এ সপ্তাহের হাইলাইটস
শিশুকে জন্মের পর অবশ্যই ভিটামিন কে ও বিসিজি টিকা দিন
শিশুর জন্মের পর পর তাকে ভিটামিন কে ইনজেকশন দিতে হয়।[১] সেই সাথে যক্ষ্মা বা টিবি রোগজনিত জটিলতা প্রতিরোধের জন্য এসময়ে বিসিজি টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
নিয়মিত মাছ খাওয়া চালিয়ে যান
গর্ভাবস্থায় মা নিয়মিত মাছ খেলে শিশুর ব্রেইনের বিকাশ ভালো হয়, আইকিউ বাড়ে, কথাবার্তায় পটু হয়।[২] তাই সপ্তাহে অন্তত ২৮০ গ্রামের মতো মাছ খাওয়ার চেষ্টা করবেন। এর মধ্যে অর্ধেক পরিমাণ তৈলাক্ত মাছ খাবেন।[৩] যেমন: ইলিশ, চাপিলা, ও পুঁটি। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়েও এভাবে মাছ খাওয়া চালিয়ে যাবেন।
এক পাশে কাত হয়ে ঘুমান
এ সপ্তাহেও ঘুমানোর সময়ে আপনার সুবিধামতো ডান অথবা বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমাবেন। কারণ চিৎ হয়ে ঘুমালে শিশুর ক্ষতি হতে পারে।[৪][৫] ঘুমের সময়ে সাপোর্ট দেয় এমন আরামদায়ক কয়েকটা বালিশ নিয়ে ঘুমাতে পারেন।
আয়রন-ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান
বিগত সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যাবেন। এগুলো গর্ভের শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[৬][৭] পাশাপাশি আপনাকে মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করতে পারে।[৮]
- মাসে কত দিন? ৯ মাস ১ সপ্তাহ
- কোন ট্রাইমেস্টার? তৃতীয় ত্রৈমাসিক
- আর কত সপ্তাহ বাকি? ৩
৩৭ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি
আপনার গর্ভের শিশু এখন মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত প্রায় ৪৮.৬ সেন্টিমিটার লম্বা। সে প্রায় দুইটি ডাবের সমান লম্বা হয়ে গিয়েছে। তার ওজন এখন প্রায় ২.৯ কেজি।
ছোট্ট শিশু এখন নানান ধরনের মুখভঙ্গি করতে পারে
আপনার ছোট্ট শিশু বিভিন্ন ধরনের মুখভঙ্গি করতে শিখে ফেলেছে।[৯] সে হয়তো এখন চোখ-মুখ কুঁচকে মুখে একটা বিরক্তির ভাব নিয়ে কিংবা হাসিমাখা মুখে আপনার গর্ভের ভেতরে শুয়ে আছে।
পরিপাক নালিতে মেকোনিয়াম জমা হচ্ছে
জন্মের পর শিশু প্রথমবারের মত যে পায়খানা করবে, তা তার পরিপাক নালিতে জমা হচ্ছে।[১০]
শিশুর প্রথম পায়খানা পিচ্ছিল হয় আর দেখতে সাধারণত গাড় সবুজ রঙের হয়।[১১] গর্ভে থাকাকালীন সময়ে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড, ঝরে যাওয়া গায়ের লোমসহ আরও যা যা জিনিস শিশু খেয়ে ফেলে, সেসব মিলে পরিপাক নালীতে এই তরল পায়খানা তৈরি হয়। একে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় ‘মেকোনিয়াম।’
শিশুর মস্তিষ্ক বিকশিত হচ্ছে
গর্ভের ভেতরে শিশুর মস্তিষ্ক সুগঠিত হচ্ছে।[১২] শুনে অবাক লাগতে পারে, তবে জন্মের পরও প্রায় দুই দশক ধরে তার মস্তিষ্ক বিভিন্নভাবে বিকশিত ও পরিণত হতে থাকবে।[১৩][১৪]
৩৭ সপ্তাহে মায়ের শরীর
প্রসবের পরের যোনিপথের স্রাব
প্রসবের পর কয়েক সপ্তাহ আপনার যোনিপথ দিয়ে বিশেষ এক ধরনের স্রাব যাবে।[১৫] প্রথমদিকে সাধারণত বেশ ভারী রক্তস্রাব যায়।[১৬] এসময়ে ভালো শোষণ ক্ষমতার স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ম্যাটারনিটি প্যাড ব্যবহার করতে হয়, যা এখনই সংগ্রহ করে রাখতে পারেন।
সময়ের সাথে সাথে প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাবের পরিমাণ কমতে থাকে। রঙও বাদামী হতে থাকে। সাধারণত ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে এই স্রাব যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।[১৭] তবে যদি ভারি রক্তপাত হয়, যেমন ঘন্টায় দুইটা করে প্যাড ভিজে যাচ্ছে, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে যাবেন।
শিশুর জন্মের পর ভিটামিন কে
