গর্ভাবস্থায় কতটুকু ওজন বাড়লে তা মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হবে, সেই হিসাবটা একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম। গর্ভধারণের আগে মায়ের ওজন ও শারীরিক গঠন কেমন ছিল, তার ওপর ভিত্তি করে গর্ভকালীন ওজন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অনেকটাই কম-বেশি হতে পারে।
সঠিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ওজন বৃদ্ধির হার কম কিংবা বেশি হলে সেটি মা ও গর্ভের শিশুর জন্য বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।[১] গর্ভাবস্থার কোন মাসে কতটুকু ওজন বাড়া উচিত, আদর্শ ওজন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে করণীয় কী, ওজন ঠিকমতো না বাড়লে কিংবা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে গর্ভের শিশুর ওপর কী প্রভাব পড়বে—এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই আর্টিকেলে তুলে ধরা হয়েছে
গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন চার্ট
গর্ভাবস্থায় কতটুকু ওজন বৃদ্ধি পাওয়া উচিত তা অনেকাংশে নির্ভর করে গর্ভধারণের ঠিক আগে আপনার ওজন স্বাভাবিক সীমায় ছিল কি না—তার ওপর। ওজন স্বাভাবিক সীমার মধ্যে ছিল কি না সেটি জানার জন্য সেই সময়ে আপনার ‘বিএমআই’ কত ছিল তা হিসাব করতে হবে। বিএমআই হিসাব করতে তিনটি সহজ কাজ করুন—
- ওজন মাপার মেশিনে আপনার ওজন কত কেজি তা দেখে নিন
- ইঞ্চি-ফিতা দিয়ে আপনার উচ্চতা মেপে নিন
- প্রাপ্ত ওজন ও উচ্চতা বসিয়ে নিচের নির্ধারিত ফাঁকা ঘর দুটি পূরণ করুন
এই ফলাফলই আপনার বিএমআই।
এবার এই বিএমআই অনুযায়ী গর্ভকালীন সময়ে আপনার বাড়তি ওজন কেমন হওয়া উচিত তা দেখে নিন।[২] আপনার গর্ভে শুধুমাত্র একটি শিশু থাকলে এই নিয়মটি আপনার জন্য প্রযোজ্য হবে।[৩] যমজ শিশুদের ক্ষেত্রে হিসাবটি ভিন্ন, যা এর পরের অংশে তুলে ধরা হয়েছে।
গর্ভধারণের ঠিক আগের বিএমআই | গর্ভধারণের আগের ওজনের ধরন | গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় বাড়তি ওজন |
---|---|---|
১৮.৫ এর কম | আন্ডারওয়েট বা অস্বাভাবিকভাবে কম ওজন | ১২.৫–১৮ কেজি |
১৮.৫ থেকে ২৪.৯ | স্বাভাবিক ওজন | ১১.৫–১৬ কেজি |
২৫ থেকে ২৯.৯ | অতিরিক্ত ওজন | ৭–১১.৫ কেজি |
৩০ অথবা তার বেশি | স্থূল বা Obese | ৫–৯ কেজি |
মোট কথা হলো, গর্ভধারণের আগে ওজন অস্বাভাবিকভাবে কম হলে, স্বাভাবিক ওজনের নারীদের তুলনায় গর্ভাবস্থায় আপনার ওজন কিছুটা বেশি বাড়ানো প্রয়োজন। তেমনি গর্ভধারণের আগে আপনার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে এই সময়ে বাড়তি ওজন তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হওয়া উচিত।
তবে আপনার যদি—
- গর্ভধারণের আগে থেকে স্থূলতা থাকে, অর্থাৎ বিএমআই ৩০ বা তার বেশি হয় এবং
- গর্ভকালীন সময়ে আপনার ওজন তেমন না-ও বাড়ে কিংবা আপনার জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ কম হয় এবং
- গর্ভকালীন চেকআপে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি দেখা যায় যে, আপনার শিশু সুস্থ–স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠছে
তাহলে কেবল আপনার ও গর্ভের শিশুর সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে ওপরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ওজন বাড়ানোর চেষ্টা না করাই শ্রেয়। কেননা ওপরের তিনটি বিষয় ঠিক থাকলে, ওজন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর মাধ্যমে মা ও শিশুর সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বাড়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।[৪]
যমজ শিশুর ক্ষেত্রে
আপনার গর্ভে যমজ শিশু থাকলে গর্ভাবস্থায় আপনার বাড়তি ওজনের পরিমাণ কিছুটা ভিন্ন হবে। গর্ভে দুটি যমজ শিশু থাকলে বিএমআই অনুযায়ী গর্ভকালীন সময়ে আপনার বাড়তি ওজন কেমন হওয়া উচিত, সেটি সহজে বোঝার জন্য নিচের ছকটি দেখুন[৫]—
গর্ভধারণের ঠিক আগের বিএমআই | গর্ভধারণের আগের ওজনের ধরন | গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় বাড়তি ওজন |
