পাইলস একটি অতি পরিচিত স্বাস্থ্য সমস্যা। মলদ্বার বা পায়খানার রাস্তার মুখ যদি ফুলে যায় এবং সেখান থেকে রক্ত পড়ে অথবা পায়খানার রাস্তা থেকে যদি কোনো মাংসপিণ্ডের মত কিছু বের হয় তখন একে বলা হয় পাইলস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম হেমোরয়েড। সাধারণভাবে বাংলায় এটি অর্শ রোগ নামেও পরিচিত।
গর্ভাবস্থায় শরীরে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আসে। ফলে নানান রকম হরমোনের মাত্রা বাড়ে-কমে। এসময় প্রোজেস্টেরন হরমোনের আধিক্যের কারণে শরীরের পেশি এবং রক্তনালীগুলো শিথিল বা রিল্যাক্সড অবস্থায় থাকে। বৃহদান্ত্র ও মলদ্বারের পেশি এবং রক্তনালীগুলো এরূপ শিথিল থাকার কারণে গর্ভবতীর পাইলস দেখা দেয়।
গর্ভাবস্থায় পাইলস হলে কীভাবে বুঝবেন?
পাইলস রোগের কিছু সাধারণ উপসর্গ রয়েছে। গর্ভাবস্থায় পাইলসের ক্ষেত্রেও এসব লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায়।
১. গর্ভাবস্থায় মলদ্বারে চুলকানি
পাইলস হলে কখনো কখনো পায়খানার রাস্তায় বা এর মুখের আশেপাশে চুলকানি হতে পারে। এছাড়া মলদ্বার দিয়ে মিউকাস বা শ্লেষ্মা-জাতীয় পিচ্ছিল ও আঠালো পদার্থ বের হতে পারে। অনেক সময় মলত্যাগ করে ফেলার পরও বারবার মনে হতে পারে যে পেট পরিষ্কার হয়নি—আবার মলত্যাগ করা প্রয়োজন।
২. মলদ্বারের মুখের অংশগুলো ফুলে যাওয়া
পাইলসের ক্ষেত্রে মলত্যাগের পরে মলদ্বারের মুখের এক বা একাধিক অংশ ফুলে যায়। কখনো নরম মাংসপিণ্ডের মতো কিছু অংশ বাইরে বের হয়ে আসে। এগুলো কিছু সময় পর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে এগুলো আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢোকানোর প্রয়োজন হতে পারে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে পাইলস এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আঙ্গুল দিয়েও এই মাংসপিণ্ড ভেতরে ঢোকানো যায় না।
৩. পায়খানার রাস্তায় ব্যথা হওয়া
পাইলস রোগে সাধারণত তীব্র ব্যথা হয় না। তবে যদি মলদ্বারের গোটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সেগুলো আঙুল দিয়ে ঠেলেও ভেতরে ঢোকানো না যায় এবং সেগুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অনেক সময় তীব্র ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত ১-২ দিন স্থায়ী হয়। ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে ঘরোয়া উপায়ে ব্যথার চিকিৎসা করা যায়।
৪. পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল বর্ণের রক্ত যাওয়া
পাইলস হলে সাধারণত পায়খানার পরে টয়লেট পেপার ব্যবহার করলে সেখানে রক্তের ফোটা লেগে থাকতে পারে। অথবা কমোডে বা প্যানের গায়ে টকটকে লাল রক্তের ছোপ দেখা যেতে পারে। পাইলস হলে মলদ্বারের মুখের জায়গাটি থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্ত বেরিয়ে গিয়ে জমাট বাধার সুযোগ পায় না। এ কারণে এক্ষেত্রে তাজা লাল রঙের রক্ত দেখা যায়।
কিন্তু যদি কোনো কারণে পায়খানার সাথে গাঢ় খয়েরী রঙের রক্ত যায় অথবা আলকাতরার মতো কালো ও নরম পায়খানা হয়, তবে তা সাধারণত পাইলস এর কারণে নয়। পরিপাকতন্ত্রের কোনো অংশে রক্তপাতের কারণে পায়খানার সাথে এমন গাঢ় রক্ত যেতে পারে। তাই এমনটা হলে রক্তপাতের কারণ জানার জন্য দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
গর্ভাবস্থায় পাইলস কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
গর্ভাবস্থায় পাইলস প্রতিরোধের জন্য দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। গর্ভাবস্থায়ও এই নিয়মগুলো মেনে চললে গর্ভাবস্থায় পাইলসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে—
