হাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ হলে সাধারণত বিশেষ কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তাই কেউ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে কি না সেটি জানার কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত রক্তচাপ মেপে দেখা।
বাড়িতে প্রেসার মাপার মেশিন থাকলে ঘরে বসেই রক্তচাপ মেপে দেখা যায়। তাছাড়া বেশিরভাগ ফার্মেসিতে রক্তচাপ মাপার ব্যবস্থা থাকে। হাসপাতাল ও ডাক্তারের চেম্বারেও রক্তচাপ মাপা হয়।
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে প্রতিটি গর্ভকালীন চেকআপের সময়ে রক্তচাপ মেপে দেখা হয়।
রক্তচাপকে মিলিমিটার (পারদ) বা mmHg এককে মাপা হয়। সাধারণত রক্তচাপ ১৪০/৯০ অথবা তার বেশি হলে হাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ আছে বলা হয়। উচ্চ রক্তচাপকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—
রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার (mmHg) | উচ্চ রক্তচাপের ধরন |
---|---|
১৪০/৯০ থেকে ১৪৯/৯৯ | মৃদু |
১৫০/১০০ থেকে ১৫৯/১০৯ | মাঝারি |
১৬০/১১০ ও তদূর্ধ্ব | তীব্র |
তীব্র উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বাকি দুই ক্ষেত্রে বাসায় ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। সবগুলো ক্ষেত্রেই ঔষধ দিয়ে রক্তচাপ ১৩৫/৮৫ বা তার নিচে আনার চেষ্টা করা হয়।
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের ধরন
গর্ভধারণের আগে থেকেই যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, বিশেষ করে যারা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ঔষধ সেবন করছেন, তারা গর্ভধারণের চেষ্টা করার আগেই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। কারণ উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ঔষধ গর্ভাবস্থায় সেবন করলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডাক্তারকে জানালে তিনি এসব ঔষধ পরিবর্তন করে দিতে পারবেন।
ইতোমধ্যে গর্ভধারণ করে ফেললে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
এসব ক্ষেত্রে হাই ব্লাড প্রেসার চিকিৎসায় অভিজ্ঞ একজন গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারলে ভালো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় হাসপাতালে গাইনি ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ সংশ্লিষ্ট ‘ফিটোম্যাটারনাল মেডিসিন’ ইউনিটে এমন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাওয়া যায়।
গর্ভাবস্থায় ব্লাড প্রেসারের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন যেভাবে
গর্ভাবস্থায় কোনো গর্ভকালীন চেকআপ যেন বাদ না যায় সেটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি চেকআপে ডাক্তার অথবা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিবিড়ভাবে আপনার রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করবেন। এর উদ্দেশ্য দুটি—
- উচ্চ রক্তচাপের জন্য গর্ভের সন্তানের বৃদ্ধি যেন বাধাগ্রস্ত না হয়
- গর্ভবতী নারীর যেন প্রি-এক্লাম্পসিয়া না হয়ে যায়
চেকআপের সময়ে ব্লাড প্রেসার মাপা হয়, পাশাপাশি প্রস্রাব পরীক্ষা করে প্রোটিন বেরিয়ে যাচ্ছে কি না সেটি দেখা হয়। এ ছাড়া প্রি-এক্লাম্পসিয়ার সম্ভাবনা আছে কি না তা দেখতে কোনো কোনো রোগীকে ‘প্লাসেন্টাল গ্রোথ ফ্যাক্টর’ নামক বিশেষ পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।
গর্ভাবস্থার সময়কালের প্রথম দিকে গর্ভবতী নারীর ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। এই সময়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কিছুদিনের জন্য ঔষধ সেবন বন্ধ রাখা যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয়
প্রতিদিন কিছু সময় ধরে শরীরচর্চা করে শরীরকে সচল রাখলে সেটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। এজন্য জিমে গিয়ে ভারী ব্যায়াম করার প্রয়োজন নেই। দিনে আধা ঘণ্টা করে হাঁটা, ইয়োগা বা যোগব্যায়াম করা কিংবা সুযোগ থাকলে সাঁতার কাটার মতো কিছু বেছে নিতে পারেন।
সুষম খাবার খাওয়া ও খাবারে লবণের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনা সম্ভব।
পড়ুন: গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
অনেকে ধারণা করেন যে ম্যাগনেসিয়াম, ফলিক এসিড অথবা মাছের তেলের মতো সাপ্লিমেন্ট উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে কার্যকর। তবে এরকম তথ্যের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধের উপায়
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সপ্তাহে ১-২ বার রক্তচাপ মাপার চেষ্টা করুন। তারিখ আর সময় উল্লেখ করে একটা কাগজে ব্লাড প্রেসারগুলো লিখে রাখতে পারেন যাতে পরবর্তী চেকআপের সময় তা দেখাতে পারেন। তাহলে ব্লাড প্রেসারের ঔষধে কোনো পরিবর্তন আনতে হবে কি না তা বুঝতে সহজ হবে।
পড়ুন: ঘরে বসে প্রেসার মাপার পদ্ধতি
উচ্চ রক্তচাপ জনিত জটিলতা
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের কারণে গর্ভবতী মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নানান রকম ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। তাই নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপে যাওয়া এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে করনীয় বিষয়গুলো মেনে চলা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি
- প্রি-এক্লাম্পসিয়া
- এক্লাম্পসিয়া বা খিঁচুনি
- ব্রেইন স্ট্রোক
- জরায়ু থেকে গর্ভফুল আলাদা হয়ে যাওয়া
- ঔষধের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে প্রসব বেদনা শুরু করার প্রয়োজন হওয়া
শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি
- গর্ভের ভেতরে বেড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদানের অভাব হওয়া
- গর্ভকাল (৩৭তম সপ্তাহ) পূর্ণ হওয়ার আগেই শিশুর জন্ম হওয়া
- জন্মের সময়ে ওজন স্বাভাবিক (২.৫ কেজি) এর চেয়ে কম হওয়া
প্রি-এক্লাম্পসিয়া
প্রি-এক্লাম্পসিয়া হলো গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ জনিত একটি জটিলতা। সাধারণত গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহের পর থেকে কিছু গর্ভবতী নারীকে এই জটিলতায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে বাচ্চা প্রসবের পর পর এই জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রি-এক্লাম্পসিয়াতে গর্ভফুলে সমস্যার কারণে সাধারণত রক্তচাপ বেড়ে যায়। সময়মতো চিকিৎসা শুরু না করলে এটি মা ও সন্তানের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
নিচের পাঁচটি লক্ষণের যেকোনোটি দেখা দিলে গর্ভবতী মাকে দেরি না করে ডাক্তার দেখাতে হবে—
- হঠাৎ করেই হাত, মুখ অথবা পা ফুলে যাওয়া
- তীব্র মাথাব্যথা হওয়া
- দৃষ্টিশক্তির সমস্যা হওয়া। যেমন: দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে হয়ে যাওয়া অথবা চোখে আলোর ঝলকানির মতো কিছু দেখা
- বুকের পাঁজরের ঠিক নিচে তীব্র ব্যথা হওয়া
- ওপরের যেকোনো লক্ষণের পাশাপাশি বমি হওয়া
এগুলো প্রি-এক্লাম্পসিয়া এর লক্ষণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় পা ফুলে যাওয়া
নিচের তিনটি ক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীর প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়—
- গর্ভধারণের আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ থাকলে
- ইতঃপূর্বে কোনো সন্তান গর্ভে থাকার সময়ে প্রি-এক্লাম্পসিয়া হয়ে থাকলে
- মা অথবা বোনের কখনো প্রি-এক্লাম্পসিয়া হয়ে থাকলে
উচ্চ রক্তচাপ হলেও গর্ভবতী নারী সুস্থ বোধ করতে পারেন, কারণ রক্তচাপ বেড়ে গেলেও সাধারণত বিশেষ কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তাই নিয়মিত চেকআপে গিয়ে রক্তচাপ ও প্রস্রাব পরীক্ষা করানো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসব ও সন্তান জন্মদান
গর্ভাবস্থায় হাই প্রেসারের জন্য ঔষধ সেবন করে থাকলে প্রসবের সময়েও সেটি চালিয়ে যাবেন।
মৃদু অথবা মাঝারি উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে প্রসব বেদনা ওঠার পর থেকে প্রতি ঘণ্টায় রক্তচাপ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এই সময়ে রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার কাছাকাছি থাকলে প্রাকৃতিকভাবে, অর্থাৎ ‘নরমাল ডেলিভারি’ এর মাধ্যমে সন্তান জন্মদান করা সম্ভব।
তীব্র উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে প্রসব বেদনা ওঠার পর থেকে প্রতি ১৫ থেকে ৩০ মিনিট পর পর রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়। এক্ষেত্রে ডাক্তার বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে কিংবা সিজারিয়ান সেকশন অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের পরামর্শ দিতে পারেন।
সন্তান প্রসবের পরেও প্রথম কয়েকদিন প্রসূতি নারীর রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করা হবে।
প্রসব পরবর্তী চেকআপ
গর্ভবতী অবস্থায় প্রথমবারের মতো উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হলে কিংবা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে, প্রসবের পরে ঔষধে কোনো পরিবর্তন আনতে হবে কি না অথবা ঔষধ সেবন করা চালিয়ে যেতে হবে কি না সেই বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। সেজন্য প্রসবের দুই সপ্তাহ পরে একবার এবং দেড় থেকে দুই মাস পরে আরেকবার চেকআপের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
প্রেসারের ঔষধ সেবন করলে নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে কি?
ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে প্রায় সবক্ষেত্রেই প্রেসারের ঔষধ সেবন অবস্থায় নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে পারবেন। যদিও প্রেসারের ঔষধগুলো বুকের দুধের মাধ্যমে প্রবাহিত হতে পারে, তবে বেশিরভাগ ঔষধ খুবই অল্প পরিমাণে প্রবাহিত হয় এবং শিশু তা খুব কম পরিমাণে শোষণ করে।
গর্ভাবস্থায় ও দুগ্ধদানকারী অবস্থায় ঔষধের প্রভাব নিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গবেষণার পরিমাণ অপ্রতুল। ঔষধের লিফলেটে গর্ভাবস্থা ও দুগ্ধদানকারী অবস্থার জন্য সতর্কবাণী থাকা মানেই যে ঔষধটা ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে—তা নয়। এমনটা থাকলে দুগ্ধদানকালে ঔষধ চালিয়ে যাওয়া কিংবা পরিবর্তন করা সম্পর্কে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।