গর্ভধারণের পর থেকে আপনার খুবই সাধারণ বিষয় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। যেমন: চাবি কোথায় রেখেছেন মনে করতে না পারা, চুলা বন্ধ করে এসেছিলেন কি না তা নিয়ে সংশয় হওয়া, নিজের ফোন নাম্বার মনে করতে না পারা কিংবা এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় ফেলে আসা।
একই সাথে আপনি কাজে বা কথার মাঝে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন না—এরকম মনোযোগহীনতাও দেখা দিতে পারে। সবমিলিয়ে আপনার দৈনন্দিন জীবনের চিন্তা ভাবনা কিছুটা ঘোলাটে কিংবা অগোছালো হয়ে আসতে পারে।
গর্ভাবস্থায় অনেক নারী এই ধরনের সমস্যায় ভুগে থাকেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গর্ভাবস্থা আপনার শরীরের অন্যান্য অংশের মতো আপনার মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে থাকে। আর এর ফলেই সাধারণত এমনটা হয়।
তাই এরকম হলে হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। বরং এটি গর্ভাবস্থায় আপনার শরীরের একটি স্বাভাবিক পরিবর্তন। কিছু সাধারণ বিষয় মেনে চললে আপনি এই পরিবর্তনের সাথে সহজে মানিয়ে নিতে পারবেন।
কখন হয়?
গর্ভাবস্থার যেকোনো সময়ে আপনার চিন্তা ভাবনা এলোমেলো বা ঘোলাটে হওয়া, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে না পাওয়া, নানান বিষয় ভুলে যাওয়া—এরকম সমস্যা হতে পারে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভকালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এটি বেশি হয়। তবে সন্তান প্রসবের পরেও কয়েক মাস এমনটা হতে পারে।[১]
করণীয় কী?
ছোটো ছোটো বিষয় মনে রাখতে না পারা, নিত্য দিনের কাজকর্মে মনোযোগ না থাকা, চিন্তা ভাবনায় ঘোলাটে ভাব থাকা—এই সমস্যাগুলো কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি না করলেও বিরক্তি বা হতাশা তৈরি করতে পারে। তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করুন এই প্রভাবগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার। এজন্য আপনি যা যা করতে পারেন—
১. দুশ্চিন্তামুক্ত থাকুন: এই সমস্যাগুলোকে আপনি আপনার অক্ষমতা বা গুরুতর কোনো সমস্যা মনে না করে, স্বাভাবিক পরিবর্তন হিসেবে দেখুন। নিজেকে চাপমুক্ত রাখুন। মানসিক চাপ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
২. দরকারি বিষয়গুলো লিখে রাখুন: কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য ভুলে যাওয়ার ফলে যাতে সমস্যায় পড়তে না হয় সেজন্য এই তথ্যগুলো কাগজে লিখে রাখুন। বাজারের লিস্ট তৈরি করে বাজার করুন। ওষুধপত্র ঠিক মতো খাওয়া হচ্ছে কি না তা খেয়াল রাখার জন্য একটি ফর্দ তৈরি করতে পারেন।
কাগজ-কলমে না লিখে, আপনি আপনার মুঠোফোনও ব্যবহার করতে পারেন। যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবে আপনার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো রেকর্ড করে রাখুন।
৩. একটি ব্যাকআপ সিস্টেম তৈরি করুন: যেসব বিষয়ে পরিবার পরিজনের সাহায্য নেওয়া যায় সেসব কাজে তাদের সাহায্য নিন। নিজের উপর বাড়তি চাপ পড়তে দিবেন না এবং এই বিষয়ে পরিবারের অন্যদের আগে থেকেই সচেতন রাখুন।
৪. নিজেকে প্রফুল্ল রাখুন: ভুলে যাওয়া, মনোযোগ হারানো এসব বিষয়ে হতাশ না হয়ে সহজ সাবলীলভাবে বিষয়গুলো গ্রহণ করুন। বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে রসিকতা করার অভ্যাস তৈরি করতে পারেন। এর ফলে বিরক্তি তৈরি না হয়ে, নিজেকে প্রফুল্ল রাখার একটি উপায় বের হতে পারে।
