প্রসবের ধাপসমূহ

গর্ভের সন্তানকে জরায়ু থেকে যোনিপথ দিয়ে বাইরের জগতে বের করে আনার প্রক্রিয়াটি হলো প্রসব। প্রসবের প্রক্রিয়াটি কয়েক ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রতিটি ধাপেই প্রসূতি নারীদের শারীরিক কিছু পরিবর্তন হয়। একই সাথে প্রসব মানসিকভাবেও মায়েদের জন্য একটি স্পর্শকাতর সময়।

সন্তান প্রসবের এ প্রক্রিয়াটি কেমন হয় তা নিয়ে নতুন মায়েদের নানান দুশ্চিন্তা থাকতে পারে। লম্বা এই প্রক্রিয়ায় শরীরে কী কী পরিবর্তন হয় এবং কীভাবে নিজেকে এর মাঝে সামলে রাখতে হয় জানা থাকলে মায়েরা অনেকখানি আশ্বস্ত থাকতে পারেন।

প্রসব শুরু হওয়ার পূর্ব লক্ষণ

প্রসবের সময় কাছে আসার কিছু প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে—

১. গর্ভের সন্তান কিছুটা নিচে নেমে আসা: এটি আপনার প্রথম গর্ভাবস্থা হয়ে থাকলে প্রসবের কয়েক সপ্তাহ আগে আপনার মনে হতে পারে আপনার সন্তানটি গর্ভের ভেতরে কিছুটা নিচের দিকে অবস্থান করছে। তবে দ্বিতীয় বা তার পরবর্তী গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে সন্তান নিচে নামার এই অনুভূতি প্রসব প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত নাও হতে পারে।

২. স্রাবের দলা নিঃসৃত হওয়া: যখন আপনার জরায়ুমুখ বড়ো হওয়া শুরু করে তখন যোনিপথে স্রাবের একটি বড়ো দলা বা একসাথে বেশি পরিমাণে স্রাব বের হয়ে আসতে পারে। আবার একসাথে এক দলা বের না হয়ে লম্বা সময় ধরে ধীরে ধীরে অল্প পরিমাণে স্রাব বের হতে পারে। অল্প অল্প করে বের হলে অনেকে স্রাব বের হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য নাও করতে পারে।

৩. জরায়ুমুখের পাতলা ও প্রসারিত হওয়া: সন্তানের প্রসব সুগম করার জন্য প্রসবকালে নারীর শরীরে স্বাভাবিকভাবে কিছু পরিবর্তন হয়। জরায়ুমুখের দেয়াল মোটা থেকে পাতলা হওয়া তার মধ্যে একটি। সন্তান প্রসবের জন্য জরায়ুমুখের সরু রাস্তা প্রসারিত হয় যাকে ‘সারভাইকাল ডাইলেশন’ বলে। নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপ-এর সময় আপনার চিকিৎসক আপনার জরায়ুমুখ পাতলা, নরম বা প্রসারিত হতে শুরু করেছে কি না তা বলতে পারবেন।

৪. স্রাবের সাথে সামান্য পরিমাণে রক্ত মিশ্রিত থাকা: কখনো কখনো যোনিপথে স্রাবের সাথে অল্প পরিমাণে রক্তও বের হতে পারে। কিন্তু রক্তক্ষরণ যদি স্বাভাবিক মাসিকের রক্তপাতের চেয়ে ভারী হয়, যদি রক্ত মাখা নিঃসরণের সাথে আপনার পেটে ব্যথা থাকে, অথবা যদি রক্তক্ষরণ অনেক দিন ধরে হয়ে থাকে এবং না কমে, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

