্ভাবস্থায় কোনো কারণে মাসিকের রাস্তা পরীক্ষা করা হলেও যোনিপথে রক্তপাত হতে পারে।
৬. যোনিপথের ইনফেকশন: কখনো কখনো যোনিপথে ইনফেকশনের কারণে লালচে স্রাব কিংবা রক্ত যেতে পারে। ডাক্তার সাধারণত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ইনফেকশনের কারণ ও ধরন নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা দিবেন।
৭. অন্যান্য কারণ: সাধারণ সময়ের মতো যোনিপথের রক্তপাতের কোনো কারণ থাকলে গর্ভাবস্থায় যোনিপথে রক্তপাত হতে পারে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে—
- জরায়ুমুখের পলিপ ও ইনফেকশন[৬][৭]
- যৌনাঙ্গ, যোনিপথ অথবা জরায়ুমুখে আঘাত পাওয়া
- যৌনাঙ্গ, যোনিপথ অথবা জরায়ুমুখের ক্যান্সার[৮]
- প্রস্রাবের রাস্তা অথবা পায়খানার রাস্তা দিয়ে (যেমন: পাইলস রোগে) রক্তপাত। এসব ক্ষেত্রেও যোনিপথে রক্তপাত হচ্ছে বলে মনে হতে পারে
- রক্ত জমাট বাঁধাজনিত রোগ
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় পাইলস
প্রথম তিন মাসের পরে যোনিপথে রক্তপাতের কারণ
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের মতো পরবর্তী মাসগুলোতেও জরায়ুমুখের পরিবর্তন, যোনিপথের ইনফেকশন ও অন্যান্য কারণে যোনিপথে রক্তপাত হতে পারে। তবে পরবর্তী মাসগুলোতে যোনিপথে রক্তপাত হওয়ার পেছনে মারাত্মক কোনো কারণ থাকতে পারে। তাই রক্তক্ষরণ হলে অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যান।[৯] এই সময়ে যোনিপথে রক্তপাতের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১. প্ল্যাসেন্টা বা গর্ভফুল ছিঁড়ে যাওয়া: এটি একটি মারাত্মক সমস্যা, যাকে ডাক্তারি ভাষায় ‘প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন’ বলা হয়। প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল গর্ভের শিশুকে মায়ের দেহ থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। পাশাপাশি শিশুর দেহ থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতেও সাহায্য করে।
কারও কারও ক্ষেত্রে প্লাসেন্টা গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহের পরে জরায়ুর দেয়াল থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত একটানা তীব্র পেট ব্যথা হয়।[১০] সাথে যোনিপথে ভারী রক্তপাত হয়।
উল্লেখ্য, প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশনে কখনো কখনো যোনিপথে রক্তপাত না-ও হতে পারে। তবে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হতে থাকার কারণে মা ও শিশু উভয়ের জীবনই হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই এমন কোনো লক্ষণ থাকলে দেরি না করে হাসপাতালে যাওয়া খুবই জরুরি।
২. প্লাসেন্টা প্রিভিয়া: প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলের অবস্থান সাধারণত জরায়ুর ওপরের অংশে থাকে। কোনো কারণে যদি প্লাসেন্টা জরায়ুর নিচের দিকে থাকে তাহলে সেটিকে ‘প্লাসেন্টা প্রিভিয়া’ বলে। প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হলে গর্ভফুল জরায়ুমুখের খুব কাছাকাছি সংযুক্ত থাকতে পারে, এমনকি জরায়ুমুখকে ঢেকে রাখতে পারে।
সাধারণত গর্ভকালীন চেকআপের অংশ হিসেবে আলট্রাসানোগ্রাম করানোর সময়ে এটি ধরা পড়ে। এক্ষেত্রে প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার কারণে বেশ ভারী রক্তপাত হতে পারে—যা আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। উল্লেখ্য, প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশনে পেট ব্যথা একটি পরিচিত লক্ষণ, তবে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হলে সাধারণত পেট ব্যথা হয় না।[১১]
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া শনাক্ত হলে আপনাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করাতে হয়।
