গর্ভাবস্থায় আপনার পেটে ব্যথা ও যন্ত্রণা হওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি হতে পারে। এমন একটি অনুভূতি হলো পেট শক্ত হওয়া বা পেট আঁটসাঁট হয়ে আসছে মনে হওয়া।
পেট শক্ত হওয়াকে মাঝে মাঝে পেট কামড়ানোর সাথেও মিলিয়ে ফেলতে পারেন। এমনকি নিয়মিত বিরতিতে পেটে টান অনুভব করলে একে জরায়ুর সংকোচনের মতোও মনে হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় পেট শক্ত হয় কেন
গর্ভাবস্থায় আপনার গর্ভের বাড়ন্ত শিশুকে জায়গা দিতে আপনার জরায়ু আকারে বাড়ে। এর ফলে আপনার পেট আঁটসাঁট হয়ে আসতে পারে। স্বাভাবিক কারণে আপনার যেমন এ অনুভূতি হতে পারে, তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে গর্ভপাত কিংবা অকাল প্রসবের মতো জটিল সমস্যা থেকেও পেট শক্ত হতে পারে।
গর্ভাবস্থার বিভিন্ন সময়ে পেট শক্ত বা টান-টান হওয়ার কারণগুলো হলো—
প্রথম ত্রৈমাসিকে
জরায়ুর মাংসপেশির স্ট্রেচিং বা টান: গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস আপনার বাড়ন্ত শিশুর কারণে বড় হয়ে যাওয়া জরায়ু চারপাশে চাপ দিতে থাকে। একারণে পেট শক্ত লাগতে পারে। জরায়ুর পেশিগুলো প্রসারিত ও দীর্ঘায়ত হওয়ার কারণে আপনার হঠাৎ হঠাৎ করে পেটে তীব্র ব্যথাও অনুভব হতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাস: গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য পরিচিত একটি সমস্যা।[১] গর্ভধারণের ফলে কিছু বিশেষ হরমোনের পরিমাণ অনেকখানি বেড়ে যায়। এসব হরমোনের প্রভাবে খাবার হজমের সাথে জড়িত পেশিগুলো কিছুটা শিথিল হয়ে আসে এবং হজমের গতি কমে যায়।[২][৩]
এতে করে আপনার পেটে গ্যাস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে এবং পেট ফাঁপা লাগে। অনেকের ক্ষেত্রে এই হরমোনের প্রভাবে কোষ্ঠকাঠিন্যও দেখা দেয়।
গর্ভপাতের কারণে: গর্ভধারণের ২৮ তম সপ্তাহের আগে গর্ভের শিশুর মৃত্যু হওয়াকে গর্ভপাত বলে। পেট শক্ত হয়ে আসার পাশাপাশি যদি আপনার পেটে ব্যথাও থাকে এটি গর্ভপাতের লক্ষণ হতে পারে।
গর্ভপাত হলে সাধারণত আপনার পেট শক্ত হয়ে আসার পাশাপাশি নিচের এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা যায়[৪]—
- যোনিপথে ফোঁটা ফোঁটা কিংবা ভারী রক্তপাত হওয়া
- পেট ব্যথা হওয়া বা মাসিকের ব্যথার মতো পেট কামড়ানো
- ব্যথা কিংবা রক্তপাত ছাড়াও যোনিপথে হঠাৎ অধিক পরিমাণে তরল বেরিয়ে আসা
- যোনিপথে যেকোনো ধরনের টিস্যু জাতীয় পদার্থ বা মাংসপিণ্ডের ন্যায় অংশ বের হয়ে আসা
এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় নিচের কারণগুলো থাকলে আপনার গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকতে পারে[৫][৬]—
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস
- ইনফেকশন
- থাইরয়েডের সমস্যা
- সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস
- জরায়ুর গঠন বা কাজে যেকোনো ধরনের ত্রুটি
- বংশগত কারণ
পেট ব্যথা ও শক্ত হয়ে আসার সাথে সাথে উপরের লক্ষণগুলো অথবা ঝুঁকির কারণগুলো থাকলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে গর্ভাবস্থার পরিবর্তনগুলোর সাথে আপনার শরীর খাপ খাওয়াতে শুরু করে। এসময়ও বিভিন্ন কারণে আপনার পেট শক্ত মনে হতে পারে।
যেমন, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে আপনার জরায়ু থেকে কুঁচকি পর্যন্ত থাকা রাউন্ড লিগামেন্টও জরায়ুর সাথে সাথে প্রসারিত হয়। এর ফলে আপনার জরায়ু ও কুঁচকির আশেপাশে শক্ত হয়ে আসছে বা টান খাচ্ছে বলে মনে হতে পারে।
ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন
গর্ভাবস্থায় ব্র্যাক্সটন হিক্স নামের সংকোচনের জন্যও আপনার পেট আঁটসাঁট বা শক্ত হয়ে আসতে পারে। প্রসবের জন্য প্রস্তুতিমূলক স্বাভাবিক সংকোচন প্রসারণ হলো ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন। একে ‘ফলস লেবার পেইন’-ও বলা হয়।
