লাল চালের উপকারিতা

লাল চাল সাধারণত ঢেঁকিছাঁটা চাল, কুড়াকাটা চাল ও ব্রাউন রাইস নামেও পরিচিত। আমরা সাধারণত চাল বলতে যেই সাদা অংশটুকু চিনি সেটি ছাড়াও চালের বাইরে খোসা ও কুড়া বা ব্র্যানের স্তর থাকে।

সাদা চালের ক্ষেত্রে চাল ছাড়া অন্যান্য স্তরগুলো ছাঁটাই করে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু লাল চালে কেবল খোসাটিই ছাঁটাই করা হয়। তাই লাল চালকে পূর্ণশস্য বলা হয় এবং এটি সাদা চালের তুলনায় অধিক ফাইবার ও খনিজ সমৃদ্ধ হয়।

লাল চাল ও সাদা চালের মধ্যে পার্থক্য

চালের কুড়াতে অনেক ধরণের পুষ্টি উপাদান থাকে। যেমন: আয়রন, কপার, জিংক, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি ও প্রচুর ফাইবার। এগুলো বিভিন্নভাবে কাজ করে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে।

মেশিনে সাদা চাল বানানোর সময়ে এই আস্তরণ ছেঁটে ফেলা হয়। ফলে চাল থেকে শক্ত ফাইবার চলে যায় ও রান্না করা ভাত নরম হয়। তখন আমাদের জন্য এই চালের ভাত চিবানো সহজ হলেও চালের পুষ্টিগুণ অনেক কমে যায়।

এ ছাড়া চালের শস্যদানার ভেতরে ‘জার্ম’ নামক অংশ থাকে। এটিতে ভিটামিন বি, ভিটামিন ই, উপকারী ফ্যাট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর মতো বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান থাকে।

চালের মধ্যে এই জার্ম অংশ থাকলে সেই চাল বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। তাই সাদা চাল বানানোর সময়ে এই পুষ্টিকর অংশটুকুও সরিয়ে ফেলা হয়, যেন অনেকদিন গুদামে অথবা দোকানে রাখা যায়।

লাল চালে এসব অংশ অটুট থাকে। তাই সাদা চালের তুলনায় লাল চাল অধিক মিনারেল বা খনিজ সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। লাল চালে পাওয়া খনিজ পদার্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম।

লাল চালে উচ্চ মাত্রায় আঁশ বা ফাইবার পাওয়া যায়। এ ছাড়া মাঝারি পরিমাণে প্রোটিনও থাকে। এসব কারণে লাল চাল স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী।

লাল চালের উপকারিতা

সুস্বাস্থ্যের জন্য লাল চাল খাওয়ার উল্লেখযোগ্য কিছু উপকারিতা হলো—

হজম প্রক্রিয়াতে

লাল চালে ফাইবার বা আঁশ থাকে। বেশি বেশি আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার সুফলের মধ্যে রয়েছে—

  • কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে সুরক্ষা পাওয়া
  • নিয়মিত পায়খানার অভ্যাস তৈরি হওয়া
  • কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যাওয়া
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ করা

লাল চালে অদ্রবণীয় ফাইবার রয়েছে। এই ধরনের ফাইবার হজমে সাহায্য করার পাশাপাশি নাড়িভুঁড়ির ভেতরে উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরিতে অবদান রাখে। এসব ব্যাকটেরিয়া পেটের সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ব্লাড সুগার বেড়ে যাওয়া রোধে

চালে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট থাকে। কার্বোহাইড্রেট ভেঙে আমাদের রক্তে সুগার তৈরি হয়। যেই খাবারগুলো খেলে রক্তে আস্তে আস্তে সুগারের পরিমাণ বাড়ে, হুট করে অনেক বেড়ে যায় না—সেই খাবারগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

সাদা চালের ভাত রক্তে সুগারের পরিমাণ খুব দ্রুত বাড়ায়। শরীর খুব তাড়াতাড়ি এই চাল ভেঙে সুগার তৈরি করতে পারে। ফলে অল্প সময়ে রক্তের সুগার অনেক বেড়ে যায়।