৩. ভাসা প্রিভিয়া: এটি একটি বিরল সমস্যা, যেখানে শিশুর রক্তনালীগুলো জরায়ুর মুখের ওপর দিয়ে যায়। পানি ভাঙার সময়ে এই রক্তনালীগুলো ছিঁড়ে প্রচুর রক্তপাত হতে পারে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে শিশুর জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।
৪. ‘শো’: গর্ভাবস্থায় জরায়ুমুখে ছিপির মতো করে মিউকাস জমে থাকে। প্রসব বেদনা শুরু হওয়ার কিছু সময় আগে কিংবা প্রসবের সময়ে এই মিউকাস যোনিপথ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এটি কিছুটা রক্ত মিশ্রিত থাকে বলে সাধারণত গোলাপি রঙের আঠালো তরলের মতো দেখায়। একেই ডাক্তারি ভাষায় ‘শো’ বলা হয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসছে। এটি দুশ্চিন্তার কারণ নয়। এসময়ে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রসবের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
যোনিপথে রক্তপাতের কারণ নির্ণয়
গর্ভাবস্থায় যোনিপথে রক্তপাতের কারণ নির্ণয় করার জন্য ডাক্তার আপনার রক্তপাত নিয়ে কিছু প্রশ্ন করবেন। তিনি আপনার পেলভিক পরীক্ষা বা তলপেট ও মাসিকের রাস্তা পরীক্ষা করতে পারেন। এভাবে তিনি কতটুকু রক্ত যাচ্ছে কিংবা রক্তের উৎস কোথায় সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন।[১২]
গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পরে যোনিপথে রক্তপাত হচ্ছে এমন গর্ভবতীকে সাধারণত সরাসরি পেলভিক পরীক্ষা করা উচিত নয়। পেলভিক পরীক্ষা করার আগে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে গর্ভবতীর ‘প্লাসেন্টা প্রিভিয়া’ না থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
যোনিপথে রক্তপাতের কারণ নির্ণয়ে ডাক্তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন: তলপেট অথবা মাসিকের রাস্তা দিয়ে আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষা।
হাসপাতালে যাওয়ার আগে ডাক্তারের সম্ভাব্য কিছু প্রশ্নের উত্তর গুছিয়ে রাখুন। যেমন—
- আপনার শেষ মাসিকের তারিখ কবে ছিল
- আপনার গর্ভধারণের কত সপ্তাহ অথবা মাস চলছে
- এর আগে আপনি গর্ভধারণ করেছেন কি না। করে থাকলে সেটায় কোনো সমস্যা বা জটিলতা ছিল কি না।
- দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় ত্রৈমাসিক চললে আপনি বাচ্চার নড়াচড়া টের পান কি না
- রক্তপাতের সাথে ব্যথা আছে কি না
- তলপেটে কোনোরকম আঘাত পেয়েছেন কি না
- অন্যান্য কোনো সমস্যা (যেমন: মাথা ঘুরানো কিংবা কাঁধে ব্যথা) আছে কি না
গর্ভাবস্থায় যোনিপথে রক্তপাতের চিকিৎসা
গর্ভাবস্থায় আপনার যোনিপথে যেই পরিমাণ রক্তপাতই হোক না কেন, দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যাবেন।
যোনিপথে অতিরিক্ত রক্তপাত হলে, কিংবা এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি ও প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশনের মতো জটিলতা থাকলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ অথবা গাইনি ইমারজেন্সিতে আপনার চিকিৎসা করা হবে। সেক্ষেত্রে আপনার ও পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এবং আপনার শারীরিক অবস্থা দেখে সেই অনুসারে দ্রুত সঠিক চিকিৎসাটি বেছে নেওয়া হবে।
গুরুতর রক্তপাতের ক্ষেত্রে আপনার শরীরে রক্ত প্রদানের প্রয়োজন হতে পারে।[১৩] তাই আপনার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে যায় এমন কেউ আশেপাশে থাকলে তাকে রক্তদানের জন্য প্রস্তুত থাকতে অনুরোধ করতে পারেন।
রক্তপাতের কারণ গুরুতর হলে হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়াই ভালো। কেননা এতে ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আপনাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এ ছাড়া হঠাৎ করে যদি জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তাহলে তারা হয়তো তুলনামূলকভাবে দ্রুত আপনার উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারবেন।