সাধারণত গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকের আগে এই সংকোচন অনুভূত হয় না।[৭] প্রকৃত প্রসব বেদনা শুরু হওয়ার অনেক সপ্তাহ আগে থেকেই এ ধরনের প্রস্তুতিমূলক ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন শুরু হতে পারে।[৮]
ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন আপনার জরায়ুর ওপর থেকে শুরু হয়ে নিচে এসে নামে। এ ধরনের সংকোচন অনিয়মিত ভাবে হয়, ১৫ সেকেন্ড থেকে ৩০ সেকেন্ড ব্যাপী স্থায়ী হয়। কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি সময় ধরেও হতে পারে।
বিভিন্ন কারণে আপনার ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন হতে পারে। যেমন—
- গর্ভাবস্থায় অনেক বেশি কাজকর্ম করলে
- মূত্রথলি পূর্ণ থাকলে বা প্রস্রাবের বেগ থাকলে
- সহবাসের সময় বা পরে
- শরীরে পানির অভাব থাকলে বা ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেলে
আপনি যদি প্রথমবারের মতো গর্ভবতী হোন, তাহলে ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচনকে প্রসবের ব্যথার সাথে মিলিয়ে ফেলতে পারেন।
ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন ও প্রসবের ব্যথার মধ্যে নিচের পার্থক্যগুলো দেখা যায়[৯][১০]—
ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন | প্রকৃত প্রসব ব্যথা |
ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন হঠাৎ করেই শুরু হয়। এই সংকোচন সাধারণত অনিয়মিত হয়, কোনো নির্দিষ্ট ছন্দ থাকে না। | প্রকৃত প্রসব ব্যথা সাধারণত নির্দিষ্ট সময় পর পর নিয়মিত ভাবে হয়। এই সংকোচন বা ব্যথার একটি সুনির্দিষ্ট ছন্দ বা ধরন থাকে। |
ব্যথার স্থায়িত্ব ও তীব্রতা সাধারণত বাড়ে না। | ধীরে ধীরে ব্যথার স্থায়িত্ব ও তীব্রতা বাড়ে। সময়ের সাথে নিয়মিত বিরতিতে ঘন ঘন ব্যথা হতে থাকে। |
হাঁটাচলা করলে কিংবা বিশ্রাম নিলে এই ব্যথা বা সংকোচন কমে আসতে পারে। অবস্থান পরিবর্তন করলেও এই সংকোচন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। | বিশ্রাম, হাঁটাচলা কিংবা অবস্থান পরিবর্তনে প্রকৃত প্রসব ব্যথা সাধারণত কমে না। |
এই ধরনের ব্যথা সাধারণত পেটের সামনের দিকেই অনুভূত হয়। | প্রকৃত প্রসব ব্যথা সাধারণত কোমরের পেছন দিক থেকে শুরু হয় এবং পরে পেটের সামনের দিকে আসে। |
গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে
গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে পেট শক্ত হয়ে আসা প্রসবের লক্ষণ হতে পারে। এক্ষেত্রে শুরুতে মৃদু অনুভূতি থাকে যা সময়ের সাথে সাথে তীব্র হয়।
যদি আপনার পেটে প্রতি ঘন্টায় চার বারের বেশি সংকোচন হয়, বিশেষ করে যদি গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের আগে এমন হয় তাহলে সেটা প্রসবের লক্ষণ হতে পারে। এসময়ে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
নিচের লক্ষণগুলোও প্রসবের কারণে দেখা যায়। এসব লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন—
- পেট আঁটসাঁট হয়ে আসার পাশাপাশি তলপেটে ব্যথা হলে
- যোনিপথে পরিষ্কার তরল বের হয়ে আসলে যাকে পানিভাঙা বলে
- যোনিপথে রক্তমিশ্রিত স্রাব কিংবা রক্ত বের হয়ে আসলে
গর্ভাবস্থায় পেট শক্ত হলে করণীয়
আপনার পেট আঁটসাঁট হয়ে আসার অনুভূতি যদি মৃদু ও অনিয়মিত হয়, তাহলে নিচের ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করে স্বস্তি পেতে পারেন—
১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন: শরীরে পানির অভাব থেকে পানিশূন্যতা হলে পেটে টান খাওয়ার মতো এমন অনুভূতি হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পানি পান করার চেষ্টা করুন ।
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। কাপ কিংবা গ্লাসের হিসাবে আপনাকে সারাদিনে মোট ৮–১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে।[১১] তবে এই বিষয়ে কখনো যদি ডাক্তার কোনো বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাহলে সেটিই অনুসরণ করবেন।
