এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি কী?
মায়ের ডিম্বাণু ও বাবার শুক্রাণুর মিলনের ফলে যে ভ্রূণ সৃষ্টি হয়, তা স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সিতে জরায়ুর ভেতরে স্থাপিত হয়। কোন কারণে যদি ভ্রূণটি জরায়ুর বাইরে স্থাপিত হয়, এ অবস্থাকে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলে।
জরায়ুর (যেখানে গর্ভাবস্থায় সন্তান বেড়ে ওঠে) বাইরে স্থাপিত হওয়ার কারণে ভ্রূণটি বড় ও পরিণত হতে পারে না। তবে এই অবস্থাতেও যদি ভ্রূণটি বেড়ে উঠতে থাকে, তাহলে গর্ভবতী নারীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হলে গর্ভের সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। ওষুধ প্রয়োগ বা অপারেশনের মাধ্যমে গর্ভপাত ঘটাতে হয়।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণ
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণগুলো সাধারণত গর্ভাবস্থার ৪র্থ থেকে ১২ তম সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায়। কারো ক্ষেত্রে শুরুতে কোন লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তারা হয়ত আলট্রাসনোগ্রাম করানোর আগে বা মারাত্মক কোন লক্ষণ দেখা দেয়ার আগে বুঝতেই পারেন না যে তাদের এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হয়েছে।
যদি আপনার মাসিক বন্ধ হয়ে যায়, প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ আসে অথবা গর্ভধারণের অন্য লক্ষণগুলো থাকে এবং সেই সাথে নিচের যে কোন লক্ষণ থাকে তাহলে আপনার এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হয়ে থাকতে পারে। উল্লেখ্য, প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ না আসলেও যদি আপনার মনে হয় আপনি গর্ভবতী, আর সাথে যদি আপনার নিচের কোন লক্ষণ থাকে, তাহলে হাসপাতালে বা আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
এক। মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত
এই রক্তপাত আপনার স্বাভাবিক মাসিকের রক্তপাত থেকে আলাদা হয়ে থাকে। এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির রক্তপাত পানির মত তরল ও গাঢ় বাদামী রঙের হতে পারে; এটি হঠাৎ শুরু হয়ে আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অনেকে এই রক্তপাতকে স্বাভাবিক মাসিকের রক্ত মনে করেন, তারা বুঝতেও পারেন না যে তারা গর্ভবতী।
গর্ভাবস্থায় মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্ত যাওয়া তুলনামূলকভাবে কমন এবং এটি সবসময় মারাত্মক কোন সমস্যার লক্ষণ নাও হতে পারে। তারপরও এ সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
দুই। পেট ব্যথা
পেটের নিচের দিকে যেকোনো এক পাশে ব্যথা হতে পারে। এটি শুরুর পরে আস্তে আস্তে বাড়তে পারে, আবার হঠাৎ করে তীব্রভাবে শুরু হতে পারে। এটি সারাক্ষণ থাকতে পারে, আবার আসা যাওয়াও করতে পারে।
হজমের বিভিন্ন সমস্যা, কোন ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ বা গ্যাসের সমস্যার কারণেও পেট ব্যথা হতে পারে। তাই পেট ব্যথা মানেই এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হয়েছে এমন নয়। কিন্তু আপনার যদি মনে হয় আপনি গর্ভবতী আর সাথে যদি এরকম ব্যথা থাকে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় পেট ব্যথা
তিন। কাঁধের শেষ প্রান্তে ব্যথা
আপনার কাঁধ যেখানে শেষ হয় ও বাহু যেখানে শুরু হয়, সেই জায়গায় এক ধরনের অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
এর পেছনের সঠিক কারণ জানা নেই, তবে এটি এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির কারণে দেহের ভেতর রক্তক্ষরণের লক্ষণ হতে পারে। তাই এ সমস্যা অনুভব করলে দেরি না করে সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
চার। টয়লেটে যাওয়ার সময় অস্বস্তি
প্রস্রাব বা পায়খানা করতে যাওয়ার সময় আপনার ব্যথা হতে পারে, সাথে থাকতে পারে ডায়রিয়া। গর্ভাবস্থায় প্রস্রাব-পায়খানার অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন ও পেটের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন ডায়রিয়া, বমির কারণে এমন হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে, ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
পাঁচ। ডিম্বনালী ফেটে যাওয়া ও তার লক্ষণ
ডিম্বনালী দুইটি ডিম্বাশয় (যেখান থেকে সাধারণত প্রতি মাসে ডিম্বাণু বের হয়) আর জরায়ুর (গর্ভের বাচ্চা যেখানে বড় হয়) মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করে।
