গর্ভাবস্থার জন্য ব্যায়াম

স্বাভাবিকভাবে করা যায় এমন অধিকাংশ ব্যায়ামই গর্ভাবস্থায় চালিয়ে যাওয়া নিরাপদ। আপনি আপনার পছন্দমতো প্রায় সব ধরনের ব্যায়ামই করতে পারবেন। এখানে এমন কিছু ঘরোয়া ব্যায়াম তুলে ধরা হয়েছে যা আপনার পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে গর্ভাবস্থার অতিরিক্ত ওজন বহনে সহায়তা করে। সেই সাথে রক্ত চলাচল উন্নত করে, জয়েন্টের শক্তি বাড়ায়, ব্যথা কমায় ও সব মিলিয়ে সুস্থ বোধ করতে সাহায্য করে।

পেটের পেশির ব্যায়াম

গর্ভের শিশু আকারে বাড়ার সাথে সাথে আপনার পেটও সামনের দিকে বাড়তে থাকে। সেই সাথে কোমরের জায়গাটুকু আরও বাঁকিয়ে যেতে পারে। ফলে কোমর ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা কমানোর জন্য এই ব্যায়ামটি করা যেতে পারে।

পেটের পেশি শক্তিশালী করার ব্যায়াম
ছবি: পেটের পেশি শক্তিশালী করার ব্যায়াম
  1. প্রথমে ছবির মতো ‘বক্স পজিশন’-এ যান, অর্থাৎ চার হাত-পা এমনভাবে মাটিতে রাখুন যেন—
    • হাঁটু কোমর বরাবর থাকে
    • হাতের তালু কাঁধ বরাবর থাকে
    • আঙুলগুলো সামনের দিকে থাকে
    • পেটের পেশি টানটান অবস্থায় থাকে
    • পিঠ সোজা ও মেঝের সমান্তরালে থাকে
  2. এবার পেটের পেশিকে যথাসম্ভব টানটান করে পিঠের দিকে নিয়ে আসুন। এরপর শরীরের উপরিভাগ খানিকটা বাঁকিয়ে পিঠ ওপরের দিকে তোলার চেষ্টা করুন। আপনার ঘাড় ও মাথা রিল্যাক্স করুন, এতে মাথা আলতোভাবে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। তবে খেয়াল রাখবেন যেন হাতের কনুই একদম সোজা হয়ে টানটান হয়ে না যায়।
  3. পেটের পেশি টানটান রেখে এই অবস্থানটি কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন। তারপর ধীরে ধীরে পিঠ নিচে নামিয়ে পূর্বের মতো বক্স অবস্থানে ফিরে আসুন। এসময়ে খেয়াল রাখুন যেন পেটের ওজনে পিঠ বেশি বাঁকা না হয়ে যায়। ব্যায়াম শেষে পিঠ সবসময় সোজা অবস্থানে আনতে হবে।
  4. এভাবে ১০ বার আস্তে আস্তে পিঠ সাবধানে ওপরে তুলুন আর সোজা করুন। প্রতিবারই পেটের পেশি টানটান করে রাখার চেষ্টা করুন।

উল্লেখ্য, পিঠে ব্যথা থাকলে সাবধানে পিঠ ওঠানোর চেষ্টা করবেন। যতদূর পর্যন্ত ওঠাতে কষ্ট না হয় ততটুকুই ওপরে তুলবেন।

পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ

দুই পায়ের মাঝখানে একটা পেশিবহুল পর্দার মতো অংশ থাকে। একে পেলভিক ফ্লোর বলা হয়। এটি জরায়ু, মূত্রথলি ও নাড়িভুঁড়িকে সঠিক স্থানে ধরে রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় বাড়ন্ত জরায়ুকে সাপোর্ট দেয়।

