গর্ভধারণের ২৭তম সপ্তাহ

এ সপ্তাহের হাইলাইটস

অবিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলুন

অবিশুদ্ধ পানি পান করলে কিংবা অবিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি খাবার খেলে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা গর্ভাবস্থায় মারাত্মক হতে পারে।[১] তাই রাস্তার ধারের ফুচকা, টক, শরবত, বরফ কুচি ও অনিরাপদ পানি দিয়ে তৈরি অন্যান্য খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলুন।

নিয়মিত পেলভিক ফ্লোরের ব্যায়াম করা চালিয়ে যান

যোনিপথের আশেপাশের মাংসপেশিগুলো শক্ত করার জন্য আপনি নিয়মিত পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ বা ‘কেগেল ব্যায়াম’ করা চালিয়ে যান। কেননা এই পেশিগুলো দুর্বল হয়ে গেলে হাঁচি-কাশির সময় কয়েক ফোঁটা প্রস্রাব বেরিয়ে আসার সমস্যাসহ নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে।[২]

টিডি টিকা নিন

নিজেকে ও নবজাতককে মারাত্মক টিটেনাস বা ধনুষ্টঙ্কার থেকে রক্ষা করতে সময়মতো টিডি টিকা নিয়ে ফেলুন। সরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে আপনি বিনামূল্যে এই টিকা নিতে পারবেন। আপনি যেখানে গর্ভকালীন চেকআপ করান, সাধারণত সেখানেই টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। তাই চেকআপের দিন ডাক্তার দেখিয়ে একেবারে টিকা দিয়ে আসতে পারেন।

আয়রন-ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান

বিগত সপ্তাহগুলোর মতো এই সপ্তাহেও নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যাবেন। এগুলো গর্ভের শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[৩][৪] পাশাপাশি আপনাকে মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করতে পারে।[৫]

২৭ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি

Week-27
ধুন্দল
আপনার বাচ্চা এখন প্রায়
একটি একটি ধুন্দল
এর সমান
দৈর্ঘ্য
৩৬.৬ সেমি
ওজন
৮৭৫ গ্রাম

এ সপ্তাহে আপনার গর্ভের শিশু মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত প্রায় ৩৬.৬ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে গিয়েছে—প্রায় একটি ধুন্দলের সমান। তার ওজন এখন প্রায় ৮৭৫ গ্রাম।

শিশুর ত্বক মসৃণ হচ্ছে

এই পর্যায়ে আপনার শিশু বেশ হৃষ্টপুষ্ট হতে থাকে। কয়েক সপ্তাহ আগেও আপনার শিশুর ত্বক কুঁচকানো অবস্থায় ছিল। এখন ত্বকের সেই কুঁচকানো ভাঁজগুলো চর্বি বা ফ্যাট দিয়ে পূরণ হতে শুরু করেছে।[৬] এভাবে তার ত্বক ধীরে ধীরে মসৃণ হতে শুরু করে।

পেটে হাত বুলালে শিশু বুঝতে পারে

আপনি যদি পেটের ওপর হাত বুলিয়ে শিশুকে আদর করেন, সেটা এখন সে বুঝতে পারবে।[৭] উত্তরে সে নড়াচড়া বাড়িয়ে দিতে পারে!

শিশুর নড়াচড়ার ধরনের দিকে খেয়াল রাখবেন। নড়াচড়া স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে কিংবা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলে দেরি না করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবেন।

ছোট্ট শিশু দ্রুত বেড়ে উঠছে

গত সপ্তাহগুলোর মতো এই সপ্তাহেও শিশুর ওজন অনেকখানি বেড়ে গেছে। তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গগুলো পরিণত হচ্ছে। ত্বক আরও পুরু হচ্ছে। শরীরে চর্বি জমছে। সবমিলিয়ে সে দ্রুত বেড়ে উঠছে।[৮]

