গর্ভকালীন সময়ে মাথা ঘুরানো খুবই কমন একটি সমস্যা। এক্ষেত্রে আপনার মনে হতে পারে যেন চারপাশের সবকিছু দুলতে বা ঘুরতে শুরু করেছে। আবার এমনও মনে হতে পারে যে আপনি নিজেই ঘুরছেন। কখনো কখনো আপনি হঠাৎ করে ভারসাম্য হারিয়ে পড়েও যেতে পারেন।
আবার কারও কারও হয়তো মাথা ঝিম ঝিম করতে পারে কিংবা হালকা হালকা লাগতে পারে। মনে হতে পারে যেন আপনি এখনই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন।
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘুরানো অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের সমস্যা হলে ভয় না পেয়ে কিছু সাবধানতা মেনে চলতে হবে। এভাবে আপনি নিজের ও গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারবেন।
গর্ভাবস্থায় কখন মাথা ঘুরানোর সমস্যা হয়?
সাধারণত গর্ভধারণের প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষদিকে মাথা ঘুরানোর সমস্যা শুরু হয়। এরপর সমগ্র গর্ভকাল জুড়েই এই সমস্যা থাকতে পারে। আবার কারও কারও গর্ভধারণের পর থেকেই মাথা ঘুরানোর সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে গর্ভাবস্থায় সবারই মাথা ঘুরানোর সমস্যা হবে—বিষয়টি এমন নয়।
মাথা ঘুরানোর সমস্যা কেন হয়?
গর্ভাবস্থায় কিছু বিশেষ কারণে মাথা ঘুরানোর সমস্যা দেখা দেয়—
- হরমোনের প্রভাব: এসময়ে আপনার শরীরে বেশ কিছু হরমোন ওঠানামা করে। এসব হরমোনের প্রভাবে মাথা ঘুরাতে পারে।
- রক্ত চলাচল বৃদ্ধি: গর্ভকালীন প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষের দিকে আপনার শরীরে রক্ত চলাচল প্রায় দেড়গুণ বেড়ে যায়। একারণে অতিরিক্ত গরম লাগা ও ঘাম হওয়ার পাশাপাশি মাথা ঘুরাতে পারে।
এসবের পাশাপাশি আরও যেসব কারণে মাথা ঘুরাতে পারে—
- ব্রেইনে পরিমাণমতো রক্ত সরবরাহ না হওয়ায় ব্রেইনে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেনের অভাব হলে। যেমন—
- হঠাৎ করে চেয়ারে বসা অথবা বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে দ্রুত দাঁড়িয়ে গেলে।[১] এসময়ে ব্রেইনে রক্ত সরবরাহ হুট করে কমে যায়
- পিঠে হেলান দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকলে। চিত হয়ে শোয়ার ফলে গর্ভের শিশুর জন্য রক্তনালীতে চাপ পড়ে। ফলে ব্রেইনে রক্ত সরবরাহ কমে যেতে পারে
- শরীরে পানিশূন্যতা হলে
- অতিরিক্ত গরমে ক্লান্ত লাগলে
- রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হঠাৎ কমে গেলে
- ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ কমে গেলে
- রক্তশূন্যতায় ভুগলে[২]
- কোনো কারণে আতঙ্কিত হলে অথবা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করলে[৩]
- ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে
এ ছাড়াও মাইগ্রেন ও কানের সমস্যাসহ অন্য কোনো রোগ থাকলেও আপনার মাথা ঘুরানোর সমস্যা হতে পারে।
মাথা ঘুরানোর কিছু ঘরোয়া সমাধান
সহজ কিছু নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে আপনি মাথা ঘুরানোর সমস্যার চিকিৎসা করতে পারবেন। তবে কোনো নির্দিষ্ট রোগের কারণে মাথা ঘুরালে এটি পুরোপুরি সারাতে ঐ রোগের সঠিক চিকিৎসা করতে হবে।
গর্ভকালীন সময়ে মাথা ঘুরানো প্রতিরোধের জন্য নিচের নিয়মগুলো মেনে চলুন—
যা করবেন
- গর্ভকালীন সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিবেন।
- বসা অথবা শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে ওঠার সময় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াবেন।
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করবেন।
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। কাপ কিংবা গ্লাসের হিসাবে আপনাকে সারাদিনে মোট ৮–১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে।[৪] তবে এই বিষয়ে কখনো যদি ডাক্তার কোনো বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাহলে সেটিই অনুসরণ করবেন।
- সারাদিনে অল্প অল্প করে বারবার পুষ্টিকর খাবার খাবেন।
- নিয়মিত ব্যায়াম করবেন—এতে শরীর ও ব্রেইনে রক্ত চলাচল ভালো হয়।[৫]
- দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মাথা ঘুরালে যত দ্রুত সম্ভব ধীরে ধীরে হেঁটে আশেপাশের চেয়ারে অথবা বিছানায় বসে পড়বেন। এরপরেও মাথা ঘুরানো না কমলে এক কাত হয়ে শুয়ে পড়বেন।
