ভিটামিন এ আপনার গর্ভের শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান। একটি সুষম খাদ্য তালিকা মেনে চলার মাধ্যমে আপনি গর্ভাবস্থায় ভিটামিন এ-এর চাহিদা পূরণ করতে পারবেন। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন এ গর্ভের শিশুর ক্ষতি করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় ভিটামিন এ কেন দরকার?
গর্ভাবস্থায় মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ভিটামিন এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভে শিশুর ভ্রূণ বড় হতে হতে পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে রূপ নেয়। এই ভ্রূণের শারীরিক বিকাশে ভিটামিন এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[১] যেমন—
- হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও কিডনির মতো অঙ্গ তৈরিতে সাহায্য করে
- সুস্থ ত্বক ও হাড়, রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা, শ্বাসতন্ত্র, ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্র গঠনে ভূমিকা রাখে
- চোখের সুস্থতা বজায় রাখে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সমুন্নত রাখতে সহায়তা করে
গর্ভবতী মায়ের শরীরেও ভিটামিন এ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। যেমন—
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ঠিকমতো কাজ করতে সাহায্য করে
- অল্প আলোতে ও অন্ধকারে দেখতে সাহায্য করে এবং রাতকানা প্রতিরোধ করে
- ত্বক এর সুস্থতা বজায় রাখে
- স্নেহ বা ফ্যাট জাতীয় খাবার পরিপাকে সহায়তা করে
- প্রসবের পরে শরীরের টিস্যুগুলোকে সুস্থ হতে এবং আগের অবস্থায় ফিরে যেতে সাহায্য করে
গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন কতটুকু ভিটামিন এ খাবো?
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী নারীকে দৈনিক ৭৫০–৭৭০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।[২] আমাদের দৈনন্দিন খাবার থেকেই সাধারণত এই চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। আলাদা করে ভিটামিন এ ট্যাবলেট খাওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না।
শিশু জন্মের পর প্রথম ৬ মাস তার বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ মায়ের বুকের দুধ থেকেই পেয়ে থাকে। এই বাড়তি চাহিদা পূরণে প্রসূতি মাকে সন্তান জন্মদানের ৬ সপ্তাহের মধ্যে ২০০০০০ IU ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ।[৩] সেই সাথে শিশুকে ৬ মাস বয়স থেকে ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারি ক্যাম্পেইন অনুযায়ী ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে।
ভিটামিন এ এর অভাব হলে কী হবে?
ভিটামিন এ এর অভাব হলে আপনার শরীরে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া ভ্রূণের বিকাশে ভিটামিন এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে গর্ভের শিশুর নানান স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।[৪] যেমন—
- দৃষ্টিশক্তির সঠিক বিকাশের অভাব
- দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
- ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের দুর্বলতা
- ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কম হওয়া
গর্ভবতী নারীদের ভিটামিন এ এর অভাব হলে সাধারণত যেসব লক্ষণ দেখা দেয়—
- শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়া
- কম আলোতে ও রাতে চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া, এমনকি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়া
- ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা। যেমন: নিউমোনিয়া[৫]
- রক্তশূন্যতা
আপনার যদি এমন কোনো লক্ষণ দেখা দেয় অথবা কোনো কারণে শরীরে ভিটামিন এ এর ঘাটতি থাকতে পারে বলে মনে হয়, তাহলে অবশ্যই ডাক্তার দেখিয়ে নিবেন।
ভিটামিন এ বেশি খেয়ে ফেললে কী হবে?
