গর্ভাবস্থায় বাইরে কাজ করা নিয়ে অনেকে সংশয়ে থাকেন। এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগাটা স্বাভাবিক। গর্ভাবস্থায় শরীরে যেসব পরিবর্তন আসে সেগুলোর সাথে মানিয়ে নিয়ে কাজ করাটা সবসময় সহজ হয় না। তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে আর সাবধানতা অবলম্বন করলে গর্ভাবস্থায়ও আপনি স্বাভাবিকের মতো কাজ করতে পারবেন।
গর্ভাবস্থায় বাইরে কাজ করা কি নিরাপদ?
সাধারণত গর্ভাবস্থায় কাজ করা নিরাপদ, এটি গর্ভকালীন জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায় না।[১] আপনি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে এবং গর্ভকালীন জটিলতা না থাকলে সাধারণত বাইরে কাজ করা নিরাপদ বিবেচনা করা হয়।
অন্যদিকে বিপদজনক অথবা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে (যেমন: বিষাক্ত কেমিক্যাল অথবা রেডিয়েশনের সংস্পর্শে) কাজ করলে, ভারী জিনিস তোলার কাজ করলে অথবা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ পড়ে এমন কাজ করলে সেটা গর্ভের শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।[২][৩] তাই গর্ভাবস্থায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো মাথায় রেখে কিছু বিষয়ে ঠিক করে নেওয়া প্রয়োজন। এভাবে গর্ভাবস্থার অনেকটা সময় পর্যন্ত নিরাপদে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।[৪]
গর্ভাবস্থার জন্য কোন কাজগুলো ঝুঁকিপূর্ণ?
গর্ভাবস্থায় চাকরি করা বা বাইরে কাজ করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপদ। তবে কিছু কিছু কাজ গর্ভাবস্থার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যেমন—
শারীরিক কসরতের কাজ
- যেসব কাজে লম্বা সময় ধরে একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, দিনে ২.৫ ঘণ্টার বেশি সময় দাঁড়িয়ে কাজ করলে অকাল প্রসবের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়।[৫]
- যেসব কাজে অনেক বেশি পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অধিক শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করলে গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতার ঝুঁকি বাড়ে৷[৬][৭] সপ্তাহে ৪২ ঘন্টার বেশি কাজ করার সাথে অকাল প্রসবের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।[৮]
- যেসব কাজে ভারী জিনিস ওঠানামা বা ওয়েট লিফটিং এর প্রয়োজন পড়ে। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ভারী কাজ করলে গর্ভপাত, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, অকাল প্রসব ও গর্ভের শিশু স্বাভাবিকের চেয়ে অপুষ্ট বা ছোটো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে।[৯] একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ১০ কেজি অথবা তার চেয়ে ভারী জিনিস ওঠানামা করা এবং দিনে দশ বারের বেশি ভারী কাজ করার সাথে গর্ভপাত ও অকাল প্রসবের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে।[১০]
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ
- যেসব কাজে বিষাক্ত কেমিক্যাল এর সংস্পর্শে যেতে হয়। রাবার, প্লাস্টিক, টেক্সটাইল অথবা লেদার ফ্যাক্টরি, প্রিন্টিং প্রেস, শিপ ইয়ার্ড, ঔষধ অথবা সার তৈরির কারখানা, ওয়েল্ডিং এর কাজ —এসব ক্ষেত্রে আর্সেনিক, লেড, মার্কারি, কার্বন মনোক্সাইড এর মতো নানান ধরনের বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি থাকে। এই ধরনের বিভিন্ন জৈব ও অজৈব পদার্থ গর্ভবতী ও গর্ভের শিশুর ক্ষতি করতে পারে।[১১][১২]
- হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স বা মেডিকেল স্টাফ এর কাজ। এক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নানান রোগজীবাণু, এক্স-রে, রেডিয়েশন, অ্যানেস্থেশিয়ার বা অজ্ঞান করার গ্যাস, অপারেশন রুমের যন্ত্রপাতি, জীবাণুমুক্ত করার কেমিক্যাল ও ক্যান্সারের ঔষধের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হয়।
- যারা পশুপাখি নিয়ে অথবা মাংসের দোকানে কাজ করেন। এমন কাজ করলে ‘টক্সোপ্লাসমোসিস’ নামক ইনফেকশনসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় টক্সোপ্লাসমোসিস রোগ হলে তা গর্ভের শিশুর চোখে দেখা ও কানে শোনার ক্ষমতা এবং বুদ্ধিমত্তার ক্ষতি করতে পারে।[১৩]
- যেসব কাজে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, অতিরিক্ত ঠান্ডা অথবা উচ্চশব্দ —এসবের মধ্যে কাজ করতে হয়। এগুলোও গর্ভাবস্থার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
- যেসব কাজে কোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ মেশিন চালাতে হয়। এসব চালানোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ ধরনের কাজ
- লম্বা সময় ধরে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে থাকার কাজ। কম্পিউটার, ট্যাব ও মোবাইল—এই ধরনের যন্ত্র থেকে সাধারণত খুব সামান্য পরিমাণে রেডিয়েশন বের হয়, যা সাধারণত গর্ভের শিশুর ক্ষতি করে না। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ একটানা স্ক্রিনের সামনে বসে থাকলে রেডিয়েশনের পরিমাণ বেড়ে শিশুর ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া লম্বা সময় ধরে টাইপিং এর কাজ করলে হাত ঝিনঝিন করতে পারে৷
- নাইট শিফট করতে হয় এমন কাজ। এই ধরনের কাজ গর্ভাবস্থার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় নাইট শিফটে কাজ করলে সেটি গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।[১৪][১৫]
- মানসিক চাপ বেড়ে যায় এমন কাজ। বিভিন্ন ধরনের কাজে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় (বিশেষ করে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে) মানসিক চাপ অথবা ক্লান্তি বেড়ে গেলে প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও অকাল প্রসবের মতো জটিলতাও বেড়ে যায়।[১৬] তাই এসময়ে মানসিক চাপ ও ক্লান্তি যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।
আপনার কাছের সহকর্মীদের সাথে স্ট্রেস নিয়ে কথা বলতে পারেন। দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ ভাগাভাগি করে নিলে সেটা মোকাবেলা করা আপনার জন্য সহজ হতে পারে। অফিসের কোনো নির্দিষ্ট কাজ অথবা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির ব্যবহারে মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে মনে হলে এই বিষয়ে আপনার ম্যানেজারের সাথে খোলাখুলি কথা বলুন।
গর্ভাবস্থায় কিভাবে কাজ করা চালিয়ে যাবেন?