অন্যদিকে লাল চালের ভাতের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। এটি ভাঙতে শরীরের বেশ সময় লাগে। রক্তে সুগারের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ে। ফলে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন কম প্রয়োজন হয়। সেই সাথে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকে। এভাবে লাল চাল টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি কমায় এবং রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

হৃৎপিণ্ডের সুস্থতায়

হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনীর রোগসহ অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে লাল চালের মতো পূর্ণশস্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা বেশি পূর্ণশস্য খায় তাদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কম থাকে।

দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধে 

লাল চালের কুড়ায় ‘ফ্ল্যাভোনয়েড’ নামক কিছু রোগ প্রতিরোধক পদার্থ থাকে। এগুলো রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এ ছাড়াও লাল চাল ও অন্যান্য পূর্ণশস্য হৃদরোগ, টাইপ ২ ডায়াবেটিসসহ অগ্ন্যাশয় ও পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

লাল চালে উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের কোষের ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারে। এভাবেও এটি হৃদরোগ, ক্যান্সার ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

গবেষণায় দেখা যায় লাল চালের ভাত, ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমায়।

লাল চাল খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ

আপনার যদি মনে হয় যে আপনি খাদ্যাভ্যাসে একটা পরিবর্তন আনবেন, রিফাইন্ড গ্রেইনের বদলে হোলগ্রেইন বা গোটা শস্যদানা বেশী খাবেন, তাহলে আপনার জন্য ৩টি পরামর্শ।

১. আস্তে আস্তে শুরু করুন। প্রথমে নতুন কিছু খেলে সেটার স্বাদ ভালো না-ই লাগতে পারে। একেবারে পুরোটা না বদলে অল্প অল্প করে বদলাতে পারেন।

সাদা ভাতের সাথে কিছু লাল ভাত মিশিয়ে খেলেন। রুটি খেলে একটা সাদা আটার রুটি, তার সাথে একটা লাল আটার রুটি খেলেন। তারপর ধীরে ধীরে আপনি হয়তো সেই স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।

২. ভাত রুটি ছাড়াও অন্যান্য হোলগ্রেইন খেতে পারেন। যেমন, নাস্তায় খাওয়ার জন্য ওটস কিনে রাখতে পারেন।

৩. অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। লাল আটা ও চাল খেলেই যে পরিমাণে বেশী খাওয়া যাবে, তা কিন্তু না। সুষম খাবারের অংশ হিসেবে আপনি লাল চাল আর লাল আটা পরিমাণ মতো  খাবেন।

সাধারণত দেখা যায় আমরা পুরো প্লেট ভাত নিয়ে অল্প একটু তরকারি দিয়ে খাই। এটা না করে চেষ্টা করবেন প্রতি বেলায় প্লেটের অর্ধেক শাকসবজি ফলমূল রাখতে।

লাল চালের পুষ্টি উপাদান

প্রতি এক কাপ বা ১৯৫ গ্রাম লাল চালের ভাতের কিছু পুষ্টি উপাদান নিচের তালিকায় তুলে ধরা হয়েছে—

পুষ্টি উপাদানপরিমাণ
ক্যালরি২৩৮
ফ্যাট বা স্নেহ১.৬ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট৪৯.৫ গ্রাম
আঁশ বা ফাইবার৩.১২ গ্রাম
সুগার০.৪৬৮ গ্রাম
প্রোটিন৫.৩২ গ্রাম

ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ

কুড়া বা ব্র্যান এর স্তরটি অক্ষত থাকার কারণে লাল চাল ভিটামিন ও মিনারেল এর মতো বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে ভরপুর থাকে। সুস্বাস্থ্যের জন্য সুপারিশকৃত দৈনিক পরিমাণের প্রায় ৮৮% ম্যাঙ্গানিজ, ২৭% সেলেনিয়াম ও ২১% ম্যাগনেসিয়াম আমরা এক কাপ লাল চালের ভাতেই পেতে পারি। ফসফরাস, কপার, ভিটামিন বি৬ এর মতো অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও লাল চালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে থাকে। 

ম্যাঙ্গানিজ হাড়, রক্ত ও ফ্যাটসহ বিভিন্ন ধরনের যোজক কলা বা টিস্যু ও যৌন হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সাহায্য করে। এ ছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ কোলেস্টেরল ও কার্বোহাইড্রেট পরিপাকে এবং রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখে।