প্রসবের সময়ও এই পেশিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো কারণে পেলভিক ফ্লোরের পেশি দুর্বল হয়ে গেলে হাঁচি, কাশি অথবা চাপ দিয়ে মলত্যাগ করার সময় কয়েক ফোঁটা প্রস্রাব বেরিয়ে আসার সমস্যাসহ নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় অথবা প্রসবের পরে অনেকেরই এই সমস্যা দেখা দেয়৷ নিয়মিত পেলভিক ফ্লোরের ব্যায়াম করলে এই ধরনের সমস্যা এড়ানো সম্ভব।

পেলভিক ফ্লোরের ব্যায়াম অনেকের কাছে ‘কেগেল ব্যায়াম’ নামেও পরিচিত। এই ব্যায়ামটি দাঁড়িয়ে, বসে অথবা শুয়ে যেকোনো ভাবেই করা যায়—

  1. প্রথমে পায়খানার রাস্তা চাপ দিয়ে এমনভাবে বন্ধ করে রাখুন যেন পায়খানা আটকানোর চেষ্টা করছেন। একই সাথে যোনিপথকে চাপ দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন। প্রস্রাবের রাস্তাতেও এমনভাবে চাপ দিন যেন প্রস্রাব আটকানোর চেষ্টা করছেন।

মোট কথা, প্রস্রাব-পায়খানার বেগ আটকানোর জন্য যেভাবে আমরা দুই পায়ের মাঝখানের পেশিগুলোকে শক্ত করে রাখি সেভাবে পেশিগুলো শক্ত করুন।

  1. প্রথম কয়েকবার করার সময়ে ব্যায়ামটি দ্রুত করুন। ওপরের পদ্ধতিতে দ্রুত চাপ প্রয়োগ করুন এবং ছেড়ে দিন।
  2. এবার ব্যায়ামটা ধীরে ধীরে করার চেষ্টা করুন। যতক্ষণ সম্ভব হয় পেশিগুলো চাপ দিয়ে ধরে রাখুন। এভাবে চাপ ধরে রেখে মনে মনে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনবেন।
  3. এরপর ধীরে ধীরে পেশিগুলো রিল্যাক্স করে চাপ ছেড়ে দিন।
  4. এরকম ভাবে ৮–১০ বার চাপ দেওয়া এবং ছেড়ে দেওয়াকে এক সেট ব্যায়াম ধরা হয়।

হিসাবের সুবিধার জন্য প্রতিবেলার খাবারের পরে ব্যায়ামটি করতে পারেন। সেই সাথে হাঁচি অথবা জোরে কাশি দেওয়ার সময়ও পেশিগুলো শক্ত করে রাখার প্র‍্যাকটিস করতে পারেন। তবে প্রস্রাব অথবা পায়খানা করার সময় এই ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকুন। ব্যায়াম করতে কোনো অসুবিধা হলে অথবা নির্দেশনা ঠিকমতো বুঝতে না পারলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

পেলভিক টিল্ট

  1. প্রথমে আলতোভাবে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ান। এসময়ে যেন কাঁধ আর শরীরের নিচের অংশ বা নিতম্ব দেয়ালের সাথে লেগে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
  2. হাঁটু রিল্যাক্স করে রাখুন।
  3. এবার আপনার পেটকে নিজে নিজে এমনভাবে ভেতরের দিকে ঢুকানোর চেষ্টা করুন যাতে পিঠ পেছনে দেয়ালের সাথে লেগে যায়। এভাবে ৪ সেকেন্ড ধরে রেখে পেট আবার স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসুন।
  4. এভাবে মোট ১০ বার পর্যন্ত করুন।

পিঠ ও কোমরের পেশির ব্যায়াম

এই ব্যায়ামটি পিঠ, কোমর ও পেটের পেশিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। এজন্য—

