গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা ও পেট কামড়ানো বেশ পরিচিত সমস্যা। এগুলো সাধারণত দুশ্চিন্তার কারণ নয়। তবে কখনো কখনো পেট ব্যথা কোনো গুরুতর সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হয়। এই আর্টিকেলে সাধারণ ও গুরুতর—উভয় ধরনের পেট ব্যথা ও করণীয় সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে।
গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথার সাধারণ কারণ
পেটে ভোঁতা ধরনের ব্যথা হতে পারে, আবার তীক্ষ্ণ ব্যথাও হতে পারে। আপনার পেট ব্যথা যদি তেমন তীব্র না হয় এবং বিশ্রাম, দেহভঙ্গির পরিবর্তন, পায়খানা অথবা বায়ুত্যাগের সাথে কমে যায়, তাহলে সেই ব্যথা নিয়ে সাধারণত ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই।
গর্ভধারণের ফলে আপনার শরীরে হরমোনজনিত নানান পরিবর্তন হয়। তা ছাড়া গর্ভে বড় হতে থাকা শিশুকে জায়গা করে দিতে আপনার পেটের অংশেও বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। মূলত এসব কারণেই গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা হতে পারে।
পেট ব্যথার সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
ইমপ্ল্যান্টেশন
মায়ের পেটে ভ্রূণ বড় হতে হতে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে রূপ নেয়। গর্ভধারণের পর পর এই ভ্রূণ যখন প্রথমবারের মতো আপনার জরায়ুতে নিজের জায়গা করে নেয়, তখন সেই ঘটনাকে ইমপ্ল্যান্টেশন বলে। এসময়ে তলপেটে কিছুটা ভোঁতা ধরনের মাসিকের ব্যথার মতো ব্যথা থাকতে পারে। যে সময়টায় আপনার মাসিক হওয়ার কথা, সাধারণত তার কাছাকাছি সময়ে দুই-এক দিন ধরে এমন হালকা ব্যথা হয়ে থাকে। তাই মাসিকের সময়ে এমন ব্যথার পরেও মাসিক না হলে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে আপনি গর্ভবতী কি না সেটা জেনে নিন।
ক্র্যাম্পিং বা পেট কামড়ানো
গর্ভে বাড়ন্ত শিশুকে জায়গা দেওয়ার জন্য সময়ের সাথে জরায়ু প্রসারিত হতে থাকে। ফলে জরায়ু পেটের অন্যান্য অঙ্গকে চাপ দেয়। একারণে পেট ব্যথা হতে পারে অথবা পেট কামড়াতে পারে। এ ধরনের ব্যথা সাধারণত তীব্র হয় না, কিছুক্ষণের বিশ্রামেই ঠিক হয়ে যায়। এ ছাড়াও গর্ভের সন্তান বড় হতে থাকলে পরিপাক নালীর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। চাপ বাড়ার কারণে হজমের গতি কমে গিয়ে পেট ফাঁপার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[১] একারণেও পেট ব্যথা হতে পারে।
গ্যাস, পেট ফাঁপা ও কোষ্ঠকাঠিন্য
গর্ভধারণের ফলে আপনার দেহে কিছু বিশেষ হরমোনের পরিমাণ অনেকখানি বেড়ে যায়। এমন একটি হরমোন হলো প্রোজেস্টেরন। এই হরমোনের প্রভাবে খাবার হজমের সাথে জড়িত পেশিগুলো কিছুটা শিথিল হয়ে আসে এবং হজমের গতি কমে যায়।[২] এতে করে আপনার পেটে গ্যাস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে এবং পেট ফাঁপা লাগে। অনেকের ক্ষেত্রে এই হরমোনের প্রভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য ও বায়ুর সমস্যা দেখা দেয়। এসব কারণে পেট ব্যথা ও অস্বস্তি হতে পারে।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় পেট ফাঁপা
লিগামেন্টের ব্যথা
লিগামেন্ট হলো সুতার মতো কিছু টিস্যু। শরীরের বিভিন্ন হাড় ও জয়েন্ট (গিরা) লিগামেন্টের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে।