৫. পেটে মৃদু টান অনুভব করা: গর্ভাবস্থার শেষের দিকে আপনি পেটে বা তলপেটে মাঝেমাঝে হঠাৎ টান অনুভব করতে পারেন। এই টান সাধারণত অনিয়মিত ভাবে দেখা দেয় এবং খুব বেশি সময়ের জন্য স্থায়ী হয় না। একে ‘ব্রেক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন’ বলা হয়। এটি অনেকটা প্রসব ব্যথার মতো লাগে দেখে এটিকে নকল প্রসব বেদনা বা ফলস লেবার পেইনও বলা হয়।

তবে যদি এই টান নিয়মিতভাবে হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে টানের স্থায়িত্ব বাড়তে থাকে তবে তা প্রকৃত প্রসব বেদনা শুরু হওয়ার লক্ষণ হতে পারে।

প্রসবকালীন সময়ের জন্য প্রস্তুতি

প্রসব জন্য নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করাটা জরুরি। এর জন্য নিচের উপায়গুলো মেনে চলতে পারেন—

  • প্রসব সম্পর্কে আগে থেকেই বিস্তারিত জেনে রাখুন। প্রসব নিয়ে পরিষ্কার ধারণা আপনাকে এর জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে সহায়তা করবে।
  • আগে থেকেই একটি জন্ম পরিকল্পনা তৈরি করে রাখুন। প্রসববেদনা উঠলে দ্রুত কীভাবে কোন হাসপাতালে যাবেন তা ঠিক করে রাখুন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগে থেকে একটি ব্যাগে গুছিয়ে রাখতে পারেন। প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ হাতে রাখুন।
  • প্রসব একটি শ্রমসাধ্য ব্যাপার। তাই প্রসবের আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করুন। তৃতীয় ত্রৈমাসিকে, বিশেষ করে শেষের দিনগুলোতে ঘুম যেন কম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
  • প্রসব নিয়ে নানারকম দুশ্চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। তবে এ নিয়ে ভয় না পেয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। আপনি মানসিকভাবে যতটা রিল্যাক্স থাকতে পারবেন আপনার জন্য প্রসবের সাথে মানিয়ে নেওয়া ততটা সহজ হবে।
  • নিজেকে শান্ত রাখার জন্য ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার প্র‍্যাকটিস করতে পারেন। এ ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম মাথা ঠান্ডা রাখতে/স্নায়বিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
  • সন্তান প্রসবের পুরো প্রক্রিয়াটিতে আপনার শরীরে প্রচুর পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন হবে। এজন্য পুষ্টিকর ও শক্তি দায়ক খাবার খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
  • গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করলে তা আপনাকে শারীরিকভাবে প্রসবের জন্য প্রস্তুত হতে সহায়তা করবে। তাই খুব বেশি সমস্যা না হলে প্রসবের আগের দিনগুলো পর্যন্ত নিয়মিত ব্যায়াম চালিয়ে যান।
  • প্রসববেদনা শুরু হওয়ার পর সাথে সাথে সন্তান প্রসব হয় না। সাধারণত ব্যথা শুরু হওয়ার বেশ কয়েক ঘন্টা পর সন্তান প্রসব হয়। এই মধ্যবর্তী সময়ে আপনি সম্ভব হলে হালকা হাঁটাচলা করতে পারেন। এতে প্রসব সহজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে ডাক্তারের নিষেধ থাকলে এসময় বাড়তি চলাফেরা করার কোনো প্রয়োজন নেই।
  • প্রসববেদনা লাঘব করার জন্য অনেকে মালিশ বা ম্যাসাজ নিয়ে থাকেন। অনেকে আবার হট ওয়াটার ব্যাগ অথবা আইস ব্যাগ ব্যবহার করে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করেন।
  • ঔষধের সাহায্যেও প্রসববেদনা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। মাস্কের সাহায্যে দেওয়া নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস কিংবা ইনজেকশন এর মাধ্যমে দেওয়া পেথিডিন প্রসববেদনা কমায়। এ ছাড়া ব্যথানাশক হিসেবে‘এপিড্যুরাল এনেস্থিসিয়াও অনেকের ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী হয়।
  • প্রসব প্রক্রিয়ায় মানসিক চাপমুক্ত থাকতে আপনজন কেউ সাথে থাকার বিকল্প নেই। আপনার স্বামী কিংবা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য সার্বক্ষণিক আপনার পাশে থেকে সাহস যোগালে তা আপনাকে মানসিকভাবে প্রসবের ধকল সহ্য করতে সহায়তা করবে। তিনি প্রয়োজনে আপনার ব্যথার জায়গায় মালিশ করে আপনাকে সহায়তা করতে পারবেন।

