গর্ভকালীন সময়ে ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টি

সন্তান নেওয়ার চেষ্টা শুরু করার সময় থেকেই নির্দিষ্ট পরিমাণে ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

গর্ভাবস্থায় আপনার প্রতিদিনের খাবার তালিকায় কিছু নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান উপস্থিত আছে কি না সে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এর পাশাপাশি গর্ভকালীন সময়ের অতিরিক্ত পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য আপনাকে কিছু ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদানের ট্যাবলেট বা বড়িও সেবন করতে হবে। যা আপনার ও আপনার গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

ফলিক এসিড

ফলিক এসিডের অপর নাম ভিটামিন বি৯। এই পুষ্টি উপাদানটি মা ও শিশু উভয়ের সুস্বাস্থ্যের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলিক এসিড গর্ভের শিশুর ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ গঠনে সাহায্য করে। এর অভাবে স্নায়ুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ—নিউরাল টিউবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন: স্পাইনা বিফিডা রোগ।[১]

সন্তান নেওয়ার চেষ্টা শুরু করার সময় থেকেই এই পরিমাণে ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেও তিন মাস পর্যন্ত ফলিক এসিড সেবন করা চালিয়ে যেতে হবে।[২] তবে গর্ভধারণের আগে থেকেই ফলিক এসিড না গ্রহণ করে থাকলে, আপনি যে গর্ভবতী তা জানার পর পরই যত দ্রুত সম্ভব ফলিক এসিড সেবন করা শুরু করতে হবে।

আপনি জানেন কি?

একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভধারণের আগে থেকেই আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবন করলে ২ বছর বয়সে শিশু তুলনামূলকভাবে বেশি লম্বা হয় এবং হাতের সূক্ষ্ম কাজে বেশি পারদর্শী হয়। যেমন: পেন্সিল ধরা ও জামার বোতাম লাগাতে চেষ্টা করা।[৩]

ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?

প্রাকৃতিক খাবারে পাওয়া ফলিক এসিডকে ‘ফোলেট’ বলে। প্রতিদিন ০.৪০ মিলিগ্রাম ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবনের পাশাপাশি আপনি প্রতিদিনের খাবার তালিকায় ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার রাখবেন। এমন কিছু খাবার হলো—

  1. বিভিন্ন শাক। যেমন: পালং শাক, পুঁই শাক, পাট শাক, কচু শাক, মেথি শাক, সজনে পাতা, লাল শাক, নটে শাক, সবুজ ডাঁটা শাক, মুলা শাক ও লাউ শাক 
  2. বিভিন্ন সবজি। যেমন: বরবটি, মটরশুঁটি, ঢেঁড়স, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ব্রকলি
  3. ছোলার ডাল, মাসকলাই ডাল ও মুগ ডাল
  4. বিভিন্ন ফল। যেমন: কমলা
  5. চিনাবাদাম

পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়ার নিয়ম

আয়রন

আয়রন গর্ভাবস্থায় আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে।[৪][৫] সেই সাথে আপনার গর্ভের শিশুর গঠন ও বিকাশে সাহায্য করে। এ ছাড়াও এটি সঠিক সময়ের পূর্বেই শিশু জন্মদান এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শিশু জন্মদানের মতো জটিলতার সম্ভাবনা কমায়।[৬]

গর্ভাবস্থার শুরু থেকে প্রসব পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম করে আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে হবে।[৭] বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী মহিলাদের এই পরিমাণে আয়রনযুক্ত ট্যাবলেট বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। এসব ট্যাবলেটে আয়রনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ফলিক এসিড যোগ করা থাকে।

উল্লেখ্য, তীব্র রক্তশূন্যতার মতো কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে তুলনামূলকভাবে উচ্চ ডোজে  আয়রন সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।

প্রচলিত ভুল ধারণা: গর্ভধারণের প্রথমদিকে আয়রন সেবন করা যাবে না।

বিজ্ঞান যা বলে: এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে গর্ভধারণের প্রথম দুই–তিন মাসে আয়রন সেবন করা উচিত নয়। তবে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং গর্ভবতী মা ও গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য গর্ভধারণের শুরু থেকেই আয়রন সেবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গর্ভধারণের পরে যত দ্রুত সম্ভব দৈনিক আয়রন ও ফলিক এসিড খাওয়া শুরু করার পরামর্শ দেয়।[৮] পুরো গর্ভকাল জুড়ে এবং সন্তান জন্মদানের পর তিন মাস পর্যন্ত এটি সেবন করা চালিয়ে যেতে হবে।

আয়রনসমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?

আয়রন ট্যাবলেট সেবনের পাশাপাশি আপনাকে নিয়মিত আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কিছু আয়রন সমৃদ্ধ খাবার হলো—

  • রেড মিট। যেমন: গরু ও খাসির মাংস
  • বিভিন্ন মাছ। যেমন: চাপিলা, ট্যাংরা, কাচকি, মলা, টাটকিনি, শিং, ফেসা ও চেলা
  • ডিম
  • দুধ ও পনির
  • বিভিন্ন ধরনের ডাল। যেমন: মটর, ছোলা, মাসকলাই, মুগ ও মসুর
  • চিনাবাদাম ও পেস্তাবাদাম
  • শাক। যেমন: পাট শাক, লাল শাক, সবুজ শাক, সবুজ ডাটা শাক, নটে শাক, সবুজ কচু শাক, চুকাই শাক, বরবটি পাতা, মালঞ্চ শাক, বকফুল শাক, মূলা শাক, লাউ শাক, পালং শাক ও পুঁই শাক
  • সবজি। যেমন: আলু, ব্রকলি, মটরশুঁটি ও মাশরুম
  • শুকনো ফল। যেমন: খেজুর, নারিকেল (শুকনা) ও আখরোট
  • বিভিন্ন শস্যদানা। যেমন: বাজরা, যব, কাউন, ভুট্টা, চিড়া, গম ও লাল চাল
  • বিভিন্ন বীজ। যেমন: তিল, সরিষা, তিসি, সয়াবিন, মিষ্টিকুমড়া বীজ, সূর্যমুখী বীজ, পদ্ম (শুকনা) ও চিলগোজা

মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র এসব খাবার দিয়ে গর্ভাবস্থায় আপনার ও গর্ভের শিশুর আয়রনের বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই আয়রন সমৃদ্ধ একটি সুষম খাবার তালিকা মেনে চলার পাশাপাশি নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড সেবন করা জরুরি।

বিশেষ দ্রষ্টব্য

কারও কারও আয়রন ট্যাবলেট খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। এমন হলে খাবার তালিকায় পানি ও ফাইবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এতেও কাজ না হলে কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসা নিতে হবে। কিন্তু আয়রন তথা আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবন বন্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

ক্যালসিয়াম

ক্যালসিয়াম আপনার প্রি-এক্লাম্পসিয়া নামক গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপজনিত মারাত্মক জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে।[৯] সেই সাথে গর্ভের শিশুর হাড় গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম একটি অত্যাবশ্যক উপাদান৷ ক্যালসিয়ামের অভাবে আপনার ও গর্ভের শিশুর হাড় ভঙ্গুর হতে পারে এবং শারীরিক গঠনে নানান জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।[১০]

ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সেবনের নিয়ম কী?

গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের পর থেকে প্রতিদিন ২ বেলা করে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সেবন করবেন। ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ভরাপেটে খাওয়া ভালো।

ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কোথায় পাবেন?

  • বাংলাদেশের সব সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়। তাই গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে আপনি সহজেই ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সংগ্রহ করতে পারেন।
  • ফার্মেসি থেকে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কিনে খেতে পারেন। তবে কেনার আগে ডাক্তারের কাছ থেকে গর্ভাবস্থার জন্য সঠিক ডোজটা জেনে নিবেন। সেই অনুযায়ী ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কিনবেন।

আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেটের সাথে একই সময়ে অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাবেন না। এতে আয়রনের কার্যকারিতা কমে যায়। অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ার অন্তত ১ ঘণ্টা আগে অথবা ২ ঘণ্টা পরে আয়রন ট্যাবলেট খাবেন।

ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?

ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের পাশাপাশি আপনি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিছু ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার হলো—

  • দুধ ও দুধের তৈরি খাবার। যেমন: টক দই ও পনির
  • বিভিন্ন মাছ। যেমন: টাকি, রুই, কাতলা, শোল, শিং, টাটকিনি, পারশে, পুঁটি, চান্দা, কই, কাচকি, মলা, চেলা, মৃগেল, মেনি, চাপিলা, খলিশা, বাচা, ফলি, বাটা, ট্যাংরা, ভেটকি, রূপচাঁদা ও চিংড়ি। উল্লেখ্য, কাঁটাসহ ছোটো মাছ খেলে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়
  • বিভিন্ন ডাল। যেমন: ছোলা ও মাসকলাই
  • সয়াবিন ও টফু
  • বিভিন্ন শস্যদানা। যেমন: যব, কাউন, চিঁড়া ও গম
  • বিভিন্ন শাক। যেমন: লাল শাক, পুঁই শাক, নটে শাক, বকফুল শাক, মালঞ্চ শাক, সবুজ ডাটা শাক, লাউ শাক, কচু শাক, সজনে পাতা ও মেথি শাক
  • বিভিন্ন বীজ। যেমন: তিল, তিসি ও সরিষা

তবে শুধুমাত্র এসব খাবার দিয়েই গর্ভকালীন সময়ে ক্যালসিয়ামের বাড়তি চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় আলাদা করে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। তা ছাড়া গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি মাল্টিভিটামিন সেবন করলে সেটায় সঠিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম আছে কি না তা লক্ষ করতে হবে। প্রয়োজনে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।

ভিটামিন ডি

ভিটামিন ডি আমাদের শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে এটি আমাদের শরীরের পেশি, হাড় ও দাঁতের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

আমাদের ত্বক সূর্যের আলোতে থাকা অতিবেগুনী রশ্মি ব্যবহার করে ভিটামিন ডি তৈরি করে। কিন্তু জামাকাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা থাকার কারণে অনেকসময় শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি তৈরি হয় না। এমন ক্ষেত্রে খাবার ও প্রয়োজনে আলাদাভাবে ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবন করে শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি এর যোগান দিতে হয়।

আপনার দেহে ভিটামিন ডি এর অভাব থাকলে আপনার গর্ভের শিশুর ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। এতে জন্মের পরে শিশুর দেহে ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ভিটামিন ডি সেবনের নিয়ম কী?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত ভিটামিন ডি ট্যাবলেট খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে ভিটামিন ডি-এর অভাবজনিত সমস্যায় ভুগলে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে প্রতিদিন ৫ মাইক্রোগ্রাম বা ২০০ ইউআই পরিমাণ ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন।[১৩] তবে গর্ভকালীন সময়ে আপনাকে অবশ্যই প্রাকৃতিক উপায়ে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে।

ভিটামিন ডি-এর প্রাকৃতিক উৎস কী?

১. সূর্যের আলো

প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি পাওয়ার প্রধান উৎস হলো সূর্যের আলো। সূর্যের আলো আমাদের ত্বকে ভিটামিন ডি তৈরি উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করে।

ঠিক কতটুকু সময় রোদে থাকলে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি পাওয়া যায় সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য এখনও জানা যায়নি। আমাদের ত্বকের রং, রোদের তীব্রতা, দিনের বিভিন্ন সময় ও শীত-বর্ষা-গ্রীষ্মকালসহ আরও অন্যান্য বিষয়ের ওপর সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি তৈরি হওয়ার হার নির্ভর করে।

তবে বেশিক্ষণ কড়া রোদে থাকলে ত্বক লাল হয়ে যাওয়া কিংবা পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই রোদে যাওয়ার আগে ত্বকে অন্তত এসপিএফ ১৫ শক্তিমাত্রার সানস্ক্রিন লাগিয়ে নিবেন।

২. বিভিন্ন ধরনের খাবার

সূর্যের আলো ছাড়াও কিছু খাবারে কিছু পরিমাণ ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ কিছু খাবার হলো—

  • ডিম
  • বিভিন্ন ধরনের মাংস
  • বিভিন্ন মাছ। যেমন: কাতলা, মৃগেল, রুই ও তেলাপিয়া
  • ফর্টিফাইড ভোজ্য তেল। বাংলাদেশ সরকার ভোজ্য তেলে ভিটামিন ডি ও ভিটামিন এ মেশানোর মাধ্যমে এসব ভিটামিনের অভাব প্রতিরোধে কাজ করছে

উল্লেখ্য, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তাই আপনার গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত কিছুক্ষণ রোদ পোহানো উচিত। এতে শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি এর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।

আপনি সবসময় পুরো শরীর কাপড়ে ঢেকে সূর্যের আলোতে গেলে কিংবা দীর্ঘদিন ধরে বাসা থেকে বের না হলে আপনার ত্বকে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারবে না এবং ভিটামিন ডি-ও তৈরি হতে পারবে না। ফলে আপনার ভিটামিন ডি এর অভাবজনিত সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে নিয়মিত ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন।

ভিটামিন এ

গর্ভের শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ (যেমন: হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্র) গঠনে এবং চোখের সুস্থতা রক্ষায় ভিটামিন এ সাহায্য করে।[১৪] গর্ভকালীন সময়ে মায়ের ভিটামিন এ-এর অভাব হলে গর্ভের শিশুর নানান ধরনের জটিলতা দেখা যায়। যেমন: দৃষ্টিশক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়া।[১৫] এ ছাড়াও গর্ভবতী নারীর সুস্থতা বজায় রাখতেও ভিটামিন এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গর্ভকালীন সময়ে সাধারণত আলাদা করে ভিটামিন এ ট্যাবলেট সেবনের প্রয়োজন নেই। খাবার থেকেই এই সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভিটামিন এ পাওয়া যায়।

অনেকেই গর্ভধারণের আগে থেকে কোনো বিশেষ প্রয়োজনে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবন করে থাকতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী আপনার ভিটামিন ট্যাবলেটে ভিটামিন এ-এর দৈনিক মাত্রা সর্বোচ্চ ১০০০০ IU এর মধ্যে সীমিত থাকে।[১৬] কেননা অতিরিক্ত ভিটামিন এ গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর।[১৭]

ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?

গর্ভকালীন সময়ে ভিটামিন এ-এর চাহিদা পূরণের জন্য আপনি যেসব খাবার খেতে পারেন সেগুলো হলো—

  • দুধ ও দুধের তৈরি খাবার। যেমন: দই ও পনির
  • লাল, হলুদ ও সবুজ শাকসবজি। যেমন: গাজর, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, লাল শাক, কচু শাক ও পালং শাক
  • রঙিন ফলমূল। যেমন: আম, পাকা পেঁপে, তাল, ডেউয়া ও বাঙ্গি
  • ডিম
  • তৈলাক্ত মাছ

উল্লেখ্য, কলিজা ও মাছের তেল ভিটামিন এ-এর খুবই ভালো উৎস। কিন্তু এগুলোতে অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে, যা সাধারণ অবস্থায় খাওয়া গেলেও গর্ভাবস্থায় শিশুর ক্ষতি করতে পারে।[১৮] গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ভিটামিন এ সেবনে গর্ভের শিশুর চোখ, মাথার খুলি, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের মতো অঙ্গে জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।[১৯][২০]

পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ভিটামিন এ কতটুকু খাবেন?

ভিটামিন সি

ভিটামিন সি আমাদের শরীরের ত্বক, হাড় ও রক্তনালীকে সুস্থ রাখে। পাশাপাশি শরীরের যেকোনো ধরনের আঘাত ও ক্ষতস্থানের ঘা শুকাতে সাহায্য করে৷

ভিটামিন সি সেবনের নিয়ম কী?

গর্ভাবস্থায় ভিটামিন সি এর দৈনিক চাহিদা পূরণের জন্য সাধারণত ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেলেই হয়। এজন্য আলাদাভাবে ট্যাবলেট খাওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না। উল্লেখ্য, গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটে ৭০ মিলিগ্রাম করে ভিটামিন সি যোগ করা থাকে।[২১] আপনি চাইলে নিয়মিত এভাবে ভিটামিন সি খেতে পারেন।

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারগুলো কী?

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ কিছু খাবার হলো—

  • বিভিন্ন ফল। বিশেষত টক ফল। যেমন: আমলকী, আমড়া, জাম, জলপাই, লেবু, জাম্বুরা, পেয়ারা, কমলা ও মাল্টা
  • কাঁচা মরিচ ও ধনে পাতা
  • লাল ও সবুজ ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, কাঁকরোল ও আলু

গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

গর্ভাবস্থায় শিশুর শারীরিক বিকাশের জন্য নির্দিষ্ট কিছু পুষ্টি উপাদান বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। এসব পুষ্টি উপাদান গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা এবং নানান ধরনের সমস্যা প্রতিরোধ করার মাধ্যমে আপনাকে ও গর্ভের শিশুকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।[২২]

গর্ভাবস্থায় শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে গর্ভের শিশুর বিকলাঙ্গতা, আকারে ছোটো হওয়া, সময়ের আগে জন্ম নেওয়া ও জন্মের সময়ে ওজন কম হওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

এতে শিশু জন্মের পর বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যেতে পারে। অন্যদিকে অপুষ্টিতে ভুগলে মা ও গর্ভের শিশুর বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি—এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও অনেকখানি বেড়ে যেতে পারে।[২৩]

গর্ভাবস্থায় শুধু সুষম খাবার খেলেই কি পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়?

গর্ভাবস্থায় কিছু পুষ্টি উপাদানের চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এসময়ে সঠিক পরিমাণে পুষ্টি নিশ্চিত করতে একটি স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা মেনে চলা প্রয়োজন। তবে শুধুমাত্র খাবার দিয়েই কিছু পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পুরোপুরি মেটানো খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। যেমন: ফলিক এসিড ও আয়রন। এই ধরনের পুষ্টি উপাদানগুলো আপনার ও গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাই নিয়মিত সুষম খাবার খাওয়ার পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু ভিটামিন ও মিনারেলযুক্ত ট্যাবলেট আলাদা করে সেবন করতে হয়। এসব ট্যাবলেট সেবন করার মাধ্যমে আপনি পুষ্টি উপাদানের বাড়তি চাহিদা মেটাতে পারবেন।

তবে এই ধরনের ট্যাবলেট কখনোই পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নয়। বরং যেসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র খাবার থেকে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি উপাদান পাওয়া খুব কঠিন, সেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব প্রতিরোধে নির্দিষ্ট ভিটামিন ও মিনারেলযুক্ত ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

গর্ভাবস্থায় মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবন

অনেকে গর্ভধারণের আগে থেকে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবন করে থাকেন। এমন ক্ষেত্রে গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার পর থেকে সাধারণ মাল্টিভিটামিনের পরিবর্তে গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ভিটামিন সাপ্লিমেন্টগুলো বেছে নিন। কেননা গর্ভাবস্থায় যেসব ভিটামিন ও মিনারেলযুক্ত ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়, সেসবের তুলনায় সাধারণ মাল্টিভিটামিন ও মাল্টিমিনারেল ট্যাবলেটে পুষ্টি উপাদানের সমন্বয় কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।

সাধারণ মাল্টিভিটামিনে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ সাধারণত গর্ভকালীন চাহিদার তুলনায় কম-বেশি থাকে। এতে ফলিক এসিডের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অন্যদিকে এসব মাল্টিভিটামিনে ভিটামিন এ এর মতো কিছু পুষ্টি উপাদান গর্ভকালীন প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণে থাকতে পারে। এসব অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করার ফলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হতে পারে।[২৪][২৫] তাই আপনাকে সঠিক পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেলযুক্ত ট্যাবলেট বেছে নিতে হবে।

এই বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার আপনাকে গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত ভিটামিন ও মিনারেল ট্যাবলেট বাছাই করতে সাহায্য করবেন। এ ছাড়া আপনি যদি আলাদাভাবে কোনো পুষ্টি উপাদানযুক্ত ট্যাবলেট (যেমন: আয়রন-ফলিক এসিড কিংবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট) সেবন করতে থাকেন, তাহলে বাকি পুষ্টি উপাদানগুলোর চাহিদা কীভাবে মেটালে সবচেয়ে ভালো হয়—এই বিষয়েও তিনি সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। একারণে নিজে নিজে ভিটামিন ট্যাবলেট সেবন না করে একজন ডাক্তারের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে নিবেন।

সাধারণ জিজ্ঞাসা

আমি ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষাশী। কীভাবে পুষ্টির চাহিদা নিশ্চিত করবো?

আপনি ভেজিটেরিয়ান হয়ে থাকলে গর্ভকালীন সময়ে অবশ্যই ডাক্তারকে এই ব্যাপারে জানাবেন। ডাক্তার আপনার জন্য বিকল্প খাবারগুলো সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারেন। প্রয়োজনে রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের কাছে রেফার করতে পারেন। তাদের সাথে পরামর্শ করে আপনি নিজের জন্য প্রয়োজনীয় একটি খাবার তালিকা তৈরি করে নিবেন।

অনেক ক্ষেত্রেই ভেজিটেরিয়ানদের আয়রন ও ভিটামিন বি১২ এর অভাব দেখা দিতে পারে।[২৬] গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় অর্ধেকের বেশি নিরামিষাশী গর্ভবতীর ভিটামিন বি১২ এর অভাব দেখা দেয়।[২৭] এর ফলে রক্তশূন্যতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ও নার্ভের সমস্যাসহ নানান গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই আগে থেকেই এই বিষয়ে সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান নিশ্চিত করতে হবে।

ভুল করে অতিরিক্ত ভিটামিন বি ঔষধ খেলে কী সমস্যা হবে?

ভুল করে সামান্য পরিমাণে অতিরিক্ত ভিটামিন বি ঔষধ খেলে সাধারণত তেমন সমস্যা হয় না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে।

যেমন: অতিরিক্ত ভিটামিন বি৩ খেলে ত্বক লালচে হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে অতিরিক্ত ভিটামিন বি৩ খেলে লিভারের সমস্যা হতে পারে। অন্যদিকে অতিরিক্ত ভিটামিন বি৬ খেলে ‘পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি’ নামক রোগ হতে পারে। এই রোগে হাত-পায়ের বোধশক্তি হারিয়ে যেতে পারে। এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কিংবা দুশ্চিন্তা হতে থাকলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

ক্যালসিয়াম ঔষধ কয় বেলা পর্যন্ত খাওয়া যাবে?

গর্ভকালীন সময়ে দৈনিক ১.৫ গ্রাম থেকে ২ গ্রাম ক্যালসিয়াম খাওয়া যায়। এই পরিমাণ ক্যালসিয়াম দিনে তিনবেলায় ভাগ করে, অর্থাৎ প্রতিবেলায় ৫০০ মিলিগ্রাম বা ০.৫ গ্রাম ট্যাবলেট হিসেবে খাওয়া যায়।