সিজার বা সিজারিয়ান সেকশন একটি বড় অপারেশন। কখন শিশুর ডেলিভারির জন্য সিজার করাতে হয়, কেমন খরচ হয়, সেরে উঠতে কতদিন লাগে, কবে থেকে সহবাস করা যায়, পরবর্তী গর্ভধারণে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব কী না—এমন অনেকগুলো কমন জিজ্ঞাসার উত্তর নিয়ে এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হয়েছে।
সিজার পূর্বপ্রস্তুতি
সাধারণত গর্ভাবস্থার ৩৯তম সপ্তাহের পর সিজার অপারেশন করার পরিকল্পনা করা হয়। এর কারণ হলো, ৩৯ সপ্তাহের আগে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।[১] যেমন: শ্বাস নিতে কৃত্রিম সহায়তার প্রয়োজন পড়তে পারে, যার জন্য তাদের স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে বা নিওনেটাল আইসিইউতে রাখতে হয়। তবে কোনো জরুরি অবস্থা (যেমন: প্রিএক্লাম্পসিয়া) সৃষ্টি হলে মা ও গর্ভের শিশুর মৃত্যুঝুঁকি কমাতে আরও আগে সিজার করার প্রয়োজন হতে পারে।
শিশু আকারে বড় হলে নরমাল ডেলিভারি করানো কঠিন হয়ে পড়ে। সাধারণত জন্মের সময়ে একটি সুস্থ বাচ্চার ওজন ২.৫ থেকে ৪ কেজির মধ্যে হয়ে থাকে। গর্ভের শিশুর ওজন যদি ৪ কেজির বেশি হয়, তাহলে সাধারণত শিশু আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত বড় বলে ধরা হয়।[২] এমন ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারি করলে বিভিন্ন জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারির প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
সিজারের খরচ সরকারি হাসপাতালে এক রকম, বেসরকারি হাসপাতালে আরেক রকম। বেসরকারি হাসপাতালে বা চেম্বারে কোন ডাক্তার অপারেশন করছেন সেটার ভিত্তিতেও খরচ কম-বেশি হতে পারে। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ান সেকশন করতে আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে ২ থেকে ১২ হাজার টাকার মতো লাগতে পারে। গড়ে ৭ হাজার টাকার মতো খরচ হয়।
বেসরকারি হাসপাতালে সিজার করাতে সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে থাকে।[৩] তবে কোনো জটিলতার কারণে রোগীকে আইসিইউ অথবা HDU-তে রাখতে হলে খরচ অনেকখানি বেড়ে যেতে পারে। এসব বিবেচনা করে হাসপাতালে যাওয়ার আগে থেকে এবং সম্ভব হলে গর্ভকালীন সময় থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।
সিজার অপারেশনের কাটা সেলাই করতে মূলত দুই ধরনের সার্জিক্যাল সুতা ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এমন সুতা ব্যবহার করা হয় যা শরীরের সাথে মিশে যায়, আলাদা করে কাটানোর প্রয়োজন হয় না। এগুলোকে সচরাচর ‘কসমেটিক সেলাই’ বলা হয়।
আবার কিছু ক্ষেত্রে এমন সুতা ব্যবহার করা হয় যা অপারেশনের কয়েকদিন পর কাটিয়ে নিতে হয়। এটাকে অনেকে ‘নরমাল সেলাই’ বলেন। সার্জন কিছু বিষয় বিবেচনা করে আপনার জন্য কোনটা ভালো হবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন। যেমন: কী ধরনের অপারেশন হচ্ছে, অপারেশনের সময়ে বিশেষ জটিলতা হয়েছে কি না, আপনার বিশেষ কোনো পছন্দ আছে কি না।
উল্লেখ্য, অপারেশনের কাটা বন্ধ করতে সার্জিক্যাল সুতার পরিবর্তে অথবা সুতার পাশাপাশি সার্জিক্যাল স্টেপলার ও সার্জিক্যাল গ্লু ব্যবহার করা হতে পারে। স্টেপলার ব্যবহার করা হলে অপারেশনের কয়েকদিন পর তা তুলে ফেলতে হয়।
নরমাল সেলাই অথবা স্টেপলার ব্যবহার করলে কতদিন পরে সেলাই কাটতে হবে সেটা হাসপাতাল থেকে দেওয়া ছুটির কাগজে লিখিয়ে নিবেন।
গর্ভবতীর হার্টের রোগ থাকলে যে সিজার করতেই হবে, নরমাল ডেলিভারি একেবারেই সম্ভব হবে না—বিষয়টি এমন নয়।[৪] আপনার সিজার করাতে হবে কি না, তা নির্ভর করবে হার্টের রোগের ধরন ও গর্ভকালীন অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকির মতো কিছু বিষয়ের ওপরে।
