গর্ভের শিশুর সঠিক বিকাশ ও সুস্থ প্রসবের জন্য গর্ভবতীর আয়রনের চাহিদা মেটানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় শরীরে আয়রনের চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়। এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে গর্ভাবস্থায় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট সেবন করা জরুরি।
এই আর্টিকেলে গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা, নিয়ম এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের তালিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট এর উপকারিতা
গর্ভকালীন সময়ে আপনার শরীরে আয়রনের চাহিদা অনেকখানি বেড়ে যায়।[১] এই চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করতে না পারলে তা আপনার ও গর্ভের শিশুর দেহে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে—
- গর্ভবতী মায়ের আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা হতে পারে। আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা হলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়—
- ক্লান্ত অনুভব করা
- শরীরের শক্তি কমে যাওয়া অথবা দুর্বল লাগা
- শ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা
- বুক ধড়ফড় করা
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা থেকে ‘পিকা’ নামের একটি সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যা হলে খুবই অদ্ভুত জিনিস, অর্থাৎ খাবার নয় এমন কিছু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হয়।[২] যেমন: মাটি, কাগজ কিংবা দেয়ালের রঙ। এমন বোধ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
- এ ছাড়াও গর্ভকালীন আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা মা ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
- পর্যাপ্ত আয়রনের অভাবে গর্ভের শিশুর গঠন ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ফলে আপনার শিশু জন্মের সময়ে এবং জন্মের পরেও বেশ কিছু সমস্যায় ভুগতে পারে। যেমন—
- নির্দিষ্ট সময়ের আগেই, অর্থাৎ প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্ম নেওয়া
- জন্মের সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজন হওয়া
- শিশুর স্বাভাবিক ব্যবহারগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণগত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া
- শিশুর শরীরে আয়রনের মাত্রা প্রয়োজনের চেয়ে কম হওয়া
গর্ভাবস্থায় আয়রনযুক্ত খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মমতো আয়রন ট্যাবলেট সেবন করলে তা মা ও গর্ভের শিশুকে বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।[৩][৪]
গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার নিয়ম
কতটুকু খাবেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা মতে, গর্ভাবস্থায় আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম করে আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে হবে।[৫][৬]
বাংলাদেশে গর্ভকালীন সময়ের জন্য আয়রন ও ফলিক এসিড একত্রে ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেট হিসেবে ফার্মেসিতে কিনতে পাওয়া যায়। এতে গর্ভাবস্থার জন্য সঠিক পরিমাণে আয়রন যোগ করা থাকে। সেই সাথে ফলিক এসিড থাকে, যা শিশুর ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে এবং নানান জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ করে।
উল্লেখ্য, আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার মতো কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে ৬০ মিলিগ্রামের বেশি ডোজে আয়রন সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
কীভাবে খাবেন?
যা করবেন
- আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খালি পেটে খেলে সবচেয়ে ভালো কাজ করে। তাই যেকোনো খাবার খাওয়ার ১ ঘণ্টা আগে অথবা ২ ঘণ্টা পরে ১ গ্লাস পানি দিয়ে এই ট্যাবলেট খাবেন।
পানির পরিবর্তে ১ গ্লাস কমলার রস অথবা লেবুর সরবত দিয়েও ট্যাবলেট খেতে পারেন। ধারণা করা হয়, কমলার রসে থাকা ভিটামিন সি শরীরকে আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
- খালি পেটে ‘আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট’ খেলে কারও কারও পেটে অস্বস্তি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডাক্তার হয়তো আপনাকে খাবারের সাথে অথবা খাওয়ার ঠিক পর পরই ভরা পেটে ট্যাবলেটটি খেয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
যা করবেন না
- আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেটের সাথে একই সময়ে অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাবেন না। এতে আয়রনের কার্যকারিতা কমে যায়। অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ার অন্তত ১ ঘণ্টা আগে অথবা ২ ঘণ্টা পরে আয়রন ট্যাবলেট খাবেন।
- এ ছাড়াও কিছু কিছু খাবার শরীরে আয়রন শোষণের হার কমিয়ে ফেলতে পারে। আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার সময়ে এসব খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এমন কিছু খাবার হলো—
- চা ও কফি
- ডিম
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
- সয়াবিনযুক্ত খাবার
কখন থেকে খাবেন?
