ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার

আঁশ বা ফাইবার হলো ফল, সবজি ও শস্যের এমন অংশ যা আমাদের পাকস্থলী হজম করতে পারে না। খাবারের এই অংশগুলো ক্যালরি, ভিটামিন অথবা মিনারেল বহন না করলেও, খাদ্য পরিপাক প্রক্রিয়ায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতিরিক্ত ওজন, কোষ্ঠকাঠিন্য, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও পাইলস এর মতো সমস্যা প্রতিরোধেও ফাইবারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

এখানে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের উপকারিতা, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবারের তালিকা এবং ফাইবার জাতীয় খাবার খাওয়ার ব্যাপারে কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে।

ফাইবার যেভাবে কাজ করে

ফাইবার দুই প্রকারের হয়ে থাকে—দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয়। উভয় প্রকারের ফাইবারকেই আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

১. দ্রবণীয় ফাইবার: এ ধরনের ফাইবার খাওয়ার পর তা পানিতে মিশে ‘জেল’ জাতীয় পদার্থে পরিণত হয়। এ পদার্থ খাবার হজম করার গতি কমিয়ে দেয়, ফলে পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে।

দ্রবণীয় ফাইবারের কিছু ভালো উৎস হলো—

  • ডাল
  • ফলমূল
  • শাকসবজি
  • ওটস ও বার্লি
  • মটরশুঁটি, শিম ও বিন জাতীয় খাবার

২. অদ্রবণীয় ফাইবার: এই ধরনের ফাইবার খাওয়ার পর পানিতে মিশে যায় না। পরিপাক নালীর ভেতরে হজম প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়ে এগুলো গোটা অবস্থাতেই থাকে। অদ্রবণীয় ফাইবার পানি শোষণ করার মাধ্যমে পায়খানা নরম করতে সাহায্য করে।

এ ছাড়া এটি মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ফলে শরীর থেকে সহজেই মল বেরিয়ে যেতে পারে। এভাবে এটি কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে ও পায়খানা নিয়মিত হতে সাহায্য করে।

অদ্রবণীয় ফাইবারের কিছু ভালো উৎস হলো—

  • পূর্ণশস্য বা হোল গ্রেইন খাবার
  • লাল আটা
  • বাদাম
  • খোসা ও বিচিসহ ফল-সবজি

ফাইবার জাতীয় খাবারের উপকারিতা

সুস্থ থাকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন। ফাইবার আমাদের দেহে যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—

  • স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে
  • কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে
  • পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। যেমন: পাইলস, ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম ও ডাইভারটিকুলাইটিস
  • রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
  • রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে
  • ডাইভারটিকুলার ডিজিজ এর মতো রোগের ঝুঁকি কমায়

উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ফাইবার জাতীয় খাবারের ভূমিকা

ফাইবার রক্তপ্রবাহ থেকে রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলকে সরিয়ে পায়খানার মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয় এবং রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায়।

এভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকলে রক্তনালীর ভেতরে কোলেস্টেরল জমে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তনালীর নানান রোগ হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে। 

ফাইবার কোলেস্টেরল কমানোর পাশাপাশি রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। হজমের প্রক্রিয়ায় শ্বেতসার জাতীয় খাবার ভেঙে সুগার তৈরি হয়। আঁশযুক্ত খাবার এই প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে দেয় এবং রক্তে সুগারের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। এভাবে আঁশযুক্ত খাবার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।

মানসিক স্বাস্থ্যের সাথেও ফাইবার গ্রহণ করার সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা পরিপাকতন্ত্রের অন্যান্য সমস্যায় ভুগলে সেটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

তাই এসব অসুস্থতা দূরে রাখার জন্য আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খেতে হবে। এভাবে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে তৈরি হওয়া অশান্তি, উদ্বিগ্নতা ও অনিদ্রা এড়ানো সম্ভব হবে।