আপনার লক্ষণগুলো যদি গুরুতর না হয় এবং বাচ্চা হওয়ার সময় এখনো অনেক দূরে থাকে, তাহলে আপনাকে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণে রাখা হতে পারে। এজন্য ডাক্তার আপনাকে বাড়িতে পাঠিয়ে ১–২ সপ্তাহ পর আবার দেখা করতে বলতে পারেন। এসময়ের মধ্যে অনেকের যোনিপথে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়।
তবে প্রয়োজন মনে করলে ডাক্তার আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে পর্যবেক্ষণে থাকার পরামর্শ দিতে পারেন। হাসপাতালে কতদিন থাকতে হবে সেটা রক্তপাতের কারণ এবং আপনি কত সপ্তাহের গর্ভবতী—এমন কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে।
গর্ভবতীর রক্তের গ্রুপ যদি ‘নেগেটিভ গ্রুপ’ হয়, তাহলে যোনিপথে রক্তপাত হলে ‘অ্যান্টি ডি’ নামের এক ধরনের বিশেষ ইনজেকশন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।[১৪] নেগেটিভ রক্তের গ্রুপের মধ্যে রয়েছে A -ve, B -ve, AB -ve ও O -ve। কিছু ক্ষেত্রে এই ইনজেকশন না দেওয়া হলে গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই ডাক্তার দেখানোর সময়ে অবশ্যই মনে করে গর্ভবতীর রক্তের গ্রুপের ফলাফল লেখা কাগজটি নিয়ে যাবেন। সেই সাথে গর্ভের শিশুর বাবার রক্তের গ্রুপের কাগজ নিয়ে গেলে আরও ভালো হয়।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে যোনিপথে রক্তপাত হওয়া বেশ কমন। গর্ভাবস্থায় যেহেতু জরায়ুমুখে নতুন রক্তনালী তৈরি হয়, তাই যোনিপথ থেকে রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সাধারণত গর্ভাবস্থায় সহবাস করা নিরাপদ। তবে গর্ভাবস্থায় মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হলে সহবাস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যোনিপথে রক্তপাত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে আবারও নিরাপদে সহবাস করতে পারবেন।
বেডরেস্টের প্রয়োজন নেই। আপনি স্বাভাবিক সব কাজ করতে পারবেন। এমনকি কর্মক্ষেত্রেও যেতে পারবেন। তবে ভারী রক্তপাত হলে রক্তপাত পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। আর ক্লান্ত লাগলে অবশ্যই প্রয়োজনমতো বিশ্রাম নিবেন।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাতের অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে কিছু বেশ গুরুতর আবার কিছু তেমন ভয়ের কারণ নয়। কাজেই গর্ভাবস্থার যেকোনো সময়ে যোনিপথে যেকোনো ধরনের রক্তপাত লক্ষ করলেই জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সহজ ভাষায় ‘স্পটিং’ হলো যোনিপথে হালকা রক্তপাত। এটি লাল বা গোলাপি রঙের এবং খুব অল্প পরিমাণে হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো মাসিকের শুরুতে অথবা শেষে যাওয়া পুরানো রক্তের মতো বাদামি রঙেরও হতে পারে। স্পটিং সাধারণত দুয়েক দিনের বেশি থাকে না। এটি সাধারণত শঙ্কার কারণ না হলেও কিছু ক্ষেত্রে বিপদজনক হতে পারে। অন্যদিকে ‘ব্লিডিং’ বলতে অনেকে স্পটিং এর চেয়ে ভারী, কিছুটা টকটকে লাল কিংবা কালচে বর্ণের রক্তপাত বুঝিয়ে থাকে।
তবে গর্ভাবস্থায় যোনিপথে ব্লিডিং অথবা স্পটিং যাই হোক না কেন, দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
গর্ভধারণের শেষের দিকে যোনিপথে রক্ত গেলে তা প্রসবের লক্ষণ হতে পারে। যদি গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রসববেদনা শুরু হয় তাহলে সেটাকে অকাল প্রসব বলে। অকাল প্রসবের অন্যান্য লক্ষণ হতে পারে—
– পানির মতো, আঠালো অথবা রক্তমিশ্রিত স্রাব হওয়া
– স্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
– তলপেটে চাপ লাগা অথবা মৃদু ব্যথা হওয়া
– একটানা মৃদু ও চাপা ধরনের পিঠ ব্যথা হওয়া
– তলপেটে মৃদু ব্যথার সাথে ডায়রিয়া হওয়া
– নিয়মিত অথবা ঘন ঘন জরায়ুতে শক্ত টান অনুভব করা। এটা অনেকসময় ব্যথা ছাড়াও হতে পারে
– যোনিপথে যেকোনো পরিমাণে পানি ভাঙা
অকাল প্রসবের চিকিৎসা আপনার ও আপনার শিশুর অবস্থার ওপর নির্ভর করে।