এ সপ্তাহের হাইলাইটস
লাল চাল ও লাল আটা ব্যবহার করুন
সাদা চাল ও সাদা আটা হঠাৎ করে রক্তে সুগারের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেয়, যা গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এর পরিবর্তে লাল চাল ও লাল আটা দিয়ে খাবার তৈরি করুন।
দিনে ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করুন
বমিভাব থাকলেও অল্প করে চুমুক দিয়ে দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি করার চেষ্টা করবেন। এটা গর্ভের শিশুর বেড়ে ওঠায় সাহায্য করবে এবং শিশু যে পানিতে বড় হয়, তা তৈরিতে সহায়তা করবে।[১][২]
প্রতিদিন আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান
মা ও শিশু সুস্থ থাকার জন্য পুরো গর্ভাবস্থা জুড়ে আয়রন–ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া প্রয়োজন।[৩] তাই আগের সপ্তাহগুলোর মতো এ সপ্তাহেও প্রতিদিন আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া চালিয়ে যান।
- মাসে কত দিন? ১ মাস ৩ সপ্তাহ
- কোন ট্রাইমেস্টার? প্রথম ত্রৈমাসিক
- আর কত সপ্তাহ বাকি? ৩৩
৭ সপ্তাহে বাচ্চার বৃদ্ধি
শিশু গর্ভে খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে। সে এখন লম্বায় প্রায় ১০ মিলিমিটার, অর্থাৎ ১ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি—এক দানা মুড়ির সমান। গত সপ্তাহের তুলনায় শরীর আরও গুটিয়ে এখন সে গর্ভে ইংরেজি ‘C’ এর মতো অবস্থান নিয়েছে।[৪]
শিশুর মাথা খুব দ্রুত বেড়ে উঠছে
শিশুর ব্রেইন এসময়ে শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। একারণে তার মাথা এখন শরীরের অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় বড়। শিশুর কপালটাও বেশ বড়।
শিশুর চোখের লেন্স তৈরি হচ্ছে
ক্যামেরায় যেমন লেন্স থাকে, আমাদের চোখেও লেন্স আছে—যা আমাদেরকে স্পষ্ট দেখতে সাহায্য করে। এ সপ্তাহে ছোট্ট শিশুর চোখের ভেতরে সেই লেন্স তৈরি হচ্ছে।[৫] কানের ভেতরের অংশ তৈরি হতে শুরু করেছে।[৬] যেখানে শিশুর নাক তৈরি হবে, সেখানে ছোট্ট গর্ত হয়েছে।[৭] সবমিলিয়ে শিশুর মুখমণ্ডল তৈরির কাজ অনেকদূর এগিয়ে যাচ্ছে।
ছোট্টমণির হাত-পা বড় হচ্ছে
এসময়ে হাত-পায়ে নরম, কচকচে হাড় বা তরুণাস্থি তৈরি শুরু হয়েছে।[৮] এগুলো থেকেই পরবর্তীতে শিশুর হাত-পায়ের শক্ত হাড়গুলো তৈরি হবে। শিশুর হাতগুলো এখন লম্বা হচ্ছে। তবে হাতের প্রান্তগুলো এখন চ্যাপ্টা—দেখতে কিছুটা বৈঠার মতো।[৯]
৭ সপ্তাহে মায়ের শরীর
আপনার কি আজকাল ঘন ঘন পানির পিপাসা লাগছে? বেশ আবেগপ্রবণ লাগছে বা মনে হচ্ছে সবকিছুর ওপর থেকে কেমন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে? আপনি একা নন। গর্ভকালীন হরমোনের ওঠানামা আর শরীরে ঘটতে থাকা নানান পরিবর্তনের কারণে অনেকেরই এই সময়টাতে এমন লাগে।
শরীরে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
গর্ভকালে আপনার শরীরে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়। গর্ভকাল বাড়ার সাথে সাথে রক্তের পরিমাণ একসময়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ে![১০] এই বাড়তি রক্ত গর্ভে বেড়ে উঠতে থাকা শিশুর জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি আপনার জরায়ুতে পৌঁছে দিবে।
পর্যাপ্ত পানি পান