২৭ সপ্তাহে মায়ের শরীর

গর্ভধারণের ২৭তম সপ্তাহ

পানিবাহিত রোগ

এসময়ে বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। যেমন: হেপাটাইটিস ই, টাইফয়েড ও কলেরা। গর্ভাবস্থায় এসব রোগ মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে।[৯][১০][১১][১২] তাই আপনি যেসব খাবার খাচ্ছেন এবং যেসব পানীয় পান করছেন সেগুলোতে ব্যবহৃত পানি পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করুন।

পানির উৎস নিরাপদ কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে যেকোনো ধরনের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। যেমন: রাস্তার ধারের ফুচকার টক ও লেবুর শরবত।

টিডি টিকা নেওয়া

এখনো প্রথম টিডি টিকা না নিয়ে থাকলে এ সপ্তাহে টিডি টিকা নিয়ে ফেলুন। এই টিকা আপনাকে ও গর্ভের শিশুকে টিটেনাস বা ধনুষ্টংকারের মতো মারাত্মক রোগ থেকে সুরক্ষা দিবে।[১৩] সেই সাথে ডিপথেরিয়া রোগ থেকেও রক্ষা করবে।[১৪] গর্ভাবস্থায় এই টিকা নেওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ।[১৫][১৬]

গর্ভাবস্থায় সাধারণত ৪ থেকে ৮ মাসের মধ্যে ২ ডোজ টিডি টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।[১৭] তবে আপনার ১৫ বছর বয়সের পর যদি টিটেনাস টিকার ৫টি ডোজ নেওয়া থাকে, তাহলে গর্ভাবস্থায় সাধারণত আবার টিটেনাস টিকা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।[১৮]

সরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে আপনি বিনামূল্যে এই টিকা নিতে পারবেন। আপনি যেখানে গর্ভকালীন চেকআপ করান, সাধারণত সেখানেই টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। তাই চেকআপের দিন ডাক্তার দেখিয়ে একেবারে টিকা দিয়ে আসতে পারেন।

প্রসব-পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য

সন্তান প্রসবের পর প্রথম কয়েকদিন আপনার নিজেকে মানসিকভাবে কিছুটা নিস্তেজ লাগতে পারে। সে সময়ে অল্পতে কান্না আসা বা মন খারাপ লাগার মতো অনুভূতি হতে পারে। প্রসব-পরবর্তী এসব লক্ষণকে ‘বেবি ব্লুজ’ বা ‘পোস্ট পার্টাম ব্লুজ’ বলা হয়।[১৯]

এমন হলে ঘাবড়ে যাবেন না, কারণ এসব লক্ষণ কয়েক দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে যদি এসব লক্ষণ ২ সপ্তাহ ধরে স্থায়ী হয়, সেটি ‘প্রসব পরবর্তী ডিপ্রেশন’ এর কারণে হতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন ডাক্তার দেখাতে হবে।

বুক জ্বালাপোড়া করা

এসময়ে পাকস্থলীর এসিড ওপরে উঠে এসে আপনার বুক জ্বালাপোড়া করতে পারে।[২০][২১] এই সমস্যা কমানোর জন্য আপনি সহজ কিছু উপায় মেনে চলতে পারেন। যেমন: খাওয়ার সময়ে একবারে বেশি করে না খেয়ে পরিমাণমতো খাওয়া, প্রয়োজনে অল্প অল্প করে বারবার খাওয়া।[২২]

রাতে এই সমস্যা হলে বিছানার যেদিকে আপনি মাথা দিয়ে শুয়ে থাকেন, সেই দিকটি কিছুটা উঁচু করতে পারেন।[২৩] এজন্য খাটের পায়ার নিচে ইট বা কাঠের টুকরা দিতে পারেন।