দৈনিক কতটুকু ফাইবার গ্রহণ করা প্রয়োজন

বয়সভেদে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কতটুকু ফাইবার থাকা উচিত সেটি নিচের ছকে তুলে ধরা হয়েছে—

বয়সদৈনিক যতটুকু ফাইবার খাওয়া উচিত
২–৫ বছর১৫ গ্রাম
৫–১১ বছর২০ গ্রাম
১১–১৬ বছর২৫ গ্রাম
১৭ বছর ও তদূর্ধ্ব  ৩০ গ্রাম

ফাইবার জাতীয় খাবারের তালিকা

এখানে বাংলাদেশে সহজলভ্য কিছু ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের তালিকা তুলে ধরা হয়েছে—

খাদ্যশস্য ও সিরিয়াল

  • লাল চাল বা ঢেঁকি-ছাঁটা চাল সাধারণ চালের তুলনায় অধিক আঁশ সমৃদ্ধ।
  • পূর্ণশস্য গমের আটায় বেশি ফাইবার থাকে। সাধারণ ময়দার বদলে লাল আটার তৈরি রুটি, পাউরুটি ও চাপাতি বেছে নিতে পারেন। এ ছাড়া পাস্তা কেনার ক্ষেত্রে হোল গ্রেইন পাস্তা দেখে কিনতে পারেন।
  • ওটস ও বার্লি বা যব ফাইবার সমৃদ্ধ সিরিয়াল জাতীয় খাবার।

ফল ও শাকসবজি

ফল ও শাকসবজি আঁশের খুব গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রতিদিন পাঁচ পরিবেশন ফল ও শাকসবজি খাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে প্রতি ৮০ গ্রামকে এক পরিবেশন ধরা হয়।

মনে রাখতে হবে, সবজির পরিবেশনের এই হিসাবে কাঁচকলা, মাটির নিচের আলু ও কাসাভার মতো সবজিগুলো বাদ পড়বে। এগুলো ভাত-রুটির মতো কার্বোহাইড্রেট বা শ্বেতসারজাতীয় খাবারের উদাহরণ।

পর্যাপ্ত পরিমাণ ফল ও শাকসবজি খাওয়া হলে শরীরে ফাইবারের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অনেক ভিটামিন ও মিনারেলও গ্রহণ করা হবে। ফল কিংবা সবজি যে আলাদা করে অথবা কাঁচাই খেতে হবে এমন শর্ত নেই। স্যুপের সাথে অথবা সালাদ হিসেবে খেলেও কাজে দেবে।

যেসব ফল ও সবজি খোসাসহ খাওয়া যায় সেগুলো খোসা না ফেলে খাওয়ার চেষ্টা করুন। কারণ খোসায় বেশি পরিমাণে আঁশ থাকে। তবে খাওয়ার আগে অবশ্যই ভালোমতো ধুয়ে নিতে হবে।

যেকোনো ফল অথবা সবজি গোটা বা আস্ত খেলে ভালো ফাইবার পাওয়া যায়। জুস করে অথবা ভর্তা বানিয়ে খেলে আঁশের পরিমাণ কমে যায়।

ডাল, ছোলা, মটর ও বিন

মসুর, মুগ, খেসারি ও অন্যান্য ডালে যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার থাকে। শিমের বিচি, ছোলা, মটর, কিডনি বিন সহ অন্যান্য বিন জাতীয় খাবারও আঁশের ভাল উৎস।

বাদাম

বাদামে ফাইবার থাকে। কিন্তু এতে ফ্যাট ও লবণের পরিমাণও বেশি থাকতে পারে। তাই অতিরিক্ত বাদাম খাওয়া পরিহার করতে হবে। দিনে এক মুঠো বা ৩০ গ্রাম বাদাম খাওয়া যেতে পারে।

এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আমাদের লক্ষ্য যদি হয় স্বাস্থ্যসম্মত ওজন রক্ষা করা অথবা ওজন কমানো, তাহলে ফাইবার খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি, অধিক ক্যালরিযুক্ত ও চর্বি-জাতীয় খাবার খাওয়া কমাতে হবে।