---|---|---|
১৮.৫ এর কম | আন্ডারওয়েট বা অস্বাভাবিক কম ওজন | ২২.৭–২৮.১ কেজি |
১৮.৫ থেকে ২৪.৯ | স্বাভাবিক ওজন | ১৬.৮–২৪.৫ কেজি |
২৫ থেকে ২৯.৯ | অতিরিক্ত ওজন | ১৪.১–২২.৭ কেজি |
৩০ অথবা তার বেশি | স্থূল (Obese) | ১১.৩–১৯.১ কেজি |
তবে আপনার গর্ভের শিশুর সংখ্যা তিন অথবা এর বেশি হলে বাড়তি ওজনের লক্ষ্যমাত্রা জানতে একজন গাইনী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
ত্রৈমাসিক অনুযায়ী ওজন বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে সাধারণত শরীরে নানান ধরনের পরিবর্তনের কারণে ওজন বাড়তে থাকে। যেমন: শরীরে রক্ত ও অন্যান্য তরল পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং স্তনের আকার বেড়ে যাওয়া।
সময়ের সাথে সাথে এক সময় আপনার শিশুর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ পুরোপুরি ভাবে তৈরি হয়ে যায় এবং সে আপনার গর্ভে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। তার দেহে চর্বি বা ফ্যাট জমতে শুরু করে। গর্ভধারণের ২৮তম সপ্তাহের পর থেকে মূলত গর্ভের শিশুর বেড়ে ওঠার কারণেই আপনার শরীরের ওজন বাড়তে থাকে।
এসব কারণ বিবেচনা করে গর্ভধারণের ১৩তম সপ্তাহের পর থেকে ধীরে ধীরে এবং নির্দিষ্ট হারে আপনার ওজন বাড়তে থাকলে তা আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য সবচেয়ে ভালো হয়।[৬]
গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে গর্ভবতীদের ওজন ০.৫–২ কেজি পর্যন্ত বাড়তে পারে।[৭] আবার কারও কারও ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে ওজন না-ও বাড়তে পারে।[৮]
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ ৪–৯ মাস পর্যন্ত গর্ভবতীর ওজন বাড়ার হার কেমন হওয়া উচিত তা তাদের গর্ভধারণের পূর্বের বিএমআই এর ওপর নির্ভর করে। গর্ভধারণের আগের বিএমআই অনুযায়ী নিচের ছক থেকে আপনি আপনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকের ওজন বাড়ার লক্ষ্যমাত্রা সহজেই বের করে ফেলতে পারেন—
গর্ভধারণের ঠিক আগের বিএমআই | গর্ভধারণের আগের ওজনের ধরন | প্রতি সপ্তাহে ওজন বাড়ার হার (দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিক) |
---|---|---|
১৮.৫ এর কম | আন্ডারওয়েট বা অস্বাভাবিক কম ওজন | প্রায় ০.৫ কেজি |
১৮.৫ থেকে ২৪.৯ | স্বাভাবিক ওজন | প্রায় ০.৪ কেজি |
২৫ থেকে ২৯.৯ | অতিরিক্ত ওজন | প্রায় ০.৩ কেজি |
৩০ অথবা তার বেশি | স্থূল বা ওবিজ | প্রায় ০.২ কেজি |
গর্ভাবস্থায় ঠিকমতো ওজন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা
মা ও গর্ভের শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে গর্ভাবস্থায় সঠিক মাত্রায় ওজন বৃদ্ধি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ কম-বেশি হলে মা ও শিশুর নানান ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। এমনকি শিশুর জন্মের বহু বছর পরেও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় অস্বাভাবিক কম ওজন
গর্ভকালীন সময়ে অপুষ্টি ও অন্যান্য কারণে ঠিকমতো ওজন না বাড়লে আপনার গর্ভের শিশু নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করতে পারে। ডাক্তারি ভাষায় এমন শিশুদের ‘প্রিম্যাচিউর’ বলা হয়।
একই সাথে আপনার নবজাতক শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম (২.৫ কেজির কম) হতে পারে। কম ওজনের শিশুরা জন্মের পর থেকেই অনেক দুর্বল থাকে এবং নানান ধরনের জটিলতায় ভোগে।[৯] এমনকি কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের মৃত্যুহারও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
কম ওজনের শিশুরা জন্মের পর পরই বিভিন্ন জটিলতার মুখোমুখি হয়। যেমন—
- জন্মের পর পরই শরীরের তাপমাত্রা অনেক কমে যাওয়া
- মায়ের বুকের দুধ পান করতে না পারা
- তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়া
- শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ত্রুটি হওয়া। যেমন: চোখ, হার্ট, ফুসফুস ও পরিপাক তন্ত্রের বিভিন্ন ত্রুটি
