এ সপ্তাহের হাইলাইটস
প্রসব-পরবর্তী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানুন
সন্তান জন্মানোর মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই পুনরায় গর্ভধারণ সম্ভব। তাই প্রসব-পরবর্তী সময়ে প্রতিবার সহবাসের সময়ে উপযুক্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করুন।
প্রসবকালীন ব্যথা কমানোর উপায় সম্পর্কে জানুন
আপনার নিকটস্থ হাসপাতালে প্রসববেদনা কমানোর জন্য সহজলভ্য যেসব ব্যবস্থা আছে সেসব সম্পর্কে আগে থেকে জেনে রাখুন। যেমন: গ্যাস সংমিশ্রণ ও এপিডুরাল অ্যানেস্থেসিয়া।
আয়রন-ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান
বিগত সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যাবেন। এগুলো গর্ভের শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[১][২] পাশাপাশি আপনাকে মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করতে পারে।[৩]
- মাসে কত দিন? ৬ মাস ২ সপ্তাহ
- কোন ট্রাইমেস্টার? দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক
- আর কত সপ্তাহ বাকি? ১৪
২৬ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি
এ সপ্তাহে আপনার গর্ভের শিশু মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত প্রায় ৩৫.৬ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে গিয়েছে—প্রায় একটি ঝিঙ্গার সমান। তার ওজন এখন প্রায় ৭৬০ গ্রাম।
জোরালো আওয়াজে শিশু চমকে যেতে পারে
আশেপাশে জোরে কোনো আওয়াজ হলে গর্ভের ভেতরে শিশু চমকে উঠতে পারে। তখন সে দ্রুত হাত-পা ভেতরের দিকে টেনে নিতে পারে।[৪]
ছোট্ট শিশু আঙুল চুষতে পারে
আপনার শিশু এরই মধ্যে আঙুল চুষতে শিখে গিয়েছে।[৫] সে হয়তো এখন আপনমনে আপনার গর্ভের ভেতরে তার হাতের আঙুল চুষছে। এই অভ্যাস পরবর্তীতে তাকে আপনার বুকের দুধ পান করার সময়ে সাহায্য করবে।
ফুসফুস একটি বিশেষ পদার্থ তৈরি করছে
এ সপ্তাহের মধ্যে শিশুর ফুসফুস ‘সারফ্যাকটেন্ট’ নামের এক ধরনের বিশেষ পদার্থ তৈরি করতে শুরু করে।[৬] জন্মের পরে শিশুর শ্বাস নেয়ার জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।[৭]
শিশুর ফুসফুস যাতে ভালোভাবে প্রসারিত হয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাতাস নিতে পারে, সেজন্য এই সারফ্যাকটেন্ট প্রয়োজন।[৮] ফুসফুসের ভেতরে এখনো ছোটো ছোটো শাখা–প্রশাখা তৈরির কাজ চলছে।[৯]
২৬ সপ্তাহে মায়ের শরীর
এখন থেকেই প্রসব ও প্রসব পরবর্তী দিনগুলোর যত্ন নিয়ে একটু-আধটু ভাবা শুরু করতে পারেন।
দাঁতের যত্ন
গর্ভকালীন সময়ে প্রায় ৬০–৭৫% নারীরা দাঁতের মাড়ির প্রদাহের সমস্যায় ভোগেন।[১০] এমন হলে দাঁতের মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যায় এবং মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে। গর্ভকালীন সময়ে শরীরে হরমোনের পরিমাণের তারতম্যের জন্য আগামী সপ্তাহগুলোতে এই সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।[১১]
এ ছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে দাঁতের মাড়ির নির্দিষ্ট রোগের সাথে গর্ভের শিশুর অকাল প্রসব ও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়ার যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে।[১২] তাই এই সময়ে দাঁত ও মাড়ির রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত দিনে দুইবার দাঁত মাজার অভ্যাস করুন। পাশাপাশি দিনে অন্তত একবার ফ্লস ব্যবহার করে আপনার দাঁতের মাঝে জমে থাকা ছোটো ছোটো খাবারের টুকরা পরিষ্কার করে ফেলুন।
এই সহজ দুইটি উপায়ে দাঁত পরিষ্কার রাখার মাধ্যমে আপনি গর্ভকালীন সময়ে দাঁতের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি দাঁত ও মাড়ির ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারেন।
দাঁতের যত্ন নেওয়ার উপায় সম্পর্কে আরও জানতে গর্ভাবস্থায় দাঁতের মাড়ি ফোলা ও রক্ত পড়া আর্টিকেলটি পড়ুন।
প্রস্রাবের ইনফেকশন
