আজকাল আপনার প্রায়ই নির্দিষ্ট কোনো খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জেগে উঠতে পারে। গর্ভাবস্থায় এই সমস্যা খুবই কমন।
তবে সবারই এমন সমস্যা হয় না। এ ধরনের সমস্যায় ভুগলে দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে আপনার খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসের ছোটোখাটো কিছু পরিবর্তন আনতে পারেন। এভাবে আপনি অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা প্রতিরোধ করতে পারবেন।
কখন শুরু হয়?
গর্ভাবস্থায় সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো সময় থেকে কোনো খাবারের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা/আসক্তি শুরু হয় না। একেকজনের ক্ষেত্রে একেকসময় ও একেক খাবারের প্রতি এই লক্ষণ দেখা দেয়। আবার কারও কারও এধরনের কোনো লক্ষণই দেখা দেয় না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের প্রথম ত্রৈমাসিকের মধ্যেই নির্দিষ্ট কোনো খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা শুরু হতে দেখা যায়। এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে গর্ভধারণের প্রথম পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই এই লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
পরবর্তী তিন মাস, অর্থাৎ গর্ভধারণের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ মাসে ধীরে ধীরে এই লক্ষণের তীব্রতা বাড়তে থাকে। তবে গর্ভধারণের শেষের ত্রৈমাসিকের মধ্যে, অর্থাৎ সপ্তম, অষ্টম ও নবম মাসের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু খাওয়ার এমন তীব্র ইচ্ছা তেমন একটা থাকে না বললেই চলে।
কোন খাবারে হয়?
গর্ভাবস্থায় যেসব খাবার খাওয়ার প্রতি তীব্র ইচ্ছা তৈরি হয় তার নির্দিষ্ট কোনো তালিকা নেই। ভিন্ন ভিন্ন নারীর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন খাবারে এমন লক্ষণ দেখা দেয়।
অনেকের ভাজাপোড়া ও চিপসের মতো তেল-চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়ার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। অন্যদিকে আগে অপছন্দ ছিল এমন কিছু খাবার খাওয়ার প্রতিও কারও কারও তীব্র ইচ্ছা জন্মাতে পারে। আপনারও কোনো খাবার খাওয়ার প্রতি তীব্র ইচ্ছা জন্মাতে পারে। তাই এসব নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার প্রয়োজন নেই।
গর্ভাবস্থায় পছন্দমতো খাবার খেতে কোনো সমস্যা নেই। তবে কোনো খাবারই অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়। সব ধরনের খাবার পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। পছন্দমতো খাবার খাওয়ার পাশাপাশি খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কেও খেয়াল রাখতে হবে।
শুধুমাত্র একই ধরনের খাবার অথবা কম পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া যাবে না। এতে মা ও গর্ভের শিশুর অপুষ্টিতে ভোগার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার খাওয়ায় ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে মা ও শিশুর নানান স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পিকা
যদি খুবই অদ্ভুত কিছু—যা খাবার নয়—এমন কিছু, খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হয় (যেমন: মাটি, কাগজ কিংবা দেয়ালের রঙ) তাহলে সেটি ‘পিকা’ নামের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা হলে এমনটি হয়।[১] তাই এমন কিছু বোধ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
কী করবেন?
গর্ভাবস্থায় যেকোনো স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে ইচ্ছা হলে তা খেয়ে নিতে পারেন। এতে কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে দিনশেষে যেন অতিরিক্ত খাবার খাওয়া না হয়ে যায় সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত বা প্রসেসড খাবার, তেল-চর্বিযুক্ত খাবার, ভাজাপোড়া ও চিনিযুক্ত খাবার যতটা এড়িয়ে চলা যায় ততই ভালো। কেননা এসব খাবার মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। এ ছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে কিছু খাবার (যেমন: কলিজা) খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হলেও সেসব খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় কি কি খাওয়া যাবে না?
