এ সপ্তাহের হাইলাইটস
সিজারের সম্ভাবনা কমাতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন
ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকলে এখন থেকে অল্প অল্প করে শুরু করুন। নিয়মিত ব্যায়াম করলে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হওয়ার সম্ভাবনা কমতে পারে।[১]
গর্ভকালীন চেকআপের কাগজপত্র সযত্নে রাখুন
এখনো গর্ভকালীন চেকআপ না করিয়ে থাকলে এই সপ্তাহেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। চেকআপে আপনাকে দেওয়া কার্ড, বই বা প্রেসক্রিপশন একটা জায়গায় গুছিয়ে রাখুন, যাতে প্রয়োজনের সময়ে দ্রুত খুঁজে পাওয়া যায়।
কোনো খাবারের প্রতি তীব্র আগ্রহ হওয়া স্বাভাবিক
অস্বাস্থ্যকর কোনো খাবারের প্রতি তীব্র আগ্রহ হলে তার পরিবর্তে কাছাকাছি স্বাদের স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিন। যেমন, মিষ্টি খেতে খুব ইচ্ছা করলে তার বদলে মিষ্টি ফল খেতে পারেন।
নিয়মিত আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবন করুন
এখনো শুরু না করে থাকলে এ সপ্তাহ থেকেই প্রতিদিন আয়রন–ফলিক এসিড ট্যাবলেট সেবন করা শুরু করুন। শিশু সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য এই ট্যাবলেট খুব গুরুত্বপূর্ণ।[২]
- মাসে কত দিন? ১ মাস ২ সপ্তাহ
- কোন ট্রাইমেস্টার? প্রথম ত্রৈমাসিক
- আর কত সপ্তাহ বাকি? ৩৪
৬ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি
আপনাকে দেখে হয়তো এখনো গর্ভবতী মনে হচ্ছে না। তবে আপনার গর্ভের শিশু খুব দ্রুত বেড়ে উঠছে। সে এখন প্রায় ৬ মিলিমিটার লম্বা—এক দানা মসুর ডালের সমান। শুনতে তেমন বড় মনে না হলেও, শিশু এখন গত সপ্তাহের আকারের প্রায় তিনগুণ লম্বা! গর্ভের ভেতরে শিশু এসময়ে ঘুমানোর মতো করে শরীর বাঁকিয়ে থাকে।
ছোট্ট শিশু দেখতে এখন ব্যাঙাচির মতো
শিশুর সারা শরীর এখন এক স্তর পাতলা ও স্বচ্ছ ত্বক দিয়ে আবৃত। তার এখন একটা ছোট্ট লেজ আছে, তাই দেখতে কিছুটা ব্যাঙাচির মতো লাগে। কয়েক সপ্তাহ পর এই লেজ মিলিয়ে যাবে।[৩]
শিশুর হার্ট বিট করছে
ছোট্টমণির হার্ট এখন সচল।[৪] কোনো কারণে যদি ডাক্তার এই সপ্তাহে যোনিপথ দিয়ে (ট্রান্সভ্যাজাইনাল) আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন, তাহলে পরীক্ষার সময়ে শিশুর হৃৎস্পন্দন টের পাওয়া যেতে পারে!
শিশুর চোখ-কান তৈরি হচ্ছে
এ সপ্তাহে ছোট্টমণির চেহারা তৈরির কাজ অনেকটাই এগিয়ে যাবে। মাথার সামনের দিকে দুটো হালকা খাঁজের মতো অংশ তৈরি হচ্ছে, যেখান থেকে শিশুর চোখ তৈরি হবে।[৫] মাথার দু’পাশে ছোটো ছোটো টোল পড়ছে—এখান থেকে তার কান দুটো তৈরি হবে।[৬]
হাত-পা গড়ে উঠছে
শিশু এসময়ে দ্রুত বেড়ে উঠছে। সে খুব তাড়াতাড়ি নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সপ্তাহের শেষ দিকে তার হাত-পা তৈরি হওয়া শুরু হয়ে যাবে।[৭] শরীরের দুপাশে ছোট্ট, ফোলা কিছু অংশ দেখা যাবে, যা থেকে আগামীতে তার পূর্ণাঙ্গ হাত-পা তৈরি হবে!