এসব বিবেচনায় রেখে গর্ভাবস্থাতেই আপনার ডেলিভারির উপযুক্ত পদ্ধতি কোনটি, তা নিয়ে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিন। সেই অনুযায়ী ডেলিভারির পরিকল্পনা তৈরি করে রাখুন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: কখনো কখনো হার্টের রোগ আছে এমন মায়েদের নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা সফল না হলে ইমারজেন্সি সিজারিয়ান অপারেশন করানোর প্রয়োজন হতে পারে।
সিজার পরবর্তী সমস্যা
সাধারণত সিজারিয়ান অপারেশন খুবই নিরাপদ একটি অপারেশন। তবে অন্য সব বড় অপারেশনের মতো এখানেও কিছু ঝুঁকি রয়েছে। ঝুঁকির মাত্রা নির্ভর করে আপনার শারীরিক অবস্থা ও সিজারের ধরনের ওপর।
সিজার অপারেশনের পর একটি অন্যতম সমস্যা হলো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে তুলনামূলকভাবে দেরি হওয়া। যেমন: ভারী কাজ, ভারী ব্যায়াম ও সহবাস। এ ছাড়া অপারেশন সংক্রান্ত আরও কিছু সমস্যা হতে পারে। যেমন: কাটা স্থানে ব্যথা, ইনফেকশন, প্রস্রাব ছুটে যাওয়া, যোনিপথে ভারী রক্তক্ষরণ, অপারেশনের ঘায়ে ইনফেকশন, রক্ত জমাট বেঁধে গুরুতর জটিলতা হওয়া, পরবর্তী গর্ভধারণের সময়ে জটিলতার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি।
সিজারের পর অপারেশনের জায়গায় কয়েকদিন বেশ ব্যথা থাকবে। কারও কারও ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যথা থাকতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যথানাশক হিসেবে প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন বেছে নিতে পারেন। এগুলো ‘ওভার দা কাউন্টার’ ঔষধ।
ওভার দা কাউন্টার ঔষধগুলো ফার্মেসি থেকে কিনে সাথে থাকা নির্দেশিকা অনুযায়ী সেবন করা নিরাপদ। তবে আপনার আগে থেকে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে কিংবা এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন। তা ছাড়া একটানা ব্যথা হওয়া, জ্বর কিংবা ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালেও প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন সেবন করা যায়। তবে সাধারণত অ্যাসপিরিন ও কোডেইন জাতীয় ঔষধ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সিজারের পর ইনফেকশন হলে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে। ইনফেকশন হলে অপারেশনের জায়গাটা অনেক লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া, ব্যথা হওয়া, সেখান থেকে পুঁজ বা দুর্গন্ধযুক্ত তরল বের হওয়া—এই জাতীয় লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
এ ছাড়া জরায়ু ও এর আশেপাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ইনফেকশন হলে জ্বর, পেট ব্যথা, যোনিপথে অস্বাভাবিক স্রাব ও ভারী রক্তপাতের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা করা গুরুত্বপূর্ণ।
সিজারের পর কাশি অথবা শ্বাসকষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এটা রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত মারাত্মক জটিলতার লক্ষণ হতে পারে। যদি ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেখা যায় যে সাধারণ কোনো কারণে কাশি হয়েছে, তাহলে নিশ্চিন্ত হতে পারবেন।
বাড়িতে মধু খেতে পারেন। এটি কাশি কমাতে সাহায্য করতে পারে। সেই সাথে বড় বড় শ্বাস নিয়ে কাশি দেওয়ার সময় পেটের ওপর হালকা করে বালিশ চেপে ধরতে পারেন। এতে কাশি দিলে তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম কষ্ট হতে পারে। সময়ের সাথে এই অস্বস্তি সাধারণত সহনীয় হয়ে আসে।
