গর্ভাবস্থা একজন মায়ের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। গর্ভাবস্থার স্বাভাবিক কিছু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের খুব কম ক্ষেত্রেই জটিলতা দেখা দেয়।
তবে কিছু বিশেষ লক্ষণ নিয়ে আপনার আগে থেকেই জেনে নেওয়া দরকার। কারণ এসব লক্ষণ আপনার ও আপনার গর্ভের শিশুর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা গেলে তাৎক্ষণিক আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন হবে।
এসব লক্ষণকে গর্ভাবস্থার বিপদ চিহ্ন বলা হয়। এ লক্ষণগুলো জানা থাকলে মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হবে এবং গর্ভবতী মা ও গর্ভের শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করা যাবে।
বিপদ চিহ্নসমূহ
গর্ভাবস্থার বেশ কিছু বিপদ চিহ্ন রয়েছে। আপনি যদি বর্তমানে গর্ভবতী হোন কিংবা সম্প্রতি গর্ভবতী হয়ে থাকেন, তবে এ লক্ষণগুলির ব্যাপারে বিশেষ নজর রাখতে হবে[১]—
১. রক্তস্রাব
গর্ভাবস্থার যেকোনো সময়ে যোনিপথে রক্তপাত হওয়া, বিপদচিহ্ন নির্দেশ করে। যেমন—
আপনি যদি গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে যোনিপথে রক্তপাতের পাশাপাশি মাসিকের ব্যথার মতো ব্যথা তীব্রভাবে অনুভব করেন এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তবে সেটি এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বা জরায়ুর বাইরের গর্ভধারণের লক্ষণ হতে পারে।
প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষের দিকে কিংবা দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের শুরুর দিকে পেট ব্যথাসহ রক্তপাত গর্ভপাত এর লক্ষণ হতে পারে।
তৃতীয় ত্রৈমাসিকে রক্তপাত প্লাসেন্টাল এবরাপশন এর কারণে হতে পারে। যার ফলে প্রসবের আগেই আপনার প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল আলাদা হয়ে যায়। এর ফলে গর্ভের শিশু মায়ের শরীর থেকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান পায় না।
২. খিঁচুনি
গর্ভাবস্থা, প্রসবের সময় কিংবা প্রসবের পর খিঁচুনি হওয়া আপনার জন্য বিপদ চিহ্ন। খিঁচুনি এক্লাম্পসিয়ার প্রধান লক্ষণ। এক্লাম্পসিয়া গর্ভাবস্থার মারাত্মক একটি জটিলতা। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে এতে মা ও শিশু উভয়েরই ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৩. মাথা ব্যথা ও ঝাপসা দেখা
গর্ভাবস্থায় যেকোনো সময় আপনার মাথা ব্যথা হলে যদি সেটি আপনার কাছে খুব তীব্র মনে হয় এবং মাথা ব্যথার চিকিৎসা নেওয়ার পরও যদি তা না সারে কিংবা সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হতে থাকে, তাহলে এটিও একটি বিপজ্জনক অবস্থা নির্দেশ করতে পারে।
মাথা ব্যথার পাশাপাশি চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘুরানো ও শরীরে পানি আসার মতো সমস্যাও হতে পারে। এ ধরনের তীব্র মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা ও শরীরে পানি আসা প্রি-এক্লাম্পসিয়ার অন্যতম লক্ষণ। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নিলে এর থেকে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।
৪. ভীষণ জ্বর
গর্ভাবস্থায় আপনার জ্বর হলে, অর্থাৎ আপনার শরীরের তাপমাত্রা ১০০.৪° ফারেনহাইট বা ৩৮°সেন্টিগ্রেডের উপরে হলে, এটিও একটি বিপদ চিহ্ন। গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পর পর একটানা তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলে কিংবা যোনিপথে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব নিঃসৃত হলে তা সাধারণত শরীরে কোনো ধরনের ইনফেকশনের উপস্থিতি নির্দেশ করে। গর্ভাবস্থায় জ্বর মা ও শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কিছু গবেষণা থেকে দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় জ্বর হলে তা গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় আবার গর্ভাবস্থার ১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত জ্বরের সাথে গর্ভপাত বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।[২]