৬ সপ্তাহে মায়ের শরীর
গর্ভের ছোট্ট শিশু যাতে সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে, সেজন্য আপনার শরীরে নানান আয়োজন চলছে। এসময়ে বিভিন্ন ধরনের হরমোন ওঠানামা করছে। শরীরে ঘটতে থাকা নানান পরিবর্তন আর হরমোনের ওঠানামা—এসব মিলিয়ে আপনার খাবারের রুচিতে ও ঘ্রাণশক্তিতে পরিবর্তন আসতে পারে।
প্রখর ঘ্রাণশক্তি
গর্ভধারণের পর আপনার ঘ্রাণশক্তি আগের চেয়ে তীব্র হয়ে উঠতে পারে।[৮] যেই গন্ধগুলো হয়তো আগে তেমন বুঝতে পারতেন না কিংবা খেয়াল করতেন না, সেগুলোও হয়তো এখন নাকে এসে লাগে।[৯] এটা একটা মজার সুপারপাওয়ারের মতো। তবে এটি কখনো কখনো অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ঘ্রাণশক্তি তীব্র মনে হওয়ার সাথে বমি বমি ভাব বেড়ে যেতে পারে।[১০] গর্ভধারণের আগে কখনোই সমস্যা হতো না এমন খাবার কিংবা জিনিসের গন্ধেও গর্ভাবস্থায় নতুন করে বমি বমি লাগা শুরু হতে পারে।
ঘ্রাণের তীব্রতা কমাতে আপনি যেখানে আছেন, সেখানে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন। ঘরের জানালাটা খুলে দিন, ফ্যান ছেড়ে দিন। যেসব জিনিসের ঘ্রাণ আপনার ভালো লাগে, সেগুলো হাতের কাছে রাখুন। যেমন: লেবুর খোসা, আদা অথবা পুদিনা।
এমন আরও সহজ কিছু ঘরোয়া সমাধান জানতে আমাদের এই লেখাটি পড়ে নিতে পারেন।
কোনো খাবারের প্রতি তীব্র আগ্রহ
আজকাল কি আপনার কোনো একটা খাবার খাওয়ার জন্য খুব ইচ্ছা করছে? গর্ভাবস্থায় অনেকেরই এমন হয়। শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে এমন ঘটে বলে ধারণা করা হয়।[১১]
সমাধানের জন্য খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসের ছোটোখাটো কিছু পরিবর্তন আনতে পারেন। একবারে অনেকখানি খাবার না খেয়ে, অল্প পরিমাণে কয়েক বারে ভাগ করে খেতে পারেন। এতে পেট ভরা থাকে, ফলে কিছু খাওয়ার ইচ্ছা কমে আসতে পারে।
অপুষ্টিকর ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকবেন। এসবের পরিবর্তে কাছাকাছি স্বাদের স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিন। তবে যদি খুবই অদ্ভুত কিছু, যা খাবার নয় এমন কিছু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হয়—যেমন: মাটি, কাগজ কিংবা দেয়ালের রঙ—তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডাক্তারি ভাষায় এটিকে ‘পিকা’ বলা হয়, যা আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার কারণে হতে পারে।
খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণের আরও উপায় জানতে এই লেখাটা পড়ুন।
আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট
আপনি যদি এখনো আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া শুরু না করে থাকেন, তাহলে আজ থেকেই শুরু করুন। কেন এই ট্যাবলেট খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
আমাদের শরীরে রক্ত তৈরির জন্য আয়রন প্রয়োজন হয়। অন্য সময়ের তুলনায় গর্ভাবস্থায় আয়রনের চাহিদা অনেকখানি বেড়ে যায়।[১২] কারণ গর্ভবতী মায়ের শরীরে নতুন রক্ত তৈরি এবং গর্ভের শিশু সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রচুর পরিমাণে আয়রন প্রয়োজন হয়।
আয়রনের ঘাটতি হলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন: গর্ভবতী মায়ের রক্তশূন্যতা, শিশু প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্ম নেওয়া বা সময়ের আগেই জন্ম নেয়া, জন্মের সময় শিশুর ওজন কম হওয়া।[১৩]
আয়রনের পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় আরেকটা পুষ্টি উপাদান খুব গুরুত্বপূর্ণ—ফলিক এসিড। এর অভাবে শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে। মাথার খুলির হাড়, মেরুদণ্ড, বা ব্রেইনের গঠনে সমস্যা হতে পারে।
বাংলাদেশে গর্ভকালীন সময়ের জন্য আয়রন ও ফলিক এসিড একত্রে ‘আয়রন-ফলিক এসিড’ ট্যাবলেট হিসেবে পাওয়া যায়। আপনি বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এই ট্যাবলেট নিতে পারবেন।
আর কোন কোন জায়গায় এই ট্যাবলেট পাবেন, কী নামে পাবেন, কীভাবে খাবেন, এসব জানতে আমাদের এই লেখাটি পড়ে নিতে পারেন।
ব্যায়াম
এসময়ে নিয়মিত ব্যায়াম করুন। এটা গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য ও কোমর ব্যথার মতো নানান স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। পাশাপাশি ডেলিভারির সময়ে সিজারের প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনাও কমতে পারে।[১৪][১৫] আগে থেকে ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকলে সমস্যা নেই—এখন ব্যায়াম করা শুরু করতে পারেন। হালকা ব্যায়াম দিয়ে শুরু করে সময়ের সাথে সাথে আপনার সহনশীলতা বাড়ান।
