গর্ভধারণের ২১তম সপ্তাহ

এ সপ্তাহের হাইলাইটস

মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন

এ সময়ে আপনার মনে নানান ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খাওয়া স্বাভাবিক। চেষ্টা করবেন নিজেকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে। প্রয়োজনে শিশুর বাবা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও সহকর্মীদের কাছে সাহায্য চাইতে দ্বিধা বোধ করবেন না। গর্ভকালীন চেকআপের সময়ে আপনার ডাক্তারকেও মনের কথা খুলে বলতে পারেন।

ব্যায়াম করা চালিয়ে যান

নিয়মিত ব্যায়াম করা চালিয়ে যান। নতুন করে ব্যায়াম শুরু করলে একটু চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে। সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সহনশীলতা বাড়াতে চেষ্টা করুন।

ক্যালসিয়াম ও আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান

বিগত সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান। এগুলো গর্ভের শিশুর ব্রেইন, হাড় ও অন্যান্য অঙ্গ স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[১][২] পাশাপাশি আপনাকে মারাত্মক কিছু স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।[৩]

২১ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি

Week-21
সাগর কলা
আপনার বাচ্চা এখন প্রায়
একটি একটি সাগর কলা
এর সমান
দৈর্ঘ্য
২৬.৭ সেমি
ওজন
৩৫০ গ্রাম

এ সপ্তাহে আপনার গর্ভের শিশু মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রায় ২৬.৭ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে গিয়েছে—প্রায় একটি সাগর কলার সমান। তার ওজন এখন প্রায় ৩৫০ গ্রাম।

ছোট্ট সোনামণি এখন স্বাদ বুঝতে পারে

আপনার শিশুর জিভে ছোট্ট ছোট্ট টেস্ট বাড বা স্বাদ কোরক তৈরি হয়েছে।[৪] এই স্বাদ কোরকের সাহায্যে সে এখন স্বাদ বুঝতে শুরু করেছে। গর্ভে শিশু যে পানির মধ্যে আছে, সেই পানি সে অল্প অল্প করে গিলে নেয়।[৫] এই পানিতে মিষ্টি বা তেঁতো স্বাদ সে এখন ধরতে পারে।[৬]

আপনি যে ধরনের খাবার খাচ্ছেন, সেসব খাবারের স্বাদ শিশু বুঝতে শুরু করেছে। বড় হয়ে সে কোন ধরনের খাবার পছন্দ করবে, তার ওপর আপনার এখনকার খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব পড়তে পারে।[৭] তাই নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।

নড়াচড়া ক্রমশ বাড়ছে

আপনার গর্ভে শিশুর চঞ্চলতা বেড়েই চলেছে। গর্ভের ভেতরে সে হয়তো লাথি দিচ্ছে এবং দিন দিন তার লাথিগুলো আরও শক্তিশালী হচ্ছে।[৮]

ছোট্ট সোনামণির মাঝে মধ্যে হেঁচকি উঠতে পারে

শিশু হয়তো এখন মাঝে মাঝে হেঁচকি তুলছে। মজার বিষয় হলো, সে যখন হেঁচকি তোলে তখন আপনি পেটের ভেতরে হালকা ঝাঁকুনির মতো নড়াচড়া অনুভব করতে পারেন।[৯]

২১ সপ্তাহে মায়ের শরীর

গর্ভধারণের ২১তম সপ্তাহ

আপনি গর্ভাবস্থার প্রায় অর্ধেকটা সময় পার করে ফেলেছেন! আপনাকে অভিনন্দন!

পঞ্চম চেকআপ

আপনার পঞ্চম গর্ভকালীন চেকআপের সময় হয়ে এসেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আপনাকে গর্ভাবস্থার ২৮তম সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে একবার করে চেকআপে যেতে হবে। এরপর ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি ২ সপ্তাহে একবার, তারপর প্রসবের আগ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে একবার চেকআপে যেতে হবে।

তাই এই মাসে কখন চেকআপ করাবেন, তা ঠিক করে ফেলুন এবং ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিয়ে নিন।

ঝলমলে চুল

গর্ভাবস্থায় শরীরের নানান পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে আপনার চুলেও বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। হয়তো আপনার চুল আগের চেয়ে ঘন, মজবুত ও ঝলমলে হয়ে যাচ্ছে এবং দ্রুত বড় হচ্ছে।

তবে প্রসবের পর অনেকে চুল পড়ার সমস্যায় ভুগে থাকেন। শরীরে গর্ভাবস্থার হরমোনগুলো কমে আসার কারণে এমনটা হয়ে থাকে।[১০] এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রসবের ৬ মাসের মধ্যে চুল আগের অবস্থায় ফিরে আসে।[১১]

গর্ভাবস্থায় পাইলস বা অর্শ

গর্ভাবস্থায় পাইলস বা অর্শ খুব কমন সমস্যা। একে ডাক্তারি ভাষায় ‘হেমোরয়েড’ বলা হয়। মলদ্বারের অথবা পায়খানার রাস্তার ভেতরের কিংবা আশেপাশের রক্তনালীগুলো ফুলে গোটার মতো হয়ে যায়। এতে পায়খানার পর রক্ত যেতে পারে, মলদ্বারের চারপাশে ব্যথা হতে পারে, মলদ্বার দিয়ে গোটার মতো কিছু বেরিয়ে আসতে পারে।

গর্ভকালীন সময়ে হরমোনের তারতম্যের জন্য রক্তনালীগুলো শিথিল হয়ে যায়। পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও বেড়ে যায়। এসব কারণে এই সময়ে আপনার পাইলস হতে পারে।