- পিঠে হেলান দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় মাথা ঘুরলে দ্রুত এক কাত হয়ে শুয়ে পড়বেন।
- ঢিলেঢালা জামা পরবেন যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাতাস চলাচল করতে পারে।
- খোলামেলা ও বাতাসপূর্ণ ঘরে থাকবেন। প্রয়োজনে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে খোলা জায়গায় হাঁটতেও পারেন। তবে যদি মনে হয় যে আপনি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে পারেন তাহলে হাঁটাহাঁটি করবেন না অথবা বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। তখন আশেপাশের কাউকে জানালা খুলে দিতে বলবেন।
- একটানা অনেকক্ষণ ধরে অথবা অতিরিক্ত পরিমাণে ভারী কোনো কাজ বা শারীরিক পরিশ্রম না করে বরং কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ পা তুলে বসে বিশ্রাম নিবেন। সেই সাথে নিয়মিত বিরতিতে পানি পান করবেন।[৬]
- কোনো ঔষধ খাওয়া শুরু করার পর থেকে মাথা ঘুরানোর সমস্যা শুরু হয়েছে মনে হলে পরবর্তী চেকআপে ডাক্তারকে বিষয়টি জানাবেন।
- গর্ভাবস্থায় চা-কফি এড়িয়ে চলুন। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সেটি ছেড়ে দিন।
যা করবেন না
- বসা ও শোয়া অবস্থা থেকে হঠাৎ করে দ্রুত দাঁড়িয়ে যাবেন না।
- হঠাৎ করে নিচু হয়ে ঝুঁকে কিছু তুলবেন না।
- নিচু হয়ে জুতা পরবেন না। প্রয়োজনে একটি চেয়ার অথবা টুলে বসে জুতা পরবেন।
- আঁটসাঁট জামা পরবেন না।
- বদ্ধ, ভ্যাঁপসা ও গরম জায়গায় বেশিক্ষণ থাকবেন না।
- মাথা ঘুরানো অবস্থায় যেসব কাজ করলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে সেগুলো এড়িয়ে চলবেন। যেমন: মই অথবা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করা, গাড়ি চালানো, সাঁতার কাটা কিংবা ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা।
- পিঠে হেলান দিয়ে সোজা হয়ে বা চিত হয়ে শুয়ে থাকবেন না।
গর্ভকালীন সময়ের শেষের দিকে এবং প্রসববেদনার সময় পিঠে হেলান দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকা ঠিক নয়। গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহ পর ঘুমানোর সময়েও পিঠে হেলান দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকা থেকে বিরত থাকবেন। কেননা এভাবে শুয়ে থাকলে মৃত শিশু জন্মানোর সম্ভাবনা বাড়তে পারে।[৭]
সাধারণত গর্ভাবস্থায় মাথা ঘুরানো একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এরপরেও চেকআপের সময়ে এই বিষয়টি আপনার ডাক্তার অথবা মিডওয়াইফকে জানিয়ে রাখুন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে?
গর্ভকালীন সময়ে মাথা ঘুরানো কমন একটি লক্ষণ। তবে কখনো কখনো কিছু গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন: ব্রেইন স্ট্রোক, কানের ইনফেকশন ও প্রি-একলাম্পসিয়া) এর কারণেও মাথা ঘুরাতে পারে। তাই দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
যেসব লক্ষণ থাকলে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে—
- মুখ, হাত অথবা পা অবশ হয়ে আসলে
- মাথা ঘুরানোর সাথে বমি বমি ভাব থাকলে
- মাথা ঘুরানোর পাশাপাশি কানে শুনতে অসুবিধা হলে
- মাথা ঘুরানোর সাথে কানের ভেতরে ভোঁ ভোঁ কিংবা বাঁশির মতো শব্দ হচ্ছে মনে হলে
- রক্তশূন্যতা থাকলে
- বার বার অথবা লম্বা সময় ধরে মাথা ঘুরানোর সমস্যা হলে
- মাথা ঘুরানোর সমস্যা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হলে
মাথা ঘুরানোর সাথে নিচের ৯টি লক্ষণের কোনোটি থাকলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে নেওয়া জরুরি—
- যোনিপথ দিয়ে রক্তপাত হলে
- তলপেটে ব্যথা হলে
- বুকে ব্যথা হলে
- শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হলে
- বুক ধড়ফড় করলে
- মাথা ঘুরানোর পাশাপাশি চোখে ঝাপসা দেখলে কিংবা দৃষ্টিশক্তিতে পরিবর্তন আসলে
- মাথা ঘুরানোর পাশাপাশি মাথা ব্যথা হলে
- মাথা ঘুরানো প্রকট হলে
- মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে মাথা অথবা পেটে আঘাত পেলে, কিংবা ১ মিনিটের বেশি সময় ধরে অজ্ঞান থাকলে
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা
এ ছাড়া সাধারণ মাথা ঘুরানোর সমস্যা থাকলেও নিয়মিত ডাক্তার দেখানোর সময় আপনার ডাক্তারকে সমস্যার কথাটি জানাবেন।