গর্ভকালীন বিভিন্ন হরমোন ও এদের প্রভাব

গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। এর মধ্যে অন্যতম হলো হরমোনাল পরিবর্তন। গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে বেশ কিছু নতুন হরমোন তৈরি হয়, আবার আগের কিছু হরমোনের মাত্রাও এসময়ে বেড়ে যায়।

এসব হরমোন আপনার শরীরকে গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের জন্য প্রস্তুত করে। পাশাপাশি আপনার শরীরে বেশ কিছু অস্বস্তিকর পরিবর্তনও নিয়ে আসে।

হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রোপিন হরমোন

শুধুমাত্র গর্ভাবস্থায়ই গর্ভবতী মায়েদের শরীরে হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রোপিন হরমোন তৈরি হয় তাই আলাদাভাবে একে গর্ভাবস্থার হরমোনও বলা হয়। এ হরমোন গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল তৈরি করে। 

সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে গর্ভবতী মায়ের রক্ত ও প্রস্রাবে এই হরমোন উচ্চ মাত্রায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় গর্ভাবস্থায় যে বমি বমি ভাব বা বমি হওয়ার সমস্যা দেখা দেয় তার পেছনে এই হরমোনের ভূমিকা রয়েছে।[১][২]

প্রথম ত্রৈমাসিকে সম্ভাব্য সন্তান ধারণের দিন থেকে ১১ দিন পর আপনার রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এবং ১২ থেকে ১৪ দিন পর প্রস্রাবের পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক আপনার শরীরে এ হরমোনের উপস্থিতি নির্ণয় করতে পারেন।

বাসায় প্রস্রাব পরীক্ষা করে গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের যেই কিটটি পাওয়া যায় সেখানেও এই হরমোনের উপস্থিতি দেখা হয়।[৩] গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে প্রতি দুইদিনে, অর্থাৎ প্রতি ৪৮ ঘন্টায় এর পরিমাণ দ্বিগুণ হতে থাকে। প্রথম ৮ থেকে ১০ সপ্তাহে এ হরমোন সর্বোচ্চ পরিমাণে পৌঁছে এরপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে।[৪]

আপনার গর্ভাবস্থা নির্ণয় করতে এই হরমোন সরাসরি ভূমিকা রাখে। যেমন—

  • আপনার শরীরে এই হরমোনের পরিমাণ ৫ mlU/mL এর কম হলে তা আপনার নেগেটিভ গর্ভাবস্থা বুঝায়। এর মানে আপনি গর্ভধারণ করেননি।
  • আপনার শরীরে এই হরমোনের পরিমাণ ২৫ mlU/mL এর বেশি হলে পজিটিভ গর্ভাবস্থা বুঝায়, অর্থাৎ আপনি গর্ভধারণ করেছেন।
  • আপনার শরীরে এই হরমোনের পরিমাণ ৬–২৪ mlU/mL হলে আপনার গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করতে পুনরায় পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।

হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রোপিন হরমোনের উপস্থিতি সাধারণভাবে গর্ভধারণ নির্দেশ করলেও এ হরমোন এর ওঠানামা আপনার গর্ভাবস্থার বিভিন্ন সমস্যা নির্দেশ করতে পারে। যেমন—

স্বাভাবিকের চেয়ে কম মাত্রা নির্দেশ করে

  • গর্ভপাত[৫][৬]
  • এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ[৭]

স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চমাত্রা নির্দেশ করে[৮]

  • যমজ সন্তান বা একাধিক গর্ভধারণ[৯]
  • মোলার প্রেগন্যান্সি[১০][১১], অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে আপনার গর্ভের শিশু কিংবা গর্ভফুল বা প্লাসেন্টা আপনার সুস্থ গর্ভাবস্থায় যতটুকু বেড়ে ওঠা দরকার ছিল ততটুকু বেড়ে ওঠে না