- সহজেই নানান ধরনের অসুখ–বিসুখে আক্রান্ত হওয়া
প্রিম্যাচিউর শিশুদের জন্মের পর পরই চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল কিংবা ইউনিট (যেমন: নিওনেটাল আইসিইউ), অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের প্রয়োজন হয়। সঠিক চিকিৎসার অভাবে শিশু মৃত্যুবরণ করতে পারে। এ ছাড়া এই শিশুরা বড় হওয়ার পরেও তাদের গঠন ও বিকাশে নানান ধরনের ত্রুটি দেখা যেতে পারে। যেমন—
- শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া[১০]
- প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়া[১১]
- কানে শোনা, চোখে দেখা, হাঁটা–চলা ও হাতের সূক্ষ্ম কাজ (যেমন: কলম ধরা) করতে অসুবিধা হওয়া
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস এবং সুষম খাবার তালিকা মেনে চলা সম্ভব না হলে ওজন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে। এটি মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।
এসব জটিলতার মধ্যে রয়েছে[১২]—
- উচ্চ রক্তচাপ
- প্রি-এক্লাম্পসিয়া
- গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
- রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি হওয়া
- সিজার অপারেশন করানোর প্রয়োজন হওয়া
- গর্ভপাত বা গর্ভের শিশু নষ্ট হওয়া
- প্রসবের পরে গর্ভাবস্থার আগের ওজনে ফিরে যেতে দেরি হওয়া
মায়ের পাশাপাশি গর্ভের শিশুও নানান ধরনের সমস্যায় ভুগতে পারে। যেমন—
- নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অপরিণত (প্রিম্যাচিউর) অবস্থায় জন্মগ্রহণ করা
- গর্ভের শিশুর আকার অস্বাভাবিক বড় হওয়া
- জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়া
- মৃত শিশু জন্ম হওয়া
- ভবিষ্যতে অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হওয়া
উল্লেখ্য, অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য গর্ভাবস্থায় নিয়মিত খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা যাবে না।
গর্ভাবস্থায় আদর্শ ওজন বজায় রাখতে করণীয়
১. ক্যালরি চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার খান
গর্ভধারণ করলেই যে একসাথে দুইজনের সমপরিমাণ খাবার খেতে হবে—এমনটা নয়। স্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে অস্বাস্থ্যকর, অতিরিক্ত চিনি ও তেল-চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া যতটা সম্ভব বাদ দিয়ে দিন। প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল খান।
গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসে সাধারণত বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় না।[১৩] তবে এর পরের মাসগুলোতে আপনাকে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি খাবার খেতে হবে।
প্রয়োজন মাফিক পুষ্টিকর খাবার খেলে আপনার গর্ভকালীন বাড়তি ওজন স্বাভাবিক সীমার মধ্যে থাকবে। গর্ভকালীন চেকআপের সময়ে আপনি কী ধরনের খাবার খাচ্ছেন সে বিষয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিন।
পড়ুন: ক্যালরি ও মাস অনুযায়ী গর্ভবতীর খাবার তালিকা
২. নিয়মিত নিজের ওজন মাপুন
গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই নিয়মিত নিজের ওজন মাপুন। এতে করে আপনার ওজন কী হারে বাড়ছে, সেটি সহজেই বুঝতে পারবেন। যদি প্রতি সপ্তাহে ওজন মাপেন, তাহলে সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিন ও সময় বেছে নিতে পারেন। যেমন, প্রতি শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রস্রাব করার পর খালি পেটে ওজন মাপতে পারেন। চাইলে প্রতিদিনও ওজন মাপতে পারেন, সেক্ষেত্রেও এমন নির্ধারিত সময়ে ওজন মেপে নিতে পারেন।
তবে বার বার ওজন মেপে অস্থির হয়ে যাবেন না। বিভিন্ন কারণে আপনার ওজন কম-বেশি হতে পারে। এজন্য অস্থির না হয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।প্রতি গর্ভকালীন চেকআপে আপনার ওজন ঠিকঠাক মতো বাড়ছে কি না সেই বিষয়ে তার মতামত নিন। ওজন বৃদ্ধিতে কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে খাবার তালিকা ও ব্যায়াম নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন এবং তার নির্দেশনা মেনে চলুন।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম করুন
