আপনার কি ইদানীং ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হচ্ছে? দিনে, এমনকি রাতেও কিছুক্ষণ পরপরই প্রস্রাবের বেগ আসছে?
খুব বিরক্তিকর হলেও ঘন ঘন প্রস্রাব করা গর্ভাবস্থার কমন একটি লক্ষণ। গর্ভাবস্থায় সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রস্রাবের হারও কমবেশি হতে দেখা যায়।
গর্ভাবস্থায় কখন থেকে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া শুরু হয়?
গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই আপনার ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা শুরু হতে পারে। পরবর্তীতে গর্ভাবস্থার মাঝের তিন মাসে প্রস্রাব হওয়ার মাত্রা অন্যান্য মাসগুলোর তুলনায় কিছুটা কমেও যেতে পারে। তবে গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসের দিকে আবারও ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার হার আগের থেকে প্রায় অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।[১][২]
মাঝেমধ্যে প্রস্রাবের পরিমাণ অনেক কম হলেও বারবার বেগ আসার কারণে বাথরুমে যাওয়া লাগে। কখনো কখনো হাঁচি-কাশি দিলে অথবা জোরে হাসলে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে সামান্য প্রস্রাব বেরিয়ে আসতে পারে। আবার ব্যায়ামের কিংবা ভারী কিছু তোলার সময়েও এমন হতে পারে। তবে সাধারণত সন্তান প্রসবের পরে ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যায়।
গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব কেন হয়?
গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে—
- গর্ভাবস্থার প্রথম কিছু সপ্তাহে শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোনের মাত্রার পরিবর্তনের কারণে কিডনির প্রস্রাব তৈরি করার ক্ষমতা অনেকখানি বেড়ে যায়। ফলে কিডনি আরও বেশি করে প্রস্রাব তৈরির কাজ করে।[৩]
- গর্ভে শিশুর অবস্থানের কারণেও প্রস্রাবের বেগ আগের থেকে বেড়ে যেতে পারে। সাধারণত গর্ভাবস্থার শেষের দিকে শিশু আগের চেয়ে অনেকটা বড় হয়ে যায়। সেসময়ে তার মাথা মূত্রথলিতে চাপ দেওয়া শুরু করে। ফলে গর্ভধারণের শেষ তিন মাসেও ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা থাকতে পারে।
- এ ছাড়াও গর্ভাবস্থার প্রথম কিছু সপ্তাহে শিশু তলপেটের নিচের দিকে মূত্রথলির পেছনে থাকে। একারণে মূত্রথলীতে চাপ লেগে প্রস্রাবের বেগ বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আবার গর্ভাবস্থার মাঝের তিন মাসে শিশু তলপেটের ওপরের দিকে চলে আসে। এজন্য তখন প্রস্রাবের বেগ কিছুটা কমে যেতে পারে বলে মনে করা হয়। তবে এসবের পক্ষে এখনো তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৪]
- এ ছাড়াও এসময়ে গর্ভবতী নারীদের পা ও গোড়ালিতে পানি জমে যায়। রাতের বেলা কাত হয়ে শুলে শরীর সেখান থেকে পানি শুষে নিতে থাকে। এটিও রাতে বার বার প্রস্রাব হওয়ার একটি কারণ হতে পারে।[৫]
বিশেষ দ্রষ্টব্য
প্রস্রাবের বেগ আসলে তা চেপে রাখার চেষ্টা করবেন না। এতে ইউরিন ইনফেকশন হওয়া সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।[৬]
ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যায় ঘরোয়া সমাধান
গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। গর্ভকালীন সময়ে এই সমস্যা সম্পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব না-ই হতে পারে। তবে সন্তান জন্মের পর ধীরে ধীরে এই সমস্যা আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। তাই এটি নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করবেন না।
কিছু সহজ নিয়ম-কানুন মেনে চললে আপনি এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। যেমন—
১. প্রস্রাবের সময়ে দেহভঙ্গি
প্রস্রাব করার সময়ে কোমর একটু পেছনের দিকে বাঁকিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসুন। এভাবে ঝুঁকে বসে থাকা অবস্থাতেই সামনে-পেছনে দুলুনির মতো করে নড়াচড়ার চেষ্টা করুন। তারপর প্রস্রাব করুন। গর্ভাবস্থার শেষের দিকের সময়টায় এই পদ্ধতি মূত্রথলি ভালোভাবে খালি হতে সাহায্য করে। এতে একবার প্রস্রাব করার কিছুক্ষণ পরেই আবার প্রস্রাবের বেগ আসে না।
২. পর্যাপ্ত পানি পান করা
রাতে বারবার প্রস্রাব করার জন্য বাথরুমে যাওয়া বিরক্তিকর হতে পারে। তবে এজন্য দৈনিক পানি পান করার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া যাবে না। সমাধান হিসেবে রাতে ঘুমানোর কয়েক ঘন্টা আগে পানি পান করা থেকে বিরত থাকতে পারেন।[৭] সেই সাথে সারাদিন নিয়মিত বিরতিতে পর্যাপ্ত পানি পান করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে হয়তো ঘুমাতে যাওয়ার ঠিক আগে পানি পান করার প্রয়োজন হবে না।
উল্লেখ্য, প্রস্রাব করার জন্য রাতে বারবার বাথরুমে যেতে হলে ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। সেখান থেকে ক্লান্ত লাগতে পারে, মনমেজাজের ওপরেও প্রভাব পড়তে পারে। এজন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
খেয়াল রাখুন রাতে ঘুমানোর আগে পানি না পান করলেও দৈনন্দিন পানির পরিমাণ যেন ঠিক থাকে। গর্ভাবস্থায় শিশুর চাহিদা পূরণের জন্য অধিক পানির প্রয়োজন হয়। এজন্য গর্ভাবস্থায় অন্তত ২–৩ লিটার অথবা ৮–১২ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করতে হবে।[৮]
৩. ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলা
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় প্রস্রাবের হার বাড়াতে পারে। এজন্য কফি, চা ও কোমল পানীয়ের (যেমন: কোক, ফান্টা, সেভেনআপ ও পেপসি) মতো ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন।
জেনে রাখা ভালো
গর্ভকালীন সময়ে দৈনিক ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় পান করা অথবা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন।[৯] এর চেয়ে বেশি পরিমাণে ক্যাফেইন জাতীয় খাবার খেলে গর্ভপাত হওয়ার বা গর্ভের শিশু মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
গর্ভাবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ওজন বাড়া স্বাভাবিক। এই বাড়তি ওজন শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাড়তি ওজন স্বাভাবিক সীমার ছাড়িয়ে গেলে সেটি মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি প্রস্রাবের বেগ বাড়িয়ে দিতে পারে।[১০]
তাই গর্ভাবস্থায় যেন আপনার ওজন স্বাভাবিকের অতিরিক্ত বেড়ে না যায় সেদিকে লক্ষ রাখুন। আপনার জন্য কতটুকু ওজন বাড়া স্বাভাবিক সেটি গর্ভকালীন চেকআপের সময়ে জিজ্ঞেস করে নিন। সেই অনুযায়ী সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খান এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
৫. কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ন্ত্রণ করা
কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব ও মূথনালীর ইনফেকশনসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হতে পারে।[১১] এজন্য সুস্থ জীবনধারণের মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। যেমন: পর্যাপ্ত পানি পান করা, আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া এবং ব্যায়াম করার মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
৬. প্রস্রাবের বেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যায়াম
প্রস্রাবের বেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আপনি একটি বিশেষ ব্যায়াম করতে পারেন। এই বিশেষ ধরনের ব্যায়ামটি ‘পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ’ বা ‘কেগেল ব্যায়াম’ নামে পরিচিত।
প্রস্রাবের বেগ নিয়ন্ত্রণ করার সাথে সাথে প্রসব ও প্রসব পরবর্তী সময়েও এই ব্যায়ামটি সুবিধাজনক ফল দেয়। এই ব্যায়ামের মাধ্যমে যোনিপথ ও প্রস্রাবের রাস্তার পেশিগুলো মজবুত হয়। এর ফলে পরবর্তীতে প্রস্রাবের বেগ নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
চেষ্টা করুন দিনে এভাবে তিন সেট ব্যায়াম করতে। মনে রাখার সুবিধার জন্য প্রতিবেলা খাওয়ার আগে এক সেট ব্যায়াম করতে পারেন।
কেগেল ব্যায়াম করার জন্য নিচের পদ্ধতি অনুসরণ করুন—
- পায়খানার রাস্তা চাপ দিয়ে এমনভাবে বন্ধ করে রাখুন যেন পায়খানা আটকানোর চেষ্টা করছেন। একই সাথে যোনিপথকে চাপ দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন। প্রস্রাবের রাস্তাতেও এমনভাবে চাপ দিন যেন প্রস্রাব আটকানোর চেষ্টা করছেন।
- প্রথম কয়েকবার করার সময়ে ব্যায়ামটি দ্রুত করুন। ওপরের পদ্ধতিতে দ্রুত চাপ প্রয়োগ করুন এবং ছেড়ে দিন।
- এবার ব্যায়ামটা ধীরে ধীরে করার চেষ্টা করুন। যতক্ষণ সম্ভব হয় চাপ দিয়ে ধরে রাখুন। এভাবে চাপ ধরে রেখে ১০ পর্যন্ত গুনুন। তারপর চাপ ছেড়ে দিন।
- এরকম ভাবে আট বার চাপ দেওয়া এবং ছেড়ে দেওয়াকে এক সেট ব্যায়াম ধরা হয়।
এই ব্যায়ামটি প্রস্রাব করার সময়ে করা উচিত নয়। ব্যায়াম করতে কোনো অসুবিধা হলে অথবা নির্দেশনা ঠিকমতো বুঝতে না পারলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
যখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত
মাঝেমধ্যে ইউরিন ইনফেকশন বা ইউটিআই এর কারণেও ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে। গর্ভাবস্থায় নারীদের প্রস্রাবের ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[১২] এজন্য ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সাথে কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। লক্ষণগুলো হচ্ছে—
- প্রস্রাবের সময়ে ব্যথা অথবা জ্বালাপোড়া হওয়া
- স্বাভাবিকের চেয়ে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
- রাতে বারবার প্রস্রাবের বেগ আসা
- অস্বাভাবিক গন্ধযুক্ত অথবা ঘোলাটে প্রস্রাব হওয়া
- হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ আসা অথবা বেগ ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া
- তলপেটে ব্যথা হওয়া
- প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া
- কোমরের পেছনে পাঁজরের ঠিক নিচের অংশে ব্যথা হওয়া
- জ্বর আসা কিংবা গা গরম লাগা এবং শরীরে কাঁপুনি হওয়া
- শরীরের তাপমাত্রা ৩৬° সেলসিয়াস বা ৯৬.৮° ফারেনহাইট এর চেয়ে কমে যাওয়া
- ক্লান্তি ও বমি বমি লাগা
এসব লক্ষণ প্রস্রাবের ইনফেকশন থেকে শুরু করে কিডনির ইনফেকশনসহ বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার কারণে হতে পারে। এগুলো দেখা দিলে প্রচুর পরিমাণ পানি পান করুন এবং দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ইনফেকশন নিশ্চিত হলে ডাক্তার প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা
গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক অথবা অন্য কোনো ধরনের ঔষধ সেবন করা বিপদজনক হতে পারে। এজন্য এ অবস্থায় যেকোনো ঔষধ সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
কিডনির ইনফেকশন প্রসব সংক্রান্ত জটিলতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।[১৩] এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করা জরুরি।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
কখনো কখনো গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। এর পাশাপাশি ঘন ঘন পিপাসা পাওয়া, ক্লান্ত লাগা এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়া—এ ধরনের অনুভূতিও হতে পারে। এগুলো গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এর লক্ষণ৷
তাই আপনি আগে থেকেই ডায়াবেটিসে ভুগলে অথবা গর্ভকালীন সময়ে তীব্র ঘন ঘন প্রস্রাবের সাথে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণ থাকলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাবের হওয়া প্রতিরোধ করা না গেলেও ওপরের প্রস্রাবের বেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যায়াম করে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে।
সাধারণত গর্ভাবস্থার পুরো সময় জুড়েই ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারেন। তবে গর্ভাবস্থার মাঝের তিন মাস, অর্থাৎ চতুর্থ মাস থেকে সপ্তম মাস পর্যন্ত প্রস্রাবের বেগ অন্যান্য মাসগুলোর তুলনায় কম থাকে। সাধারণত শিশুর জন্মের পর থেকে প্রস্রাবের বেগ স্বাভাবিক হতে থাকে।