কখন নিয়মিত এই হরমোন এর পরিমাণ নির্ণয় করা প্রয়োজন

সুস্থ ও স্বাভাবিক গর্ভধারণের ক্ষেত্রে আপনার নিয়মিত হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রোপিন এর পরিমাণ নির্ণয় করার প্রয়োজন হয় না। তবে নিচের লক্ষণগুলো থাকলে আপনার চিকিৎসকের নির্দেশ মতো নিয়মিত এই হরমোন এর পরিমাণ নির্ণয় করতে হতে পারে—

  • যোনিপথে রক্তপাত হলে
  • তলপেটে বা জরায়ুতে তীব্র ব্যথা হলে
  • এর আগে গর্ভপাতের ইতিহাস থাকলে

হিউম্যান প্লাসেন্টাল ল্যাকটোজেন হরমোন

এ হরমোনকে অনেকসময় হিউম্যান কোরিওনিক সোমাটোম্যামোট্রপিনও বলা হয়। এটিও গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল থেকে তৈরি হয়। নামের মতোই এটি মায়ের দুধ উৎপাদনের সাথে জড়িত।

এটি গর্ভাবস্থায় আপনার সন্তানকে পুষ্টি উপাদান সরবরাহে সাহায্য করে এবং সন্তান প্রসবের পর এ হরমোন স্তনের দুগ্ধ গ্রন্থিকে উদ্দীপ্ত করে এবং কলোস্ট্রাম নামের এন্টিবডি যুক্ত আঠালো পদার্থ তৈরি করে, যা থেকে পরবর্তীতে মায়ের বুকের দুধ আসে।[১২] কলোস্ট্রাম শালদুধ নামেও পরিচিত।

কখনো কখনো হিউম্যান প্ল্যাসেন্টাল ল্যাকটোজেন আর প্লাসেন্টাল গ্রোথ হরমোন নামক প্লাসেন্টার আরেকটি হরমোনের অস্বাভাবিকতা থেকে গর্ভাবস্থায় নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং গর্ভের শিশুর বৃদ্ধিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।[১৩]

ইস্ট্রোজেন হরমোন

এ হরমোন নারীদের স্তনের বৃদ্ধি ও মাসিকের সূচনা করে। সাধারণ সময়ে নারীদের ওভারি বা গর্ভাশয়ে এবং গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলে এ হরমোন তৈরি হয়।[১৪]

আপনার শরীরে সারাজীবন যে পরিমাণ ইস্ট্রোজেন হরমোন তৈরি হয়, একটি গর্ভাবস্থায় তার চেয়েও বেশি পরিমাণ হরমোন তৈরি হয়।

ইস্ট্রোজেন হরমোন গর্ভাবস্থায় মূলত নিচের কাজগুলো করে—

  • নতুন রক্তনালী তৈরি করে ও রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা মজবুত করে[১৫][১৬]
  • পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে
  • বাড়ন্ত শিশুর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে

ইস্ট্রোজেন ধীরে ধীরে বাড়ে এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সর্বোচ্চ হয়। প্রথম ত্রৈমাসিকে হঠাৎ করে এ হরমোন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বমি বমি ভাব হতে পারে এবং দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে দুগ্ধনালী বিকশিত করে স্তন বড় করে।

পড়ুন: গর্ভাবস্থায় স্তনের পরিবর্তন

প্রোজেস্টেরন হরমোন

সাধারণ সময়ে নারীদের ওভারি বা গর্ভাশয়ে এবং গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলে এ হরমোন তৈরি হয়।[১৭]

এ হরমোন নিষিক্ত ডিম্বাণু প্রতিস্থাপনের জন্য জরায়ুর প্রাচীরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।[১৮] শরীরের মাংসপেশি ও জয়েন্টগুলোকে ঢিলে করে দেয়। শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অংশকে বাড়তে সাহায্য করে। যেমন, স্বাভাবিক সময়ে একটি নাশপাতির সমান আকারের জরায়ুকে গর্ভাবস্থায় একটি পূর্ণাঙ্গ মানবশিশু ধারণ করতে প্রস্তুত করে।