ভিটামিন কে আমাদের শরীরে রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে। কিন্তু নবজাতক শিশুর শরীরে ভিটামিন কে এর মাত্রা কম থাকে।[১৮] ভিটামিন কে এর অভাব হলে নবজাতক শিশুর মারাত্মক রক্তক্ষরণ হতে পারে।[১৯] তাই জন্মের পর পর নবজাতক শিশুকে ভিটামিন কে ইনজেকশন দিতে হয়।[২০]
ভিটামিন কে শিশুর রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা অনেকখানি কমিয়ে আনতে পারে।[২১] তাই আপনার শিশুকে জন্মের পর পর ভিটামিন কে দেয়া নিশ্চিত করুন। কখনো কখনো ইনজেকশনের বদলে মুখে খাওয়ার ভিটামিন কে দেওয়া হতে পারে।
শিশুর বিসিজি টিকা
জন্মের পর শিশুকে বিসিজি টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। বিসিজি টিকা যক্ষ্মা রোগজনিত জটিলতা থেকে সুরক্ষা দেয়।[২২][২৩] সাধারণত জন্মের পর পর ১ ডোজ বিসিজি টিকা নিতে হয়। তাই জন্মের পর ছোট্টমণির বিসিজি টিকা নেওয়া যেন বাদ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখুন। সরকারি হাসপাতালে সাধারণত বিনামূল্যে এই টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
ডেলিভারির পর পর আপনার শরীরটা হয়তো ক্লান্ত থাকবে, এই কথাটা মাথায় না-ও থাকতে পারে। তাই এখনই শিশুর বাবাকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখতে পারেন। তিনি ছোট্টমণিকে জন্মের পর পর বিসিজি টিকা আর ভিটামিন কে ইনজেকশন দেওয়ানোর ব্যবস্থা করতে পারবেন।
গর্ভকালীন চেকআপ
আপনাকে এখন প্রতি সপ্তাহে একবার করে চেকআপে যেতে হবে। তবে গর্ভাবস্থায় কোনো জটিলতা না থাকলে ডাক্তার আপনাকে এর চেয়ে কম ঘন ঘন চেকআপ করাতে বলতে পারেন
চেকআপের শিডিউলটা জেনে নিয়ে পরবর্তী চেকআপের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলুন। চেকআপে যাওয়ার সময়ে প্রয়োজনীয় সব কাগজ, প্রেসক্রিপশন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট নিতে ভুলবেন না।
প্রসব-পরবর্তী কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলস
প্রসবের পর আপনার কয়েকদিন পায়খানা না-ও হতে পারে। এসময়ে যেন কোষ্ঠকাঠিন্য না হয়, সেজন্য বেশি বেশি ফাইবার বা আঁশসমৃদ্ধ খাবার ও প্রচুর পানি খাবেন। দিনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেও সেটা কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করতে পারে।
আপনার যদি সেলাই দেওয়া থাকে, তাহলে পায়খানা করার সময়ে কয়েকটা পরিষ্কার টিস্যু একসাথে ভাঁজ করে প্যাডের মতো বানিয়ে সেলাইয়ের জায়গার ওপরে ধরতে পারেন। এতে আরাম লাগতে পারে।
প্রসবের পর কোষ্ঠকাঠিন্যের পাশাপাশি পাইলস হওয়াও খুব পরিচিত সমস্যা। তবে এটা সাধারণত কয়েকদিনের মধ্যে দূর হয়ে যায়।
পাইলস সম্বন্ধে আরও জানতে আমাদের এই লেখাটি পড়তে পারেন।
অন্যান্য লক্ষণ
এ সপ্তাহে আপনার আরও যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—
- পেট টান-টান বা শক্ত হওয়া। একে ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্র্যাকশনও বলা হয়
- ঘুমের সমস্যা
- স্ট্রেচ মার্ক বা ফাটা দাগ
- দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া এবং মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
- পেটের আকার বাড়ার সাথে সাথে পেটের চারপাশের পেশিতে ব্যথা করা
- পাইলস
- মাথা ব্যথা
- কোমর ব্যথা
- পেট ফাঁপা লাগা
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- বদহজম ও বুক জ্বালাপোড়া করা
- অল্পতেই গরম লাগা কিংবা সামান্য গরম আবহাওয়াতেই অস্বস্তি বোধ করা
- পা কামড়ানো
- মাথা ঘুরানো
- হাত–পায়ে পানি আসা বা ফুলে যাওয়া
- প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন হওয়া
- যোনিপথে ইনফেকশন হওয়া
- মুখে মেছতার মতো বাদামি ও ছোপ ছোপ দাগ পড়া
- তৈলাক্ত ত্বক ও ত্বকে দাগ পড়া