ভিটামিন এ একদিকে শরীরের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে এটি শরীরের ক্ষতি করতে পারে। যেমন—
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
- মাংসপেশি ও গিরায় ব্যথা হওয়া
- লিভারের সমস্যা হওয়া। এক্ষেত্রে লিভার-সংক্রান্ত রক্ত পরীক্ষা করলে অস্বাভাবিক ফলাফল পাওয়া যেতে পারে[৬]
- ক্লান্তি
- বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন
- এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ভিটামিন এ সেবনে গর্ভের শিশুর চোখ, মাথার খুলি, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের মতো অঙ্গে জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে[৭][৮]
তাই গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভিটামিন এ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এজন্য যেসব খাবারে অনেক বেশি ভিটামিন এ থাকে সেগুলো গর্ভাবস্থায় খেতে নিষেধ করা হয়। খেলেও খুব অল্প পরিমাণে খেতে বলা হয়। যেমন: মুরগি ও গরুর কলিজা, কলিজা দিয়ে তৈরি খাবার ও কড মাছের তেল।
গর্ভবতী মায়ের শরীরে ভিটামিন এ বেশি থাকলে তা গর্ভাবস্থার একদম শুরু থেকেই গর্ভের শিশুর ক্ষতি করতে পারে। তাই সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করার সময় থেকেই সাবধানতাবশত কলিজা জাতীয় খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি ফলিক এসিড সেবন শুরু করা উচিত।
উল্লেখ্য, গর্ভাবস্থায় মাঝেসাঝে (যেমন: সপ্তাহে একবার অথবা তার চেয়েও কম) ৫০–৭০ গ্রাম রান্না করা কলিজা খাওয়া গর্ভের শিশুর জন্য তেমন ঝুঁকির কারণ নয়। কলিজা গর্ভাবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফলিক এসিড ও আয়রনের ভালো উৎস।[৯]
অনেকে গর্ভধারণের আগে থেকে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট সেবন করে থাকেন। এমন ক্ষেত্রে গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার পর থেকে সাধারণ মাল্টিভিটামিনের পরিবর্তে গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ভিটামিন সাপ্লিমেন্টগুলো বেছে নিন।
সাধারণ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটে ভিটামিন এ থাকে। অতিরিক্ত ভিটামিন এ গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর।[১০] বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভিটামিন ট্যাবলেটে ভিটামিন এ এর দৈনিক মাত্রা সর্বোচ্চ ১০০০০ IU এর মধ্যে সীমিত রাখতে সুপারিশ করা হয়।[১১]
তাই মাল্টিভিটামিন খেতে হলে গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি মাল্টিভিটামিন বেছে নিন, যাতে গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ পরিমাণে ভিটামিন এ আছে। প্রয়োজনে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ইতোমধ্যে মাল্টিভিটামিন সেবন করতে থাকলে চেকআপের সময়ে বিষয়টি ডাক্তারকে জানান।
কোন কোন খাবারে ভিটামিন এ থাকে?
গর্ভাবস্থার জন্য উপযোগী ভিটামিন এ এর কিছু ভালো উৎস হলো—
- দুধ ও দুধের তৈরি খাবার। যেমন: দই ও পনির
- লাল, হলুদ ও সবুজ শাকসবজি। যেমন: গাজর, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, লাল শাক, কচু শাক ও পালং শাক
- রঙিন ফলমূল। যেমন: আম, পাকা পেঁপে, তাল, ডেউয়া ও বাঙ্গি
- ডিম
- তৈলাক্ত মাছ
উল্লেখ্য, কলিজা ও মাছের তেল ভিটামিন এ এর খুবই ভালো উৎস। কিন্তু এগুলোতে অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে, যা সাধারণ অবস্থায় খাওয়া গেলেও গর্ভাবস্থায় শিশুর ক্ষতি করতে পারে। তাই গর্ভকালীন সময়ে এগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভাবস্থায় সাধারণত আলাদা করে ভিটামিন এ ট্যাবলেট খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না৷ কারণ আমরা দৈনন্দিন যেই খাবার খাই, তাতেই সাধারণত ভিটামিন এ এর চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।
গর্ভাবস্থায় অথবা গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময় থেকে অনেকে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট খেয়ে থাকেন। সেখানেও ভিটামিন এ থাকে।
প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভিটামিন এ খেলে তা গর্ভের শিশুর ক্ষতি করতে পারে। তাই মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট খাওয়ার আগে সেখানে ভিটামিন এ এর পরিমাণ সঠিক মাত্রার ভেতরে আছে কি না তা যাচাই করে নিন। এ ধরনের ট্যাবলেট খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিলে সবচেয়ে ভালো হয়।
সাধারণ অবস্থায় কলিজা ভিটামিন এ এর খুবই ভালো একটি উৎস। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ পাওয়া যায়৷ একসাথে বেশি পরিমাণে কলিজা খেয়ে ফেললে শরীরে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ভিটামিন এ চলে আসে। এই অতিরিক্ত ভিটামিন এ গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে৷ এজন্য গর্ভবতী নারীদের সাবধানতাবশত কলিজা বা কলিজা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
রেটিনল মূলত এক ধরনের ভিটামিন এ। এটি ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য রূপচর্চার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ব্রণের চিকিৎসায় ‘আইসোট্রেটিনয়েন’ ট্যাবলেট আকারেও রেটিনল বাজারে পাওয়া যায়। এই ট্যাবলেটে উচ্চ মাত্রায় রেটিনল বা ভিটামিন এ থাকে। এটি গর্ভের শিশুর অকাল প্রসব ও জন্মগত ত্রুটিসহ নানান মারাত্মক জটিলতার জন্য দায়ী।[১২] এমনকি এটি গর্ভপাত ঘটাতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় ও অদূর ভবিষ্যতে গর্ভধারণের পরিকল্পনা থাকলে এই ট্যাবলেট সেবন করা যাবে না।
উল্লেখ্য, মুখে সেবনের পরিবর্তে ত্বকের ওপর যেসব রেটিনলযুক্ত পণ্য (যেমন: সিরাম ও ক্রিম) ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর প্রভাব নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। এক্ষেত্রে গর্ভের শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞরা এগুলো ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।[১৩][১৪]