গর্ভধারণের ৩৪তম সপ্তাহ

এ সপ্তাহের হাইলাইটস

প্রসব ও শিশুর যত্নের বিষয়গুলো একত্রে শিখে রাখুন

প্রসব, শিশুর জন্ম, জন্মের পর তার যত্ন এবং শিশুর মায়ের যত্ন—এসব বিষয়ে দুজনে মিলে এখন থেকেই জানাশোনা শুরু করুন।

শিশুকে জন্মের পর পরই গোসল করাবেন না

শিশুকে জন্মের পর প্রথম কখন গোসল করাবেন সেই বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সাধারণত একটা সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুকে জন্মের পর প্রথমবার গোসল করানোর আগে অন্তত ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়।[১] শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গিয়ে শিশুর যেন কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা না হয়, সেজন্য অন্তত এই সময়টুকু অপেক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

এক পাশে কাত হয়ে ঘুমান

এ সপ্তাহেও ঘুমানোর সময়ে আপনার সুবিধামতো ডান অথবা বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমাবেন। কারণ চিৎ হয়ে ঘুমালে শিশুর ক্ষতি হতে পারে।[২][৩] ঘুমের সময়ে সাপোর্ট দেয় এমন আরামদায়ক কয়েকটা বালিশ নিয়ে ঘুমাতে পারেন।

আয়রন-ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান

বিগত সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যাবেন। এগুলো গর্ভের শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[৪][৫] পাশাপাশি আপনাকে মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করতে পারে।[৬]

৩৪ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি

Week-34
২টা জাম্বুরা
আপনার বাচ্চা এখন প্রায়
একটি ২টা জাম্বুরা
এর সমান
দৈর্ঘ্য
৪৫ সেমি
ওজন
২.১ কেজি

আপনার গর্ভের শিশু এখন মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার লম্বা। সে প্রায় দুইটি জাম্বুরার সমান লম্বা হয়ে গিয়েছে। তার ওজন এখন প্রায় ২.১ কেজি।

শিশুর ত্বক দিন দিন আরও মসৃণ হচ্ছে

কিছুদিন আগেও আপনার সোণামণির ত্বক কিছুটা কুঁচকানো অবস্থায় ছিল।[৭] তবে এখন তার ত্বকের নিচে চর্বির স্তর বাড়ছে।[৮] তাই ধীরে ধীরে শিশুর ত্বক আরও মসৃণ ও তুলতুলে হচ্ছে।[৯]

হাতের আঙুলের নখ তৈরি হয়ে গেছে

ছোট্ট শিশু এখন হাত দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে।[১০] তার হাতের আঙুলের নখগুলো তৈরি হয়ে গেছে। এ সপ্তাহে নখ লম্বা হয়ে আঙুলের মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।[১১]

পায়ের আঙুলের নখ বড়ো হচ্ছে

হাতের আঙুলের নখের সাথে সাথে শিশুর পায়ের আঙুলের নখগুলোও লম্বা হচ্ছে। তবে সেগুলো এখনো আঙুলের মাথা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। পায়ের নখ পুরোপুরি লম্বা হতে আরও চার সপ্তাহের মতো সময় লাগবে।[১২]

৩৪ সপ্তাহে মায়ের শরীর

গর্ভধারণের ৩৪তম সপ্তাহ

অদ্ভুত স্বপ্ন

এসময়ে আপনার ঘুমের সমস্যা হতে পারে। ঘুমের সমস্যার মধ্যে আপনি হয়তো অদ্ভুত বা বিদঘুটে স্বপ্ন দেখতে পারেন। গর্ভাবস্থার এই পর্যায়ে এসে অনেকেই তাদের গর্ভাবস্থা, প্রসব ও গর্ভের শিশুকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন দেখতে পারেন। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। মনে রাখবেন, এসব অদ্ভুত স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন কেবলই স্বপ্ন, বাস্তব নয়।

