গর্ভধারণের ১৪তম সপ্তাহ

এ সপ্তাহের হাইলাইটস

পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম শুরু করে দিন

যোনিপথের আশেপাশের মাংসপেশিগুলো শক্ত করার জন্য আপনি নিয়মিত পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ বা ‘কেগেল ব্যায়াম’ করতে পারেন। এতে প্রসবের পর জটিলতার (যেমন: হাঁচি, কাশি ও হাসির সময়ে কয়েক ফোটা প্রস্রাব বেরিয়ে আসার) সম্ভাবনা কমতে পারে।[১]

৩৪০ ক্যালোরি পরিমাণ বাড়তি খাবার খাবেন

গর্ভাবস্থায় দুজনের পরিমাণে খাবার খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মাঝের তিন মাসে সাধারণত দিনে প্রায় ৩৪০ ক্যালরি পরিমাণ অতিরিক্ত খাবার খাওয়াই যথেষ্ট।[২] গর্ভকালীন মাস অনুযায়ী খাবারের আদর্শ তালিকা পেতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।

আয়রন-ফলিক এসিড ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান

গর্ভের শিশুর ব্রেইন, স্নায়ুতন্ত্র, হাড় ও অন্যান্য অঙ্গ যাতে স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠে, সেজন্য আগের সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও প্রতিদিন আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান।[৩][৪]

১৪ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি

Week-14
আপেল
আপনার বাচ্চা এখন প্রায়
একটি আপেল
এর সমান
দৈর্ঘ্য
৮.৫ সেমি
ওজন
৫৭ গ্রাম

আপনার গর্ভের শিশু এখন প্রায় একটি আপেলের সমান লম্বা হয়ে গিয়েছে—প্রায় ৮.৫ সেন্টিমিটার সমান।

ছোট্ট শিশু পানি গিলে নিচ্ছে

জরায়ুর ভেতরে পানির মতো এক ধরনের তরল পদার্থ দিয়ে ছোট্ট শিশুটি ঘেরা আছে। ডাক্তারি ভাষায় এই তরল পদার্থকে বলা হয় ‘অ্যামনিওটিক ফ্লুইড’। সেই অ্যামনিওটিক ফ্লুইড শিশু এখন মুখ দিয়ে অল্প অল্প করে গিলে নেয়।[৫]

শিশু এখন প্রস্রাব করে

শুনতে অবাক লাগতে পারে, তবে ছোট্ট শিশু এখন প্রস্রাব করে।[৬] যে পানির মত তরল শিশু গিলে খায়, কিডনি সেটা থেকে মূত্র বা প্রস্রাব তৈরি করে। যে কিডনি নিয়ে শিশু জন্মাবে, এই সপ্তাহে সেই কিডনি ভালোভাবে কাজ করতে শুরু করবে।[৭]

শিশুর লিভার পিত্তরস তৈরি শুরু করছে

শিশুর শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলো নানান ধরনের কাজ করা শুরু করে ফেলেছে। এ সপ্তাহে শিশুর লিভার পিত্তরস তৈরি শুরু করবে।[৮] পিত্তরস পরবর্তীতে শিশুর খাবার হজমে সাহায্য করবে। শিশু জন্মের পর প্রথম পায়খানার রং গাড় সবুজ হয় এই পিত্তরসের কারণেই।[৯]

শিশুর হার্টবিট শুনতে পেতে পারেন

আনন্দের বিষয় হলো, ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করার সময়ে আপনার শিশুর হার্টবিট শুনতে পাবেন। সেই সময়ে পাশ থেকে আপনিও হয়তো ছোট্ট শিশুর হার্টবিট শুনতে পাবেন!

১৪ সপ্তাহে মায়ের শরীর

গর্ভধারণের ১৪তম সপ্তাহ

গর্ভাবস্থার এই পর্যায়ে এসে হয়তো আপনি আগের মতো শক্তি ফিরে পাচ্ছেন। ক্লান্তি কমার সাথে সাথে আপনার ক্ষুধাও বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর নাস্তা বেছে নিতে চেষ্টা করবেন। এটা হতে পারে আপনার প্রিয় কোনো ফল, কয়েকটা বাদাম অথবা একটা সেদ্ধ ডিম।

স্বাস্থ্যকর অপশনগুলো হাতের নাগালে রাখার মাধ্যমে ক্ষুধা লাগলে ভাজাপোড়া ও বিস্কুট-চানাচুরের মতো অস্বাস্থ্যকর অপশন এড়িয়ে চলা সহজ হবে।

পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম

এই সময় থেকে আপনি পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম বা ‘কেগেল ব্যায়াম’ শুরু করে দিতে পারেন। সকল গর্ভবতী নারীর জন্য এই ব্যায়ামটা উপকারী। নিয়মিত ব্যায়াম করলে প্রসবের পরে সহবাস বেশি উপভোগ্য হতে পারে, এবং প্রসব পরবর্তী কিছু জটিলতা এড়ানো যেতে পারে।[১০][১১] যেমন, হাঁচি, কাশি ও হাসির সময়ে কয়েক ফোটা প্রস্রাব বেরিয়ে আসার সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কমতে পারে।[১২]

কেগেল ব্যায়াম করার জন্য নিচের পদ্ধতি অনুসরণ করুন—

  • পায়খানার রাস্তা চাপ দিয়ে এমনভাবে বন্ধ করে রাখুন যেন পায়খানা আটকানোর চেষ্টা করছেন। একই সাথে যোনিপথকে চাপ দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন। প্রস্রাবের রাস্তাতেও এমনভাবে চাপ দিন যেন প্রস্রাব আটকানোর চেষ্টা করছেন।
  • প্রথম ১০ বার ব্যায়ামটা ধীরে ধীরে করবেন। ১০ সেকেন্ড পর্যন্ত চাপ দিয়ে ধরে রাখুন।
  • এরপর ১০ বার ব্যায়ামটি দ্রুত করুন। ওপরের পদ্ধতিতে দ্রুত চাপ প্রয়োগ করুন এবং ছেড়ে দিন।
  • এরকমভাবে ২০ বার চাপ দেওয়া এবং ছেড়ে দেওয়াকে এক সেট ব্যায়াম ধরা হয়।

চেষ্টা করুন দিনে এভাবে তিন সেট ব্যায়াম করতে। মনে রাখার সুবিধার জন্য প্রতিবেলা খাওয়ার আগে এক সেট ব্যায়াম করতে পারেন।

স্তনের বোঁটা থেকে শালদুধ বের হওয়া

এসময়ে আপনার স্তনের বোঁটা থেকে হলুদাভ-সাদা অথবা সোনালী রঙের দুধের মতো তরল বের হতে পারে। এই তরল হলো কোলোস্ট্রাম বা শালদুধ। আপনার গর্ভের শিশু জন্মের পর প্রথম দুধ হিসেবে এই শালদুধ পান করবে, যা তাকে প্রয়োজনীয় নানান গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করবে।

গর্ভাবস্থায় শালদুধ নিঃসৃত হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে শালদুধ যদি কোনো কারণে রক্তমিশ্রিত থাকে, তাহলে সেটা গুরুতর কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে। তাই এমন কিছু লক্ষ করলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

গর্ভাবস্থায় যোনিপথে ফাঙ্গাল ইনফেকশন

এসময়ে আপনার যোনিপথে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হতে পারে। এটি অনেকের কাছে ঈস্ট ইনফেকশন নামেও পরিচিত। এমন হলে অস্বাভাবিক ধরনের সাদা স্রাব হতে পারে, যা দেখতে দই অথবা পনিরের মতো এবং চাকা চাকা হয়।

গর্ভাবস্থায় ফাঙ্গাল ইনফেকশন হলে ভয়ের কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসা নিলে এটি সহজেই সেরে যায়। তবে সব ধরনের অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধ গর্ভাবস্থায় ব্যবহারের জন্য নিরাপদ নয়। তাই নিজে নিজে ঔষধ কিনে চিকিৎসা শুরু না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

দুজনের জন্য খাওয়ার প্রয়োজন নেই

আপনার হয়তো আগের চেয়ে ক্ষুধা বেড়ে গিয়েছে। কী খাবেন, কতটুকু খাবেন—এসব প্রশ্ন মাথায় ঘোরাঘুরি করছে। আপনজনদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এসময়ে বেশি বেশি খেতে বা দুজনের পরিমাণে খাবার খেতে উপদেশ দিবেন।

তারা হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই এই পরামর্শ দেন। তবে গর্ভাবস্থায় দুজনের পরিমাণে খাবার খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং বেশি খাওয়ার ফলে ওজন অতিরিক্ত বাড়লে সেটি গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।[১৩]

গর্ভধারণের আগে ওজন স্বাভাবিক হলে, গর্ভাবস্থার ৪ মাস থেকে ৬ মাসে প্রতিদিন ৩৪০ ক্যালরির কাছাকাছি পরিমাণ অতিরিক্ত খাবার খাওয়াই যথেষ্ট।[১৪] গর্ভবতীর খাবারের তালিকা পেতে আমাদের এই লেখাটা পড়তে পারেন।

