প্রসবের জন্য হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি

পরিবারে নতুন অতিথির আগমন নিঃসন্দেহে আনন্দের ও উত্তেজনার। এই সুন্দর সময়টি নিশ্চিন্তে কাটানোর জন্য দরকার পূর্বপ্রস্তুতি। এই পূর্বপ্রস্তুতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ডেলিভারির আগের প্রস্তুতি।

আপনার সন্তান জন্মদানের সম্ভাব্য তারিখের অন্তত তিন সপ্তাহ আগে থেকেই এই পরিকল্পনা শুরু করে দিন। হাসপাতালে থাকার জন্য নিজের ও নবজাতকের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আগেই ব্যাগে গুছিয়ে রাখুন। এক্ষেত্রে নিচের তালিকা অনুসরণ করে একটা ব্যক্তিগত চেকলিস্ট তৈরি করে নিতে পারেন।

নিজের জন্য যা যা নিতে পারেন

  • আপনার গর্ভকালীন সকল চেকআপের কাগজপত্র অবশ্যই সাথে নিয়ে যাবেন। যেমন: প্রেসক্রিপশন, আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট, ব্লাড গ্রুপঅন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট
  • আপনি এর আগে গর্ভধারণ করে থাকলে, বিশেষ করে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন কোনো জটিলতা হয়ে থাকলে, সে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই আগেরবারের কাগজ এবং বর্তমান গর্ভকালীন কাগজপত্র আলাদা করে গুছিয়ে নিন। সম্ভব হলে দুইটি আলাদা ফাইল ব্যবহার করুন। গোছানোর সময়ে সর্বশেষ তারিখ থেকে সর্বপ্রথম তারিখ অনুযায়ী সিরিয়াল করতে পারেন।
  • আপনার যদি অন্য কোনো রোগ (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েডের সমস্যা, থ্যালাসেমিয়া কিংবা দীর্ঘমেয়াদী কোনো রোগ) থাকে এবং এর জন্য আপনি কোনো ওষুধ খান, তাহলে ৭–৮ দিনের হিসেবমতো সেই ওষুধ নিয়ে যান। এসব রোগের জন্য যদি চিকিৎসকের পক্ষ থেকে কোনো সতর্কবার্তা বা সাবধানতার পরামর্শ সংক্রান্ত লিফলেট থাকে, তবে সেই কাগজটি সাথে নিয়ে যান।
  • ডায়াবেটিসের জন্য সুগার মাপার যন্ত্র বা গ্লুকোমিটার ব্যবহার করলে সেটা মনে করে নিয়ে যাবেন। 
  • প্রসবকালে পরার জন্য ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক একটি জামা নিন, যেটা পরে আপনার নড়াচড়া অথবা চলাফেরা করতে কোনো সমস্যা হবে না। খুব গরম কিংবা ঠাণ্ডা লাগবে না।
  • এসময়ে বড় গলার হাফ হাতা জামা বা ম্যাক্সি ড্রেস পরতে পারেন। এতে সঠিকভাবে প্রেশার মাপতে, প্রয়োজনে ইনজেকশন দিতে ও রক্তের স্যাম্পল নিতে সুবিধা হবে। নিচে পরার জন্য পেটিকোট বেছে নিতে পারেন। এতে প্রস্রাব পরীক্ষা করার কিংবা প্রস্রাবের নল পরানোর সময়ে সুবিধা হতে পারে।
  • হাসপাতালে থাকাকালে পরার জন্য তিন থেকে চার সেট আরামদায়ক জামা-কাপড় গুছিয়ে নিন। এক্ষেত্রে সামনে হুক অথবা বোতাম দেওয়া জামা নিতে পারেন, এতে পরবর্তীতে আপনার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে সুবিধা হবে।
  • শীতকালে ডেলিভারি হলে শীতের কাপড় সাথে নিয়ে যান। সম্ভব হলে একটা পানি গরম রাখার ফ্লাস্ক নিতে পারেন।
  • দুই জোড়া স্যান্ডেল নেওয়া উচিত; একটি হাসপাতালে পরার জন্য আরেকটি গোসলখানা অথবা টয়লেটে যাওয়ার জন্য।
  • দুই থেকে তিনটি অন্তর্বাস সেট নিন। যেহেতু সন্তান জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়বে, কাজেই সম্ভব হলে ‘নার্সিং ব্রা’ সাথে নিন। ‘নার্সিং ব্রা’ শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর উপযোগী করে তৈরি করা হয়। এসময়ে যেহেতু স্তন স্বাভাবিকের তুলনায় আকারে কিছুটা বড় হয়ে যায়, কাজেই সেই মাপ অনুযায়ী অন্তর্বাস নির্বাচন করুন।
  • দুই থেকে তিন প্যাকেট ভালো শোষণ ক্ষমতাযুক্ত ম্যাটার্নিটি প্যাড বা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে রাখুন। সাধারণত প্রসবের সময় থেকেই এটা প্রয়োজন হয়।
  • ‘ব্রেস্ট প্যাড’ সাথে নিয়ে যেতে পারেন। এটি মূলত এক ধরণের কাপড় বা প্যাড যা মায়ের স্তন থেকে নিঃসৃত হওয়া অতিরিক্ত দুধটুকু শোষণ করে স্তন শুষ্ক রাখে। এটি ইনফেকশন প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
  • একটি ছোটো ব্যাগে দাঁত মাজার ব্রাশ-পেস্ট, টিস্যু পেপার, চিরুনি, সাবান, ছোটো শ্যাম্পুর প্যাকেট, লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ, গামছা বা তোয়ালে, ছোটো এক বোতল লোশন—এই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আলাদা করে রাখুন।
  • সাথে কিছু স্বাস্থ্যকর নাস্তা (যেমন: আপেল, সেদ্ধ ডিম, গাজর ও পর্যাপ্ত পানি) নিয়ে যাবেন।  খাবারের প্লেট, চামচ ও গ্লাস নিয়ে যান। সাথে একটা ডিশ ওয়াশিং লিকুইড নিন। সম্ভব হলে ঝামেলা এড়াতে ওয়ান-টাইম-ইউজ কয়েক সেট নিতে পারেন।
  • যেহেতু আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল এবং প্রসবকালে আপনার গরম অনুভূত হতে পারে, তাই সাথে ছোটো আকারের চার্জ দেওয়া অথবা ব্যাটারি চালিত ফ্যান কিনে রাখতে পারেন। আবার বিদ্যুৎ চলে গেলে যাতে সমস্যা না হয় তাই সাথে একটি মোমবাতি-দেশলাই অথবা টর্চলাইট রাখা উচিত।
  • আপনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তার চার্জার নিতে ভুলবেন না। সম্ভব হলে একটা মাল্টিসকেট অ্যাডাপটার ও পাওয়ার ব্যাংক নিতে পারেন।
  • সময় কাটানোর জন্য চাইলে ভালো একটা বই কিংবা ম্যাগাজিনও রাখতে পারেন।
  • আপনার সাথে কারও হাসপাতালে থাকার সুযোগ থাকলে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিন। বহন করতে কষ্ট না হলে তাদের জন্য ভাঁজ করা যায় এমন ছোটো টুল বা পিঁড়ি, বিছানার চাদর ও ছোটো একটা কুশন নিতে পারেন।
  • হাসপাতালে বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা লাগতে পারে। আগে থেকে টাকা জমিয়ে ডেলিভারির সময়ে সেই টাকা সঙ্গে নিয়ে যান ও সাবধানে রাখুন। মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ব্যক্তিগত মূল্যবান সামগ্রীও যথাসম্ভব সতর্কভাবে ব্যবহার করুন।