সেলেনিয়াম আমাদের শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম ও প্রোটিনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। এগুলো দেহের কোষকে বিভিন্ন ধরনের আঘাত, ক্ষতি ও ইনফেকশন থেকে সুরক্ষা দেয়। এ ছাড়া প্রজনন ও থাইরয়েড হরমোনের বিপাকেও এসব প্রোটিন বিশেষ ভূমিকা রাখে।

ম্যাগনেসিয়াম অক্সিজেনকে কাজে লাগিয়ে শরীরে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি গ্লুকোজ ভেঙে শক্তি উৎপাদনের জন্যও প্রয়োজনীয়।

শর্করা

পূর্ণশস্য হিসেবে লাল চাল স্বাভাবিকভাবেই শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ। এই কার্বোহাইড্রেটের বেশিরভাগ আসে শ্বেতসার বা স্টার্চ থেকে।

সাদা চালের তুলনায় লাল চালে থাকা শর্করার পরিমাণ কিছুটা কম। এ ছাড়াও সাদা চালে ফাইবারের পরিমাণ থাকে নগণ্য।

হজমের প্রক্রিয়ায় শ্বেতসার জাতীয় খাবার (যেমন: ভাত, আলু ও রুটি) ভেঙে সুগার বা গ্লুকোজ তৈরি হয়। এভাবে শ্বেতসার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। লাল চাল ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় হজম হতে বেশি সময় লাগে এবং রক্তের সুগার তুলনামূলক ধীর গতিতে বাড়ে। একারণে সাদা চালের তুলনায় লাল চাল বেশি স্বাস্থ্যকর। 

ফাইবার ও সুগার

প্রতি কাপ লাল চালে ৩.১২ গ্রাম ফাইবার পাওয়া যায়। অন্যদিকে সুগার থাকে না বললেই চলে। ফাইবার খাদ্য পরিপাক প্রক্রিয়ায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতিরিক্ত ওজন, কোষ্ঠকাঠিন্য, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও পাইলস এর মতো সমস্যা প্রতিরোধেও ফাইবারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

পড়ুন: ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার

প্রোটিন

প্রোটিন বা আমিষ কোষের প্রায় সব ধরনের কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্তবয়স্কদের নিজ দেহের প্রতি কেজি ওজনের জন্য দৈনিক গড়ে ১ গ্রাম করে প্রোটিন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থাৎ ৬০ কেজি ওজনের একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ৬০ গ্রাম প্রোটিন খাওয়া উচিত।

কোনো চালেই সাধারণত উচ্চ মাত্রায় প্রোটিন থাকে না। উচ্চ মাত্রায় না হলেও, লাল চালে বেশ কিছুটা প্রোটিন পাওয়া যায়। লাল চালের এক কাপে ৫.৩২ গ্রাম প্রোটিন থাকে।

লাল চাল খাওয়ার ঝুঁকি

আর্সেনিক

সাধারণ চালের মতো লাল চালেও সামান্য আর্সেনিক থাকে। এই ক্ষুদ্র পরিমাণ আর্সেনিক ক্ষতিকর নয়। তবে বছরের পর বছর একটানা লাল চাল খাওয়া চালিয়ে গেলে সেটি বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছাতে পারে।

আর্সেনিকের ঝুঁকি কমাতে চাইলে চাল বেশি করে পানি দিয়ে রান্না করে খাওয়া যায়। যেমন, নির্দিষ্ট পরিমাণ লাল চালে ৬ গুণ পানি দিয়ে রান্না এবং ভাত সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর অতিরিক্ত পানি ফেলে দিয়ে খেলে আর্সেনিকের পরিমাণ কমে যায়। এ ছাড়া লাল চালের পাশাপাশি অন্যান্য পূর্ণশস্য (যেমন: লাল আটার রুটি) খেলেও আর্সেনিকের ঝুঁকি কমে।

অ্যালার্জি

যদিও চালে সাধারণত অ্যালার্জি দেখা যায় না, কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। লাল চালে অ্যালার্জি থাকলে বমি বা পেট খারাপ হতে পারে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে, র‍্যাশ অথবা মুখ, ঠোঁট বা জিহ্বা ফুলে যেতে পারে। আপনার যদি মনে হয় চালে আপনার অ্যালার্জি রয়েছে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।