প্রসবের প্রথম ধাপ: জরায়ুর সংকোচন

সন্তান প্রসবের সময় হলে অক্সিটোসিন নামক হরমোনের প্রভাবে জরায়ুতে সংকোচন শুরু হয়। এই সংকোচন মূলত গর্ভের সন্তানকে ঠেলে নিচে নামানোর জন্য হয়। প্রসব প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে জরায়ুর সংকোচনের ফলে আপনার জরায়ুমুখ প্রসারিত হয়। সেই সাথে আপনি সংকোচনের কারণে পেটে টান অনুভব করেন। এ ধাপটি আবার দুইটি পর্যায়ে হয়ে থাকে—

  1. প্রাথমিক পর্যায়
  2. সক্রিয় পর্যায়

সাধারণত যখন সক্রিয় পর্যায় শুরু হবে তখন আপনার চিকিৎসক অথবা ধাত্রী এর সহায়তা নিতে হবে।

প্রসব প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে কী কী হয়?

১. পেটে টান অনুভব করা

জরায়ুর সংকোচনের কারণে আপনার পেটে নিয়মিতভাবে টান অনুভব করতে থাকবেন। প্রাথমিক পর্যায়ে আপনি প্রতি ৪ থেকে ৫ মিনিটে ১টি করে টান অনুভব করতে পারেন। একেকটি টান ৪০ থেকে ৬০ সেকেন্ড ধরে হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে আপনি তলপেটে ব্যথা অনুভব করতে পারেন। তবে  সাধারণত এই ধাপে খুব গুরুতর ব্যথা হয় না। আপনি টানের মাঝে হাঁটাচলা করতে পারবেন এমনকি ঘুমাতেও পারবেন।

সক্রিয় পর্যায় বা অ্যাক্টিভ লেবার শুরু হলে আপনার পেটের টানগুলো অনেক ঘন ঘন হতে থাকবে এবং একই সাথে অনেক লম্বা সময় ধরে হবে। আপনি প্রতি আড়াই থেকে তিন মিনিটে একটি করে টান অনুভব করতে পারেন। এক মিনিটের বেশি সময় ধরে টান স্থায়ী হতে শুরু করবে। এই পর্যায়ে ব্যথাও আগের চেয়ে তীব্র হবে এবং আপনি ব্যথার ভেতর স্বাভাবিক কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারবেন না।

এই অবস্থায় যদি হাসপাতালে প্রসব করার পরিকল্পনা থেকে থাকে তাহলে হাসপাতালে যেতে হবে। যদি আপনার গর্ভাবস্থা জটিলতামুক্ত হয়ে থাকে এবং আপনি ঘরে প্রসব করতে আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে সক্রিয় ধাপেই দক্ষ ধাত্রীকে খবর দিতে হবে।

সুতরাং তলপেটে টান কত সময় পর পর এবং কতক্ষণ ধরে অনুভব করছেন—সেটি খেয়াল রাখা আপনার প্রসবের প্রস্তুতি নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই সঠিকভাবে এই সময়গুলো মাপার চেষ্টা করুন এবং সম্ভব হলে লিখে রাখুন।