শিশুর জন্য যা কিছু নিতে পারেন

  • নবজাতককে মোড়ানোর জন্য ভালো সুতি কাপড়ের ছোটো কাঁথা কিংবা তোয়ালে
  • নবজাতকের পরার উপযোগী আরামদায়ক সুতি কাপড়ের জামা
  • সঠিক মাপের ডায়পার অথবা প্রস্রাব-পায়খানার জন্য উপযুক্ত কাপড়ের টুকরা
  • শীতকালে প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত কাঁথা ও অন্যান্য গরম কাপড়
  • বাচ্চার ঘুমানোর জন্য ছোটো বালিশ, মশারি ও চাদর
  • বাচ্চার প্রস্রাবের জন্য যাতে বিছানা না ভিজে এমন ক্লথ (অয়েল ক্লথ) অথবা মোটা পলিথিন
  • বাচ্চা যাতে বিছানা থেকে পড়ে না যায়–এজন্য অতিরিক্ত দুইটি বালিশ অথবা কোলবালিশ

কিছু আগাম পরিকল্পনা

  • আপনার নরমাল ডেলিভারি করানোর পরিকল্পনা থাকলেও মাথায় রাখতে হবে যে, গর্ভাবস্থায় যেকোনো সময়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং চিকিৎসক আপনাকে অবিলম্বে সিজারিয়ান সেকশন (যাকে আমরা প্রচলিত ভাষায় সিজার অপারেশন বলে থাকি) করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। কাজেই সেই অনুযায়ী মানসিক ও আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে যান।

