এ সপ্তাহের হাইলাইটস
অ্যানোমালি স্ক্যান করিয়ে ফেলুন
সাধারণত গর্ভাবস্থার ১৮–২২তম সপ্তাহের মধ্যে একটি আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করতে হয়। এর নাম অ্যানোমালি স্ক্যান। এই পরীক্ষার সাহায্যে গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটি থাকলে তা খুঁজে বের করা যেতে পারে। পাশাপাশি শিশু কীভাবে বেড়ে উঠছে তাও জানা যায়। এখনো না করিয়ে থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এই সপ্তাহেই পরীক্ষাটি করে ফেলুন।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে জানাশোনা শুরু করুন
জন্মের পর থেকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ শিশুকে প্রয়োজনীয় সবটুকু শক্তি ও পুষ্টির যোগান দেয়।[১] পাশাপাশি মায়ের অনেকগুলো স্বাস্থ্য জটিলতার সম্ভাবনা কমে। যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও স্তন ক্যান্সার।[২]
যদি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে এখন থেকেই বুকের দুধ খাওয়ানোর নিয়মগুলো নিয়ে জানাশোনা শুরু করতে পারেন।
আয়রন-ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান
বিগত সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান। এগুলো গর্ভের শিশুর ব্রেইন, হাড় ও অন্যান্য অঙ্গ স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[৩][৪] পাশাপাশি আপনাকে মারাত্মক কিছু স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।[৫]
- মাসে কত দিন? ৫ মাস ২ সপ্তাহ
- কোন ট্রাইমেস্টার? দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক
- আর কত সপ্তাহ বাকি? ১৮
২২ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি
এ সপ্তাহে আপনার গর্ভের শিশু মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রায় ২৭.৮ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে গিয়েছে—প্রায় একটি মিষ্টি আলুর সমান। তার ওজন এখন প্রায় ৪৩০ গ্রাম।
ছোট্ট শিশুর মাথায় এখন চুল আছে
শিশুর চেহারা দিন দিন আরও বিকশিত হচ্ছে। চোখ-নাক-কান ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে। তার মাথায় এখন চুল গজিয়েছে।[৬] দুই চোখের ওপরে ছোটো ছোটো ভ্রু আছে।[৭]
শিশুর হার্ট খুব দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে
আমাদের হার্ট সাধারণত এক মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বার বিট করে। গর্ভাবস্থায় শিশুর হার্টের গতি প্রথমে বাড়ে, তারপর কমে আসতে থাকে।
শিশুর বয়স যখন সাত সপ্তাহ ছিল, তখন তার হার্ট মিনিটে প্রায় ১০০ বার করে স্পন্দিত হত।[৮] তারপর গতি বাড়তে বাড়তে দশম সপ্তাহের দিকে মিনিটে প্রায় ১৬০ বার করে স্পন্দন করত।[৯] এরপর গর্ভের শিশুর হার্টের গতি কমতে শুরু করে।
এই সময়ে এসে শিশুর ছোট্ট হার্ট মিনিটে প্রায় ১৪০ বার করে স্পন্দিত হচ্ছে।[১০] পরবর্তীতে জন্মের কাছাকাছি সময়ে আপনার শিশুর হার্ট মিনিটে প্রায় ১৩০ বার করে স্পন্দিত হবে।[১১]
অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণ বাড়ছে
ছোট্ট শিশুটি গর্ভের ভেতরে পানির মতো এক ধরনের তরল পদার্থের মধ্যে আছে। ডাক্তারি ভাষায় এই তরল পদার্থকে বলা হয় অ্যামনিওটিক ফ্লুইড। এই অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। শিশুর বয়স যখন ১২ সপ্তাহ, তখন এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৩০ মিলিলিটারের কাছাকাছি।[১২] এখন তা বেড়ে প্রায় ৪৫০ মিলিলিটার হয়ে গেছে।[১৩]
২২ সপ্তাহে মায়ের শরীর
বাড়তি ওজনের উৎস
গর্ভের ছোট্ট শিশু ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার কারণে গর্ভাবস্থায় আপনার ওজন বেড়ে যায়। এ ছাড়াও এসময়ে আপনার শরীরের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে, যা আপনার ওজন বাড়ায়। যেমন: শরীরে রক্ত ও পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, চর্বি বা ফ্যাট জমা হওয়া, স্তন ও জরায়ুর আকার বেড়ে যাওয়া, প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল সৃষ্টি হওয়া, গর্ভে শিশুকে ঘিরে রাখার তরল (অ্যামনিওটিক ফ্লুইড) জমা হওয়া।[১৪]
গর্ভাবস্থার কোন মাসে কতটুকু ওজন বাড়া উচিত, আদর্শ ওজন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে করণীয় কী—এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।
শোয়া-বসা থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানো
হঠাৎ করে চেয়ারে বসা অথবা বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে দ্রুত দাঁড়িয়ে যাবেন না। এতে আপনার ব্রেইনে রক্ত সরবরাহ কমে গিয়ে মাথা ঘুরাতে পারে।[১৫] তাই বসা অথবা শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে ওঠার সময়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর কথা মাথায় রাখবেন। মাথা ঘুরানোর অন্যান্য কারণ ও ঘরোয়া সমাধান জানতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।
বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা
জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য সেরা খাবার। প্রথম ৬ মাসের জন্য শিশুর যতটুকু শক্তি ও পুষ্টি প্রয়োজন, মায়ের বুকের দুধ তার সবটুকুই যোগান দেয়।[১৬] এই সময়ে আলাদা করে কোনো খাবার কিংবা পানি প্রয়োজন হয় না।
বুকের দুধে অ্যান্টিবডি থাকে, যা শিশুকে অনেকগুলো রোগ-বালাই থেকে সুরক্ষিত রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে যে বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুরা বুদ্ধির পরীক্ষায় বেশি ভালো রেজাল্ট করে।[১৭] বড় হওয়ার পর অতিরিক্ত ওজন ও ডায়াবেটিসের মতো স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি কম থাকে।[১৮],[১৯]
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে তা মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্তন ক্যান্সার, ও ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।[২০] তাই এখন থেকেই এসব বিবেচনা করে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে পারেন।
মাতৃত্বকালীন ছুটি
আপনি যদি চাকরি করেন, তাহলে আপনার কর্মক্ষেত্রের ম্যাটারনিটি লিভ বা মাতৃত্বকালীন ছুটির নিয়ম-কানুন এখনই জেনে রাখুন। গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে কতদিন ছুটি পেতে পারেন, সেসময় পুরো বেতন পাবেন কি না, অবৈতনিক ছুটির সুযোগ আছে কি না এবং থাকলে সেটা সর্বোচ্চ কতদিনের জন্য, ছুটির আবেদন করতে কী কী কাগজ প্রয়োজন, কমপক্ষে কতদিন আগে আবেদনপত্র জমা দিতে হবে—এসব বিস্তারিত জেনে নিন।
ছুটির নিয়ম-কানুনের একটা লিখিত কপি আপনার কাছে রাখুন। সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এখন থেকে সংগ্রহ করে রাখুন। সম্ভব হলে আগেভাগেই ছুটির আবেদন করে রাখুন।
অন্যান্য লক্ষণ
এ সপ্তাহেও আগের সপ্তাহের মতো আপনার যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—
- দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া ও মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
- পাইলস
- পেটের আকার বাড়ার সাথে সাথে পেটের চারপাশে ব্যথা হওয়া
- মাথা ব্যথা
- নাক থেকে রক্ত পড়া
- পেট ফাঁপা লাগা ও কোষ্ঠকাঠিন্য
- বদহজম ও বুক জ্বালাপোড়া করা
- বেশি গরম লাগা
- হাত–পা ফুলে যাওয়া