১. ফাইবারযুক্ত খাবার খেতে হবে। পাইলসের প্রধান ও প্রথম কারণ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য বা পায়খানা কষা হওয়া। গর্ভাবস্থায় নানান শারীরিক পরিবর্তনের কারণে পায়খানা কষা হওয়ার প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। তাই এসময়ে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচতে বেশি বেশি আঁশ বা ফাইবারযুক্ত খাবার খতে হবে। আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে—শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, লাল চাল ও লাল আটার তৈরি খাবার।
সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। ফাইবার পানি শোষণ করার মাধ্যমে পায়খানা নরম করে, তাই ফাইবার ঠিকভাবে কাজ করতে হলে সারাদিনে অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে।
গর্ভবতীর খাদ্য তালিকায় কেমন খাবার থাকা উচিত সেই সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে গর্ভাবস্থায় খাদ্যাভ্যাস এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
২. মলত্যাগের সময় খুব জোরে চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পায়খানা যাতে নরম হয় এবং সহজেই মলত্যাগ করা যায়, সেই উপদেশগুলো মেনে চলতে হবে।
৩. পায়খানার চাপ আসলে তা আটকে রাখবেন না। এতে পায়খানা আরও শক্ত হয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। চাপ আসলে দেরি না করে বাথরুমে চলে যেতে হবে।
৪. দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা পরিহার করার চেষ্টা করতে হবে। সম্ভব হলে বসে বা আরামদায়ক ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করতে হবে।
৫. নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করতে হবে। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত হালকা ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করলে শরীরে রক্তচলাচল ভালো থাকে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলস প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৬. ওজন অতিরিক্ত হলে তা কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হলে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই পাইলস প্রতিরোধে ওজন কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়।
গর্ভাবস্থায় পাইলস হলে করণীয়
১. ব্যথার জায়গাটি কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখা যায়। ছোট বাচ্চাদের গোসল করানো হয় এমন ছোট আকারের একটি পাত্রে কুসুম গরম পানি নিয়ে সেখানে বসতে পারেন। দিনে ৩ বার পর্যন্ত এটি করা যায়। অন্য সময়ে কোথাও বসতে গেলে একটি বালিশ ব্যবহার করে সেটার ওপর বসা যেতে পারে।
২. একটা প্যাকেটে কিছু বরফ নিয়ে সেটা তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে মলদ্বারের ফোলা অংশের ওপরে লাগানো যায়। এতে আরাম পাওয়া যাবে।
৩. বিছানায় শুয়ে পা উঁচু করে রাখলে মলদ্বারে রক্ত চলাচল সহজ হবে ও ব্যথা উপশম হবে। শোবার সময় পায়ের নিচে বালিশ দিতে পারেন। এছাড়া খাটের পায়ার নিচে কোন কিছু দিয়ে খাটের এক পাশ উঁচু করে সেদিকে পা দেওয়া যেতে পারে।
৪. মলদ্বার সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকনো রাখতে হবে। মলত্যাগের পর জোরে ঘষাঘষি না করে আলতোভাবে জায়গাটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। টয়লেট পেপার হালকা ভিজিয়ে তারপর সেটা দিয়ে মুছতে পারেন।
৫. পায়খানার সময়ে ভেতর থেকে মাংসপিণ্ড বের হয়ে আসলে জোরে চাপাচাপি না করে আলতোভাবে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে পিচ্ছিল জেলি অথবা তেল জাতীয় কিছু আঙুলে মেখে নিয়ে তারপর চেষ্টা করলে ব্যথা কম লাগবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
পাইলস রোগ ও এর ব্যথা সারানোর জন্য বাজারে নানান ধরনের ঔষধ ও মলম পাওয়া যায়৷ গর্ভাবস্থায় এধরণের যেকোনো ঔষধ সেবন বা ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে যে তা গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ কিনা।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এসময় কোনো ধরনের ঔষধই সেবন বা ব্যবহার করা উচিত নয়।