ফাইবার জাতীয় খাবার সম্পর্কে চারটি গুরুত্বপূর্ণ টিপস

১. বেশি করে পানি ও তরল খাবার খেতে হবে

ফাইবার পানি শোষণ করে পায়খানা নরম করে এবং মলত্যাগ সহজ করে। তাই ফাইবার যেন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণ পানি পান করতে হবে।

প্রতিদিন নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে ৬–৮ গ্লাস, অর্থাৎ অন্তত ২ লিটার পানি খাওয়ার চেষ্টা করুন। দুধ, চা ও কফি—সবই এই পরিমাণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে শরীর সুস্থ রাখতে লো-ফ্যাট দুধ ও চিনিছাড়া চা-কফি খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত।

২. ফাইবারের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে।

অনিয়মিত বা অপরিকল্পিতভাবে আঁশ জাতীয় খাবার খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানো উচিত নয়। কোনো একদিন অনেক বেশি পরিমাণ আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া এবং পরের দিন অনেক কম খাওয়া—এমন অভ্যাস থেকে বিরত থাকতে হবে।

হঠাৎ ডায়েটে ফাইবারের পরিমাণ বাড়িয়ে ফেললে বায়ুর সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া পেট ফাঁপা, পেট খারাপ হওয়া ও তলপেটে তীব্র ব্যথাসহ নানান ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই খাদ্যতালিকায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন নিয়ে আসা উচিত। একটি অভ্যাস তৈরি হওয়ার পরই কেবল অন্য আরেকটি পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।

যেমন, গতকাল যদি শুধু একটি ফল খেয়ে থাকেন, তাহলে আজ দুটো খাওয়ার চেষ্টা করুন। সাথে কিছু বাদাম খান। রান্না করা সবজি খেতে না চাইলে ভাতের সাথে টমেটো, শসা, গাজর কেটে সালাদ খাওয়া শুরু করতে পারেন।

৩. নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে

যারা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করেন তারা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় কম আক্রান্ত হন। শরীর সচল রাখলে তা পায়খানা নরম রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যায়াম পরিপাক নালীর পেশিগুলোকে সচল রাখে। এর ফলে মল নিষ্কাশন সহজ হয়।

প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য ব্যায়াম করা উচিত। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি ধরনের ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন। মাঝারি ধরনের শরীরচর্চার মধ্যে রয়েছে—দ্রুত হাঁটা, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করা ও সাঁতার কাটা। বিকল্প হিসেবে সপ্তাহে ৭৫ মিনিট করে সাইকেল চালানো, ফুটবল খেলা অথবা বাস্কেটবল খেলার মতো ভারী ব্যায়াম করার চেষ্টা করতে পারেন।

এসব ভারী ব্যায়ামই বেছে নিতে হবে, এরকম নয়। দেহ সচল রাখতে হাঁটাচলা, হালকা স্ট্রেচিং এবং যোগব্যায়াম সবই কার্যকর। গবেষণায় দেখা গেছে, কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে হাঁটাহাঁটি বা হালকা শরীরচর্চাও ভালো ভূমিকা রাখে। অন্য কিছু করার সুযোগ না হলে প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ মিনিট হাঁটার চেষ্টা করুন। আর আপনি যদি নিয়মিত দৌড়ানোর অভ্যাস তৈরি করতে চান, সেক্ষেত্রে ৯ সপ্তাহে দৌড়ানোর অভ্যাস তৈরির গাইডলাইনটি অনুসরণ করতে পারেন।

৪. কেনার সময়ে ফাইবারের পরিমাণের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে

অনেক খাবারের প্যাকেট অথবা কৌটার গায়ে প্রতি ১০০ গ্রামে কতটুকু ফাইবার আছে সেটি উল্লেখ করা থাকে।

প্রতি গ্রাম আঁশের হিসাব রাখা জরুরি নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার মাধ্যমে খাবার কেনা ও খাওয়ার সময়ে স্বাস্থ্যসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।