  1. প্রথমে মাটিতে বা শক্ত বিছানার ওপরে হাঁটু ভাঁজ করে বসুন।
  2. ধীরে ধীরে শরীরের ওপরের অংশ ডানদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করুন। এরপর ডান হাত পেছনে নিয়ে তা দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করুন। এসময়ে ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য বামহাত ওপরের দিকে তুলে রাখতে পারেন।
  3. কিছুক্ষণ এই অবস্থানে থাকার পর ধীরে ধীরে শুরুর অবস্থানে ফিরে আসুন। এরপর একই নিয়মে বাম দিকে শরীর ঘুরিয়ে বাম হাত দিয়ে ডান পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করার চেষ্টা করুন।
  4. এভাবে উভয় পাশে ৪-৬ বার ব্যায়াম করুন। প্রতিবার ব্যায়াম করার সময়ে দিক পরিবর্তন করে নিন।

ভারসাম্য ঠিক রাখার ব্যায়াম

গর্ভাবস্থায়, বিশেষ করে শেষ ত্রৈমাসিকে পেটের আকার সামনের দিকে অনেকটা বেড়ে যায়। একারণে শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এই সমস্যা মোকাবেলায় নিচের ব্যায়ামটি সাহায্য করতে পারে—

  1. প্রথমে যতটা সম্ভব সোজা হয়ে দাঁড়ান। এরপর দাঁড়ানো অবস্থায় দুই হাত পেছনে নিয়ে কোমরের ওপর রাখুন।
  2. এবার দুই হাতের ওপর ভার দিয়ে ধীরে ধীরে শরীর পেছনের দিকে কিছুটা বাঁকানোর চেষ্টা করুন। তবে ঘাড় পুরোপুরি বাঁকিয়ে ফেলার দরকার নেই।
  3. এই অবস্থানটি ২০ সেকেন্ডের মতো ধরে রাখুন।
  4. এভাবে মোট ৫-৬ বার ব্যায়ামটি করুন। ব্যায়ামটি করার সময়ে সাপোর্টের জন্য পাশে একটি চেয়ার রাখতে পারেন।

পায়ের ব্যায়াম

  1. পিঠ সোজা রেখে একটি চেয়ারে বসুন। পিঠ টানটান রাখার দরকার নেই, কিন্তু হেলান দেওয়াও যাবে না। এসময়ে আপনার দুই পা কিছুটা ফাঁকা রেখে পায়ের পাতা মাটিতে রাখুন।
  2. এবার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে পেট ভেতরের দিকে ঢুকানোর চেষ্টা করুন। পেট ছাড়া শরীরের বাকি অংশ রিল্যাক্সড রাখার চেষ্টা করুন। বিশেষ করে দুই বাহু আর কোমরের একেবারে নিচের হাড়ের ওপর যেন চাপ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
  3. পেট চেপে রাখা অবস্থায় বাম পা আস্তে আস্তে ওপরে তোলার চেষ্টা করুন। ওপরে তোলার সময় পা সোজা রাখতে হবে, হাঁটু ভাঁজ করা যাবে না। একই সময়ে ডান হাতও শপথ নেয়ার ভঙ্গিতে সামনের দিকে সোজা করে মেলে ধরুন। এই অবস্থানটি কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন।
  4. কয়েক সেকেন্ড পরে হাত-পা নামিয়ে আবার শুরুর অবস্থানে ফিরে আসুন। এবার ডান পা ও বাম হাত দিয়ে ব্যায়ামটি আবার করুন।
  5. এভাবে ডান ও বাম প্রতিপাশে ৪–৬ বার করে মোট ৮–১২ বার ব্যায়ামটি করুন। প্রতিবার পাশ পরিবর্তন করে নিন। অর্থাৎ প্রথমে ডানপাশে করলে এরপর বামপাশে এবং তারপর আবার ডানপাশে ব্যায়ামটি করুন।

হাতের ব্যায়াম

ব্যায়াম ১: এই ব্যায়ামটি মূলত দুই হাত ও বুকের পেশিকে মজবুত করতে সহায়তা করে। এই ব্যায়ামটি করার জন্য একটি রাবারের তৈরি লম্বা ব্যান্ড প্রয়োজন হবে, যা সাধারণত ফার্মেসিতে ‘রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড’ নামে পাওয়া যায়।