ব্যায়াম শুরু করার একটা উপায় হলো, প্রথমে ১০ মিনিট স্বাভাবিক গতিতে হাঁটাচলা করুন। এরপর ৫ মিনিট দ্রুত গতিতে হাঁটুন। তারপর ৫ মিনিট ধীরে হেঁটে ব্যায়াম শেষ করুন। এভাবে কয়েকদিন অভ্যাস করে নেওয়ার পর সপ্তাহে ৫ মিনিট করে দ্রুত হাঁটার সময়টা বাড়ান।
এভাবে একসময় এমন পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে আসুন যেন প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ধরে দ্রুত গতিতে হাঁটতে পারেন।
অন্যান্য লক্ষণ
এ সপ্তাহে আপনার ক্লান্ত লাগা, এমনকি একেবারে পরিশ্রান্ত অনুভব করা স্বাভাবিক। গর্ভাবস্থার প্রথমদিকের অন্যান্য লক্ষণগুলো এ সপ্তাহেও প্রায় একই রকম থাকে—
- মাথা ব্যথা
- স্তনে হালকা ব্যথা হওয়া বা চাপ দিলে ব্যথা করা
- ঘন ঘন মনমেজাজ বদলানো বা মুড সুইং। এই খুশি, আবার এই মন খারাপ—এমনটা হতে পারে। পাশাপাশি এসময়ে ছোটোখাটো বিষয়ে মন খারাপ লাগা অথবা কান্না করে ফেলার প্রবণতা দেখা দিতে পারে
- বমি বমি লাগা
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা
- মুখে অদ্ভুত/ধাতব স্বাদ পাওয়া
- সাদা স্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
- যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত হওয়া। এমন হলে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তার দেখাবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা কোনো মারাত্মক কারণে হয় না। তবে কখনো কখনো এটা গর্ভপাতের একটা লক্ষণ হতে পারে
- পিরিয়ড বা মাসিকের ব্যথার মতো তলপেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা অনুভব করা
- পেটে অস্বস্তি বা পেট ফাঁপা হয়েছে এমন মনে হওয়া
- মুখে মেছতার মতো বাদামী, ছোপ ছোপ দাগ পড়া
- ঘন ও ঝলমলে চুল
এ সপ্তাহে বাবার করণীয়
আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খেতে মনে করিয়ে দিন
গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন মাকে আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খেতে হয়।[১৬] নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস না থাকলে কখনো কখনো এটা মনে নাও থাকতে পারে। এই মনে করিয়ে দেয়ার দায়িত্বটা আপনি নিয়ে নিতে পারেন। ঘড়িতে বা ফোনে একটা অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে পারেন, যাতে ট্যাবলেট খাওয়া মিস না হয়।
গর্ভকালীন চেকআপের কাগজপত্র সযত্নে রাখুন
পুরো গর্ভাবস্থা জুড়ে অনেকগুলো পরীক্ষার রিপোর্ট ও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন জমা হবে। গর্ভকালীন চেকআপে আলাদা করে একটি কার্ড বা বই দেওয়া হতে পারে। এসব কাগজপত্রে মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। তাই এগুলো যত্ন করে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এসব একসাথে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখার কাজে শিশুর মাকে সাহায্য করতে পারেন।
স্বাস্থ্যকর খাবার কিনে রাখুন
আপনার সঙ্গীর হয়তো আজকাল হঠাৎ করেই কোনো একটা খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জেগে উঠতে পারে। এসময়ে স্বাস্থ্যকর অপশনগুলো হাতের কাছে থাকলে অপুষ্টি বা অতিরিক্ত ওজন বাড়ার সম্ভাবনা কমবে।
কোন ধরনের স্বাস্থ্যকর খাবার কিনে রাখলে ভালো হবে, সেটা আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে শুনে নিন। যেমন, মিষ্টি কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলে কয়েক ধরনের মিষ্টি ফল কিনে রাখুন। আপনার সুবিধামতো সময়ে টুকরো করে কেটে কেটে সঙ্গীর হাতের নাগালে রেখে দিতে পারেন।
রান্নার কাজে সাহায্য করুন
এসময়ে আপনার সঙ্গীর ঘ্রাণশক্তি আগের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে। ফলে অনেকসময় রান্না করতে গেলে বিভিন্ন খাবার ও মসলার গন্ধে তার অস্বস্তি হতে পারে, বমি আসতে পারে। রান্নার সময়ে আপনি ঘরের জানালা খুলে দিন এবং ফ্যান ছেড়ে দিন। এটা অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
তাকে রান্নার কাজ থেকে কিছুদিনের জন্য বিরতি নিতে বলতে পারেন। আপনি নিজে রান্নার দায়িত্ব নিতে পারেন অথবা অন্য কাউকে অনুরোধ করতে পারেন।