শিশুর জন্মের সাথে সাথে আপনাদের জীবনে কী কী পরিবর্তন ঘটবে, তা নিয়ে হয়তো আপনার মাথায় বিভিন্ন চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব চিন্তা আর হরমোনের প্রভাবই মূলত অদ্ভুত স্বপ্নগুলোর পেছনে দায়ী।

আপনি এমন কোনো স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন দেখলে আপনার সঙ্গী ও কাছের মানুষদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করতে পারেন। এতে মাথায় ঘুরতে থাকা দুশ্চিন্তাগুলো হয়তো পরিষ্কার হয়ে আসবে। তারপরেও আপনার এই বিষয়ে দুশ্চিন্তা হলে অথবা মানসিক চাপে থাকলে বিষয়টা ডাক্তারকে জানান।

হঠাৎ করে কিছু লক্ষণ দূর হয়ে যাওয়া

আগামী কয়েক সপ্তাহে আপনার হঠাৎ করেই কিছু গর্ভকালীন লক্ষণ উধাও হয়ে গিয়েছে বলে মনে হতে পারে। শিশুর মাথা যখন তলপেটের আরও গভীরে নেমে যায়, তখন এমন হতে পারে। শিশুর তলপেটের গভীরে ডুব দেওয়ার এই ঘটনাকে ডাক্তারি ভাষায় ‘লাইটেনিং’ বলা হয়।

শিশু পেটের নিচের দিকে যাওয়ার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সময়ে ফুসফুস আবারও পুরোপুরি প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পায়। তাই যদি এতদিন আপনার শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন। এখন থেকে হয়তো শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা কমে আসবে। সেই সাথে পাকস্থলীর ওপর থেকে চাপ কমবে। তাই বুক জ্বালাপোড়ার মতো হজমের সমস্যাও সেরে যেতে পারে!

এতদিন পর এসব লক্ষণ উপশম হওয়ায় আপনি কিছুটা আরাম পাবেন। তবে এসব পরিবর্তনের মানেই যে সন্তান প্রসবের সময় একেবারে ঘনিয়ে এসেছে, তা নয়। আপনার ছোট্টমণিকে পৃথিবীর আলো দেখাতে আরও কয়েকটা সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।

যোনিপথে মিউকাস ও ‘শো’

প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসার অন্যতম লক্ষণ হলো যোনিপথ দিয়ে পিচ্ছিল মিউকাস বেরিয়ে আসা, যা আগামী কয়েক সপ্তাহে আপনি লক্ষ করতে পারেন। একে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় ‘শো’।

গর্ভাবস্থায় নারীদের জরায়ুমুখে মিউকাস জমা থাকে। প্রসবের কাছাকাছি সময়ে জরায়ুমুখ যখন খোলা শুরু করে, তখন মাসিকের রাস্তা দিয়ে সেই মিউকাস বের হতে পারে। এটা একেবারে বেরিয়ে আসতে পারে, আবার কয়েক খণ্ডেও বের হতে পারে। অনেকসময় ‘শো’ দেখা গেলেও প্রসব শুরু হতে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে।

প্রসববেদনা শুরু হলে করণীয়

প্রসববেদনা শুরু হলে যতটা সম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে হাসপাতালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিন। আপনার সাথে যাদের যাওয়ার কথা, তাদের ফোন করে প্রসববেদনা ওঠার বিষয়টা জানান। কত মিনিট পর পর ব্যথা উঠছে, একবার ব্যথা উঠলে কতক্ষণ ধরে ব্যথা থাকছে—এসব লিখে রাখতে পারেন। তাহলে প্রসব কতখানি আগাচ্ছে, তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।

আপনার সব ডাক্তারি কাগজপত্র, হাসপাতালের জন্য গোছানো ব্যাগ ও প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা সাথে করে নিয়ে যান। প্রস্তুতির এই সময়ে আপনার সঙ্গী ও বাড়ির অন্য সদস্যদের সাহায্য নিন, যেন দরকারি কিছু বাড়িতে থেকে না যায়।

হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি সম্বন্ধে আরও জানতে আমাদের এই লেখাটি পড়তে পারেন।

শিশুকে ফর্মুলা খাওয়ানো

শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো মা ও শিশু দুজনের জন্যই সবচেয়ে ভালো অপশন।[১৩] তবে নির্দিষ্ট কিছু রোগসহ বিভিন্ন কারণে সব মায়ের পক্ষে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসাবে শিশুর জন্য ফর্মুলা ফিড বেছে নিতে পারেন।

এখন থেকেই বিভিন্ন ধরনের ফর্মুলা ফিড সম্পর্কে জেনে রাখার চেষ্টা করুন। ফর্মুলা বানানোর নিয়ম কী, বানাতে কী কী সরঞ্জাম লাগে, সেগুলো কীভাবে পরিষ্কার রাখবেন, বানানোর পর শিশুকে কীভাবে খাওয়ালে ভালো হয়, চামচ না কি ড্রপার ব্যবহার করতে হবে—এমন তথ্যগুলো আগে থেকে জেনে রাখলে পরবর্তীতে অনেক ঝামেলা এড়ানো সহজ হবে।

অন্যান্য লক্ষণ

এ সপ্তাহে আপনার আরও যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—

এ ছাড়াও এ সপ্তাহে আপনার প্রথম দিকের সময়ের লক্ষণগুলো থাকতে পারে। যেমন—

এ সপ্তাহে বাবার করণীয়

আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই আপনার শিশু পৃথিবীর আলো দেখবে! এই সপ্তাহগুলোতে আমরা গর্ভাবস্থায় জেনে রাখা প্রয়োজন এমন সব তথ্যের পাশাপাশি শিশুর জন্ম-পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ করণীয়গুলোও তুলে ধরছি। এতে ডেলিভারির পর থেকেই নতুন শিশু ও শিশুর মায়ের যত্ন সম্পর্কে জানতে পারবেন।

শিশুর মা কী খাচ্ছেন সেদিকে খেয়াল রাখুন

শিশুর মা ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছেন কি না সেদিকে লক্ষ রাখুন। অনেকসময় বাড়ির অন্যদের ভাজাপোড়া, কয়েক বেলা করে চা-কফি কিংবা তেল–চর্বিযুক্ত অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস থাকতে পারে। এমন অভ্যাস থাকলে বাড়ির সবাই মিলে সেটি কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন।

বেশি বেশি ফলমূল, শাকসবজি, ও পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈলাক্ত মাছ খাওয়ার অভ্যাস করুন। খাবার ঠিকমতো সেদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রান্না হচ্ছে কি না সেদিকেও লক্ষ রাখুন।

নবজাতক শিশুকে কখন গোসল করাবেন জেনে নিন

শিশুকে কখন প্রথমবারের মতো গোসল করাবেন, সেটা ডেলিভারির পর ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিতে ভুলবেন না। সাধারণত জন্মের পর অন্তত ২৪ ঘন্টা পার হওয়ার আগে গোসল না করাতে বলা হয়।[১৪]

অনেকে বলতে পারেন যে, আগে আগে গোসল করালে শিশু ইনফেকশন থেকে সুরক্ষা পাবে। তবে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।[১৫] বরং অন্তত ২৪ ঘন্টা পার হওয়ার পর গোসল করালে শিশুর শরীর অতিরিক্ত ঠাণ্ডা হয়ে মারাত্মক জটিলতার সম্ভাবনা প্রতিরোধ করতে পারবেন।