এই ব্যায়ামটি যেভাবে করবেন—

  1. প্রথমে পিঠ সোজা রেখে একটি চেয়ারে বসুন। পা স্বাভাবিকভাবে মাটিতে রাখুন। 
  2. এবার রাবারের তৈরি ব্যান্ডটি হাতে নিন। ব্যান্ডটি মাথার পেছনে নিয়ে যান। বাম হাতের সাহায্যে ব্যান্ডটির এক প্রান্ত কোমর বরাবর শক্ত করে ধরে রাখুন৷ ডান হাত দিয়ে আরেক প্রান্ত ধরুন।
  3. এবার প্রথমে ডান হাত দিয়ে ব্যান্ডটি টেনে লম্বা করে মাথার ওপরে নিয়ে যান। এরপর কনুই ভাঁজ করে ব্যান্ডটিকে ছোটো করে আনুন। অনেকটা স্প্রিং এর মতো ব্যান্ডটিকে এভাবে ছোটো-বড়ো করতে থাকুন। খেয়াল রাখবেন ব্যান্ডটি ছোটো-বড়ো করার সময়ে কোমরের কাছে শক্ত করে ধরে রাখা প্রান্তটি যেন স্থির থাকে। 
  4. এভাবে ৪–৬ বার ডান হাত দিয়ে ব্যান্ডটিকে ছোটো-বড়ো করুন।
  5. তারপর হাত বদল করে একেবারে প্রথম অবস্থানে ফিরে যান। এবার ডান হাত দিয়ে কোমরের প্রান্তটি ধরে রাখুন৷ আর বাম হাত দিয়ে ব্যায়ামটি করুন। এভাবে ক্রমান্বয়ে দুই হাতের ব্যায়াম করে নিন।

ব্যায়াম ২: এই ব্যায়ামটি আপনার শরীরের দুই পাশের আঁটসাঁট ভাব কমাতে ও শরীরকে রিল্যাক্স রাখতে সহায়তা করবে।

ব্যায়ামটি যেভাবে করবেন—

  1. প্রথমে পিঠ স্বাভাবিক অবস্থানে রেখে চেয়ারে বসুন। পেটের পেশিগুলোকে টানটান করুন। পা সোজাভাবে মাটিতে রাখুন। দুই পায়ের মাঝে ফাঁকা জায়গা রাখুন।
  2. আপনার বাম হাত আপনার ডান হাঁটুর ওপর রাখুন। এবার ডান হাত উঁচু করে মাথার ওপর তুলুন। এরপর হাত ঐ অবস্থানে ধরে রেখে শরীর বামদিকে বাঁকানোর চেষ্টা করুন। যতদূর বাঁকালে শরীরের ডানপাশের পেশিগুলোতে হালকা টান বা স্ট্রেচ অনুভব করছেন ততদূর পর্যন্ত বাঁকান৷
  3. এই অবস্থানটি কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিন। কাঁধ আলাদা করে কম কিংবা বেশি বাঁকানোর দরকার নেই। শরীর বাঁকাতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে কাঁধ যেভাবে বাঁকে সেই অবস্থানই ধরে রাখুন।
  4. কয়েক সেকেন্ড পর সোজা হয়ে স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসুন। এরপর পাশ পরিবর্তন করে আবার ব্যায়ামটি করুন। এবার ডান হাত বাম হাঁটুতে রাখুন এবং বাম হাত ওপরে তুলে ডান দিকে শরীর বাঁকানোর চেষ্টা করুন।
  5. এভাবে প্রতি পাশে ৪–৬ বার করে ব্যায়ামটি করুন। প্রতিবার পাশ পরিবর্তন করে নিন, অর্থাৎ একবার ডান পাশে করলে পরের বার বাম পাশে—এভাবে মোট ৮–১২ বার ব্যায়াম করুন।