প্রসব প্রক্রিয়ার শুরুর দিকের এই সংকোচনকে অনেকে ব্রেক্সটন হিক্স নামক সংকোচনের সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। গর্ভাবস্থায় বিশেষ করে শেষের দিকে জরায়ুতে অনিয়মিতভাবে যেই টান বা সংকোচন অনুভব হয় সেটিই হলো ব্রেক্সটন হিক্স। গর্ভবতী মায়ের শরীরকে প্রসবের জন্য তৈরি করার উদ্দেশ্যে সত্যিকারের প্রসববেদনার আদলে এই ধরনের সংকোচন হয়ে থাকে। ব্রেক্সটন হিক্স সংকোচনকে প্রকৃত প্রসববেদনা থেকে আলাদা করার উপায় হলো, এটি—

  •  নির্দিষ্ট সময় পর পর হয় না
  • অস্বস্তিকর হলেও ব্যথা তৈরি করে না
  • নড়াচড়া করলে এটি কমে যেতে পারে

খুব সহজভাবে বললে, কারো সাথে কথোপকথনের মাঝে যদি আপনি টান অনুভব করেন এবং এরপরও স্বাভাবিকভাবে কথা চালিয়ে যেতে পারেন, টানের কারণে কথা থামিয়ে দীর্ঘ শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন না হয়—তাহলে সেটি ব্রেক্সটন হিক্স। আর এর অন্যথা হলে সেটি প্রকৃত প্রসববেদনা।

পড়ুন: ব্রেক্সটন হিক্স ও প্রকৃত প্রসববেদনার মধ্যে পার্থক্য

২. জরায়ুমুখ প্রসারিত হওয়া

প্রসবের প্রথম ধাপে আপনার জরায়ুমুখ বড়ো হতে থাকবে। প্রাথমিক পর্যায়ে তা ৪ সে.মি. পর্যন্ত বড়ো হবে এবং এরপর সক্রিয় পর্যায় শুরু হয়। এই পর্যায়ে আপনার জরায়ুমুখ আরও দ্রুত বড়ো হবে। আপনার চিকিৎসক অথবা দক্ষ ধাত্রী প্রসারণের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং সেই সাথে যোনিপথের পরীক্ষাও করে নিবেন। সাধারণত ৩ থেকে ৪ ঘন্টা পর পর তিনি পর্যবেক্ষণ করবেন। যখন জরায়ুমুখ ১০ সেমি প্রসারিত হয়ে যাবে তখন প্রসবের প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ হবে।

৩. যোনি দিয়ে পাতলা ও আঠালো স্রাব নিঃসরণ

এসময় আপনার যোনিপথ দিয়ে পাতলা-আঠালো একটি স্রাব নিঃসৃত হতে পারে। এর সাথে রক্তের হালকা লাল লাল ভাব থাকতে পারে। এটি স্বাভাবিক এবং দুশ্চিন্তার কোনো বিষয় নয়। তবে হালকা লাল লাল ভাবের চেয়ে বেশি রক্ত লক্ষ করলে দ্রুত আপনার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

৪. পানি ভাঙা 

যদি প্রসববেদনাসহ পানি ভেঙ্গে থাকে তাহলে আপনার প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যদি গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ অথবা তার পরে আপনার পানি ভাঙে কিন্তু এর সাথে প্রসব বেদনা শুরু না হয়, সেক্ষেত্রে আপনি পানি ভাঙার জন্য ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারেন। তারপরও প্রসব প্রক্রিয়া শুরু না হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবে ৩৭ সপ্তাহ বা ৯ মাসের আগে পানি ভেঙে গেলে তা অকাল প্রসব ঘটাতে পারে। তাই এমনটা হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের সহায়তা নিন।

৫. গর্ভের সন্তান নিচের দিকে নেমে আসতে শুরু করা 

সাধারণত গর্ভের সন্তান দ্বিতীয় ধাপে জরায়ু থেকে নিচে নামতে শুরু করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রথম ধাপেই সক্রিয় পর্যায়ে শিশুটি এই যাত্রা শুরু করতে পারে।

৬. বমি অথবা বমি বমি ভাব হওয়া

এই ধাপে স্বাভাবিকভাবেই মায়েদের বমি অথবা বমি বমি ভাব হতে পারে। এ ছাড়া যদি আপনি এপিডুরাল অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে থাকেন, সেটির কারণেও আপনার বমি কিংবা বমি ভাব হতে পারে।

প্রথম ধাপ কতক্ষণ স্থায়ী হয়?