শরীরে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এখন বেশি পিপাসা লাগতে পারে। খেয়াল করে সারাদিনে ৮–১২ গ্লাস (২–৩ লিটার) পানি পান করার চেষ্টা করবেন।[১১] পানি একদিকে যেমন আপনার হজমে ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করবে, অন্যদিকে গর্ভে শিশুকে ঘিরে যে পানির মতো তরল থাকে, সেটা তৈরিতেও সহায়তা করবে।[১২] ডাক্তারি ভাষায় এটাকে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বলে, যা শিশুকে গর্ভের ভেতরে নানানভাবে সুরক্ষিত রাখে।[১৩] বমিভাব থাকলে ছোটো চুমুকে অল্প অল্প করে বারবার পানি খাবেন।
লাল চাল ও লাল আটা
খেয়াল করুন বাসায় কোন চাল আর আটা ব্যবহার হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সাদা চাল ও সাদা আটা ব্যবহার করি। তবে সেগুলোর তুলনায় লাল চাল ও লাল আটাতে পুষ্টিমান ও ফাইবার অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। লাল চালকে অনেকে ঢেঁকিছাঁটা চাল, কুড়াকাটা চাল বা ব্রাউন রাইস নামে চেনেন। এগুলো খেলে রক্তে সুগারের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ে, যা গর্ভের শিশুর জন্য ভালো।
অন্যদিকে সাদা চাল ও সাদা আটা খাওয়ার পর রক্তে সুগারের পরিমাণ হুট করে অনেক বেড়ে যায়, যা গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই সাদা চাল ও সাদা আটার বদলে লাল চাল ও লাল আটা ব্যবহার করা শুরু করুন।
এই পরিবর্তনটা ধীরে ধীরে করুন। প্রথমে হয়তো কয়েকদিন সাদা আটার সাথে লাল আটা মিশিয়ে রুটি বানালেন কিংবা এক বেলা সাদা চালের ভাত আর অন্য বেলায় লাল চালের ভাত মিশিয়ে খেলেন। লাল চাল ও লাল আটা খাওয়ার সাথে সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করবেন। নাহলে পেটে অস্বস্তি হতে পারে।
ঘন ঘন মনমেজাজ বদলানো বা মুড সুইং
আপনার এই খুশি, আবার এই মন খারাপ লাগতে পারে। ছোটোখাটো বিষয়ে মন খারাপ লাগা কিংবা কান্না করে ফেলার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। মনে হতে পারে যেন সবকিছুর ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে। গর্ভাবস্থায় এই অনুভূতিগুলো স্বাভাবিক।
তবে আপনার যদি প্রতিনিয়তই মন খারাপ লাগে অথবা দুশ্চিন্তা থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ছন্দপতন হয়, তাহলে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনে আপনার সঙ্গী, পরিবারের সদস্য, ও সহকর্মীদের কাছে সাহায্য চাইতে দ্বিধা বোধ করবেন না।
গর্ভের আকার
গর্ভের ভেতরে শিশু এখন খুব দ্রুত বেড়ে উঠছে। বাড়ন্ত শিশুকে ধারণ করার জন্য আপনার জরায়ুও ক্রমাগত বড় হচ্ছে। এ সপ্তাহে আপনার জরায়ুর আকার বেড়ে একটা মাঝারি আকারের কমলার সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আপনি হয়তো খেয়াল করছেন যে পায়জামার ফিতা একটু ঢিলা করে বাঁধতে হচ্ছে। তবে এখনই হয়তো বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাবে না যে আপনি মা হতে চলেছেন। সেজন্য ১২তম সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে
তবে আপনার আগে সন্তান হয়ে থাকলে তার আগেই বোঝা যেতে পারে। কারণ তখন পেট ও জরায়ুর পেশিগুলো একটু ঢিলে হয়ে আসে, আগের মত টানটান থাকে না।
অন্যান্য লক্ষণ
এ সপ্তাহেও ক্লান্তি, বমি বমি লাগা ও আবেগপ্রবণ অনুভব করা—সবমিলিয়ে সময়টা বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে। অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- মাথা ব্যথা
- সাদা স্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
- যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত হওয়া। এমন হলে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তার দেখাবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা কোনো মারাত্মক কারণে হয় না। তবে কখনো কখনো এটা গর্ভপাতের একটা লক্ষণ হতে পারে