গর্ভাবস্থায় প্রস্রাব করার সময়ে যদি আপনার প্রস্রাবের রাস্তায় ব্যথা অথবা জ্বালাপোড়া হয়, তা প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন হওয়ার লক্ষণ হতে পারে। প্রস্রাবের সময়ে জ্বালাপোড়া ছাড়াও আপনার আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন: জ্বর আসা কিংবা গা গরম লাগা, শরীরে কাঁপুনি হওয়া এবং তলপেটে ব্যথা হওয়া।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কেননা এই সময়ে প্রস্রাবের ইনফেকশন গর্ভের শিশুর জন্য মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।[১৩]
প্রসব বেদনা কমানোর উপায়
প্রসববেদনার কষ্ট কমানোর জন্য আপনি কী ধরনের ব্যথানাশক ব্যবস্থা নিতে ইচ্ছুক—সে বিষয়ে এখন থেকেই চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে পারেন। প্রসববেদনা কমানোর জন্য অনেক জায়গায় এক ধরনের গ্যাস ব্যবহার করা হয়, যাতে ব্যথার তীব্রতা বেশ কমে এবং ব্যথা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসতে পারে।
প্রসববেদনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার আরেকটি উপায় হলো ‘এপিডুরাল অ্যানেস্থেসিয়া’। এই পদ্ধতিতে আপনার পিঠের নীচের অংশে মেরুদণ্ড বরাবর একটি ইনজেকশনের মাধ্যমে চেতনানাশক ঔষধ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ব্যথা কমানোর আরও বিভিন্ন উপায় আছে।
সব হাসপাতালে কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সব ধরনের ব্যথা কমানোর পদ্ধতি থাকে না। তাই আপনি যেখানে ডেলিভারি করানোর পরিকল্পনা করছেন, সেখানে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে সেসব সম্পর্কে এখন থেকে জানার চেষ্টা করুন।
প্রসব পরবর্তী জন্মনিরোধক পদ্ধতি
গর্ভের সন্তান প্রসবের মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই আপনি পুনরায় গর্ভধারণ করতে পারেন। আপনার শিশু নিয়মিত বুকের দুধপান করতে থাকলেও আপনি গর্ভবতী হতে পারেন।
এমনকি প্রসবের পর পুনরায় মাসিক শুরু হওয়ার আগেই আপনি আবারও গর্ভধারণ করে ফেলতে পারেন। কেননা মাসিক শুরু হওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ আগে সাধারণত আপনার ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হয়ে আসে। তাই পুনরায় মাসিক শুরু হওয়ার আগেও আপনি আবার গর্ভধারণ করতে পারেন।
সতর্ক না থাকলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনি আবারও গর্ভধারণ করতে পারেন। অল্প সময়ের বিরতিতে পুনরায় গর্ভধারণ করলে তা নানান ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।[১৪] এজন্য প্রসব-পরবর্তী সময়ে প্রতিবার সহবাসের ক্ষেত্রে এমনকি প্রথমবারের ক্ষেত্রেও জন্মনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করুন।[১৫]
সেই সময়ে আপনার জন্য কোন ধরনের জন্মনিরোধক পদ্ধতি নিরাপদ হবে—সেসব জানতে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
পেটে ফাটা দাগ বা স্ট্রেচ মার্ক
গর্ভাবস্থায় আপনার ত্বকে ফাটা ফাটা দাগ খেয়াল করতে পারেন। গর্ভকালীন সময়ে অনেকেরই এমন হয়। সাধারণত হরমোনের প্রভাব, ত্বকে টান পড়াসহ বিভিন্ন কারণে এমন হয়।[১৬] সাধারণত শিশুর জন্মের পর এই দাগগুলো ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসে। ফাটা দাগ প্রতিরোধ করতে কোনো তেল অথবা ক্রিমের কার্যকারিতা সম্পর্কে তেমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[১৭][১৮]
এ সম্পর্কে আরও জানতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।
অন্যান্য লক্ষণ
এ সপ্তাহে আপনার আরও যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—
- ক্লান্তি
- ঘুমের সমস্যা
- স্ট্রেচ মার্ক বা ফাটা দাগ
- পেটের আকার বাড়ার সাথে সাথে পেটের চারপাশের পেশিতে ব্যথা করা
- পাইলস
- মাথা ব্যথা
- কোমর ব্যথা
- নাক দিয়ে রক্ত পড়া
- নাক ডাকা ও নাক বন্ধ থাকা
- পেট ফাঁপা লাগা
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- বদহজম ও বুক জ্বালাপোড়া করা
- পা কামড়ানো
- অল্পতেই গরম লাগা কিংবা সামান্য গরম আবহাওয়াতেই অস্বস্তি বোধ করা
- মাথা ঘুরানো
- হাত–পায়ে পানি আসা বা ফুলে যাওয়া