সক্রিয় প্রসব শুরু হওয়ার পর প্রথম ধাপে প্রথমবারের মতো সন্তান প্রসব করা মায়েদের ক্ষেত্রে ১২ ঘন্টা সময় পর্যন্ত লাগতে পারে। তবে যেসব মায়েরা আগেও সন্তান জন্ম দিয়েছেন তাদের জন্য এই ধাপটি সাধারণত ৬ ঘন্টা স্থায়ী হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় ধাপ: সন্তান প্রসব

দ্বিতীয় ধাপে আপনার সন্তান জরায়ু থেকে জরায়ুমুখ দিয়ে যোনিপথে নেমে আসে এবং পর্যায়ক্রমে ভূমিষ্ঠ হয়। শিশুটিকে বের হয়ে আসতে সহযোগিতা করার জন্য এই পর্যায় মাকে নিজে নিজে পেটে চাপ তৈরি করে কিছুটা ধাক্কা দেওয়ার বা পুশ করার প্রয়োজন হয়।

প্রসব প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপে কী কী হয়?

১. সংকোচনের তীব্রতা ও পুনরাবৃত্তি কমে আসবে: এই ধাপের শুরুতে সক্রিয় পর্যায়ের তুলনায় জরায়ুর সংকোচন কম তীব্র হয়। জরায়ু থেকে সন্তান ইতোমধ্যে কিছুটা নিচে চলে আসে দেখে এমনটা হয় বলে ধারণা করা হয়। আপনি এখন আগের তুলনায় কম ঘন ঘন টান অনুভব করবেন। এতে করে দুই টানের মধ্যে যে বিশ্রামটুক দরকার সেটি আপনি পেতে পারেন।

২. সন্তানকে নিচের দিকে ধাক্কা দেওয়ার তাগিদ অনুভব করবেন: জরায়ুর সংকোচন আপনার সন্তানকে অনেকটুকু পথ নিচে নামিয়ে দেয়। যখন সন্তান তলপেটের নিচের দিকে চলে আসে তখন আপনি নিজে জোরে পেটে চাপ সৃষ্টি করে সন্তানকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করবেন। অর্থাৎ এই পর্যায়ে পেটে চাপ তৈরির মাধ্যমে আপনি ধাক্কা দিয়ে সন্তানকে নিচের দিকে নামতে সাহায্য করবেন।

যদি আপনি এপিডুরাল অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে থাকেন তাহলে পুশ করার তাগিদ কম টের পেতে পারেন কিংবা নাও পেতে পারেন।

৩. আপনার সন্তান নিচে নেমে আসবে ও জন্মলাভ করবে: জরায়ুর সংকোচন ও আপনার ধাক্কার ফলে গর্ভের সন্তান নিচে নেমে আসতে থাকে। প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে জরায়ু থেকে নিচে যোনিপথে নামতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগবে।

শিশুটি এক পর্যায়ে একেবারে নিচের দিকে নেমে আসলে তার শরীরের চাপের ফলে বাইরে থেকে আপনার যোনির চারপাশের অংশটি ফোলা দেখাবে এবং ধীরে ধীরে যোনির মুখে শিশুটির মাথার তালু দেখা যেতে থাকবে। একই সাথে শিশুটির মাথার চাপের কারণে আপনার পুশ করার তাগিদ আরও বেড়ে যেতে পারে। 

এই পর্যায়ে আপনাকে আপনার চিকিৎসক পুশ করা বা ধাক্কা দেওয়া থামাতে অথবা কমাতে বলতে পারেন। এই পর্যায়ে আপনার সন্তান সাবলীলভাবে যোনিপথ দিয়ে বের হয়ে যাবে এমনটাই কাম্য।