গর্ভাবস্থার প্রথমদিকে জ্বর আসার সাথে গর্ভের শিশুর কিছু জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।[৩][৪]
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বা ১২তম সপ্তাহের পর জ্বর আসলে গর্ভের শিশুর অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।[৬] গর্ভাবস্থার এই সময়ের পর তিনবার বা তার বেশি জ্বর আসলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যেতে পারে।
কিছু কিছু গবেষণায় এসব প্রমাণ পাওয়া গেলেও আবার কিছু গবেষণায় গর্ভাবস্থায় জ্বরের সাথে এসব জটিলতার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এ বিষয়ে আরও গবেষণার অবকাশ রয়েছে।
তবে যেকোনো ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থায় জ্বর আসলে দ্রুত তা কমানোর ব্যবস্থা করা ও সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এতে করে গর্ভবতী মা ও গর্ভের শিশুর জ্বরের কারণে কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তা এড়ানো সম্ভব হবে।
৫. বিলম্বিত প্রসব
আপনার প্রসবের ব্যথা যদি ১২ ঘন্টার বেশি থাকে তাহলে একে বিলম্বিত প্রসব বলে।[৭] বিলম্বিত প্রসবও একটি বিপদ চিহ্ন। বিলম্বিত প্রসবের সময় মাথা ছাড়া বাচ্চার অন্য যেকোনো অঙ্গ প্রথমে বের হতে পারে। বিলম্বিত প্রসব হলে জন্মের পর শিশুর শ্বাসকষ্ট ও খিঁচুনি হতে পারে।
অন্যান্য লক্ষণ
উপরের বিপদ চিহ্নগুলোর পাশাপাশি নিচের উপসর্গগুলির ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে—
- মাথা ঘোরা বা জ্ঞান হারানো
- ডেলিভারির সম্ভাব্য দিনের আগেই পানি ভেঙে যাওয়া
- অতিরিক্ত বমি হওয়া এবং একদমই খেতে না পারা
- গর্ভের শিশুর নড়াচড়া কমে যাওয়া বা একদমই নড়াচড়া না হওয়া
- আপনার হাত বা মুখমণ্ডল অত্যধিক ফুলে যাওয়া বা শরীরে পানি আসা
- শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া
- বুকে ব্যথা কিংবা বুক ধড়ফড় করা
- অতিরিক্ত ক্লান্তি
গর্ভকালীন সময়ের পাশাপাশি সন্তান প্রসবের পরও মায়ের শারীরিক অবস্থার দিকে লক্ষ রাখা জরুরি। প্রসবের পর নিচের উপসর্গগুলির দিকে লক্ষ রাখুন—
- প্রসবের পর যোনি থেকে ভারী রক্তপাত বা স্রাব নিঃসরণ
- ডিপ্রেশন
- স্তনের বোঁটায় ফাটল ধরা বা লাল হয়ে যাওয়া
প্রতিরোধ
গর্ভাবস্থার বিপদ চিহ্নগুলো হয়তো সবসময় আগে থেকে টের পাওয়া সম্ভব নয়। তবে গর্ভাবস্থায় নিচের সহজ পরামর্শগুলো মেনে চললে এসব বিপদ চিহ্ন থেকে আপনি অনেকটাই নিরাপদ থাকতে পারবেন—
১. নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করান: গর্ভাবস্থায় আপনার ও আপনার গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা খুবই প্রয়োজনীয়। গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩০ সপ্তাহে বা ৭ মাসে ন্যূনতম প্রতি মাসে একবার এবং ৩০ সপ্তাহের পর প্রতি সপ্তাহে একবার করে আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত।
প্রতি চেকআপে ডাক্তার আপনার ওজন, রক্তশূন্যতা, পায়ে পানি আসা, রক্তচাপ এবং গর্ভের ভেতরে শিশুর পজিশন বা অবস্থান নিশ্চিত করবেন। সেই সাথে আপনার যদি গর্ভকালীন কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা (যেমন: গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, প্রি-এক্লাম্পসিয়া) থেকে থাকে, চিকিৎসক সেগুলো চিহ্নিত করতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