সিজারের পর কয়েকদিন বেশ ব্যথা বা অস্বস্তি বোধ করা স্বাভাবিক। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে সিজারের পর দীর্ঘ সময়ের জন্য—এমনকি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যথা থাকতে পারে। একটানা ব্যথা হলে, জ্বর কিংবা ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
অপারেশনের পর যোনিপথ দিয়ে কিছুটা রক্ত যেতে পারে। প্রায় ১–১.৫ মাস এমন রক্ত অথবা স্রাব যেতে পারে। এ ছাড়া কিছুটা চাকা চাকা রক্ত যেতে পারে, সাথে পেট কামড়াতে পারে। এজন্য ম্যাটারনিটি প্যাড বা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারেন। এসময়ে ইনফেকশন এড়াতে কয়েক সপ্তাহ যোনিপথে ট্যাম্পনের মতো কিছু ব্যবহার করা অথবা সহবাস করা থেকে বিরত থাকুন।[৫]
ভারী রক্তপাতের বিষয়ে সতর্ক থাকুন। ১ ঘন্টায় যদি ২টা প্যাড পুরোপুরি ভিজে যায়, আর এভাবে ১–২ ঘন্টার বেশি সময় ধরে রক্তপাত হতে থাকে, তাহলে ভারী রক্তপাত ধরা হয়।[৬] এমন হলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
সিজার পরবর্তী সুস্থতা লাভ
সিজারিয়ান অপারেশনের পর যত দ্রুত সম্ভব হালকা কাজকর্মে ফিরে গিয়ে নিজেকে সক্রিয় রাখতে হবে। হালকা হাঁটাহাঁটি দিয়ে শুরু করতে পারেন। এসময়ে অপারেশনের কাটা স্থানের যত্ন নিতে হবে। ব্যথা থাকলে প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন সেবন করতে পারেন। যোনিপথে হালকা রক্তপাত হতে পারে, এজন্য স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করবেন।
একদিকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিবেন, অন্যদিকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে চেষ্টা করবেন। প্রচুর পানি পান করবেন। পরিমাণমতো পুষ্টিকর খাবার খাবেন। নিয়মিত ব্যায়াম করবেন। কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
পড়ুন: সিজারের পর সেরে ওঠা
যদি সিজারের সময়ে শরীরের সাথে মিশে যায় এমন ‘কসমেটিক’ সুতা ব্যবহার না করে ‘নরমাল’ সুতা ব্যবহার করা হয়, তাহলে সাধারণত অপারেশনের ৫–৭ দিন পর সেলাই কাটার পরামর্শ দেওয়া হয়। আপনার ছুটির কাগজে এই সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া থাকবে। বাড়ি ফেরার আগে ছুটির কাগজে এই সংক্রান্ত নির্দেশনা স্পষ্টভাবে লেখা আছে কি না তা দেখে নিন।
সিজারের সময়ে কাটা অংশ পুরোপুরি শুকাতে প্রায় ৬ সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। তবে এই সময়টা বাঁধাধরা নয়, একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হয়ে থাকে।
সময়ের সাথে সাধারণত সিজারের দাগ নিজে থেকে মিলিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশি মায়েদের ত্বকে বাদামি কিংবা সাদাটে একটা ফ্যাকাসে দাগের মতো থেকে যেতে পারে। এজন্য আলাদা করে কিছু ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। সাধারণ সময়ের মতো শরীরের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি পেটে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন।
দাগ কমানোর ক্রিম নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও সিজারের দাগ কমানোর ওপর এসবের প্রভাব নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। এগুলো আদৌ কাজ করে কি না সেই বিষয়ে তেমন তথ্য-প্রমাণ নেই।
দাগ কমানোর জন্য কেউ কেউ সিলিকন জেল ব্যবহার করেন। সিলিকন জেল শক্ত দাগকে নরম করতে এবং স্বাভাবিক ত্বকের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করতে পারে বলে কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে।[৭] তবে এগুলো বেশ দামি হয়। ব্যবহার করতে চাইলে কেনার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