বেশি জোরাজোরির ফলে সন্তান বের হওয়ার সময় আপনার যোনিপথের আসে পাশের জায়গা, যাকে বলে পেরিনিয়াম, তা ছিড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তাই আপনাকে আপনার চিকিৎসক বা ধাত্রী প্রতি সংকোচনের সাথে লম্বা শ্বাস নিতে বলতে পারেন যাতে করে তাগিদ থাকলেও আপনি ক্ষতিকর চাপ তৈরি করে ধাক্কা না দেন।

এই পর্যায়ে, সন্তানের বের হয়ে আসা সহজ করার জন্য আপনার চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী আপনার পেরিনিয়াম, অর্থাৎ যোনি ও পায়ুপথের মাঝের জায়গাটিতে ছোটো করে কেটে দিতে পারেন। এর নাম এপিসিওটমি। এটিকে ‘সাইড কাটা’ নামেও অভিহিত করা হয়। প্রসবের পর এই কাটা জায়গাটি সেলাই করে দেওয়া হয়। তবে সব ক্ষেত্রে এপিসিওটমি প্রয়োজন হয় না।

ধীরে ধীরে আপনার সন্তানের মাথার সবচেয়ে প্রশস্ত অংশটি এমনভাবে বের হয়ে আসবে যাতে করে মাথা আর ভেতরে ফেরত যাওয়া সম্ভব হবে না, এই পর্যায়কে বলা হয় ‘ক্রাওনিং’। তারপর একে একে তার কপাল, নাক ও থুতনি বেরিয়ে আসে। এরপর আস্তে আস্তে তার ঘাড় এবং শরীরের বাকি অংশ বের হয়ে আসে।

সন্তান জন্মের ১ থেকে ২ মিনিটের ভেতর নাড়িতে ক্লিপ দিয়ে তা কেটে দেওয়া হয়। তারপর প্রাথমিকভাবে একবার আপনার সন্তানকে চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখবেন। তারপর তাকে আপনার কোলে তুলে দেওয়া হবে। আপনি সাথে সাথেই তাকে বুকের দুধ দিতে পারবেন। জন্মের প্রথম এক ঘন্টার ভেতর বুকের দুধ দেওয়া সন্তানের জন্য সবচেয়ে উপকারী।

দ্বিতীয় ধাপ কতক্ষণ স্থায়ী হতে পারে?

যদি এটি আপনার প্রথম সন্তান জন্মদান হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে এই ধাপে ৩ ঘন্টার মতো সময় লাগবে। যদি আপনি আগেও প্রসব করে থাকেন সেক্ষেত্রে সাধারণত ২ ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগতে পারে। তবে আপনি এপিডুরাল অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে থাকলে আরও বেশি সময় লাগতে পারে।

তৃতীয় ধাপ: গর্ভফুল বের হয়ে আসা

তৃতীয় ধাপে আপনার জরায়ু থেকে গর্ভফুল আলাদা হয়ে বের হয়ে আসে। এই গর্ভফুলের মাধ্যমেই গর্ভাবস্থায় শিশু আপনার থেকে অক্সিজেন ও পুষ্টি পেয়ে এসেছে। আবার সন্তানের বর্জ্য পদার্থগুলোও বের হয়েছে এই গর্ভফুলের মাধ্যমেই।

গর্ভফুল দুইভাবে বের হয় আসতে পারে—

১. স্বাভাবিকভাবে: এক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ না করে গর্ভফুল গর্ভ থেকে আলাদা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা হয়। আলাদা হয়ে গেলে আপনার চিকিৎসক আবার আপনাকে একটি পুশ বা ধাক্কা দেওয়ার জন্য বলতে পারেন। তবে এটি ছোটো একটি ধাক্কা যা কষ্টদায়ক হয় না। গর্ভফুল নিজে নিজে আলাদা হতে বেশ খানিকটা সময় লাগতে পারে। আলাদা হয়ে যাওয়ার পর কয়েক মিনিটেই এটি চাপ দিয়ে বের করে ফেলা যায়।

