গর্ভধারণের ১২তম সপ্তাহ

এ সপ্তাহের হাইলাইটস

ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সংগ্রহ করে রাখুন

আগামী সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সেবন করতে হবে।[১] বাংলাদেশের সব সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়। নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এ সপ্তাহেই ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সংগ্রহ করে নিন, যাতে আগামী সপ্তাহে সময়মতো খাওয়া শুরু করতে পারেন।

প্রথম আল্ট্রাসনোগ্রাম করে ফেলুন

গর্ভাবস্থার ১০তম১৪তম সপ্তাহের মধ্যে প্রথম আলট্রাসনোগ্রাম করে ফেলার চেষ্টা করুন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে আপনি ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ সম্পর্কে জানতে পারবেন। সেই সাথে গর্ভের শিশু ঠিকমতো বেড়ে উঠছে কি না, গর্ভে একাধিক শিশু আছে কি না—এমন সব তথ্যও জানা যাবে।

মনে করে আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাবেন

গর্ভের শিশুর সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করতে আগের সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও অবশ্যই মনে করে প্রতিদিন আয়রনফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যাবেন।[২]

১২ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি

Week-12
কাগজি লেবু
আপনার বাচ্চা এখন প্রায়
একটি একটি কাগজি লেবু
এর সমান
দৈর্ঘ্য
৫.৪ সেমি
ওজন
১৮ গ্রাম

আপনার গর্ভের শিশু এখন প্রায় ৫.৪ সেন্টিমিটার লম্বা—প্রায় একটি কাগজি লেবুর সমান। তার ওজন এখন ১৮ গ্রামের কাছাকাছি। অর্থাৎ সে এখন প্রায় তিনটি আঙুরের সমান ভারী।

ছোট্ট শিশুকে ঘিরে আছে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড

ছোট্ট সোনামণি আপনার জরায়ুর ভেতরে পানির মতো তরল পদার্থ দিয়ে ঘেরা আছে। ডাক্তারি ভাষায় এই বিশেষ ধরনের তরল পদার্থকে বলা হয় ‘অ্যামনিওটিক ফ্লুইড’। এই সপ্তাহে অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণ ৩০ মিলিলিটারের কাছাকাছি।[৩]

অ্যামনিওটিক ফ্লুইড শিশুর নড়াচড়ায় সাহায্য করে। আপনার গর্ভের ভেতরে সে বেশ নড়াচড়া করছে। তবে বাইরে থেকে এখনো আপনি তা বুঝতে পারবেন না।

হাতের আঙ্গুলের নখ তৈরি হচ্ছে

ছোট্ট শিশুর হাত-পায়ের আঙুলগুলো প্রথমে একসাথে জোড়া লাগানো অবস্থায় থাকে। এখন সেগুলো আলাদা হয়ে গেছে।[৪] প্রতিটি আঙুল এখন বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। শিশুর হাতের আঙুলগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট নখ তৈরি হতে শুরু করেছে।[৫]

শিশুর লিভার রক্ত তৈরি করছে

ছোট্ট শিশুর লিভারের ওজন এখন তার পুরো শরীরের ওজনের ১০%, অর্থাৎ ১০ ভাগের ১ ভাগ।[৬] শিশুর লিভার এখন নিজে নিজেই রক্ত কণিকা তৈরি করছে।[৭]

শিশু গিলতে শিখে যাচ্ছে

এই সপ্তাহের মধ্যে আপনার শিশু মুখ দিয়ে কীভাবে গিলতে হয়, সেটা শিখে যাবে।[৮] পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলোও তাদের নিজেদের কাজ শিখে নিতে শুরু করেছে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষায় ছোট্ট শিশুর হার্টবিট বোঝা যাবে

ছোট্ট শিশুর হৃৎপিণ্ড এখন নিজে নিজেই স্পন্দিত হয়। এই সপ্তাহে আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করালে আপনার গর্ভের শিশুর হার্টবিট শোনা যাবে! সাধারণত গর্ভাবস্থার ১০–১৪তম সপ্তাহে প্রথম আলট্রাসনোগ্রাম করাতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