এক্ষেত্রে যেসব পরামর্শ মেনে চলতে পারেন—
১. পুষ্টিমান জেনে খাবার খান: কোনো খাবার খেতে তীব্র ইচ্ছা হলে তা খাওয়ার আগে খাবারের পুষ্টিমান সম্পর্কে চিন্তা করুন। অপুষ্টিকর ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকুন।
কোনো অপুষ্টিকর খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হলে এর বিকল্প অথবা কাছাকাছি স্বাদ-গন্ধের অন্য কোনো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
২. প্রতিবারে অল্প অল্প করে খাবার খান: অনেকসময় কম পুষ্টিসম্পন্ন ও তেল-চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হতে পারে। এক্ষেত্রে একবারে অনেকখানি খাবার না খেয়ে, অল্প পরিমাণে কয়েক বারে ভাগ করে খেতে পারেন। এতে করে অতিরিক্ত অপুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারবেন।
৩. বারবার খাওয়ার ইচ্ছা হলে মন অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করুন: একই খাবার বারবার খেতে ইচ্ছা করলে মন অন্য দিকে সরানোর চেষ্টা করতে পারেন। এজন্য হালকা ব্যায়াম করা, হাঁটাহাঁটি করা কিংবা গল্প করার মতো কোনো কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন।
পড়ুন: গর্ভবতীর খাবার তালিকা
কেন হয়?
গর্ভাবস্থায় কোনো খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হওয়ার জন্য দায়ী নির্দিষ্ট কোনো কারণ সম্পর্কে এখনও জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, গর্ভাবস্থায় শারীরিক পরিবর্তনের কারণে রুচির এমন পরিবর্তন ঘটে।[২] গর্ভকালীন সময়ে অতিরিক্ত পুষ্টির চাহিদা থাকার কারণেও এমনটা হতে পারে।
কোন ধরনের খাবারের প্রতি তীব্র ইচ্ছা জন্মাবে তার ওপরে পারিপার্শ্বিক ও সংস্কৃতির একটা প্রভাব আছে বলে কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে।[৩] এ ছাড়াও কিছু গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় যে, সাধারণত গর্ভকালীন সময়ে যেসব খাবার (যেমন: টক ফল) খেলে বমি বমি ভাব ও বমি হওয়ার সম্ভাবনা একটু কমে যায়—সেসব খাবার খাওয়ার প্রতি তীব্র ইচ্ছা জন্মে।[৪] তবে এসবের পক্ষে এখনও জোরালো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৫]
গর্ভাবস্থায় অস্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ১১.৫–১৬ কেজি ওজন বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক একটি ঘটনা।[৬] তবে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে, অথবা খাবারের পরিমাণ পরিমিত না রাখলে ওজন অতিরিক্ত বেড়ে যেতে পারে। ওজন প্রয়োজনের চেয়ে বেড়ে গেলে সেটি মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় চিনি জাতীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছা হলেই যে আপনি সরাসরি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন, এমন কোনো তথ্য গবেষণায় পাওয়া যায়নি।[৭] তবে এই জাতীয় খাবার বেশি খেলে ওজন বেড়ে যায়। আর ওজন বেড়ে গেলে গর্ভকালীন জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এসব জটিলতার মধ্যে রয়েছে—
- উচ্চ রক্তচাপ
- প্রি-এক্লাম্পসিয়া
- গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
- সিজার (সিজারিয়ান) অপারেশন করানোর প্রয়োজন হওয়া
- রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি হওয়া
- গর্ভপাত বা গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়া
মায়ের পাশাপাশি গর্ভের শিশুও নানান ধরনের সমস্যায় ভুগতে পারে। যেমন—
- নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অপরিণত (প্রিম্যাচিউর) অবস্থায় জন্মগ্রহণ করা
- গর্ভের শিশুর আকার অস্বাভাবিক বড় হওয়া
- জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়া
- মৃত শিশু জন্ম হওয়া
- ভবিষ্যতে অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হওয়া
তবে মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য গর্ভাবস্থায় নিয়মিত খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা যাবে না। বরং পুষ্টিকর খাবার পরিমিত পরিমাণে খাবেন এবং অস্বাস্থ্যকর, চিনি ও তেল-চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়ার চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি নিয়মিত গর্ভাবস্থায় উপযোগী শারীরিক পরিশ্রম করবেন। এভাবে আপনার জন্য এসব সমস্যা এড়িয়ে চলা সহজ হবে।