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম করা নিরাপদ।[১৪] গর্ভবতী নারীদের সপ্তাহে ২.৫ ঘণ্টা মাঝারি তীব্রতার ‘অ্যারোবিক’ শরীরচর্চাকে করা উচিত।[১৫] এমন ব্যায়ামের মধ্যে রয়েছে দ্রুত হাঁটা, বাগান করা, সাঁতার কাটা, নাচ ও সাইকেল চালানো। গর্ভাবস্থায় আপনার পছন্দমতো এমন যেকোনো ব্যায়াম বেছে নিতে পারেন। এ ছাড়া আগে থেকে ভারী ব্যায়াম করার অভ্যাস থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সেটাও চালিয়ে যেতে পারেন।
সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট ধরে ব্যায়াম করলেই আপনি এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবেন। আবার চাইলে দিনে ১০ মিনিট ধরে কয়েক ভাগে ব্যায়াম করে নিতে পারেন। এই রুটিনের পুরোটাই নির্ভর করবে আপনার স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর।
আপনার গর্ভধারণের আগে থেকে ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। গর্ভাবস্থায় নিশ্চিন্তে ব্যায়াম করা শুরু করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে শুরু করে সময়ের সাথে আপনার সহনশীলতা বাড়ান। সহজ কিছু কাজ প্রতিদিনের রুটিনে যোগ করতে পারেন। যেমন, বাজারে কিংবা দোকানে গেলে একটু বেশি ঘুরে হেঁটে যাওয়ার রাস্তাটি বেছে নিতে পারেন। লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি বেছে নিন। মূল কথা হলো, ব্যায়ামের সব ধরনের উপকার পেতে প্রতিদিন একটু একটু করে শরীরচর্চার পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করুন এবং এটি নিয়মিত রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসুন।
তবে এসময়ে নতুন করে ভারী ধরনের কোনো ব্যায়াম শুরু না করাই ভালো। সেই সাথে যেসব এক্সারসাইজ করলে আপনার পড়ে যাওয়ার অথবা আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি থাকে (যেমন: বক্সিং, ব্যাডমিন্টন ও কারাতে) সেগুলো এসময়ে এড়িয়ে চলবেন। গর্ভাবস্থায় ঠিক কোন ধরনের এক্সারসাইজগুলো আপনার জন্য নিরাপদ হবে তা আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলে নির্ধারণ করে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়৷
গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করার সময়ে স্বাভাবিক সহ্যক্ষমতার বাইরে ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার কোনো গর্ভকালীন জটিলতা থাকলে ব্যায়াম করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতামত মেনে চলুন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় কোন ব্যায়াম নিরাপদ
গর্ভাবস্থায় ওজন বাড়ার কারণ
গর্ভের ছোট্ট শিশু ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার কারণে মূলত গর্ভাবস্থায় আপনার ওজন বেড়ে যায়।[১৬] এ ছাড়াও এসময়ে আপনার শরীরের বেশ কিছু অংশে পরিবর্তন ঘটে। এসব কারণেও আপনার ওজন বাড়তে থাকে। যেমন—
- শরীরে রক্ত ও পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
- শরীরে চর্বি বা ফ্যাট জমা হওয়া
- অ্যামনিওটিক ফ্লুইড তৈরি হওয়া, যা গর্ভের ভেতরে শিশুকে ঘিরে থাকে
- স্তনের আকার বেড়ে যাওয়া
- জরায়ুর আকার বেড়ে যাওয়া
- প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল সৃষ্টি হওয়া
সাধারণ জিজ্ঞাসা
ডায়েট: পূর্বে ওজন কমানোর জন্য কোনো বিশেষ ডায়েট করে থাকলে, গর্ভাবস্থায় সেটা চালিয়ে যেতে পারবেন কি না তা জানতে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। গর্ভাবস্থায় আপনার শিশুর গঠন ও বিকাশের জন্য সঠিক পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। বিশেষ ডায়েটে প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান সঠিক পরিমাণে না-ও থাকতে পারে। তাই এই সময়ে গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা অনুযায়ী সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খান।