১২ সপ্তাহে মায়ের শরীর

গর্ভধারণের ১২তম সপ্তাহ

এই সপ্তাহটি পার হলেই আপনার গর্ভধারণের তিন মাস পূর্ণ হয়ে যাবে! চতুর্থ মাস আসতে আর মাত্র কয়েক দিন বাকি! এই সময়ে আপনার নিজেকে আগের চেয়ে প্রাণবন্ত মনে হতে পারে। ক্লান্তি কমে যাওয়ার কারণে আপনি কাজ-কর্মে উদ্দীপনা ফিরে পেতে পারেন।

তবে সব গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে এসব সমস্যা একইভাবে প্রকাশ পায় না এবং একইভাবে কমেও যায় না। তাই আপনার ক্ষেত্রে এসব সমস্যা তেমন একটা না-ও কমতে পারে।

বাড়ন্ত পেট

আজকাল আপনি হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা পেটে হাত বুলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন যে, আপনার পেট একটু একটু করে বড় হচ্ছে কি না। এই সময়ে আপনার বাড়ন্ত পেটের একটি ছবি তুলে রাখতে পারেন—যা এই সপ্তাহের একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে আপনার কাছে!

এসময়ে আপনার পেটের আকারে তেমন কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন আসতেও পারে কিংবা না-ও আসতে পারে। কেননা গর্ভকালীন সময়ে সব গর্ভবতীর পেটের আকার একই হারে বাড়ে না। আপনার পেট বড় হওয়ার হার নির্ভর করে মূলত আপনার শরীরে হরমোন, গর্ভধারণের আগের ওজন, গর্ভে শিশুর সংখ্যা এবং আপনার শরীরের পেশির শক্তিমাত্রার ওপর।

তাই আয়নায় আপনার পেট দেখতে এখনো আগের মতো লাগতে পারে। আবার হয়তো পেটের আকার সামান্য বেড়ে যাওয়ার কারণে আপনার আগের জামা-কাপড় এখন কিছুটা আঁটসাঁট লাগতে পারে। তবে যাই-ই হোক না কেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। এই সময়ে পেটের আকার একটু বড় হওয়া কিংবা না হওয়া—দুইটিই স্বাভাবিক।

গর্ভাবস্থার কোন সময়ে আপনার পেটের আকার কেমন হবে জানার জন্য গর্ভাবস্থায় পেটের আকার আর্টিকেলটি পড়ুন।

গর্ভাবস্থায় ওজন

এই সপ্তাহ থেকে আপনার ওজন নিয়মিত নোট করে রাখার অভ্যাস শুরু করতে পারেন। এতে করে পুরো গর্ভকালীন সময় জুড়ে আপনার ওজন ঠিকমতো বাড়ছে কি না তা বুঝতে সুবিধা হবে।

কতটুকু ওজন বৃদ্ধি পাওয়া উচিত, তা অনেকাংশে নির্ভর করে গর্ভধারণের আগে আপনার ওজন কেমন ছিল তার ওপর। গর্ভধারণের আগে ওজন স্বাভাবিক হলে, পুরো গর্ভাবস্থায় ১১.৫ কেজি থেকে ১৬ কেজি পর্যন্ত ওজন বাড়াটা স্বাভাবিক।[৯]

গর্ভবতী হওয়ার আগে অতিরিক্ত ওজন হলে গর্ভাবস্থায় কতখানি ওজন বাড়া উচিত, তা জানতে গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।

ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সংগ্রহ করা

গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ক্যালসিয়াম খেলে আপনার প্রি-এক্লাম্পসিয়া নামক গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপজনিত মারাত্মক জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমতে পারে।[১০][১১] তাই প্রতিদিনের খাবার তালিকায় ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি বাড়তি চাহিদা মেটাতে আপনাকে আগামী সপ্তাহ থেকে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সেবন করতে হবে।[১২]

বাংলাদেশের সব সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়। নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এই সপ্তাহেই ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সংগ্রহ করে নিন, যাতে আগামী সপ্তাহে সময়মত খাওয়া শুরু করতে পারেন।

গর্ভাবস্থায় যেসব ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান বিশেষভাবে প্রয়োজন সেগুলোর তালিকা পেতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।

কোষ্ঠকাঠিন্য

আজকাল আপনার পায়খানা করতে কষ্ট, অর্থাৎ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে। নানান কারণে এমন হতে পারে। যেমন, এই সময়ে ‘প্রোজেস্টেরন’ নামক এক ধরনের গর্ভকালীন হরমোনের প্রভাবে আপনার হজমের গতি কমে যেতে পারে।[১৩] ফলে খাবার হজম হয়ে মল তৈরি হতে বেশি সময় লাগার কারণে পায়খানা কষা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[১৪]