৫. কোলিনযুক্ত খাবার খেতে পারেন: কোলিন একটি উপাদান যা ভিটামিন বা মিনারেলের থেকে আলাদা তবে তাদের মতোই শরীরের নানান ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব খাবারে বেশি পরিমাণে কোলিন রয়েছে তা আপনার ও আপনার সন্তানের মস্তিষ্কের জন্য উপকারী হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রক্তে কোলিনের অভাব থাকলে গর্ভের শিশুর নিউরাল টিউব ডিফেক্ট নামক জটিলতা দেখা দিতে পারে—এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।[২][৩] যদিও এখনো তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত নয়। কলিজা, ডিম, গরুর মাংস –এসব খাবার কোলিনের ভালো উৎস।[৪] তবে কলিজায় কোলিন ছাড়াও উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ থাকে, আর গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন এ সেবন গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।[৫] তাই গর্ভাবস্থায় সাধারণত কলিজা খেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে গর্ভাবস্থায় মাঝেসাঝে (যেমন: সপ্তাহে একবার অথবা তার চেয়েও কম) ৫০–৭০ গ্রাম রান্না করা কলিজা খাওয়া গর্ভের শিশুর জন্য তেমন ঝুঁকির কারণ নয়। কলিজা গর্ভাবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফলিক এসিড ও আয়রনের ভালো উৎস।[৬]
এ বিষয়ে আরোও বিস্তারিত জানতে আমাদের এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন: গর্ভাবস্থায় ভিটামিন এ
৬. ওমেগা ৩ যুক্ত খাবার খেতে পারেন: এসব খাবার আপনার ও আপনার সন্তানের মস্তিষ্কের সুস্থতা এবং আপনার সন্তানের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে। ওমেগা ৩ যুক্ত খাবারের মধ্যে আছে মাছ – বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, বাদাম, মিষ্টিকুমড়ার বিচি, সয়াবিন তেল এবং বাজারে মজুদ কৃত্রিমভাবে ওমেগা ৩ যুক্ত ডিম, দুধ, দই, ও জুস।[৭]
৭. নিজেকে প্রস্তুত রাখুন: গর্ভাবস্থায় যেমনি আপনার মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি নিয়ে সমস্যা হয়েছে, তেমনি সন্তানের জন্ম হওয়ার পরও এই সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে। এর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন।
কেন হয়?
গর্ভকালে কেন ও কীভাবে এই পরিবর্তনগুলো হয় তা নিয়ে আরও অনেক কিছু জানার ও বুঝার থাকলেও, এর পিছনে কিছু কারণ দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে। যেমন—
১. গর্ভাবস্থার হরমোন: আপনার শরীরের কিছু স্বাভাবিক হরমোন গর্ভকালে অনেক বেড়ে যায়। এই হরমোনগুলোই শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন প্রভাব ফেলে এবং গর্ভাবস্থার বিভিন্ন লক্ষণ ও সমস্যার জন্য দায়ী। ধারণা করা হয় এই হরমোনগুলোর প্রভাবে আপনার স্মৃতিশক্তি কিছুটা দুর্বল হতে পারে এবং মন-মেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকতে পারে।
২. পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব: যদিও ধারণা করা হচ্ছে গর্ভাবস্থা আপনার মস্তিষ্কে নানান পরিবর্তন আনে, তবে দৈনন্দিন জীবনের কিছু পরিবর্তনও আপনার ভুলে যাওয়া অথবা মনোযোগ হারানোর জন্য দায়ী থাকতে পারে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় নানান কারণে আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম না হওয়ার কারণে আপনার কাজকর্মে দক্ষতা কিছুটা কমে আসতে পারে। ঘুম কম হওয়ার কারণে আপনার মন-মেজাজ খারাপ থাকার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরও ঘুমের এরকম সমস্যা থাকতে পারে।
৩. দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ: অনেক গর্ভবতী নারীর নতুন মাতৃত্ব, নতুন সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়া—এরকম নানান বিষয়ে উৎকণ্ঠা থাকে। গর্ভাবস্থার পরও এরকম মানসিক চাপ থেকে যেতে পারে। এর প্রভাবে আপনার মনোযোগ হারানোর প্রবণতা, ভুলে যাওয়া, কাজকর্মে আগ্রহ হারানো—এরকম নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
আপনার স্মৃতি, মন মেজাজ ও মনোযোগে পরিবর্তন আসা গর্ভকালের একটি স্বাভাবিক ও অতিপরিচিত ঘটনা। একটি সন্তানকে জন্ম দিতে এবং পরবর্তীতে তার লালন পালন করার জন্য আপনার শরীরে কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক। তবে যদি আপনার দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম এর ফলে বাধা পায় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।