এ ছাড়া অন্যান্য অপশনের মধ্যে রয়েছে ম্যাসাজ, স্টেরয়েড ইনজেকশন, লেজার ও দাগ কমানোর সার্জারি। এগুলোর কোনোটাই জরুরি নয়। তবে আপনি চাইলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এসবের মধ্যে একটি অপশন বেছে নিতে পারেন।
সিজারের পর কোমরে ম্যাটারনিটি বেল্ট পরলে তা আদৌ দ্রুত সেরে উঠতে কিংবা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে কি না, সেই বিষয়ে খুব বেশি গবেষণা নেই।[৮] যেসব গবেষণা রয়েছে, সেগুলোতে উঠে আসা প্রমাণও অনেকটা বিপরীতমুখী।[৯][১০] তাই সিজারের পর বেল্ট পরতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই।
আপনি চাইলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ম্যাটারনিটি বেল্ট ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে নরম, মোটা কাপড়ের বেল্ট ব্যবহার করা যেতে পারে, যা আপনার পেট ও তলপেট ঘিরে রেখে সাপোর্ট দিবে। এই ধরনের বেল্ট ফার্মেসিতে কিনতে পাওয়া যায়।
কেনার সময়ে ভালোমতো ফিট হয় কি না সেটা দেখে নেওয়া উচিত। কতক্ষণ ও কীভাবে বেল্ট পরতে হবে, সেটা ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন। অস্বস্তি হলে বেল্ট ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
সিজার পরবর্তী খাদ্যাভ্যাস
সিজারের পর খাবার নিয়ে সাধারণত বিশেষ কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে না। তবে কিছু খাবার হজম হতে বেশি সময় লাগে কিংবা খাওয়ার পরে পেট ফাঁপার আশংকা থাকে। এতে পেটে অস্বস্তি হতে পারে। সিজারের পর সাময়িকভাবে এগুলো এড়িয়ে চলা যায়। এমন খাবারের মধ্যে রয়েছে—
- ভাজা-পোড়া
- কার্বনেটেড ড্রিংক বা কোমল পানীয়
- চা-কফি জাতীয় খাবার
- অ্যালকোহল
- যেসব খাবারে আপনার পেট ফাঁপার প্রবণতা রয়েছে। অনেকের বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, ডাল, পেঁয়াজ ও ঢেঁড়সের মতো খাবারে এমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে
দ্রুত সেরে ওঠার জন্য একটা সুষম ও পুষ্টিকর খাবার তালিকা মেনে চলার ব্যাপারে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। সেই সাথে মনে রাখতে হবে যে, যেকোনো এক ধরনের খাবার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিলে সেই ধরনের খাবার থেকে আসা পুষ্টির অভাব দেখা দিতে পারে। এই বিষয়ে প্রয়োজনে একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন।
সিজারের পর সাধারণত সব ধরনের ফলই খেতে পারবেন। ফলমূলে থাকা ফাইবার সিজার পরবর্তী কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করবে। লেবু, আমলকী ও পেয়ারার মতো ফলে থাকা ভিটামিন সি কাটা বা ক্ষত সারাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে, এগুলো খেতে পারেন। তবে কোনো ফল খেলে যদি আপনার পেটে গ্যাস বা অস্বস্তি হয়, তাহলে সেটা এড়িয়ে চলতে পারেন।
সিজারের পর গরুর দুধ খেতে কোনো বাধা নেই। কোথাও কোথাও এমন ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, সিজারের পর দুধ খেলে ঘা শুকাতে দেরি হয়। এমন ধারণার পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই।
আপনি সিজারের পর স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি গরুর দুধ খেতে পারবেন। তবে দুধ অবশ্যই ফুটিয়ে পান করতে হবে অথবা পাস্তুরিত দুধ বেছে নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের পরে (শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়ে) মায়েদের জন্য ক্যালসিয়াম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ে ক্যালসিয়াম হাড়ের সুস্থতা বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস।[১১] তাই অন্যান্য সময়ের মতো সিজারের পরে খাবার তালিকায় নিয়মিতভাবে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার রাখার চেষ্টা করুন।