গর্ভাবস্থার শুরু থেকে প্রসব পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রাম আয়রনযুক্ত ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। সন্তান জন্মদানের তিন মাস পর পর্যন্ত আয়রন সেবন চালিয়ে যেতে হবে।[৭]
প্রচলিত ভুল ধারণা: গর্ভধারণের প্রথমদিকে আয়রন সেবন করা যাবে না।
বিজ্ঞান যা বলে: এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে, গর্ভধারণের প্রথম দুই–তিন মাসে আয়রন সেবন করা উচিত নয়। তবে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং গর্ভবতী মা ও গর্ভের শিশুর জন্য গর্ভধারণের শুরু থেকেই আয়রন সেবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গর্ভধারণের পরে যত দ্রুত সম্ভব দৈনিক আয়রন ও ফলিক এসিড খাওয়া শুরু করার পরামর্শ দেয়।[৮] পুরো গর্ভকাল জুড়ে এবং সন্তান জন্মদানের পর তিন মাস পর্যন্ত এটি চালিয়ে যেতে হবে। আয়রন গর্ভবতী মায়ের রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।[৯][১০] এ ছাড়াও এটি সঠিক সময়ের পূর্বেই শিশু জন্মদান এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শিশু জন্মদানের মতো জটিলতার সম্ভাবনা কমায়।[১১] একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভধারণের আগে থেকেই ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেট সেবন করলে ২ বছর বয়সে শিশু তুলনামূলক বেশি লম্বা হয় এবং হাতের সূক্ষ্ম কাজে বেশি পারদর্শী হয়।[১২] যেমন: জুতার ফিতা বাঁধা ও পেন্সিল দিয়ে আঁকাআঁকি।
আয়রন ট্যাবলেট কোথায় পাবেন?
গর্ভকালীন সময়ে আপনি নিকটস্থ কোনো সরকারি হাসপাতাল অথবা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেট সংগ্রহ করতে পারেন। এই একটি ট্যাবলেটের মাধ্যমেই আপনার গর্ভকালীন সময়ের আয়রন ও ফলিক এসিড উভয়ের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
সরকারি হাসপাতালে অথবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেট না পেলে আপনাকে ফার্মেসি থেকে এই ঔষধ সংগ্রহ করতে হবে। এক্ষেত্রে দুইটি অপশন রয়েছে—
এক. ফার্মেসিতে বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামে শুধু আয়রন ট্যাবলেট অথবা সিরাপ পাওয়া যায়। তবে গর্ভকালীন সময়ে এসবের পরিবর্তে সাধারণত ফলিক এসিড ও আয়রনসহ ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এসব ঔষধ যে নামে পাবেন—
ব্র্যান্ড নাম | কোম্পানি |
---|---|
ফেরো প্লাস | এমিকো ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড |
জেনিফল প্লাস | জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
ফিওফল সিআই | এস কে এফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
ফিওফল | এস কে এফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
ফেরিগান | মেডিমেট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
ফেরোসন টিআর | হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
ফেরোস্প্যান | ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড |
ফেরোসিট টিআর | একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড |
দুই. অনেকসময় আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেটে জিংক যোগ করা থাকতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় জিংক খেলে বাচ্চার ওজনে ভালো প্রভাব পড়তে পারে।[১৩] তাই আপনি ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেটের পরিবর্তে জিংকযুক্ত এসব ট্যাবলেট অথবা ক্যাপসুলও কিনে খেতে পারেন। এমন কয়েকটি নাম হচ্ছে—
ব্র্যান্ড নাম | কোম্পানি |
---|---|
জিফ সিআই | স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
ফেরিক্স ভি | রেনেটা লিমিটেড |
প্রিনিড সিআই | ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
প্রিন্যাট সিআই | হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
কারোফল জেড | বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড |
জিফোক্যাপ | নুভিস্তা ফার্মা লিমিটেড |
আইপেক-প্লাস | অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেড |
গর্ভকালীন সময়ে সেবন করা যায় এমন কিছু মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটেও আয়রন থাকে। তবে আপনি মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবন করলে, তাতে আয়রনের পরিমাণ কতটুকু তা খেয়াল রাখবেন। কেননা প্রয়োজনের চেয়ে কম আয়রন সেবন করলে আয়রনের অভাবজনিত সমস্যাগুলো হওয়ার ঝুঁকি থেকে যেতে পারে।
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ক্ষেত্রে নিচের চারটি বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি—