প্রোজেস্টেরন ও রিল্যাক্সিন হরমোন মিলে আপনার বেশ কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেমন—

রিল্যাক্সিন হরমোন

মায়েদের প্রজননে রিল্যাক্সিন হরমোন বড় ভূমিকা রাখে। সাধারণত ডিম্বপাতের পর রিল্যাক্সিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা আপনার জরায়ুর প্রাচীরকে সন্তানধারণের জন্য তৈরি করে।

গর্ভাবস্থায় রিল্যাক্সিন হরমোন জরায়ুর সংকোচনকে বাঁধা দেয় যার ফলে অকাল প্রসব হয় না।[২০] এ হরমোন রক্তনালীকে প্রসারিত করে প্লাসেন্টায় রক্ত প্রবাহ করে। এ ছাড়া এটি প্রসবের সময়ে তলপেটের হাড় ও লিগামেন্টকে প্রসারিত করে সারভাইকাল রাইপেনিং, অর্থাৎ প্রসবের জন্য জরায়ুমুখকে নরম ও প্রসারিত করতে সহায়তা করে।[২১][২২]

অক্সিটোসিন হরমোন

অক্সিটোসিন মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশে তৈরি হয় এবং পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়।[২৩] এ হরমোন সন্তান প্রসব ও ডেলিভারিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আপনার প্রসবের সময় অক্সিটোসিন হরমোন এর পরিমাণ বাড়ে। তখন এ হরমোন জরায়ুর মাংসপেশির সংকোচনে উদ্দীপনা দেয় এবং প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন নামের একটি হরমোন তৈরিতেও উদ্দীপনা দেয়, যা পরবর্তীতে জরায়ুর সংকোচনকে বাড়িয়ে দেয়।[২৪]

প্রসব যদি আপনাআপনি শুরু না হয়, তবে অনেকসময় আপনাকে কৃত্রিমভাবে অক্সিটোসিন দেওয়া হতে পারে।[২৫]

প্রসবের পর অক্সিটোসিন আপনার জরায়ুকে স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসতে এবং স্তনে দুধ আসতে সাহায্য করে। নবজাতকের সাথে মায়ের ইমোশনাল বন্ডিং তৈরিতেও এই হরমোন ভূমিকা রাখে।[২৬]

উপরের ৬টি হরমোন ছাড়াও আরও কিছু হরমোন এই আলোচনায় আসতে পারে। সরাসরি গর্ভকালীন হরমোন হিসেবে গণ্য না হলেও গর্ভাবস্থা তৈরির পেছনে এদের ভূমিকা রয়েছে। যেমন—

ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন

এ হরমোন মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে তৈরি হয়ে আপনার গর্ভাশয় বা ওভারিকে ডিম্বাণু ও ইস্ট্রোজেন হরমোন তৈরিতে উদ্দীপনা যোগায় এবং আপনার মাসিকের চক্র নিয়ন্ত্রণ করে।[২৭]

গর্ভাবস্থার শুরু করতেই এই হরমোন প্রয়োজন। এ হরমোন নিয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনার শরীরে যদি এ হরমোনের পরিমাণ বেশি থাকে তবে তা আপনার যমজ সন্তান হবার সম্ভাবনা নির্দেশ করতে পারে।[২৮]

লুটিনাইজিং হরমোন

লুটিনাইজিং হরমোনও আপনার পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় এবং ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন এর সাথে মিলে আপনার ডিম্বপাত এবং মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ করে।[২৯][৩০]

সহবাসের পর আপনার সঙ্গীর শুক্রাণু আর আপনার ডিম্বাণু একত্রিত হলে লুটিনাইজিং হরমোন আপনার গর্ভাবস্থার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ হরমোন (যেমন: প্রজেস্টোরন) তৈরি করে এবং আপনার জরায়ুকে সন্তান প্রসবের উপযোগী করে তুলে।