সিজারের পর আনারস খাওয়া নিয়ে বিশেষ বিধিনিষেধ নেই। আনারস পটাশিয়াম ও ভিটামিন সি-সহ বিভিন্ন ভিটামিনের ভালো উৎস।[১২] তবে কারও কারও আনারস খেলে পেটে অস্বস্তি হতে পারে। আপনার এমন হলে আনারসের পরিবর্তে পছন্দের যেকোনো ফল বেছে নিতে পারেন।
সিজারের পর মিষ্টি খাওয়া নিয়ে বিশেষ বিধিনিষেধ নেই। তবে মিষ্টি স্বাস্থ্যকর খাবারগুলোর মধ্যে একটি নয়। তাই এর পরিবর্তে ফল খাওয়া ভালো। আস্ত ফলে থাকা মিষ্টি শরীরে সাধারণ চিনির মতো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না।[১৩] তা ছাড়া ফলে অনেক ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানও থাকে, যা শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
মিষ্টি যদি খেতেই হয়, তাহলে যতটুকু না খেলেই নয়, ততটুকু খাবেন।
সিজার পরবর্তী যৌনস্বাস্থ্য
সিজারের পর সাধারণত প্রায় ১.৫ মাস সহবাস থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। সিজারের পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার সময়ে আপনার ডাক্তারের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করে নিন এবং কোনো বিশেষ বিধিনিষেধ আছে কি না তা জেনে নিন। এই আলোচনার সময়ে আপনার সঙ্গীকে সাথে রাখতে পারেন।
সহবাস থেকে বিরত থাকার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সহবাস করা নিয়ে শারীরিক কিংবা মানসিক অস্বস্তি হলে আপনার সঙ্গীর সাথে খোলাখুলি আলোচনা করুন। সেই সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
সিজারের কতদিন পর থেকে আবার মাসিক শুরু হবে তা কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন, মা যদি শিশুকে বুকের দুধ না খাওয়ান অথবা বুকের দুধের পাশাপাশি ফর্মুলা খাওয়ান, তাহলে ডেলিভারির ৫–৬ সপ্তাহ পরই মাসিক শুরু হয়ে যেতে পারে।
আর মা যদি শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ান, তাহলে শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার দেওয়া শুরু করার আগ পর্যন্ত হয়তো মাসিক শুরু হবে না।
তবে সিজারের পর ঠিক কবে থেকে আপনার মাসিক শুরু হবে সেটা বের করা কঠিন। কেননা একেকজনের শারীরিক অবস্থা ও হরমোনের ভিত্তিতে সময়টা একেকরকম হয়।
সিজারের পর পুনরায় গর্ভধারণ
সিজারের পর সেরে উঠতে নরমাল ডেলিভারির তুলনায় বেশি সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে অপারেশনের সময়ে পেট ও জরায়ুতে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত সেরে উঠতে থাকে। তাই সিজারের পর পুনরায় গর্ভধারণ করার আগে শরীরকে সেরে ওঠার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
দুই গর্ভধারণের মাঝে যথেষ্ট বিরতি না থাকলে মা ও শিশুর বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা, এমনকি শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।[১৪]
বিশেষজ্ঞদের মতে সিজারের পর আবার বাচ্চা নেওয়ার আগে ১.৫–২ বছর অপেক্ষা করা উচিত। বিশেষ করে পরেরবার নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান প্রসবের চেষ্টা করতে চাইলে এই বিরতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, সিজারের পর ১.৫ বছর পার হওয়ার আগে পরবর্তী ডেলিভারির ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকি থাকতে পারে। এই সময়ের আগে পরবর্তী ডেলিভারির (নরমাল) প্রচেষ্টার সাথে জরায়ু ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ার সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।[১৫]
তাই আবার বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একজন ডাক্তারের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে নিন।