তবে আপনার ওজন অনেক বেশি কিংবা কম হয়ে থাকলে, সেই অনুযায়ী আপনার খাবারের পরিমাণ কিছুটা কম–বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনাকে কোন খাবার কতটুকু খেতে হবে সেটি জানার জন্য ডাক্তার ও রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন।
ব্যায়াম: গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করা নিরাপদ ও কার্যকর।[১৭] তবে আপনি পূর্বে কী ধরনের ব্যায়াম করতেন তার ওপর নির্ভর করে যে, সেটি আপনি গর্ভকালীন সময়েও চালিয়ে যেতে পারবেন কি না। আপনার আগে থেকে ভারী ব্যায়ামের অভ্যাস থাকলে গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ মেনে সেটি চালিয়ে যেতে পারেন। তবে কিছু কিছু ব্যায়াম গর্ভকালীন সময়ে না করাই ভালো। যেমন—
– লাফঝাঁপ অথবা হঠাৎ করে দেহভঙ্গি বদলাতে হয় এমন ব্যায়াম
– পা একত্রে ওঠাতে অথবা নামাতে হয় এমন ব্যায়াম
– সিট আপ বা হাঁটু ভেঙে মাটিতে পুরোপুরি বসে আবার দাঁড়িয়ে যাওয়ার ব্যায়াম
– হাঁটু বেশি ভাঁজ করার ব্যায়াম
– পা সোজা রেখে হাতের আঙুল দিয়ে পায়ের আঙুল স্পর্শ করার ব্যায়াম
– ফ্লোরে শুয়ে থাকা কিংবা বসা অবস্থা থেকে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যাওয়া
– ভারোত্তোলনের মতো ব্যায়াম
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গর্ভাবস্থায় নতুন করে ওজন কমানোর চেষ্টা করবেন না। এটি আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য নিরাপদ না-ও হতে পারে।
গর্ভাবস্থার সাধারণত আগের চেয়ে ওজন বেড়ে যায়। তবে অনেকের গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে বমি বমি ভাব ও বমির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই সমস্যার কারণে অনেকের খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে আসে। সেক্ষেত্রে আপনার গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকে ওজন কিছুটা কমে যেতে পারে।
কিন্তু এই সময়ে আপনার গর্ভের শিশুর সুস্থ–স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে আপনার নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। তাই বেশি সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
গর্ভাবস্থায় শুধু বাচ্চার ওজন বাড়ানোর জন্য আলাদা করে আপনাকে কোনো নির্দিষ্ট খাবার খেতে হবে না। তবে এই সময়ে ছয় ধরনের খাবার খাওয়ার মাধ্যমে আপনি আপনার ও আপনার শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারেন। এই ছয় ধরনের খাবার হলো—
শর্করা জাতীয় খাবার। যেমন: ভাত ও রুটি
গাঢ় সবুজ ও রঙিন শাক
রঙিন ফল ও সবজি
ডিম
দুধ জাতীয় খাবার
মাছ, মাংস ও ডাল
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা অনুযায়ী প্রতিদিন এসব খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়ার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি নিয়ম মেনে গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় অন্যান্য পুষ্টি উপাদানযুক্ত ট্যাবলেট বা সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত সেবন করুন। যেমন: ফলিক এসিড, আয়রন ও ক্যালসিয়াম। এগুলো গর্ভের শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করতে পারে।
তবে আপনার কোনো সমস্যার কারণে খাবার খেতে অসুবিধা হলে অথবা ওজন ঠিকঠাক না বাড়লে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
গর্ভাবস্থায় চিনি জাতীয় খাবার খেলেই যে আপনি সরাসরি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন, এমন কোনো তথ্য গবেষণায় পাওয়া যায়নি।[১৮] তবে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবারে সাধারণত পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য থাকে না এবং এসব বেশি খেলে ওজন বেড়ে যায়। আর ওজন বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসসহ গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। তাই চেষ্টা করবেন সবসময় একটি সুষম খাবার তালিকা মেনে চলতে।