২. চিকিৎসকের সক্রিয় ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে: গর্ভফুল তাড়াতাড়ি বের করার জন্য চিকিৎসক কিছু ব্যবস্থা নিতে পারেন। এক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের ১ মিনিটের ভেতর আপনাকে অক্সিটোসিন ইনজেকশন দেওয়া হবে। এর ফলে আপনার জরায়ু আবার তীব্রভাবে সংকুচিত হবে। চিকিৎসক তার এক হাত আপনার তলপেটের উপর রাখবেন। জরায়ু যখন সংকুচিত থাকবে তখন আরেক হাত দিয়ে আপনার ক্লিপ করা নাড়ি ধরে আস্তে আস্তে টেনে গর্ভফুল বের করে আনবেন।

তৃতীয় ধাপে কতক্ষণ সময় লাগবে?

তৃতীয় ধাপের ক্ষেত্রে প্রথম প্রসব কিংবা পরবর্তী প্রসবগুলোর মধ্যে সময়ের কোনো পার্থক্য হয় না। সাধারণত এই ধাপে ১৫ মিনিটের মতো সময় লাগে। তবে সক্রিয় ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে এই সময়কাল ৫ মিনিটে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়।

প্রসবের বিপদ চিহ্ন

প্রসবের সময় কোন কোন লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে তা জানতে প্রসবের বিপদ চিহ্নগুলো চিনে রাখুন—

  • যোনিপথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়া
  • গর্ভফুল গর্ভে থেকে যাওয়া
  • খিঁচুনি হওয়া
  • সন্তান প্রসব হতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় (১২ ঘণ্টার বেশি) লাগা

প্রসব পরবর্তী সমস্যা ও বিপদ চিহ্ন

প্রসব পরবর্তী সময়ে আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যই কাম্য। এই সময়ে স্বাভাবিকভাবেই আপনি শারীরিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন। তবে প্রসব পরবর্তী সময়ে আপনার শরীরে কিছু সমস্যা বা জটিলতা দেখা দিতে পারে। সমস্যাগুলোর বিষয়ে যথা সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। তাই এই সময়ে এই সমস্যা বা জটিলতাগুলোর লক্ষণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।

প্রসব পরবর্তী সমস্যা ও যেসব লক্ষণ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে—

প্রসব পরবর্তী জটিলতালক্ষণ
পায়ের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা বা ডিপ ভেইন থ্রম্বসিসপায়ের নিচের অংশে ব্যথা, ফুলে যাওয়া কিংবা লাল হয়ে যাওয়া। সাধারণত পায়ের নিচের অংশের পেছনের দিকে, যাকে গোড়ালি বা কাফ বলে, সেখানে এটি বেশি হয়
ফুসফুসের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা বা পালমনারি এম্বোলিজমবুকে ব্যথা অথবা শ্বাসকষ্ট হওয়া
প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণযোনিপথ দিয়ে হঠাৎ করে খুব বেশি রক্ত বের হওয়া, সাথে দুর্বলতা ও বুক ধড়ফড় করাও থাকতে পারে
ইনফেকশনগায়ে জ্বর (তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রীর উপরে) থাকা, পেটে ব্যথা করা
উচ্চ রক্তচাপ জনিত জটিলতা বা পোস্ট-পার্টাম প্রি-এক্লাম্পসিয়ামাথা ব্যথা করা, দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হওয়া ও বমি হওয়া
প্রসব-পরবর্তী মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা পোস্ট-পার্টাম সাইকোসিসনিজের বা সন্তানের ক্ষতি করতে চাওয়ার প্রবণতা

এই সমস্যাগুলোর পরিণতি গুরুতর হতে পারে, তাই এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।

এ ছাড়া, প্রসবের পরে আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে, প্রস্রাবে কিছুটা জ্বালা-পোড়া থাকতে পারে। প্রসবের পর স্বাভাবিকভাবেই আপনার তলপেটের নিচের দিকের পেশিগুলো আগের চেয়ে কিছুটা দুর্বল হয়ে যাবে। যদি আগে থেকে হার্টে বা অন্য কোথাও কোনো অসুস্থতা থেকে থাকে তাহলে প্রসবের পর সেখানে জটিলতা দেখা দিতে পারে।

প্রসব পরবর্তী বিপদ চিহ্ন 

প্রসবোত্তর সময়ে কিছু উপসর্গ বেশি গুরুত্ব সহকারে খেয়াল করতে হবে। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দেরি না করে, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রসব পরবর্তী বিপদ চিহ্নগুলো হলো—

  • যোনিপথে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব বের হওয়া
  • যোনিপথ দিয়ে অতিরিক্ত রক্ত বের হওয়া
  • গায়ে জ্বর আসা

সাধারণ জিজ্ঞাসা

প্রসবের ব্যথা না হলে কী করণীয়?

যদি সন্তান প্রসবের নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পর আপনার প্রসব বেদনা শুরু না হয়, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যান। তিনি আপনার কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আপনার গর্ভের সন্তান কেমন আছে তা দেখে নিবেন। আপনার ও আপনার সন্তানের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে তিনি পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিবেন।
যদি সন্তানের অবস্থা ভালো থাকে তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে প্রসব বেদনা উঠানো বা লেবার পেইন ইন্ডিউস করার আগে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, জটিলতা মুক্ত গর্ভাবস্থায় কৃত্রিমভাবে প্রসববেদনা উঠানোর জন্য ৪১ সপ্তাহ (৪১ সপ্তাহ + ০/৭ দিন) পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।[১]

প্রসবের কতদিন পর সহবাস করা যায়?

প্রসবের পর সহবাসের আগে আপনার যোনিপথ ও তার পার্শ্ববর্তী জায়গাটুকু সেরে ওঠার জন্য অপেক্ষা করুন। সাধারণত সেরে উঠতে প্রসবের পর ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হয়।[২]

বাচ্চা প্রসবের কতদিন পর মাসিক হয়?

প্রসবের পর মাসিক শুরু হওয়ার বিষয়টি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সাথে সম্পর্কিত। বুকের দুধ নিঃসরণের জন্য দায়ী প্রো-ল্যাকটিন হরমোন ওভুলেশন বা ডিম্বপাত বন্ধ রাখার মাধ্যমে মাসিক বন্ধ রাখতে পারে।
সাধারণত জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ-ই খাওয়ানো হয়। তাই সাধারণত এসময় মাসিক হয় না। ৬ মাসের পর শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার খাওয়ানো শুরু করলে কিছু সময় পরে ধীরে ধীরে মাসিক ফিরে আসতে শুরু করে।
এ ছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে বুকের দুধ খাওয়ানো একেবারে বন্ধ না করা পর্যন্ত মাসিক অনুপস্থিত থাকতে পারে। তবে কেও যদি বুকের দুধের পরিবর্তে নবজাতক ও শিশুর জন্য বাজারজাত করা গুড়ো দুধ বা ফর্মুলা মিল্ক দিয়ে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে মাসিক প্রসবের ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পরেই ফিরে আসতে পারে।

(২)

  1. Guidelines Review Committee. “WHO Recommendations on Induction of Labour, at or beyond Term.” World Health Organization, 5 Oct. 2022, https://www.who.int/publications/i/item/9789240052796. Accessed 21 Dec. 2022.
  2. Lopez-Gonzalez, Diorella M., and Anil K. Kopparapu. “Postpartum Care Of The New Mother.” NCBI Bookshelf, 4 Feb. 2022, https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK565875/. Accessed 21 Dec. 2022.