সিজারের মাধ্যমে প্রথম সন্তানের ডেলিভারি হয়ে থাকলে পরবর্তী সন্তানের ডেলিভারির সময়ে সিজার করাতেই হবে—এমন ধারণা সঠিক নয়। সবকিছু ঠিক থাকলে প্রথম সন্তান সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি হলেও পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হতে পারে।[১৬]
সিজার পরবর্তী স্বাভাবিক কাজকর্ম
কসমেটিক সেলাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সাধারণত সিজারের ২–৪ দিন পর থেকে গোসল করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আর যেসব ক্ষেত্রে সেলাই কাটাতে হয়, সেসব ক্ষেত্রে সেলাই কাটানোর পর গোসল করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া যেসব ক্ষেত্রে শরীর ডুবিয়ে গোসল করতে হয় (যেমন: সুইমিং পুল, পুকুর ও বাথটাব), সেখানে গোসল করার আগে ঘা শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
গোসল করার সময়ে সিজারের সেলাইয়ের জায়গায় ঘষাঘষি করবেন না। আলতো করে ঘষে পরিষ্কার করবেন। চাইলে সাবান বা বডি ওয়াশ হাতে নিয়ে আগে দুই হাতঘষে ফেনা বানিয়ে নিতে পারেন। এরপর সেলাইয়ের জায়গা সেই ফেনা দিয়ে আলতোভাবে পরিষ্কার করতে পারেন।
এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ার আগে ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন।
সাধারণত সিজারের পর বাড়ি ফেরার পর পরই আপনি হালকা কাজকর্ম করতে পারবেন এবং আপনার সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁটতে চলতে পারবেন। তবে নবজাতকের চেয়ে ওজনে ভারী কিছু বহন করা, ব্যায়াম, সহবাস কিংবা গাড়ি চালানোর মতো কসরতের কাজ করতে কমপক্ষে প্রায় ৬ সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে। আপনি যখন এসব কাজ করতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট মনে করবেন, কেবল তখনই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনের সব কাজে ফিরে আসবেন।
এই বিষয়ে যেকোনো প্রশ্ন থাকলে প্রসূতি বা পোস্টনেটাল চেকআপের সময়ে ডাক্তারকে তা জানান।
তবে অপারেশনের পর সেরে ওঠার সময়টায় একেবারে শুয়ে-বসে থাকবেন না। নিজেকে কিছুটা সক্রিয় রাখার চেষ্টা করুন। হালকা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকুন। প্রতিদিন একটুখানি হেঁটে আসুন। এতে করে রক্ত জমাট বেঁধে প্রাণঘাতী জটিলতা হওয়ার আশংকা কমবে।
সিজারের পর সাধারণত অন্তত ১.৫ মাস শরীরের ওপর চাপ পড়ে এমন কাজকর্ম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে কতদিন পর থেকে নিয়মিত যাতায়াত করা যাবে সেই বিষয়ে বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই।
এক্ষেত্রে যাতায়াতের কারণে শরীরের ওপর কেমন চাপ পড়বে কিংবা ঝাঁকুনি লাগবে কি না—এমন কিছু বিষয় বিবেচনার প্রয়োজন হয়। আপনার যদি সিজারের পর নিয়মিত যাতায়াতের প্রয়োজন হয়, তাহলে হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ার আগে এই বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
উল্লেখ্য, ডেলিভারি-পরবর্তী ৩ মাস পর্যন্ত মায়েদের রক্ত জমাট বেঁধে মারাত্মক জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।[১৭] প্লেন ভ্রমণ ও দূরপাল্লার যাত্রায় এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া সার্জারির পরে প্লেনে ভ্রমণের ব্যাপারে এয়ারলাইন্সেরও বিশেষ নিয়ম-কানুন থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারি সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হতে পারে। তাই সিজারের পর এই ধরনের যাত্রার পরিকল্পনা করার আগে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিন।