গর্ভধারণের ২৮তম সপ্তাহ

এ সপ্তাহের হাইলাইটস

পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন

এখন থেকে আপনাকে খাবারের পরিমাণটা বাড়িয়ে দিতে হবে। দিনে অতিরিক্ত প্রায় ৪৫০ ক্যালরি পরিমাণ খাবার খাবেন।[১] তবে গর্ভাবস্থার আগে ওজন অতিরিক্ত হলে এর চেয়ে কম পরিমাণে অতিরিক্ত খাবার খাবেন, যাতে ওজন অতিরিক্ত না বেড়ে যায়।

ভালো ঘুমের জন্য আরামদায়ক বালিশ ব্যবহার করুন

ঘুমের সময় গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ‘প্রেগন্যান্সি পিলো’ ব্যবহার করতে পারেন। এসব বালিশ বাড়ন্ত পেটকে ভালোভাবে সাপোর্ট দিয়ে ঘুম ভালো হতে সাহায্য করতে পারে।

আয়রন-ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান

বিগত সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যাবেন। এগুলো গর্ভের শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[২][৩] পাশাপাশি আপনাকে মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করতে পারে।[৪]

২৮ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি

Week-28
চিচিঙ্গা
আপনার বাচ্চা এখন প্রায়
একটি একটি চিচিঙ্গা
এর সমান
দৈর্ঘ্য
৩৭.৬ সেমি
ওজন
১ কেজি

আপনার গর্ভের শিশু এখন মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত প্রায় ৩৭.৬ সেন্টিমিটার লম্বা—প্রায় একটি চিচিঙ্গার সমান। তার ওজন এখন প্রায় ১ কেজি।

ছোট্ট শিশু চোখ মেলছে

এতদিন ছোট্ট শিশুর চোখ দুটো বন্ধ ছিল—চোখের পাতা চোখ দুটোকে ঢেকে রেখেছিল।[৫] এই সপ্তাহে প্রথমবারের মত শিশু তার চোখ মেলবে।[৬] প্রথমে আধো-আধো চোখ মেলবে। কয়েক সপ্তাহ পর পুরোপুরি চোখ খুলে তাকাবে। আর ইতোমধ্যেই সে এদিক-ওদিক চোখ নাড়াতে শিখে ফেলেছে।[৭][৮]

শিশুর চোখে পাপড়ি আছে

শিশুর ছোটো ছোটো চোখের পাতায় এখন পাপড়ি আছে।[৯] দুই চোখের ওপরে ভ্রু আছে।[১০] তার মাথায় চুল আছে।[১১] সবমিলিয়ে ওর চেহারা দিন দিন বিকশিত হচ্ছে।

স্টেথোস্কোপের সাহায্যে হার্টবিট শোনা সম্ভব

স্টেথোস্কোপের সাহায্যে এখন শিশুর হার্টবিট শোনা যায়। এবারের চেকআপে গেলে ডাক্তারকে বললে হয়তো তিনি আপনাকেও স্টেথোস্কোপের মাধ্যমে শিশুর হার্টবিট শোনাতে পারবেন।

২৮ সপ্তাহে মায়ের শরীর

গর্ভধারণের ২৮তম সপ্তাহ

ভালো ঘুমের রহস্য: আরামদায়ক বালিশ

গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।[১২][১৩] ঘুমাতে যাওয়ার সময়ে আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করে নিলে তা ভালো ঘুম হতে সাহায্য করতে পারে।

এসময়ে আপনার বাড়ন্ত পেট ও শরীরকে ভালো সাপোর্ট দিতে বিশেষভাবে তৈরি ‘প্রেগন্যান্সি পিলো’ ব্যবহার করে দেখতে পারেন। এগুলো অনলাইনে ও বড় বড় দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। অনেকে এসব বালিশ ব্যবহার করে এত আরাম পান যে, প্রসবের পরবর্তী সময়েও এগুলো ব্যবহার করা চালিয়ে যান।

ছবি: প্রেগন্যান্সি পিলো

বাড়তি খাবার খাওয়া

গর্ভাবস্থার শেষ ৩ মাসে, অর্থাৎ ৭ মাস থেকে ৯ মাসে, একজন গর্ভবতী মাকে সাধারণ সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত প্রায় ৪৫০ ক্যালরি পরিমাণ খাবার খেতে হয়।[১৪] তবে গর্ভাবস্থার আগে ওজন অতিরিক্ত হলে এর চেয়ে কম পরিমাণে অতিরিক্ত খাবার খাবেন। এই বিষয়ে আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে বিস্তারিত পরামর্শ নিন।[১৫]

তাই এখন থেকে আপনার খাবারের পরিমাণটা বাড়িয়ে দিন। আপনার ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কোন ধরনের বাড়তি খাবার বেছে নেওয়া উচিত, সেটা জানতে আমাদের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা দেখে নিতে পারেন।

ভুলে যাওয়ার প্রবণতা সমাধানের টিপস

এসময়ে আপনি আগের চেয়ে কিছুটা বেশি ভুলোমনা হয়ে যেতে পারেন।[১৬] গর্ভাবস্থায় এমন হওয়া কমন, তাই দুশ্চিন্তা করবেন না। টেনশন কমাতে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো কাগজে লিখে রাখতে পারেন। একটা চেকলিস্ট বানিয়ে রাখলে ভুলে কাজ বাদ পড়ার সম্ভাবনা এড়াতে পারবেন। যেমন, বাজার করার আগে একটা লিস্ট বানিয়ে নিয়ে গেলে জরুরি কিছু কিনতে ভুলে যাওয়ার টেনশন থাকবে না।

ওষুধপত্র সময়মতো খাওয়ার জন্য ফোনে অ্যালার্ম বা রিমাইন্ডার সেট করতে পারেন। ডায়েরিতে প্রতিদিনের জন্য একটি চেকলিস্টও তৈরি করতে পারেন। লিস্টটা আপনার সঙ্গীর সাথে শেয়ার করলে তিনিও বিভিন্ন সময়ে আপনাকে ঔষধ খাওয়ার কথা মনে করাতে পারবেন।

এই সম্বন্ধে আরও জানতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।

অ্যান্টি ডি ইনজেকশন নেওয়া

যদি মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হয় (যেমন: A -ve) এবং গর্ভের শিশুর রক্তের গ্রুপ পজিটিভ হয় (যেমন: A +ve), তাহলে গর্ভের শিশুর মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতার আশংকা থাকে। ডাক্তারি ভাষায় এই ঘটনাকে ‘আরএইচ (Rh) ইনকম্প্যাটিবিলিটি’ বলা হয়।

সাধারণত প্রথম গর্ভধারণে সমস্যা হয় না, তবে পরবর্তী গর্ভধারণে জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আগে থেকে রক্তের গ্রুপ জেনে ব্যবস্থা নিলে এই সংক্রান্ত জটিলতা প্রতিরোধ করতে পারবেন।

সাধারণত প্রথম গর্ভকালীন চেকআপের সময়েই আপনার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হবে। যদি আপনার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হয়, তাহলে শিশু গর্ভে থাকাকালেই আপনাকে ‘অ্যান্টি ডি’ ইনজেকশন বা আরএইচ ইমিউনোগ্লোবিউলিন নেওয়ার পরামর্শ দেয়া হতে পারে।

এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৮তম সপ্তাহে দেওয়া হয়।[১৭] অনেকসময় ৩৪তম সপ্তাহে আরেকবার ইনজেকশন দেওয়া হতে পারে। আপনার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হলে পরবর্তী চেকআপের সময়ে ডাক্তারের কাছ থেকে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।

অন্যান্য লক্ষণ

এ সপ্তাহে আপনার আরও যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—

এ ছাড়াও এই সপ্তাহে আপনার প্রথম দিকের সময়ের লক্ষণগুলো থাকতে পারে। যেমন—

এ সপ্তাহে বাবার করণীয়

রাতে এক গ্লাস দুধ গরম করে দিতে পারেন

শিশুর মায়ের রাতে ভালো ঘুম হওয়ার জন্য তাকে ঘুমের কাছাকাছি সময়ে এক গ্লাস দুধ গরম করে দিতে পারেন।[১৮] কারণ দুধে ট্রিপ্টোফ্যান থাকে, যা ভালো ঘুম হতে সাহায্য করতে পারে।[১৯]

শিশুর মায়ের ওজন ঠিকঠাক বাড়ছে কি না খেয়াল রাখুন

গর্ভধারণের আগে ওজন স্বাভাবিক হলে, পুরো গর্ভাবস্থায় শিশুর মায়ের ওজন ১১.৫ কেজি থেকে ১৬ কেজি পর্যন্ত বাড়াটা স্বাভাবিক।[২০] তবে গর্ভবতী হওয়ার আগে অতিরিক্ত ওজন হলে হিসাবটা একটু ভিন্ন। সেক্ষেত্রে গর্ভাবস্থা জুড়ে ৭ কেজি থেকে ১১.৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বাড়াটা স্বাভাবিক।[২১]

গর্ভকালীন সময়ে মায়ের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি বাড়লে মা ও শিশু দুজনেরই ক্ষতি হতে পারে।[২২] তাই শিশুর মায়ের ওজন কেমন বাড়ছে, তার হিসাব রাখতে সাহায্য করতে পারেন। বাসায় ওজন মাপার মেশিন না থাকলে একটা মেশিন কিনে নিতে পারেন।

সময়মতো অ্যান্টি-ডি টিকা নিতে সহায়তা করুন

গত সপ্তাহে আমরা টিডি টিকা নিয়ে বলেছিলাম। এর পাশাপাশি শিশুর মায়ের ‘অ্যান্টি ডি’ নামের আরেকটা ইনজেকশন নিতে হতে পারে।

শিশুর মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ কিন্তু গর্ভের শিশুর রক্তের গ্রুপ পজিটিভ—এমন শিশুদের বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা হতে পারে।[২৩] তবে সময়মতো অ্যান্টি ডি ইনজেকশন নিয়ে এই ঝুঁকি কমানো যেতে পারে।

তাই শিশুর মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হলে ডাক্তারের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করার কথা মনে করিয়ে দিন। ডাক্তার এই ইনজেকশন নেওয়ার পরামর্শ দিলে সময়মতো এই ইনজেকশন নেওয়ার ব্যবস্থা করতে সহায়তা করুন।

ভুলে যাওয়ার প্রবণতা থাকলে সঠিক সাপোর্ট দিন

শিশুর মা এখন কিছুটা ভুলোমনা হয়ে যেতে পারেন।[২৪] গর্ভাবস্থায় এমন হওয়া বেশ কমন, দুশ্চিন্তার কোনো বিষয় না। প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর লিস্ট বানিয়ে আপনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। এতে জরুরি কিছু ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কমবে।

শিশুর মায়ের সাথে কথা বলে তার কাছ থেকে বিভিন্ন ঔষধ খাওয়ার সময় জেনে নিতে পারেন। সেই শিডিউল অনুযায়ী তাকে প্রতি বেলায় প্রয়োজনীয় ঔষধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিন।

কিছু ভুলে গেলে সেটা নিয়ে তাকে কোথা শোনানো থেকে বিরত রাখুন। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এই ব্যাপারে সহনশীল হতে অনুরোধ করুন।

এই বিষয়ে আরও জানতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।

(২৪)

  1. Council, National Research, et al. Weight Gain During Pregnancy: Reexamining the Guidelines. National Academies Press, 2009.
  2. World Health Organization. Guideline: Daily Iron and Folic Acid Supplementation in Pregnant Women. WHO, 2012, pp. 3–5.
  3. World Health Organization. WHO Recommendations on Antenatal Care for a Positive Pregnancy Experience. WHO, 2016.
  4. Hofmeyr, Gj, et al. “Dietary Calcium Supplementation for Prevention of Pre-Eclampsia and Related Problems: A Systematic Review and Commentary.” BJOG: An International Journal of Obstetrics & Gynaecology, vol. 114, no. 8, Aug. 2007, pp. 933–43.
  5. Moore, Keith L., et al. “Development of Eyes and Ears.” The Developing Human: Clinically Oriented Embryology, Saunders, 2019.
  6. Moore, Keith L., et al. “Fetal Period: Ninth Week to Birth.” The Developing Human: Clinically Oriented Embryology, Saunders, 2019.
  7. Prechtl, H. F. R., and J. G. Nijhuis. “Eye Movements in the Human Fetus and Newborn.” Behavioural Brain Research, vol. 10, no. 1, Oct. 1983, pp. 119–24.
  8. Moore, Keith L., et al. “Fetal Period: The Ninth Week to Birth.” Before We Are Born: Essentials of Embryology and Birth Defects, Elsevier Health Sciences, 2019.
  9. American College of Obstetricians and Gynecologists. Your Pregnancy and Childbirth: Month to Month. American College of Obstetricians and Gynecologists Women’s Health Care Physicians, 2021.
  10. American College of Obstetricians and Gynecologists. Your Pregnancy and Childbirth: Month to Month. American College of Obstetricians and Gynecologists Women’s Health Care Physicians, 2021.
  11. Moore, Keith L., et al. “Fetal Period: Ninth Week to Birth.” The Developing Human: Clinically Oriented Embryology, Saunders, 2019.
  12. Yang, Ziyi, et al. “Association between Adverse Perinatal Outcomes and Sleep Disturbances during Pregnancy: A Systematic Review and Meta-Analysis.” The Journal of Maternal-Fetal & Neonatal Medicine, vol. 35, no. 1, Jan. 2020, pp. 166–74.
  13. Lu, Qingdong, et al. “Sleep Disturbances during Pregnancy and Adverse Maternal and Fetal Outcomes: A Systematic Review and Meta-Analysis.” Sleep Medicine Reviews, vol. 58, Aug. 2021, p. 101436.
  14. Council, National Research, et al. Weight Gain During Pregnancy: Reexamining the Guidelines. National Academies Press, 2009.
  15. Council, National Research, et al. Weight Gain During Pregnancy: Reexamining the Guidelines. National Academies Press, 2009.
  16. Davies, Sasha J., et al. “Cognitive Impairment during Pregnancy: A Meta‐analysis.” Medical Journal of Australia, vol. 208, no. 1, Jan. 2018, pp. 35–40.
  17. American College of Obstetricians and Gynecologists. “The Rh Factor: How It Can Affect Your Pregnancy.” ACOG, https://www.acog.org/womens-health/faqs/the-rh-factor-how-it-can-affect-your-pregnancy.
  18. Semple, David, and Roger Smyth. “Sleep–Wake Disorders.” Oxford Handbook of Psychiatry, Oxford University Press, USA, 2019.
  19. Hartmann, Ernest. “Effects of L-Tryptophan on Sleepiness and on Sleep.” Journal of Psychiatric Research, vol. 17, no. 2, Jan. 1982, pp. 107–13.
  20. National Research Council, et al. Weight Gain During Pregnancy: Reexamining the Guidelines. National Academies Press, 2009.
  21. National Research Council, et al. Weight Gain During Pregnancy: Reexamining the Guidelines. National Academies Press, 2009.
  22. Goldstein, Rebecca F., et al. “Association of Gestational Weight Gain With Maternal and Infant Outcomes.” JAMA, vol. 317, no. 21, June 2017, p. 2207.
  23. American College of Obstetricians and Gynecologists. “The Rh Factor: How It Can Affect Your Pregnancy.” ACOG, https://www.acog.org/womens-health/faqs/the-rh-factor-how-it-can-affect-your-pregnancy.
  24. Davies, Sasha J., et al. “Cognitive Impairment during Pregnancy: A Meta‐analysis.” Medical Journal of Australia, vol. 208, no. 1, Jan. 2018, pp. 35–40.