    সরকারী হাসপাতালে সাধারণত এই অপারেশনগুলো বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে হয়ে থাকে। তারপরেও কিছুটা আর্থিক প্রস্তুতি রাখা ভালো যাতে জরুরি ভিত্তিতে কোনোকিছু দরকার হলে অপেক্ষা না করে নিজেই ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।

    তবে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হলে অবশ্যই সেই অনুযায়ী আগে থেকে টাকার পরিমাণ জেনে প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে স্থানভেদে টাকার পরিমাণ তারতম্য হয়ে থাকে।
  • আপনার চিকিৎসক আপনাকে নরমাল অথবা সিজার যেই পদ্ধতির কথাই বলুন না কেন, নিজের রক্তের গ্রুপ জেনে রাখবেন। প্রথম গর্ভকালীন চেকআপের পরই অন্তত দুই-তিনজন রক্তদাতা জোগাড় করে রাখবেন। কেননা অপারেশনের জন্য যেমন আপনার রক্ত লাগতে পারে, তেমনি নরমাল পদ্ধতিতে প্রসব করলেও যোনিপথ থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে রক্ত লাগতে পারে। ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে যাওয়ার আগে সম্ভাব্য রক্তদাতাদের জানিয়ে যাবেন এবং প্রয়োজনে প্রস্তুত থাকতে অনূর্ধ্ব করবেন।
  • আপনি হাসপাতাল পর্যন্ত কিভাবে যাবেন, কার সাথে যাবেন—এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলুন। আপনার সাথে হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য অন্তত দুই তিনজনকে বলে রাখুন, যাতে হঠাৎ প্রয়োজন হলে এবং কেউ একজন ব্যস্ত থাকলে অন্যজন আপনাকে সহযোগিতা করতে পারে। আপনি চাইলে আপনার ব্যক্তিগত কাজে সাহায্য করার জন্য পরিবারের একজন নারী সদস্যকে বলে রাখতে পারেন। একই সাথে উনিও যেন উনার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আলাদা একটি ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে আসেন সেটি জানিয়ে রাখুন।
  • যাতায়াতের জন্য এমন একটি যানবাহন পছন্দ করুন যেটা নিরাপদ ও রাস্তায় ঝাঁকুনি কম লাগবে। সম্ভব হলে যানবাহন চালকের সাথে আগে থেকেই কথা বলে রাখুন। অ্যাম্বুলেন্সের নাম্বার জোগাড় করে রাখুন, যাতে হঠাৎ করে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছানো যায়।
  • নরমাল ডেলিভারিতে সাধারণত এক থেকে দুই দিন এবং সিজারিয়ান সেকশনের পর তিন থেকে চার দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশিদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হতে পারে। এই সময়টুকুতে আপনার সংসার এবং অন্য সন্তানদের দেখাশোনার জন্য একজন সাহায্যকর্মী বা পরিচিতজনকে ঠিক করে রাখতে পারেন।

আগেভাগেই আপনার সঙ্গী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের এসব প্রস্তুতির দায়িত্ব দিয়ে রাখুন। প্রসবের সময়ে আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাবেন। এসময়ের বাড়তি দায়িত্বগুলো পরিবারের সদস্যরা ভাগাভাগি করে নিলে পুরো যাত্রাটা হয়তো কিছুটা সহজ হয়ে আসবে।

সাধারণ জিজ্ঞাসা

গর্ভবতীকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার সময় কী ধরনের যানবাহন ব্যবহার করতে হবে?

যাতায়াতের জন্য এমন একটি যানবাহন পছন্দ করুন যেটায় আপনার রাস্তায় ঝাঁকুনি কম লাগবে। সম্ভব হলে যানবাহন চালকের সাথে আগে থেকেই কথা বলে রাখুন। অ্যাম্বুলেন্সের নাম্বার জোগাড় করে রাখুন, যাতে হঠাৎ করে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছানো যায়।

হসপিটালে যাওয়ার আগে সর্বনিম্ন কতদিনের প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে?

নরমাল ডেলিভারিতে সাধারণত এক থেকে দুই দিন এবং সিজারিয়ান সেকশনের পর তিন থেকে চার দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশিদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হতে পারে। আবার মনে রাখা প্রয়োজন যে, শুরুতে নরমাল ডেলিভারির পরিকল্পনা থাকলেও মা এবং শিশুর অবস্থার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক যেকোনো মুহূর্তে আপনাকে অপারেশনের পরামর্শ দিতে পারেন। কাজেই নরমাল ডেলিভারির পরিকল্পনা থাকলেও সর্বনিম্ন তিন থেকে চার দিনের প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া ভালো।