গর্ভকাল বাড়ার সাথে জরায়ু দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এসময়ে জরায়ুর আশেপাশের থাকা পেশি ও লিগামেন্টগুলো জরায়ুকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে কিছুটা টান খায় ও পুরু হয়ে যায়। এজন্য আপনার পেটে ব্যথা প্রায়ই আসা যাওয়া করতে পারে অথবা পেটে অস্বস্তি হতে পারে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে জরায়ু প্রসারিত হয়ে জরায়ু ও কুঁচকির মাঝামাঝি থাকা ‘রাউন্ড লিগামেন্টে’ টান পড়ে পেট ব্যথা হতে পারে।
উল্লেখ্য, রাউন্ড লিগামেন্টের ব্যথা মূলত গর্ভাবস্থার ১৮ থেকে ২৪ সপ্তাহের মাঝে দেখা যায়। এক্ষেত্রে আপনি নড়াচড়া করার সময়ে সাধারণত পেটের যেকোনো এক পাশে ধারালো ছুরির আঘাতের মতো ব্যথা অনুভব করতে পারেন। তবে ব্যথা সাধারণত কয়েক সেকেন্ড পরে নিজে নিজেই উপশম হয়।
ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন
গর্ভাবস্থায় অনেক গর্ভবতীর মতো আপনিও ‘ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন’ অনুভব করতে পারেন। এতে মূলত পেটে হালকা কামড়ানো অথবা পেটের নির্দিষ্ট কোনো অংশে টান লাগার মতো এক ধরনের অনুভূতি হয়। জরায়ুর অনিয়মিত সংকোচন-প্রসারণের কারণে সাধারণত দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এই ধরনের অনুভূতি হয়ে থাকে। এটি খানিকটা প্রসবের ব্যথার মতো মনে হতে পারে। ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, এটি আপনার গর্ভের শিশুর জন্য নিরাপদ।
অর্গাজম বা যৌন উত্তেজনার সময়ে ব্যথা
সহবাসের সময়ে অর্গাজমের সময় কিংবা তার পরে পেট কামড়ানো অথবা ব্যথা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এসময়ে এ ধরনের ব্যথার সাথে কোমর ব্যথাও হতে পারে। অর্গাজমের সময়ে তলপেটে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায় এবং জরায়ুর সংকোচন হয়। এর ফলে পেটে কামড়ানো অথবা টান লাগার মতো অনুভূতি হতে পারে।
আপনার যদি গর্ভাবস্থার সাথে সম্পর্কিত কোনো ঝুঁকি না থাকে, কিংবা ডাক্তার যদি আপনাকে আগে থেকে সহবাস বা অর্গাজম সম্পর্কে নিষেধ না করে থাকেন, তাহলে সাধারণত সহবাসে বা অর্গাজমের সময়ে এই ধরনের ব্যথা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সহবাস বা অর্গাজম-এর পরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে অথবা একটু ঘুমিয়ে নিলে সাধারণত এই ধরনের ব্যথা চলে যায়। তবে এই ধরনের ব্যথা অথবা পেট কামড়ানো নিয়ে দুশ্চিন্তা হলে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় সহবাস করার নিয়ম
গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথার গুরুতর কারণ
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেট ব্যথা ঝুঁকির কারণ না হলেও কিছু ক্ষেত্রে পেট ব্যথা গুরুতর জটিলতা নির্দেশ করতে পারে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে—
জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ
মায়ের ডিম্বাণু ও বাবার শুক্রাণুর মিলনের ফলে শিশুর ভ্রূণ সৃষ্টি হয়। এই ভ্রূণই বড় হতে হতে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে রূপ নেয়। স্বাভাবিক গর্ভধারণের বেলায় ভ্রূণটি জরায়ুর ভেতরে জায়গা করে নেয়। তবে কখনো কখনো ভ্রূণটি জরায়ুর বাইরে অস্বাভাবিক কোনো স্থানে (যেমন: ডিম্বনালীতে) স্থাপিত হতে পারে। এই ঘটনাকে ডাক্তারি ভাষায় এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলে।[৩]
এই ধরনের গর্ভধারণে শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হয় না এবং জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়৷ যদি ভ্রূণটি বেড়ে উঠতে থাকে, তাহলে ডিম্বনালী অথবা অন্য অঙ্গ ফেটে গর্ভবতীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই দেরি না করে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির সঠিক চিকিৎসা নেওয়া খুবই জরুরি।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণগুলো সাধারণত গর্ভাবস্থার ৪র্থ সপ্তাহ থেকে ১২তম সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায়, যার মধ্যে অন্যতম হলো পেট ব্যথা। সাধারণত তলপেটের নিচের দিকে যেকোনো একপাশে ব্যথা হয়। অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- যোনিপথে রক্তপাত