২. সুষম খাবার গ্রহণ করুন: গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি পরিমাণ খাবার দরকার হয়। কারণ এসময় আপনার পাশাপাশি আপনার গর্ভের শিশুর পুষ্টিও আপনার উপর নির্ভরশীল। গর্ভাবস্থায় সুষম খাবার গ্রহণ করুন।
নিয়মিত বিরতিতে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাবেন। প্রয়োজনে দৈনিক তিনবেলা বেশি করে খাবার না খেয়ে, অল্প অল্প করে ছয় বার খান। অথবা দৈনিক তিনবার খাওয়ার পাশাপাশি ক্ষুধা লাগলে পরিমিত পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ও হালকা নাস্তা খেতে পারেন।
এ ছাড়া অবশ্যই সকালে ঠিকমতো নাস্তা খাওয়ার চেষ্টা করবেন। রাতে ঘুমানোর আগে কোনো হালকা খাবার খেয়ে নিবেন। এক গ্লাস কুসুম গরম দুধ খেয়ে ঘুমাতে যেতে পারেন। দুধ ভালো ঘুমে সাহায্য করে।
এর পাশাপাশি প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন, ফলিক এসিড, আয়রন, প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম এর সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন।
৩. সময়মতো ধনুষ্টংকার বা টিটেনাস এর টিকা গ্রহণ করুন: আপনার ডেলিভারির সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গর্ভাবস্থায় টিটি বা টিটেনাস টিকা নেওয়া প্রয়োজন। তবে আগে থেকে টিটেনাসের ৫টি টিকার ডোজ সম্পন্ন থাকলে আর গর্ভাবস্থায় এই টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আগে যদি কোনো ডোজ না নিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ৫ মাসের পর ১ মাসের ব্যবধানে পর পর দুটি টিটি টিকা নিন। আর যদি পূর্বে দুই ডোজ টিকা নেওয়া থাকে তাহলে প্রতি গর্ভাবস্থায় মাত্র একটি বুস্টার ডোজ নিন। আপনার ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী এ বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।
৪. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: গর্ভাবস্থায় যেকোনো ভারী কাজ এড়িয়ে চলুন। গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়া খুবই জরুরি। রাতে অন্তত ৭–৯ ঘণ্টা ভালোমতো ঘুমানোর চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে দিনের বেলাও কমপক্ষে এক ঘন্টা বিশ্রাম নিতে পারেন।
ঘুমের একটি রুটিন মেনে চলুন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন। খুব বেশি অথবা খুব কম না ঘুমিয়ে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
৫. পূর্বের স্বাস্থ্য সমস্যা বা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: আপনার আগে থেকেই ছিল এমন কিছু অসুখ নিয়ন্ত্রণে না রাখলে গর্ভাবস্থায় জটিলতা তৈরি করতে পারে। যেমন—
- উচ্চ রক্তচাপ
- হৃদরোগ
- ডায়াবেটিস
- এইডস অথবা যৌনবাহিত অন্য কোনো রোগ
- অটোইমিউন রোগ
দৈনন্দিন কাজ ও অভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে গর্ভাবস্থায় জটিলতা কমানো সম্ভব।
৬. প্রসব কালীন খরচের জন্য সঞ্চয় করুন: গর্ভাবস্থায় অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতার কারণে আপনার অতিরিক্ত খরচও হতে পারে। এজন্য আগে থেকেই প্রসবকালীন খরচের জন্য সঞ্চয় করুন।
৭. প্রয়োজনে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা রাখুন: গর্ভাবস্থায় এসব বিপদ চিহ্ন দেখা গেলে সাথে সাথে আপনার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। কাজেই আগে থেকে আপনার নিকটস্থ হাসপাতালে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত যানবাহন ঠিক করে রাখুন।