- পিরিয়ড বা মাসিকের ব্যথার মতো তলপেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা অনুভব করা
- মুখে মেছতার মতো বাদামী, ছোপ ছোপ দাগ পড়া
- ঘন ও ঝলমলে চুল
- স্তনে হালকা ব্যথা হওয়া বা চাপ দিলে ব্যথা করা
- খাবারের অভ্যাসে লক্ষণীয় পরিবর্তন আসা। হঠাৎ প্রিয় কোনো খাবারে অরুচি কিংবা নতুন কোনো খাবারের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখা দিতে পারে। আবার নির্দিষ্ট কিছু খাবারের গন্ধে বমি বমিও লাগতে পারে
- তীব্র ঘ্রাণশক্তি
- মুখে অদ্ভুত/ধাতব স্বাদ পাওয়া
- পেটে অস্বস্তি বা পেট ফাঁপা হয়েছে এমন মনে হওয়া
এ সপ্তাহে বাবার করণীয়
পানি ভরে হাতের নাগালে রেখে দিন
এসময়ে গর্ভবতী মায়ের দিনে ২ থেকে ৩ লিটার পানি খাওয়া প্রয়োজন।[১৪] এই কাজটা আপনি একটু সহজ করে দিতে পারেন। সকালে আর সন্ধ্যায় একটা বোতলে পানি ভরে তার হাতের নাগালে রেখে দিন, তাহলে ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা কমবে। সাথে রাখুন একটা গ্লাস বা মগ, সম্ভব হলে সাথে গ্লাসের ঢাকনাও রেখে দিতে পারেন।
লাল চাল ও লাল আটা দিয়ে তৈরি খাবার খাওয়া শুরু করুন
লাল চাল ও লাল আটাতে অনেক পুষ্টিগুণ থাকে, যা মা ও গর্ভের শিশুর পাশাপাশি আপনাদের পুরো পরিবারের সুস্থতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। তবে একজনের জন্য বাসায় লাল চাল বা লাল আটা দিয়ে খাবার তৈরি করা কষ্টসাধ্য। তাই পরিবারের অন্য সদস্যদেরকেও চেষ্টা করে দেখতে অনুরোধ করুন। তাহলে আলাদা করে রান্না করার ঝামেলা থাকবে না, আবার সবার স্বাস্থ্যেরই উপকার হবে।
আপনি যদি বাজার করেন, তাহলে সাদা চাল ও আটার পাশাপাশি লাল চাল ও লাল আটাও কিনে আনুন। লাল চালকে অনেকে ঢেঁকিছাঁটা চাল, কুড়াকাটা চাল বা ব্রাউন রাইস নামে চেনেন।
সঙ্গীর সাথে কথা বলে খাবার তালিকায় এসবের পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়ানোর ব্যবস্থা করুন। স্বাদের সাথে অভ্যস্ত হতে হয়তো খানিকটা সময় লাগবে। এজন্য প্রথমে কয়েকদিন সাদা আটার সাথে লাল আটা মিশিয়ে রুটি তৈরি করে খেতে পারেন। একবেলা লাল চালের ভাত, আরেক বেলা সাদা চালের ভাত—এভাবেও চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
আস্তে আস্তে পরিমাণ বাড়াবেন ও পর্যাপ্ত পানি পান করবেন। নাহলে পেটে অস্বস্তি হতে পারে।
মুড সুইং হলে মানসিক সাপোর্ট দিন
আপনার সঙ্গীর এখন বেশি আবেগপ্রবণ লাগতে পারে। ছোটোখাটো বিষয়ে তার মন খারাপ হতে পারে, এমনকি কেঁদে ফেলতে পারে। এসময়ে আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে তাকে মানসিক সাপোর্ট দিন। আবেগ নিয়ে কথা বলার অভ্যাস না থাকলেও সঙ্গীর পাশে বসে তার মনের অবস্থা শুনুন, নিজে থেকে দুই-একটা প্রশ্ন করুন এ নিয়ে। এই কয়েকটা সপ্তাহে তার ইচ্ছাকে যথাসম্ভব প্রাধান্য দিন এবং ধৈর্য ধরুন।
কথা কাটাকাটি হলে আপনি মাথা ঠাণ্ডা রাখুন
আবেগপ্রবণ অবস্থায় সঙ্গী আপনাকে কষ্টদায়ক কথাবার্তা বলতে পারে বা সামান্য বিষয়ে কথা কাটাকাটি হতে পারে। এসময়ে আপনার মাথা ঠাণ্ডা রাখা সহজ না হলেও শিশুর মা আসলে কী বলতে চাইছেন সেদিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করবেন। আপনার কোনো ভুল হয়েছে বুঝতে পারলে সেটা ঠিক করার উদ্যোগ নিবেন। আর গায়ে লাগার মতো কথাগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।