কিছু ক্ষেত্রে এই ডিম্বনালীতে গর্ভের শিশু এতটা বড় হয়ে যায় যে এটি ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। একে বলা হয় রাপচার, যার অর্থ ফেটে যাওয়া।
রাপচার খুব মারাত্মক। এই ঘটনা ঘটলে মায়ে জীবন বাঁচাতে ও ছিঁড়ে যাওয়া ডিম্বনালী ঠিক করতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করা প্রয়োজন।
রাপচার এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- পেটে হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ ও তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়া,
- মাথা ঘুরানো বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া,
- বমি বমি ভাব,
- হঠাৎ করে অনেক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে যান।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হলে কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
আপনি যদি গর্ভবতী হন আর আপনার এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির উপসর্গগুলোর যেকোনটি থাকে, তাহলে প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ না আসলেও অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ডাক্তারের কাছে আপনার উপসর্গগুলো খুলে বলুন। এরপরে সাধারণত আপনাকে একটি প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে দেওয়া হবে।
ভ্রূণটি জরায়ুর বাইরে বেড়ে উঠছে কিনা তা নিশ্চিত করতে এবং আপনার অবস্থা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে আপনাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পাঠানো হতে পারে, ইনি আপনাকে আল্ট্রাসাউন্ড ও রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেবেন, যার মাধ্যমে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি সুনিশ্চিত করা যাবে।
কখন জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
আপনার ডিম্বনালী ছিঁড়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলে আর দেরি করা যাবে না। দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
ডিম্বনালী ছিঁড়ে গেলে এর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু আশার কথা হল, দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এর জটিলতা সম্পূর্ণ এড়ানো সম্ভব। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে এখন এধরনের ঘটনায় মায়ের মৃত্যুহার অনেক কমে এসেছে।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির মূলত ৩ ধরনের চিকিৎসা রয়েছে–
- নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা। আপনাকে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং নিষিক্ত ডিম্বাণুটি নিজে থেকেই ভেঙে না গেলে নিচের যেকোন একটি চিকিৎসা দেয়া হবে।
- ওষুধ। গর্ভের ভ্রূণে যেন আর না বেড়ে উঠতে না পারে, সেজন্য মেথোট্রেক্সেট (Methotexate) নামক একটি শক্তিশালী ইনজেকশন দেয়া হয়।
- অপারেশন বা সার্জারি। ল্যাপারোস্কোপি সার্জারির মাধ্যমে নিষিক্ত ডিম্বাণুটি ফেলে দেওয়া হয়, সাধারণত এর সাথে আক্রান্ত গর্ভনালীও কেটে ফেলা হয়। রোগীকে পুরোপুরি অজ্ঞান করে এই অপারেশন করা হয়।
চিকিৎসক আপনাকে সবগুলো চিকিৎসা পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধার ব্যাপারে বিস্তারিত জানাবেন। তবে আপনার উপসর্গ ও পরীক্ষার রিপোর্টের উপর নির্ভর করে কেবলমাত্র কোন একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি আপনার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি ভবিষ্যতে আপনার স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে, যদিও বেশিরভাগ নারীই পরবর্তীতে আবার গর্ভধারণ করতে পারেন। আপনার ডাক্তারের সাথে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করে নিন।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির পরে মানসিক চাপ ও করণীয়
গর্ভধারণের পর সন্তানকে হারালে, তা মনের উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করে। অনেক মা পরিবারের কোন সদস্য বা নিজের জীবনসঙ্গীকে হারানোর মত কষ্ট অনুভব করেন।
সময়ের সাথে সাথে এই কষ্ট কমে আসলেও, এই অনুভূতি কখনো কখনো মাসের পর মাস থেকে যায়। নিজেকে ও নিজের সঙ্গীকে এ মানসিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট সময় দিন। আপনি বা আপনার সঙ্গী যদি এ মানসিক অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে ডাক্তারের সাহায্য নিন।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হবার কতদিন পর সন্তান নেবার চেষ্টা করবেন?