সম্পর্কে টানাপোড়ন

গর্ভাবস্থায় মাথায় নানান ধরনের চিন্তা-দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। আপনার ভেতরে-বাইরে ঘটে যাওয়া অসংখ্য পরিবর্তনের কারণে আপনি মানসিকভাবে চাপে থাকতে পারেন। চাপের প্রভাবে আপনাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে।

আপনারা দুজনেই হয়তো আপনাদের ছোট্ট সংসারে নতুন অতিথিকে স্বাগত জানাতে নিজেদের প্রস্তুত করছেন। কিন্তু এই কাজটা সবসময় সহজ হয় না।

ভবিষ্যৎ জীবনে কী কী পরিবর্তন আসবে, পরিবারে নতুন অতিথি যোগ হওয়ার সাথে সাথে আপনাদের মধ্যকার সম্পর্ক বদলে যাবে কি না—এমন চিন্তাগুলো হয়তো দুজনকেই বেশ ভাবাচ্ছে। এই অনুভূতিগুলো নিয়ে দুজনে খোলাখুলিভাবে কথা বলুন। এতে আপনাদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া দূরত্ব কমে আসবে, দুজনের বোঝাপড়াও ভালো হবে।

অন্যান্য লক্ষণ

আগের সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহে আপনার আরও যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—

এ ছাড়া গর্ভাবস্থার প্রথমদিকের কিছু লক্ষণ থেকে যেতে পারে। যেমন—

যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত হওয়া। এমন হলে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তার দেখাবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা কোনো মারাত্মক কারণে হয় না। তবে কখনো কখনো এটা গর্ভপাতের একটা লক্ষণ হতে পারে।

এ সপ্তাহে বাবার করণীয়

সঙ্গীর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন

এসময়ে আপনার সঙ্গীর মনে অনেক কল্পনা, ইচ্ছা কিংবা চিন্তার সৃষ্টি হতে পারে। চেষ্টা করুন মনোযোগী শ্রোতা হয়ে তার কথাগুলো শোনার। এতে তার মন কিছুটা হালকা হবে। দুজনের মতের অমিল হলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ধৈর্যের সাথে ব্যাপারটা মীমাংসা করার চেষ্টা করুন, যেন আপনাদের সম্পর্কে টানাপোড়ন সৃষ্টি না হয়।

এর পাশাপাশি আপনার সঙ্গীর ছোটোখাটো যেকোনো সমস্যাকে গুরুত্ব দিন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

নিজেদের জন্য সময় বের করুন

আপনাদের পরিবার আর কয়েক মাস পর আর ছোটো থাকবে না, নতুন অতিথি এসে পরিবারে যুক্ত হবে। তাই এই সময়টা যতটা সম্ভব উপভোগ করার চেষ্টা করুন। শিশু জন্মের পর থেকে আপনার সঙ্গী হয়তো আপনার সাথে একান্তে সময় কাটানোর ফুরসত পাবেন না। হয়তো দুজনের ব্যস্ততাই অনেক গুণে বেড়ে যাবে। তাই এই সময়টাকে পুরোপুরি কাজে লাগান। দুজনের ভালো লাগে এমন কিছুতে একসাথে সময় কাটান।

পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম করতে উৎসাহ দিন

গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়।[১৫] এই ব্যায়াম করতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে।

প্রসবের পর হাঁচি, কাশি ও হাসির সময়ে প্রস্রাবের বেগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম অনেকখানি সাহায্য করতে পারে।[১৬] নিয়মিত এই ব্যায়ামটা করলে প্রসবের পর সহবাস বেশি উপভোগ্য হতে পারে।[১৭]

সাধারণত সারাদিনে মোট তিন সেট পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আপনি মাঝে মাঝে এই ব্যায়াম করার কথা মনে করিয়ে দিতে পারেন। যদি শিশুর মা তিনবেলা খাওয়ার আগে এই ব্যায়াম করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তখন মনে করিয়ে দিতে পারেন।

স্তনের বোঁটা দিয়ে শালদুধ বের হওয়া স্বাভাবিক

এসময়ে আপনার সঙ্গীর স্তনের বোঁটা থেকে দুধের মতো হলুদাভ-সাদা অথবা সোনালী রঙের আঠালো তরল বের হতে পারে। আপনি এমন কিছু খেয়াল করলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবেন না। গর্ভাবস্থায় এমন হওয়াটা স্বাভাবিক ঘটনা, এতে চিন্তার কিছু নেই।