আরও জানতে আমাদের গর্ভাবস্থায় বুক জ্বালাপোড়া লেখাটি পড়তে পারেন।

অন্যান্য লক্ষণ

এ সপ্তাহে আপনার আরও যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—

এ ছাড়াও এই সপ্তাহে আপনার প্রথম দিকের সময়ের লক্ষণগুলো থাকতে পারে। যেমন—

এ সপ্তাহে বাবার করণীয়

সময়মতো শিশুর মায়ের টিডি টিকা নেওয়া নিশ্চিত করুন

গর্ভাবস্থায় সাধারণত ৪ থেকে ৮ মাসের মধ্যে ২ ডোজ টিডি টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।[২৪] এই টিকা ভবিষ্যতে শিশুর মা ও শিশুকে মারাত্মক টিটেনাস রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখবে।[২৫]

যেখানে শিশুর মা গর্ভকালীন চেকআপ করান, সাধারণত সেখানেই টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও বিনামূল্যে এই টিকা দেওয়া হয়। সময়মতো টিকা নিতে শিশুর মাকে উদ্বুদ্ধ করুন। কোথায় এই টিকা দেয়া হয়, সেটা খোঁজ নিয়ে সাহায্য করতে পারেন।

আগে থেকে টিটেনাসের এক বা একাধিক টিকা দেওয়া থাকলে শিশুর মাকে টিকা কার্ড সাথে নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিন। স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা কার্ড দেখালে তিনি পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে যথাযথ পরামর্শ দিতে পারবেন।

বিছানার একদিক একটু উঁচু করে দিন

শিশুর মা রাতের বেলায় বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যায় ভুগলে তার বিছানার মাথার দিকটি একটু উঁচু করে দিতে পারেন।[২৬] এজন্য খাটের পায়ার নিচে ইট অথবা কাঠের ব্লক দিয়ে মাথার দিকটা কিছুটা উঁচু করে দিতে পারেন। এতে করে বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা কমে আসতে পারে।[২৭]

রাতের খাবার আগেভাগেই সেরে ফেলুন

শিশুর মা হয়তো রাতের খাবারটা আপনার সঙ্গে একসাথে বসে উপভোগ করতে চান। রাতে একটু আগেভাগে খেলে তা শিশুর মায়ের বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা কমাতে সাহায্য করতে পারে। তাই রাতের খাবারের সময়টা এগিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। বিছানায় যাওয়ার অন্তত ৩ ঘন্টা আগে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফেলতে পারেন।[২৮]

খুব তাড়াহুড়া না করে হাতে একটু সময় রাখুন, ধীরে ধীরে খাবার খান। এতে খাবারটা একসাথে উপভোগ করা হবে, আবার হজমের সমস্যা কমানোও সহজ হবে।

সন্তান প্রসবের পরে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যেরও যত্ন নিন

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে সাধারণত নতুন মা ও শিশুকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত থাকে। নতুন বাবা হিসেবে তখন আপনার অনেক দায়িত্ব থাকবে, যা হয়তো আপনি খুব আনন্দের সাথে পালন করবেন। পাশাপাশি নিজের দিকেও খেয়াল রাখবেন এবং নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিবেন। কারণ এসময়ে বাবারাও বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ অনুভব করতে পারেন।[২৯]

শিশু জন্মের পর প্রথম কয়েক মাসে নতুন মায়েদের মতো নতুন বাবারাও কখনো কখনো ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন।[৩০] তাই দুজনেরই মনের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি ডিপ্রেশন রোগের লক্ষণগুলো চিনে রাখা প্রয়োজন, যাতে রোগ দেখা দিলে সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া যায়।

কারো যদি প্রায় সবসময় মন খারাপ লাগতে থাকে, কোনো কিছুতে আগ্রহ না আসে, আগে যে কাজগুলো ভালো লাগতো তাতে কোনো আনন্দ না পায়—এগুলো ডিপ্রেশন রোগের কারণে হতে পারে। কোনো পর্যায়ে যদি আপনার বা আপনার সঙ্গীর এমন লাগে এবং তা দুই সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে, তাহলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করবেন।