- চুল ঘন ও ঝলমলে হওয়া
এ ছাড়াও এই সপ্তাহে আপনার প্রথম দিকের সময়ের লক্ষণগুলো থাকতে পারে। যেমন—
- ঘন ঘন মনমেজাজ বদলানো বা মুড সুইং। এই খুশি, আবার এই মন খারাপ—এমনটা হতে পারে। পাশাপাশি এসময়ে ছোটোখাটো বিষয়ে মন খারাপ লাগা অথবা কান্না করে ফেলার প্রবণতা দেখা দিতে পারে
- বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া
- অদ্ভুত জিনিস (যেমন: মাটি) খাওয়ার ইচ্ছা হওয়া
- তীব্র ঘ্রাণশক্তি
- স্তনে ব্যথা
- স্তন থেকে তরল নিঃসৃত হওয়া
- সাদাস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
- যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত হওয়া। এমন হলে অবশ্যই একজন ডাক্তার দেখাবেন, কারণ এটা মারাত্মক জটিলতার লক্ষণ হতে পারে
এ সপ্তাহে বাবার করণীয়
ডেলিভারির সময় একেবারেই কাছে চলে এসেছে! এখন আমরা ডেলিভারি সংক্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি শিশুর জন্মের পর পর কোন কাজগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও তুলে ধরছি। এতে আপনি ডেলিভারির পর থেকেই নতুন শিশু ও শিশুর মায়ের যত্ন নিতে পারবেন।
প্রসবকালীন সময়ে শিশুর মায়ের পাশে থাকুন
প্রসবকালীন সময়ে শিশুর মায়ের পাশে থেকে তাকে পুরোটা সময় জুড়ে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই সময়ের ব্যথা ও কষ্ট থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার উপায়গুলো এখনই ভেবে রাখুন।
তাকে বেশি বেশি মানসিক উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তার জন্য হালকা ঠাণ্ডা পানি ও কিছু নাস্তা সাথে রাখতে পারেন। তাকে বাথরুমে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে পারেন। পাশাপাশি তাকে সাহস ও ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
শিশুর মায়ের সমস্যাগুলো ডাক্তারের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করুন
প্রসবকালীন সময়ে শিশুর মায়ের নানান ধরনের সমস্যা হতে পারে। তার পাশে থেকে সেগুলো বোঝার এবং জানার চেষ্টা করুন। ডাক্তারকে সেগুলো সম্পর্কে অবহিত করুন। কেননা ব্যথা ও অস্বস্তির কারণে অনেক কিছুই হয়তো শিশুর মায়ের বলতে খেয়াল থাকবে না।
শিশুকে ভিটামিন কে ও বিসিজি টিকা দেওয়া নিশ্চিত করুন
জন্মের পর পর শিশুকে ভিটামিন কে ইনজেকশন ও বিসিজি টিকা দেওয়া জরুরি।[২৪] ডেলিভারির পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার আগে এগুলো শিশুকে দেয়া হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। মারাত্মক কোনো রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।[২৫] কখনো কখনো ইনজেকশনের বদলে মুখে খাওয়ার ভিটামিন কে দেওয়া হতে পারে।
বিসিজি টিকা যক্ষ্মা রোগজনিত জটিলতা থেকে সুরক্ষা দেয়।[২৬][২৭] সাধারণত জন্মের পর পর এক ডোজ বিসিজি টিকা নেওয়াই যথেষ্ট। সরকারি হাসপাতালে সাধারণত বিনামূল্যে এই টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
শিশুর জন্মের সুসংবাদ সবাইকে কীভাবে জানাবেন সেটা ঠিক করে রাখুন
শিশুর জন্মের পর পর আপনি হয়তো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবেন। তাই শিশুর জন্মের সংবাদ জানানোর দায়িত্বটা কাকে দেওয়া যায় সেটা আগেই পরিকল্পনা করে রাখুন।
হতে পারে যে আপনি শিশুর জন্মের সাথে সাথে কয়েকজন কাছের মানুষকে সংবাদটা জানালেন। তখন তারা পরিবারের অন্য সদস্য ও কাছের বন্ধুদের সার্কেলে খবরটা জানিয়ে দিতে পারবেন।
শিশুর মাকেও জিজ্ঞাসা করে রাখুন যে তিনি প্রথমে কাদের সুসংবাদটা জানাতে চান এবং সবাইকে জানানোর দায়িত্ব কাকে দিতে চান। প্রসবের পর শিশুর মা হয়তো পরিশ্রান্ত থাকবেন। তখন আপনিই তার নির্বাচিত মানুষগুলোর কাছে সংবাদটা পৌঁছে দিতে পারবেন।