আপনারা দুইজনেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুত মনে করলে আবার গর্ভধারণের চেষ্টা করতে পারেন। এক্টোপিক প্রেগনেন্সির জন্য চিকিৎসা নেওয়ার পর আবার গর্ভধারণের চেষ্টা করার আগে অন্তত দুইবার ঋতুস্রাব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যেন আপনার শরীর প্রথমে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
মেথোট্রেক্সেট দিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরে আবার গর্ভধারণের আগে অন্তত ৩ মাস অপেক্ষা করার জন্য বলা হয়ে থাকে, কারণ এর মধ্যে গর্ভধারণ করলে তা আপনার বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বেশিরভাগ নারী যাদের এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হয়েছে তাঁদের একটি ডিম্বনালী কেটে ফেলা হলেও, অন্য ডিম্বনালীটি সুস্থ থাকলে, তাঁরা আবার গর্ভধারণ করতে পারেন। সর্বোপরি, ৬৫% নারী এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হওয়ার ১৮ মাসের মধ্যে আবার সফলভাবে গর্ভধারণ করতে পারেন। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা, যেমন আইভিএফ এর প্রয়োজন হতে পারে।
একবার এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হলে আবার এটি হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যদিও তা খুব সামান্য (প্রায় ১০%)।
আপনি যদি আবার গর্ভধারণ করে ফেলেন, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারকে জানিয়ে রাখুন, যেন আগে থেকেই পরীক্ষা করে দেখে নেয়া যায় সব ঠিক আছে কিনা।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি কেন হয়?
অনেক সময় এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির কারণ পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে ডিম্বনালীতে কোন সমস্যা থাকলে, যেমন যদি এর পথ সরু হয় বা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এটি হতে পারে।
নিচের কারণগুলো এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়:
- পেল্ভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ বা পিআইডি। সাধারণত কোন যৌন সংক্রমনের কারণে মহিলাদের প্রজনন্তন্ত্রের কোথাও, যেমন জরায়ু, ডিম্বনালী, ইত্যাদি যেকোন স্থানে ইনফেকশন হলে;
- আগে কখনো এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হলে আবার এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ১০%;
- আগে গর্ভনালীর কোন অপারেশন হলে, যেমন সফল না হওয়া বন্ধ্যাত্বকরণ প্রক্রিয়া বা লাইগেশন;
- বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা যেমন আইভিএফ, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় অনেক সময় রজঃচক্রের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে যে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণ অর্থাৎ অভ্যুলেশন হয়, তা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য কোন ওষুধ নিয়ে থাকলে তা এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়;
- জন্মনিয়ন্ত্রনের জন্য আইইউডি বা আইইউএস ব্যবহারকালীন অবস্থায় গর্ভধারণ করা, এগুলো ব্যবহার করার সময় গর্ভধারণ করার ঘটনা বিরল, কিন্তু যদি করে থাকেন তাহলে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি;
- ধূমপান;
- বয়স – ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীদের এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
আপনি সবসময় এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি প্রতিরোধ করতে পারবেন না, কিন্তু যখন আপনি গর্ভধারণ করতে চাচ্ছেন না তখন যৌন সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কনডম ব্যবহার করুন আর যদি ধূমপান করে থাকেন তাহলে তা বন্ধ করার চেষ্টা করুন।