ঘর গোছানো শুরু করতে পারেন

নতুন শিশুকে স্বাগত জানাতে এখন থেকেই প্রস্তুত হোন। আপনারা হয়তো তার জন্য ছোট্ট একটা খাট বা কট কিনবেন। তার খেলার জন্য কিছু জায়গা করবেন। ছোট্টমণির জন্য নতুন নতুন খেলনা, জামাকাপড়, ডায়াপার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনবেন। এসব রাখার জন্য আপনাদের ঘরগুলোকে প্রস্তুত করুন।

যেসব জিনিস কিংবা আসবাবপত্র বাসায় পড়ে আছে কিন্তু ব্যবহার করা হয় না, সেগুলো বাসা থেকে সরানোর ব্যবস্থা করুন। আপনার পরিচিত কারও এসবের মধ্যে কোনো কিছু প্রয়োজন কি না সেটা খোঁজ নিতে পারেন। তাদের কোনো কিছু কাজে লাগলে দিয়ে দিতে পারেন। নাহলে বাড়তি জিনিসগুলো বিক্রি করে দিতে পারেন। ধীরে ধীরে বাসা গুছিয়ে শিশুকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিন।

(১৫)

  1. World Health Organization. WHO Recommendations on Maternal and Newborn Care for a Positive Postnatal Experience. WHO, 2022, p. 114.
  2. Heazell, Aep, et al. “Association between Maternal Sleep Practices and Late Stillbirth – Findings from a Stillbirth Case-Control Study.” BJOG: An International Journal of Obstetrics & Gynaecology, vol. 125, no. 2, Nov. 2017, pp. 254–62.
  3. McCowan, Lesley M. E., et al. “Going to Sleep in the Supine Position Is a Modifiable Risk Factor for Late Pregnancy Stillbirth; Findings from the New Zealand Multicentre Stillbirth Case-Control Study.” PLOS ONE, vol. 12, no. 6, June 2017, p. e0179396.
  4. World Health Organization. Guideline: Daily Iron and Folic Acid Supplementation in Pregnant Women. WHO, 2012, pp. 3–5.
  5. World Health Organization. WHO Recommendations on Antenatal Care for a Positive Pregnancy Experience. WHO, 2016.
  6. Hofmeyr, Gj, et al. “Dietary Calcium Supplementation for Prevention of Pre-Eclampsia and Related Problems: A Systematic Review and Commentary.” BJOG: An International Journal of Obstetrics & Gynaecology, vol. 114, no. 8, Aug. 2007, pp. 933–43.
  7. Moore, Keith L., et al. “Fetal Period: Ninth Week to Birth.” The Developing Human: Clinically Oriented Embryology, Saunders, 2019.
  8. American College of Obstetricians and Gynecologists. Your Pregnancy and Childbirth: Month to Month. American College of Obstetricians and Gynecologists Women’s Health Care Physicians, 2021.
  9. Moore, Keith L., et al. “Fetal Period: The Ninth Week to Birth.” Before We Are Born: Essentials of Embryology and Birth Defects, Elsevier Health Sciences, 2019.
  10. Carlson, Bruce M. “ Fetal Period and Birth.” Human Embryology and Developmental Biology, Elsevier, 2019.
  11. Moore, Keith L., et al. “Fetal Period: The Ninth Week to Birth.” Before We Are Born: Essentials of Embryology and Birth Defects, Elsevier Health Sciences, 2019.
  12. Moore, Keith L., et al. “Fetal Period: Ninth Week to Birth.” The Developing Human: Clinically Oriented Embryology, Saunders, 2019.
  13. Centers for Disease Control and Prevention. “Five Great Benefits of Breastfeeding.” CDC, 27 July 2021, https://www.cdc.gov/nccdphp/dnpao/features/breastfeeding-benefits/index.html. Accessed 22 June 2023.
  14. World Health Organization. WHO Recommendations on Maternal and Newborn Care for a Positive Postnatal Experience. WHO, 2022, p. 114.
  15. World Health Organization. WHO Recommendations on Maternal and Newborn Care for a Positive Postnatal Experience. WHO, 2022, p. 114.