- যোনিপথে ইনফেকশন হওয়া
- মুখে মেছতার মতো বাদামি ও ছোপ ছোপ দাগ পড়া
- তৈলাক্ত ত্বক ও ত্বকে দাগ পড়া
- চুল ঘন ও ঝলমলে হওয়া
এ ছাড়াও এ সপ্তাহে আপনার প্রথম দিকের সময়ের লক্ষণগুলো থাকতে পারে। যেমন—
- ঘন ঘন মনমেজাজ বদলানো বা মুড সুইং। এই খুশি, আবার এই মন খারাপ—এমনটা হতে পারে। পাশাপাশি এসময়ে ছোটোখাটো বিষয়ে মন খারাপ লাগা অথবা কান্না করে ফেলার প্রবণতা দেখা দিতে পারে
- বমি বমি ভাব
- অদ্ভুত জিনিস খাওয়ার ইচ্ছা। যেমন: মাটি
- তীব্র ঘ্রাণশক্তি
- স্তনে ব্যথা এবং বোঁটা থেকে দুধের মতো তরল বের হওয়া
- সাদাস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
- যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত হওয়া। এটা গর্ভফুলের গুরুতর সমস্যার কারণে হতে পারে, তাই এমন হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাবেন
এ সপ্তাহে বাবার করণীয়
ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুজনেই দাঁত ব্রাশ করুন
গর্ভাবস্থায় দাঁত ও মাড়ির যত্ন নেওয়া বিশেষভাবে জরুরি, কারণ এসময়ে মাড়ি ফুলে যাওয়া ও মাড়ি থেকে রক্ত পড়া খুব কমন।[১৯] দাঁতের মাড়ির নির্দিষ্ট রোগের সাথে গর্ভের শিশুর নানান জটিলতার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে।[২০] তাই দাঁতের যত্ন নিতে শিশুর মায়ের প্রতিদিন দুই বেলা করে দাঁত মাজা প্রয়োজন।
ঘুম থেকে ওঠার পর ব্রাশ করা হলেও ঘুমাতে যাওয়ার আগে অনেকেরই ব্রাশ করার কথা মনে থাকে না। রাতে ব্রাশ করার কথা শিশুর মাকে মনে করিয়ে দিতে পারেন। সম্ভব হলে দুজনেই প্রতি রাতে একসাথে ব্রাশ করার অভ্যাস করতে পারেন। তাহলে শিশুর মা রাতে ব্রাশ করার কথা ভুলে যাবেন না।
দাঁত ফ্লস করার নিয়ম শিখে নিন
দিনে দুই বেলা দাঁত মাজার পাশাপাশি অন্তত একবার দাঁত ফ্লস করা বা খিলাল করা দরকার।[২১] শিশুর মায়ের যদি নিয়মিত দাঁত ফ্লস করার অভ্যাস না থাকে, সেক্ষেত্রে আপনি ফ্লস করার নিয়মগুলো শিখে তাকে দেখিয়ে দিতে পারেন। অথবা দুজনে একসাথেই নিয়মগুলো শিখে নিতে পারেন। আপনি নিজেও নিয়মিত দাঁত ফ্লস করার অভ্যাস করলে হয়তো শিশুর মা এটা চালিয়ে যেতে উৎসাহ পাবে।
গর্ভাবস্থায় দাঁত ও মাড়ির যত্নের অন্যান্য ঘরোয়া উপায় জানতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।
প্রসববেদনা উঠলে কী করবেন তা নিয়ে ভাবা শুরু করুন
এখন থেকেই প্রসব ও প্রসব পরবর্তী দিনগুলোর যত্ন নিয়ে একটু-আধটু ভাবা শুরু করতে পারেন। প্রসববেদনা শুরু হয়ে যাওয়ার পরে আপনি কীভাবে সাহায্য করলে শিশুর মায়ের সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়, সেটা নিয়ে তার সাথে আলাপ করুন।
আপনি হয়তো ব্যাগ গোছানো, ডাক্তারি কাগজপত্র গুছিয়ে নেওয়া ও হাসপাতালে যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করার মতো কাজগুলোতে সাহায্য করতে পারেন।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পরে তাকে কীভাবে সহায়তা করতে পারেন, সেটাও এখন থেকে চিন্তা শুরু করতে পারেন। হয়তো সেই সময়ে আপনার পাশে থাকাটাই তাকে অনেকটা সাহস জোগাবে।
তার জন্য হাতের কাছে পানি রাখতে পারেন। মুখ মুছিয়ে দেয়ার জন্য টিস্যু রাখতে পারেন। সেই সময়ে কী কী করলে শিশুর মায়ের আরাম হতে পারে, তা তার কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
প্রসব-পরবর্তী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানুন
অনেকে ভাবেন যে, সন্তান জন্মানোর পর বোধ হয় বেশ কিছুদিন কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।
সম্ভাবনা কম হলেও সন্তান জন্মানোর মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই শিশুর মা আবার গর্ভবতী হতে পারেন। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালেও তিনি আবারও গর্ভবতী হতে পারেন।
তাই সন্তান জন্মের পর সহবাসের ক্ষেত্রে অবশ্যই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের কথা মাথায় রাখবেন।[২২] কোন পদ্ধতি ব্যবহার করবেন, সেটা নিয়ে এখন থেকেই ভাবা শুরু করতে পারেন।