২. খাবার গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করুন: কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে পেট শক্ত হয়ে আসলে সারাদিনে অল্প অল্প করে বেশ কয়েকবার খান। আঁশ জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। ভাজা-পোড়া খাবার ও কোমল পানীয় (যেমন: কোক, ফান্টা ও পেপসি) এড়িয়ে চলুন।
সতর্কতা: গর্ভকালীন সময়ে দৈনিক ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন জাতীয় খাবার অথবা পানীয় খাওয়া এড়িয়ে চলবেন।[১২] সাধারণত ২ কাপ কফি কিংবা ২–৩ কাপ চায়েই এই পরিমাণ ক্যাফেইন থাকতে পারে।
নিয়মিত শরীরচর্চা করুন: গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম খাবার হজমে সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়া ব্যায়াম গর্ভাবস্থার নানান জটিলতা কমাতেও সাহায্য করতে পারে।[১৩] গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম করা নিরাপদ ও কার্যকর।[১৪] এটি নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বাড়াতে সাহায্য করে।[১৫]
এ ছাড়া সময়ের আগে সন্তান প্রসব হওয়া এবং কম ওজনের শিশু জন্মদানের সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে।[১৬] শুধু তাই নয়, গর্ভাবস্থায় শরীরচর্চা করলে নারীরা সন্তান প্রসবের পরে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।[১৭]
কাজেই আপনার ডাক্তারের নিষেধ না থাকলে গর্ভাবস্থায় নিয়মিত হালকা পরিশ্রম অথবা পছন্দের কোনো ব্যায়াম করতে পারেন।
অবস্থানের পরিবর্তন করুন: আপনি যদি বুঝতে পারেন যে আপনার ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন হচ্ছে, তাহলে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করুন। যেমন, দাঁড়িয়ে থাকলে শুয়ে পড়ুন।
যেকোনো অস্বস্তিকর দেহভঙ্গিতেও এমন হতে পারে, সেক্ষেত্রে আপনার জায়গার পরিবর্তন করে দেখুন।
খুব দ্রুত জায়গা পরিবর্তনেও এমন হতে পারে। শোয়া-বসা থেকে ওঠার সময়ে তাড়াহুড়ো না করে আস্তে ধীরে উঠুন। বসা কিংবা শোয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী বালিশ বা কুশন ব্যবহার করে আরামদায়ক অবস্থান তৈরি করে নিন।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করুন। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক ৭–৯ ঘণ্টার ঘুমকেই আদর্শ বলে ধরা হয়।[১৮][১৯] এর চেয়ে কম ঘুম হলে সেটি আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে ও গর্ভাবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।[২০][২১][২২] তাই গর্ভাবস্থায় নিয়ম মেনে ঘুম ও বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করুন।
গরম সেঁক বা মালিশ নিন: মাংসপেশির ব্যথায় হালকা মালিশে উপকার পেতে পারেন। তাই হালকা গরম কিছুর সেঁক নিতে পারেন এবং হালকা গরম পানিতে গোসল করতে পারেন। তবে খুব বেশি গরম এড়িয়ে চলুন।
জরুরি অবস্থা
আপনার অস্বস্তি যদি ঘরোয়া পদ্ধতিতে প্রশমিত না হয় অথবা নিচের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
- আপনার গর্ভাবস্থার সময়কাল ৩৬ সপ্তাহের কম হলে এবং সেই সাথে আপনার অকাল প্রসবের অন্যান্য লক্ষণ দেখা গেলে
- যোনিপথে রক্তপাত হলে
- যোনিপথে যেকোনো ধরনের তরল পদার্থ বের হয়ে আসলে
- তলপেটে অথবা যোনিপথে চাপ অনুভূত হলে
- প্রতি ৫ মিনিট পর পর বা নির্দিষ্ট বিরতিতে পেটে তীব্র সংকোচন বোধ করলে, এবং সংকোচনগুলো প্রায় ৩০ সেকেন্ড থেকে ৬০ সেকেন্ড স্থায়ী হলে ও ক্রমাগত জোরালো হতে থাকলে
- আপনার গর্ভের শিশুর নড়াচড়া অনুভব করতে না পারলে কিংবা নড়াচড়া স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে
সাধারণ জিজ্ঞাসা
সিজার এক ধরনের অপারেশন। এতে পেট কেটে গর্ভের শিশুকে বের করে আনা হয়। পেট কাটার সময় পেটের বাইরের দিক থেকে ভেতর পর্যন্ত কয়েক স্তরের চামড়া, মেদ ও মাংসপেশির স্তর কাটা পড়ে। সিজারের পর এই কাটা স্তর গুলোতে স্কার টিস্যু বা ক্ষত তৈরি হয়। এই স্কার টিস্যুগুলো সময়ের সাথে সাথে শক্ত হয়ে আসে। ফলে সিজারের পর অনেকে পেটে টান খায় বা সিজারের কাটা জায়গার আশেপাশে পেট শক্ত হয়ে আছে বলে অনুভব হয়।
পড়ুন: সিজারের পর সেরে ওঠা