- প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন
- যোনিপথে ইনফেকশন
- মুখে মেছতার মতো বাদামি ও ছোপ ছোপ দাগ পড়া
- তৈলাক্ত ত্বক ও ত্বকে দাগ পড়া
- চুল ঘন ও ঝলমলে হওয়া
এ ছাড়া গর্ভাবস্থার প্রথমদিকের কিছু লক্ষণ থেকে যেতে পারে। যেমন—
- ঘন ঘন মনমেজাজ বদলানো বা মুড সুইং। এই খুশি, আবার এই মন খারাপ—এমনটা হতে পারে। পাশাপাশি এসময়ে ছোটোখাটো বিষয়ে মন খারাপ লাগা অথবা কান্না করে ফেলার প্রবণতা দেখা দিতে পারে
- বমি বমি ভাব
- অদ্ভুত জিনিস খাওয়ার ইচ্ছা
- স্তনে ব্যথা এবং বোঁটা থেকে দুধের মতো তরল বের হওয়া
- সাদাস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
- যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত হওয়া। এমন হলে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তার দেখাবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা কোনো মারাত্মক কারণে হয় না। তবে কখনো কখনো এটা গর্ভপাতের একটা লক্ষণ হতে পারে
এ সপ্তাহে বাবার করণীয়
পরিমাণমতো তৈলাক্ত মাছ খেতে সাহায্য করুন
আমরা নবম সপ্তাহে মাছ খাওয়ার কথা আলোচনা করেছিলাম। গর্ভবতী মা নিয়মিত মাছ খেলে শিশুর ব্রেইন ভালো হয়, আইকিউ বাড়ে, কথাবার্তায় পটু হয়, ও সবমিলিয়ে বুদ্ধিবৃত্তি নানাভাবে বিকশিত হয় বলে গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে।[২১]
মাছে যে পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, তা গর্ভের শিশুর ব্রেইন ও চোখের রেটিনা গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[২২] তাই শিশুর মায়ের পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ খাওয়া হচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে পারেন।
আপনার ওপর যদি বাজার করার দায়িত্ব থাকে, তাহলে নিয়মিত মাছ কিনে আনুন। এমন পরিমাণে মাছ কিনবেন যেন শিশুর মায়ের সপ্তাহে অন্তত ৩০০ গ্রামের মতো মাছ খাওয়া হয়। কেনার সময়ে এক ভাগ সাধারণ মাছ, আরেক ভাগ ইলিশ, চাপিলা অথবা পুঁটির মতো তৈলাক্ত মাছ কেনার চেষ্টা করবেন।[২৩] পরিবারের অন্য কেউ বাজার করলে তার সাথে এ নিয়ে আলাপ করবেন।
মাথা ঘুরানো কমাতে কিছু বিষয় খেয়াল রাখুন
মাথা ঘুরানোর সমস্যা কমাতে আপনি ছোটো ছোটো কিছু সাহায্য করতে পারেন। উপুড় হয়ে কোনো কাজ করলে বা লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকলে এই সমস্যা আরও বাড়তে পারে। তাই শিশুর মায়ের যদি উপুড় হয়ে বা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কোনো কাজ করা লাগে, আপনি সেই কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারেন। নিচে কোনো কিছু পড়ে থাকলে, আপনি সেটি তুলে দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। জুতা পরার সময়ে তাকে একটি চেয়ার অথবা টুল এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
ডেলিভারির জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিন
আপনাদের সন্তানের জন্ম হতে আরও কয়েক মাস বাকি আছে। তারপরও বিভিন্ন ব্যস্ততায় সময়টা হয়তো খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাবে। তাই এখন থেকেই অল্প অল্প করে ডেলিভারির জন্য প্রস্তুতি নিন। কোন হাসপাতালে ডেলিভারি হবে, সঙ্গীকে কীভাবে সেখানে নিয়ে যাবেন, সাথে কে কে যাবে, কী কী নিতে হবে—এসব নিয়ে দুজন মিলে আলোচনা শুরু করতে পারেন।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে শিশুর মায়ের মতামত এবং তার স্বস্তিকে প্রাধান্য দিন।
ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে যাওয়ার আগে কী কী মনে রাখা প্রয়োজন জানতে এই লেখাটা পড়তে পারেন।