- কাঁধের আগায় ব্যথা
- প্রস্রাব ও পায়খানা করার সময়ে ব্যথা বা অস্বস্তি
- যোনিপথ দিয়ে বাদামী রঙের পানির মতো তরল বের হওয়া
এসব লক্ষণের মধ্যে যেকোনোটি দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যান।
গর্ভপাত
গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহের আগে গর্ভের শিশুর মৃত্যু হওয়াকে গর্ভপাত বলে।[৪] এই সময়ে পেট ব্যথা অথবা পেট কামড়ানোর সাথে যোনিপথে রক্তপাত হলে সেটি কখনো কখনো গর্ভপাতের লক্ষণ হতে পারে। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে—
- বমি বমি ভাব ও বমি
- যোনিপথ দিয়ে স্রাব জাতীয় তরল বের হওয়া
- যোনিপথ দিয়ে কোষগুচ্ছ বা টিস্যু বের হয়ে আসা
- গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণগুলো (যেমন: বমি বমি ভাব ও স্তনে ব্যথা) আর অনুভূত না হওয়া
- জ্বর
- দুর্বলতা ও অবসাদ
গর্ভপাতের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখান।
প্রি-এক্লাম্পসিয়া
গর্ভাবস্থার শেষের দিকে বাচ্চার বৃদ্ধির ফলে জরায়ু ওপরের দিকে উঠে যেতে পারে। এতে নিচের দিক থেকে পাঁজরে চাপ লেগে পাঁজরের ঠিক নিচে ব্যথা হতে পারে। কিন্তু এ ব্যথা অসহ্যকর কিংবা একটানা হলে, বিশেষ করে ডান পাশের পাঁজরের নিচে এমন ব্যথা হলে, দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। এটি প্রি-এক্লাম্পসিয়ার লক্ষণ হতে পারে।
প্রি-এক্লাম্পসিয়া গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত একটি মারাত্মক জটিলতা, যা সাধারণত গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহের পর থেকে দেখা দিতে পারে। পাঁজরের ঠিক নিচে তীব্র ব্যথা হওয়া ছাড়াও নিচের চারটি লক্ষণের মধ্যে কোনোটি থাকলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে—
- তীব্র মাথা ব্যথা
- চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া। যেমন: দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে হয়ে যাওয়া অথবা চোখে আলোর ঝলকানির মতো কিছু দেখা
- হঠাৎ করেই পা, হাত অথবা মুখ ফুলে যাওয়া
- ওপরের যেকোনো লক্ষণের পাশাপাশি বমি হওয়া
সময়মতো চিকিৎসা শুরু না করলে পরবর্তীতে এক্লাম্পসিয়া হতে পারে, যা থেকে আপনি কোমায় চলে যেতে পারেন। এমনকি আপনার ও গর্ভের শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
অকাল প্রসব
নির্দিষ্ট সময়ের আগে সন্তান জন্মদানকে অকাল প্রসব বলা হয়। গর্ভাবস্থার ৩৭তম সপ্তাহের আগে নিয়মিত বিরতিতে পেট কামড়ানো অথবা পেটে টান খাওয়া অকাল প্রসবের লক্ষণ হতে পারে। এসময়ে কোমরেও ব্যথা হতে পারে। এমন হলে আপনার হাসপাতালে ভর্তি থেকে ডাক্তারি পর্যবেক্ষণে থাকা প্রয়োজন। অকাল প্রসবের অন্যান্য লক্ষণ হতে পারে—
- পানির মতো, আঠালো অথবা রক্তমিশ্রিত স্রাব হওয়া
- স্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
- যোনিপথে যেকোনো পরিমাণে পানি ভাঙা
- তলপেটে চাপ লাগা অথবা মৃদু ব্যথা হওয়া
- একটানা মৃদু ও চাপা ধরনের পিঠ ব্যথা হওয়া
- তলপেটে মৃদু ব্যথার সাথে ডায়রিয়া হওয়া
- গর্ভের শিশুর নড়াচড়া কমে যাওয়া
প্ল্যাসেন্টা বা গর্ভফুল ছিঁড়ে যাওয়া
গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহের পর প্ল্যাসেন্টা বা গর্ভফুল জরায়ুর দেয়াল থেকে হঠাৎ করেই আলাদা হয়ে যেতে পারে। এসময়ে সাধারণত যোনিপথে ভারী রক্তপাতের পাশাপাশি একটানা তীব্র পেট ব্যথা হতে দেখা যায়। পেটে চাপ দিলে পাথরের মতো শক্ত জরায়ু হাতে লাগে। এই ব্যথা সহজে প্রশমিত হয় না।
এটিও এক ধরনের জরুরি অবস্থা, কারণ এসময় প্লাসেন্টা গর্ভের শিশুকে অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে পারে না। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকায় মা ও শিশু উভয়ের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই এমন কোনো লক্ষণ থাকলে দেরি না করে হাসপাতালে যাওয়া খুবই জরুরি।
ইউরিন বা প্রস্রাবের ইনফেকশন
গর্ভাবস্থায় নারীদের প্রস্রাবের ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[৫] প্রস্রাবের ইনফেকশন হলে পেট ব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া প্রস্রাবের সময়ে জ্বালাপোড়া ও ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া ও প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
প্রস্রাবের ইনফেকশনের সঠিক চিকিৎসা না নিলে কিডনির ইনফেকশনসহ বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা হতে পারে। তাই এসময়ে প্রচুর পানি পান করুন এবং দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ইনফেকশন নিশ্চিত হলে ডাক্তার প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক অথবা অন্য কোনো ধরনের ঔষধ সেবন করা বিপদজনক হতে পারে। এজন্য এ অবস্থায় যেকোনো ঔষধ সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
পড়ুন: ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের সংক্রমণ
অন্যান্য কারণ
পেট ব্যথার ওপরের কারণগুলো গর্ভধারণের সাথে সম্পর্কিত। এমন কারণের বাইরে, অর্থাৎ গর্ভাবস্থার সাথে সরাসরি সম্পর্ক নেই এমন কিছু কারণেও পেট ব্যথা হতে পারে। গর্ভাবস্থার যেকোনো সময় এসব রোগের কারণে পেট ব্যথা হলেও জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা নিতে হবে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- অ্যাপেন্ডিসাইটিস: অ্যাপেন্ডিসাইটিসের সময় পেটের ডান পাশে নিচের দিকে ব্যথা হয়। পেট ব্যথার পাশাপাশি ক্ষুধা কমে যাওয়া, বমি ও বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
- কোলিসিস্টাইটিস বা পিত্তথলির প্রদাহ: এ ধরনের ব্যথা পেটের ডান পাশে উপরের দিকে হয়। এটি পেছনে এবং ডান পাশের কাঁধের দিকেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
- কিডনির পাথর: এক্ষেত্রে পেটের যেকোনো একপাশে বেশ তীব্র ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত আসা-যাওয়া করে। ব্যথার পাশাপাশি বমি ভাব অথবা বমি হতে পারে।
- প্যানক্রিয়াটাইটিস: এক্ষেত্রে সাধারণত পেটের মাঝখানে অথবা দুই পাঁজরের মাঝের অংশে ব্যথা হয়, যা সময়ের সাথে তীব্র হতে থাকে। এ ছাড়া বমি, জ্বর, বদহজম, চোখ-ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া ও নাড়ির গতি বেড়ে যাওয়াসহ নানান গুরুতর লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথার পাশাপাশি নিচের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাবেন—
- হঠাৎ করে তীব্র পেট ব্যথা অথবা কামড়ানো দেখা দিলে
- যোনিপথে রক্তপাত হলে
- নিয়মিত বিরতিতে পেট কামড়ানো অথবা পেটে টান পড়ার মতো অনুভূতি হলে
- মাসিকের রাস্তা দিয়ে অস্বাভাবিক স্রাব গেলে
- মাথা ঘুরালে, অজ্ঞান হয়ে গেলে অথবা হঠাৎ করে অনেক ফ্যাকাশে হয়ে গেলে
- প্রি-এক্লাম্পসিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে
- পায়খানার সাথে রক্ত গেলে অথবা তীব্র ডায়রিয়া হলে
- কোমর ব্যথা হলে
- প্রস্রাবের সময়ে ব্যথা অথবা জ্বালাপোড়া হলে কিংবা রক্ত গেলে
- শরীরে কাঁপুনি অথবা জ্বর হলে
- বমি অথবা বমি বমি ভাব হলে
- হঠাৎ করেই পিপাসা বাড়ার পাশাপাশি প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে কিংবা প্রস্রাব একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে
আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়ার পরেও ব্যথা না কমলে এগুলো পেট ব্যথার কোনো গুরুতর কারণের লক্ষণ হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পেলে মা ও গর্ভের শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
পেট ব্যথা না কি প্রসবের ব্যথা
অনেক নারী, বিশেষত যারা প্রথমবারের মতো গর্ভধারণ করছেন তারা ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচনকে প্রসবের ব্যথা ভেবে ভুল করতে পারেন। গর্ভাবস্থার শেষ সপ্তাহগুলোতে এ ধরনের ভুল হয়ে থাকে।
সাধারণত এই দুই ধরনের ব্যথায় নিচের পার্থক্যগুলো দেখা যায়—
ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন | প্রসব ব্যথা |
---|---|
ঠিক ব্যথা না, বরং পেটে টান লাগার মতো অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। | ব্যথা হয়। |
হঠাৎ করেই শুরু হয়। এই ব্যথা সাধারণত অনিয়মিত হয়, কোনো নির্দিষ্ট ছন্দ থাকে না। | নিয়মিত বিরতিতে বারবার ব্যথা হয়। ব্যথা সাধারণত একটা ছন্দ অনুসরণ করে। |
ব্যথার স্থায়িত্ব ও তীব্রতা সাধারণত বাড়ে না। | ধীরে ধীরে ব্যথার স্থায়িত্ব ও তীব্রতা বাড়ে। সময়ের সাথে নিয়মিত বিরতিতে ঘন ঘন ব্যথা হতে থাকে। |
তাই গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে পেট ব্যথা দেখা দিলে যদি এই দুই ধরনের ব্যথার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারেন অথবা প্রসবের ব্যথা হচ্ছে বলে মনে হয় তাহলে জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথার চিকিৎসা
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ পেট ব্যথা নিজে নিজেই সেরে যায়। তাই আলাদা করে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। নিচের ঘরোয়া উপদেশগুলো মেনে চলে পেট ব্যথা অনেকটাই কমানো যেতে পারে—
- ইমপ্ল্যান্টেশন ও রাউন্ড লিগামেন্টের ব্যথাসহ সাধারণ কোনো কারণে পেট ব্যথা হলে শুয়ে থাকুন এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। এটি পেট ব্যথা ও কামড়ানো কমাতে পারে।
- আপনি যদি বুঝতে পারেন যে আপনার ব্র্যাক্সটন হিক্স সংকোচন হচ্ছে, তাহলে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করুন। যেমন, দাঁড়িয়ে থাকলে শুয়ে পড়ুন।
- হাঁচি-কাশি রাউন্ড লিগামেন্ট এর টান বাড়িয়ে দেয়। হাঁচি-কাশির সময়ে কোমর কিছুটা বাঁকিয়ে নিলে ব্যথা উপশম হতে পারে। সেই সাথে শোয়া-বসা থেকে ওঠার সময়ে তাড়াহুড়ো না করে আস্তে ধীরে উঠুন। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় পেটে পরার জন্য কিছু ব্যান্ড বা বেল্ট পাওয়া যায়। এগুলো পড়ে দেখতে পারেন। এতে রাউন্ড লিগামেন্ট এর ব্যথা প্রশমিত হতে পারে।
- খাদ্যাভ্যাসে পানির পরিমাণ বাড়ান। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। কাপ কিংবা গ্লাসের হিসাবে আপনাকে সারাদিনে মোট ৮–১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে। তবে এই বিষয়ে কখনো যদি ডাক্তার কোনো বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাহলে সেটিই অনুসরণ করবেন।
পর্যাপ্ত পানি পান করার মাধ্যমে ডিহাইড্রেশন কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য পেট ব্যথা হলে সেটা কমানো যাবে।
- সারাদিনে অল্প অল্প করে বেশ কয়েকবার খান। আঁশ জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। ভাজা পোড়া খাবার ও কোমল পানীয় (যেমন: কোক, ফান্টা ও পেপসি) এড়িয়ে চলুন।
- গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম খাবার পরিপাকে সাহায্য করতে পারে। কাজেই নিয়মিত হালকা পরিশ্রম অথবা পছন্দের কোনো ব্যায়াম করতে পারেন।
যদি ঘরোয়া উপায়েও ব্যথা না কমে, তাহলে গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা কমাতে নির্দিষ্ট ডোজ অনুযায়ী প্যারাসিটামল খাওয়া যায়। এটি একটি ‘ওভার দা কাউন্টার’ ঔষধ। সাধারণত ফার্মেসি থেকে কিনে এনে এর সাথে থাকা নির্দেশিকা অনুযায়ী সেবন করতে পারবেন। এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
তবে পেট ব্যথার সাথে কোনো বিপদজনক লক্ষণ থাকলে অথবা তীব্র পেট ব্যথা হলে অবশ্যই দেরি না করে ডাক্তার দেখিয়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথার ঔষধ সেবন করবেন না
পেট ব্যথার চিকিৎসায় নন-স্টেরয়ডাল প্রদাহনাশক বা ব্যথার ঔষধ সেবন করবেন না। এই ধরনের ঔষধ হলো আইবুপ্রোফেন ও অ্যাসপিরিন। গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে এ ধরনের ঔষধ সেবনের ফলে গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। এমনকি গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।[৬] অন্যদিকে গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহ বা তারপরে এই ঔষধ সেবন করলে আপনার অনাগত শিশুর কিডনিতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।[৭] এ ছাড়া গর্ভের শিশুর হার্টের সমস্যা হতে পারে।[৮]
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভধারণের শুরু থেকেই আপনার পেট ব্যথা হতে পারে। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে এই সময় থেকে পেট ব্যথা হবে তা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেট ব্যথা তেমন দুশ্চিন্তার কারণ নয়। আবার গর্ভধারণের পরে পেট ব্যথা না হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
গর্ভাবস্থায় হালকা পেট ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, প্রতি পাঁচ জন গর্ভবতীর মধ্যে চারজনেরই গর্ভাবস্থায় কোনো না কোনো সময়ে পেট ব্যথা হয়। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম ২০ সপ্তাহে এটি দেখা যায়। অধিকাংশ পেট ব্যথা গর্ভকাল বাড়ার সাথে সাথে উপশম হয়। তবে মনে রাখতে হবে যে, পেট ব্যথার সাথে অন্যান্য জটিলতার কারণে ২৮ শতাংশ গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত হয়ে থাকে।[৯] তাই তীব্র ও অবিরাম পেট ব্যথার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কোন ধরনের পেট ব্যথায় দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তা জেনে রাখুন।
গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে বমি হওয়া খুব পরিচিত একটি লক্ষণ। এটি সাধারণত গর্ভধারণের ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে অবস্থার উন্নতি হয় কিংবা সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।
এরপরেও বমি ও পেট ব্যথা হলে সেটা বিভিন্ন গুরুতর জটিলতার লক্ষণ হতে পারে। যেমন, এসময়ে অ্যাপেন্ডিসাইটিস হতে পারে। আবার পিত্তথলিতে কোলেস্টেরল জমে পাথরসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। আবার ফুড পয়জনিং হতে পারে। এসব কারণে গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথার সাথে বমি হতে পারে।[১০] এমনটা হলে দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে সঠিক চিকিৎসা নিন।