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা এড়াতে চেষ্টা করুন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করার। এজন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২–৩ লিটার বা ৮–১২ গ্লাস পানি পান করুন। পাশাপাশি শরীর সচল রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করুন। প্রতিদিন আঁশযুক্ত খাবার খান। যেমন: শাকসবজি, ফলমূল এবং লাল চাল ও লাল আটার মতো গোটা শস্যদানার তৈরি খাবার। এতে করে আপনার সমস্যা কিছুটা কমতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রেহাই পাওয়ার আরও কিছু ঘরোয়া সমাধান সম্পর্কে জানতে গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য আর্টিকেলটি পড়ুন।

পেট কামড়ানো বা পেট ব্যথা

বাড়ন্ত শিশুকে ধারণের জন্য আপনার জরায়ু ক্রমাগত বড় হচ্ছে। জরায়ু বড় হওয়ায় আশেপাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টে চাপ পড়ে। লিগামেন্ট হলো সুতার মতো কিছু টিস্যু যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে। মাংসপেশি ও লিগামেন্টে চাপ পড়ার ফলে পেটে হালকা ব্যথা হতে পারে। এতে দুশ্চিন্তা করবেন না।

তবে যদি তীব্র পেট ব্যথা হয় অথবা ঘন্টাখানেক বিশ্রাম করার পরেও ব্যথা না যায়, কিংবা ব্যথার সাথে যোনিপথে রক্তপাত হলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। কেননা গর্ভপাতের মতো মারাত্মক সমস্যার কারণেও আপনার পেট ব্যথা হতে পারে। পেট ব্যথা হওয়ার আরও নানান কারণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা আর্টিকেলটি পড়ুন।

অন্যান্য লক্ষণ

এ ছাড়াও এই সপ্তাহে আপনার আরও যেসব গর্ভকালীন লক্ষণ থাকতে পারে সেগুলো হলো—

এ সপ্তাহে বাবার করণীয়

রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন

ছোটোবেলা থেকে শিশুরা তার আশেপাশের মানুষ বিশেষত মা-বাবাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। তাই আপনাদের ছোট্ট সোনামণি বড় হয়ে সবার সাথে কেমন ব্যবহার করবে বা কীভাবে কথা বলবে—এসব সে ছোটোবেলা থেকেই আপনাদের কাছ থেকে শিখতে শুরু করবে।

আপনার শিশুর কাছে আপনি বাবা হিসেবে কেমন হতে চান—এসব নিয়ে অল্পস্বল্প চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে পারেন। আপনার আচরণে যদি এমন কোনো দিক থাকে যা আপনি পালটে ফেলতে চান, এখন থেকেই সেই বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেন। যদি হুটহাট রেগে যাওয়া কিংবা চিৎকার করার অভ্যাস থাকে, তাহলে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করুন।

ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সংগ্রহে সাহায্য করতে পারেন

শিশুর মাকে আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু করে ডেলিভারির আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে হবে।[১৫] তাই এই সপ্তাহে বাসায় ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট এনে রাখতে সাহায্য করতে পারেন, যাতে আগামী সপ্তাহে সময়মতো খাওয়া শুরু করা যায়।

অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলুন

আপনার ওজন অতিরিক্ত হলে এখন কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে পারেন। কারণ ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে বেশ কিছু অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[১৬] শিশুর মা যেহেতু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চলার চেষ্টা করছে, আপনিও তার সাথে যোগ দিলে হয়তো ওজন কমানো সহজ হবে।

গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত নানান ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সঠিকভাবে জানার চেষ্টা করুন

এসময়ে আপনার সঙ্গীর নানান ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। তাই গর্ভকালীন সময়ের বিভিন্ন লক্ষণ ও সেগুলোর ঘরোয়া সমাধান জানার চেষ্টা করুন। গর্ভকালীন বিপদচিহ্ন ও করণীয়গুলো জেনে রাখুন। এসব তথ্য সঠিকভাবে জানতে এই অ্যাপের ‘মায়ের স্বাস্থ্য’ অংশটি দেখতে পারেন।