ব্যথা কমানোর জন্য ঠাণ্ডা সেঁক দিতে পারেন। একটি প্যাকেটে কিছু বরফ নিয়ে সেটা তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে ফোলা অংশের ওপরে লাগালে আরাম লাগতে পারে।

পাইলস সারানোর কার্যকর ঘরোয়া উপায় জানতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।

ছোট্টমণির জন্য চিঠি

আপনার মনে নিশ্চয়ই ছোট্টমণিকে ঘিরে নানান চিন্তা-ভাবনা আর স্বপ্ন ঘোরাফেরা করছে। এই অনুভূতিগুলোকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে ভবিষ্যতের ছোট্টমণির কাছে চিঠির মতো করে লিখে রাখতে পারেন।

শিশু গর্ভে থাকার সময়ে কোন খাবারগুলো খেতে ইচ্ছে করছিল, তার জামাকাপড় আর ঘুমানোর জায়গা কিভাবে সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন—এমন সব মজার তথ্য সেখানে লিখে রাখতে পারেন। একদিকে আপনার মধুর স্মৃতিগুলো জমে থাকবে, অন্যদিকে শিশুর জন্য ভবিষ্যতে একটা দারুণ উপহার হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া

গর্ভকালীন সময় এবং গর্ভাবস্থার আগে ও পরে—পুরোটা সময় জুড়ে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে আপনার অল্পতেই মন খারাপ, আতঙ্কিত কিংবা হতাশ লাগতে পারে। নিজেকে একা মনে হতে পারে, যেন কেউ আপনাকে বুঝতে পারছে না। নানান অজানা আশঙ্কা ও হতাশায় মন খারাপ হয়ে যেতে পারে।

মা হতে চলেছেন বলে যে আপনি সবসময় হাসিখুশি থাকবেন, বিষয়টা এমন নয়। মন খারাপ, দুশ্চিন্তা কিংবা মানসিক চাপ অনুভব করলে নিজেকে দোষ দিবেন না।

মন ভালো রাখার জন্য প্রতিদিন ডায়েরি লিখতে পারেন। এতে করে আপনার মনের অগোছালো সব চিন্তাভাবনা গুছিয়ে উঠে মন কিছুটা হালকা লাগতে পারে। মনের কথাগুলো সঙ্গী, বন্ধু-বান্ধব অথবা পরিবারের নির্ভরযোগ্য কারও সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারেন।

মন খারাপ ও দুশ্চিন্তার বিষয়ে কোনো ধরনের সংকোচ না করে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলে তার পরামর্শ নিন। তিনি আপনার মনোবল বাড়াতে সাহায্য করতে পারেন। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করতে পারেন।

অন্যান্য লক্ষণ

এ সপ্তাহেও আগের সপ্তাহের মতো আপনার যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—

এ ছাড়া গর্ভাবস্থার প্রথমদিকের কিছু লক্ষণ থেকে যেতে পারে। যেমন—

এ সপ্তাহে বাবার করণীয়

অ্যানোমালি স্ক্যানের কথা মনে করিয়ে দিন

গর্ভাবস্থার ১৮–২২তম সপ্তাহের মধ্যে একটি বিশেষ আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করাতে হয়, যার নাম ‘অ্যানোমালি স্ক্যান’। এর সাহায্যে শিশুর জন্মগত কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা খুঁজে দেখা হয়। এখনো না করিয়ে থাকলে এ সপ্তাহেই দুইজন মিলে অ্যানোমালি স্ক্যান করানোর পরিকল্পনা করে ফেলুন।

গর্ভাবস্থায় কোন কোন খাবার খাওয়া উচিত না তা জেনে নিন

গর্ভাবস্থায় নানান রকম ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে। তাই এসময়ে কাঁচা বা ভালোভাবে রান্না হয়নি এমন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যেমন: কাঁচা বা আধাসিদ্ধ ডিম, কাঁচা দুধ, কাঁচা দুধ দিয়ে তৈরি দই-মিষ্টি-পনির। পাশাপাশি অপরিষ্কার পানি দিয়ে তৈরি খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত।[১২]

এ ছাড়াও ক্যাফেইনযুক্ত খাবার ও পানীয় (যেমন: চা, কফি, নির্দিষ্ট কিছু কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিঙ্কস) এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ ক্যাফেইন গর্ভের শিশুর নানাভাবে ক্ষতি করতে পারে। বাজার করার সময় এবং বাসায় রান্নাবান্না করার সময় এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখুন।

গর্ভাবস্থায় যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে সেগুলোর তালিকা পেতে আমাদের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা আর্টিকেলটি পড়ুন।

মানসিক সাপোর্ট দিন

আশেপাশের অনেকের কাছ থেকেই এসময়ে নানান ধরনের কথা-বার্তা শুনে শিশুর মায়ের মানসিক চাপ বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি পাশে থেকে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করুন। তাকে সাহস-সমর্থন ও ভরসা দিন। তার ভালো লাগে এমন কাজ করার চেষ্টা করুন।

দুজন বাড়ির আশেপাশের কোনো খোলামেলা জায়গায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আসতে পারেন। হাঁটতে হাঁটতে পুরনো কোনো মধুর স্মৃতির কথা ভাবতে পারেন। এতে মনের ভার কিছুটা হালকা হয়ে আসতে পারে।

নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হলে আপনি এসময়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করুন। শিশুর মা রাগ করলেও আপনি রাগ না করে তাকে বোঝার এবং বোঝানোর চেষ্টা করুন। যেকোনো সমস্যা দুইজনে মিলেমিশে সমাধানের চেষ্টা করুন।