- আপনি আগে থেকেই শুধুমাত্র আয়রন অথবা কোনো মাল্টিভিটামিন সেবন করে থাকলে, তা ডাক্তারকে জানাবেন৷ ডাক্তারের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ছাড়া কয়েক ধরনের মাল্টিভিটামিন, আয়রন ও ফলিক এসিড একত্রে সেবন করা থেকে বিরত থাকবেন।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন সময়ে যেসব মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়, সেসবে আয়রন যোগ করা থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় ডাক্তার আপনাকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে আয়রন-ফলিক এসিড সমৃদ্ধ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকলে আলাদা করে আয়রন ট্যাবলেট সেবনের প্রয়োজন নেই।
- গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিমাণে আয়রন ও ফলিক এসিড একত্রে ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেট হিসেবে পাওয়া যায়। এই ট্যাবলেট গর্ভাবস্থায় একই সাথে আয়রন ও ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণ করে। তাই এটি সেবন করলে, কোনো বিশেষ প্রয়োজন (যেমন: আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা) ছাড়া আলাদা করে শুধু আয়রন ট্যাবলেট অথবা সিরাপ সেবনের প্রয়োজন নেই।
- নিয়মিত ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেট সেবনের পরেও আপনার রক্তশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা করাবেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করবেন।
- গর্ভাবস্থায় আপনি অন্য যেকোনো ঔষধ সেবন করলে ডাক্তারকে সেই ঔষধের নাম ও ডোজটি জানান। অনেকসময় আয়রনের সাথে অন্যান্য ঔষধের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডোজ কমানো কিংবা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
আয়রন ট্যাবলেট এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ফলে কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে হতে পারে। যেমন—
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- পাতলা পায়খানা
- পেট ব্যথা
- অ্যাসিডিটি, বুক জ্বালাপোড়া করা বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা
- বমি বমি ভাব ও বমি
- কালচে পায়খানা
- ড্রপের ক্ষেত্রে দাঁত কালচে হয়ে যাওয়া
যদিও খালি পেটে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া ভালো, তবুও পেট ব্যথা কিংবা পাতলা পায়খানার সমস্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য খাবারের সাথে অথবা খাওয়ার ঠিক পর পরই আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন। সেই সাথে পর্যাপ্ত পানি ও ফাইবারযুক্ত খাবার খাবেন। এতে করে আয়রন ট্যাবলেটজনিত কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও কিছুটা কমতে পারে।
তবে আপনার এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ খাওয়া বন্ধ করবেন না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও এই ঔষধ সেবন চালিয়ে যাওয়া খুব জরুরি। আপনার যদি খুব বেশি সমস্যা বা অস্বস্তি হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। ডাক্তার আপনাকে অন্য ব্র্যান্ডের ঔষধ কিংবা ট্যাবলেটের বদলে ইনজেকশন হিসেবে আয়রন গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারে। তবে নিজে নিজে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বদল করে ফেলবেন না। এ ছাড়াও যদি আপনার অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন দেখা দেয় তাহলে ঔষধ সেবন বন্ধ করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
আয়রনযুক্ত ঔষধ শিশুদের হাতের নাগালের বাইরে রাখুন। অতিরিক্ত পরিমাণে আয়রন সেবনে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের পাশাপাশি আপনাকে নিয়মিত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র এসব খাবার দিয়ে সাধারণত গর্ভাবস্থায় আয়রনের বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। কিছু আয়রন সমৃদ্ধ খাবার হলো—
- মাংস, বিশেষত গরু ও খাসির মাংসের মতো ‘রেড মিট’
- বিভিন্ন ডাল। যেমন: ছোলা, মাসকলাই, মুগ ও মসুর
- চিনাবাদাম, কাজুবাদাম ও পেস্তাবাদাম
- মটর ও মটরশুঁটি
- শুকনো ফল। যেমন: খেজুর, নারিকেল (শুকনা) ও আখরোট
- বিভিন্ন মাছ। যেমন: চাপিলা, ট্যাংরা, কাচকি, মলা, টাটকিনি, শিং, ফেসা ও চেলা
- ডিম
- দুধ ও পনির
- বিভিন্ন শাক। যেমন: পাট শাক, লাল শাক, সবুজ শাক, সবুজ ডাটা শাক, নটে শাক, সবুজ কচু শাক, চুকাই শাক, বরবটি পাতা, মালঞ্চ শাক, বকফুল শাক, মূলা শাক, লাউ শাক, পালং শাক ও পুঁই শাক
- বিভিন্ন সবজি। যেমন: আলু, ব্রকলি ও মাশরুম
- বিভিন্ন শস্যদানা। যেমন: যব, কাউন, ভুট্টা, চিড়া, গম, চালের কুড়া ও ঢেঁকিছাঁটা চাল
- বিভিন্ন বীজ। যেমন: সয়াবিন, তিল, সরিষা, তিসি, মিষ্টিকুমড়া বীজ, সূর্যমুখী বীজ, পদ্ম (শুকনা) ও চিলগোজা
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভাবস্থার একদম শুরু থেকে প্রসব পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত আপনাকে দৈনিক ৩০–৬০ মিলিগ্রাম করে আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। সম্ভব হলে গর্ভধারণের আগে থেকেই এটি সেবন করা উচিত। সন্তান জন্ম দেওয়ার তিন মাস পর পর্যন্ত আয়রন ট্যাবলেট সেবন চালিয়ে যাবেন।[১৪]
গর্ভকালীন সময়ে আপনার শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলে তা শুধুমাত্র আয়রন সমৃদ্ধ খাবার দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে আয়রন ট্যাবলেট সেবনের অথবা ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
এ ছাড়া গর্ভাবস্থার শুরু থেকে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পাশাপাশি গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট সেবন করা প্রয়োজন।[১৫]
গর্ভাবস্থায় আপনার আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। রক্তশূন্যতার সমস্যা গুরুতর অবস্থায় পৌঁছালে ডাক্তার আপনাকে আয়রন ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
এ ছাড়াও গর্ভাবস্থার শেষের দিকে অর্থাৎ তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আপনার শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলে সেটি ট্যাবলেটের মাধ্যমে দ্রুত সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। অল্প সময়ের মধ্যেই এই ঘাটতি পূরণের জন্য আপনাকে ডাক্তার আয়রন ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ফলে আপনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সমস্যা বেশি হলেও ডাক্তার আপনাকে ট্যাবলেটের বদলে ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
তবে গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে আয়রন ইনজেকশন নেওয়া নিরাপদ নয়। প্রথম তিন মাস শেষ হওয়ার পরে, অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সাধারণত আয়রন ইনজেকশন নেওয়া নিরাপদ। এক্ষেত্রেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যদিও এগুলো খুব কমন নয়—ইনজেকশনের স্থান কালচে হয়ে যাওয়া, এলার্জি, গায়ে র্যাশ, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা ও কোষ্ঠকাঠিন্য।
আয়রন ইনজেকশন কেবলমাত্র ডাক্তারের পরামর্শ মেনে হাসপাতালে এবং ডাক্তারের উপস্থিতিতে নিতে হবে। এতে করে যেকোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, আয়রন ইনজেকশনের পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যাবেন না।
গর্ভাবস্থার একদম শুরু থেকে প্রসব পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত আপনাকে দৈনিক ৩০–৬০ মিলিগ্রাম করে আয়রন ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। সন্তান জন্ম দেওয়ার তিন মাস পর পর্যন্ত আয়রন ট্যাবলেট সেবন চালিয়ে যাবেন।[১৬]
অতিরিক্ত আয়রন ট্যাবলেট সেবন করলে আয়রন ট্যাবলেটের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যেতে পারে। যেমন: কোষ্ঠকাঠিন্য, পাতলা পায়খানা, পেট ব্যথা, বুক জ্বালাপোড়া করা, বমি বমি ভাব ও কালচে পায়খানা।
এ ছাড়াও গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভকালীন সময়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ফলে প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।[১৭][১৮]
তাই গর্ভকালীন সময়ে আপনি আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেটের পাশাপাশি অন্য কোনো মাল্টিভিটামিন সেবন করলে সেখানে আয়রন আছে কি না সেটি লক্ষ রাখুন। একাধিক আয়রন সমৃদ্ধ ট্যাবলেট সেবন করা এড়িয়ে চলুন। তবে আপনি আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতায় ভুগলে ডাক্তার আপনাকে দৈনিক ৬০ মিলিগ্রামের চেয়ে বেশি পরিমাণে আয়রন ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় কিংবা অন্য যেকোনো সময়ে আয়রন ট্যাবলেটের সাথে একই সময়ে অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাবেন না। এতে শরীরে আয়রন শোষণের হার কমে যায়। ফলে শরীরে আয়রনের কার্যকারিতাও কমে যায়। তাই অ্যান্টাসিড অথবা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ার অন্তত ১ ঘণ্টা আগে অথবা ২ ঘণ্টা পরে আয়রন ট্যাবলেট খাবেন।