গর্ভাবস্থায় আরামদায়কভাবে কাজ করার জন্য কিছু সাধারণ উপায় মেনে চলতে পারেন—
- একটানা কাজ না করে মাঝে মাঝে বিরতি নিন।
- কাজের ফাঁকে ফাঁকে হালকা হাঁটাচলা করুন।
- আরামদায়ক ঢিলেঢালা পোশাক পরার চেষ্টা করুন।
- ঘন ঘন পানি পান করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- একসাথে বেশি না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খান।
- কম্পিউটারের সামনে কাজ করলে আপনার চেয়ার ও মনিটরের উচ্চতা যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- কর্মক্ষেত্রে আপনার বসার জায়গাটি অসুবিধাজনক হলে তা পরিবর্তন করে দেওয়ার অনুরোধ করতে পারেন।
- প্রয়োজনে বসার জায়গার পাশে পা রাখার জন্য টুল বা মোড়া ব্যবহার করতে পারেন।
- সুযোগ থাকলে কাজের ফাঁকে হালকা ব্যায়াম করে নিন। দ্রুত হাঁটার মতো সহজ কিছু বেছে নিতে পারেন। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত অ্যারোবিক এক্সারসাইজ (যেমন: হাঁটা ও সাইকেল চালানো) ও স্ট্রেংথ এক্সারসাইজ (যেমন: পুশ আপ ও স্কোয়াট) করা উচিত।[১৭][১৮] চাইলে যোগব্যায়ামও করতে পারেন। এগুলো শরীর ও মন দুটোই ভালো রাখতে সাহায্য করবে।[১৯] তবে গর্ভাবস্থায় ভারোত্তোলনের মতো ব্যায়ামের ক্ষেত্রে কতটুকু ভার নিয়ে কাজ করা হচ্ছে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
সর্বোপরি যেভাবে নিজের ও গর্ভের শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত হয় সেভাবে কাজ করার চেষ্টা করুন। গর্ভাবস্থায় আগের মতো একই পরিমাণ কাজ করা হয়তো আপনার পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। এটা নিয়ে মন খারাপ করবেন না, অপরাধবোধে ভুগবেন না।
কর্মক্ষেত্রে গর্ভকালীন লক্ষণগুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন?
গর্ভাবস্থায় কাজ করা নিরাপদ হলেও সবসময় সহজ নয়। নানান শারীরিক পরিবর্তন ও লক্ষণের সাথে মানিয়ে নিয়ে তবেই কাজ করতে হয়। গর্ভাবস্থার কমন লক্ষণগুলো কর্মক্ষেত্রে যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন—
মর্নিং সিকনেস বা বমি বমি ভাব
গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই বমি বমি ভাব একটা কমন লক্ষণ। অফিসে বা কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন ধরনের গন্ধ থেকে বমি বমি ভাব অথবা বমি হতে পারে।[২০] এমন হলে কাজে বাধা পড়া অস্বাভাবিক নয়। তাই যেসব কারণে আপনার বমি বমি ভাব বেড়ে যায় সেগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
প্রতিবার খাওয়ার সময়ে অল্প অল্প করে খাওয়ার চেষ্টা করুন। আদা দিয়ে চা অথবা শুধু আদা খেয়ে দেখতে পারেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আদা গর্ভকালীন বমি বমি ভাব কমাতে সাহায্য করে।[২১]
সেই সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন গড়ে ৮–১২ গ্লাস পানি পান করা উচিত।[২২] এ ছাড়া অতিরিক্ত তেল-মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। সাধারণত এসব পরামর্শ মেনে বমি বমি ভাব মোকাবেলা করা যায়।
এসব পরামর্শ মেনে চলার পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করতে পারেন। যেমন, খারাপ লাগতে শুরু করলে কাজের ফাঁকে অল্প কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে নিতে পারেন। যদি সম্ভব হয় তাহলে আপনার যখন একটু ভালো লাগবে, তখন কাজের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশটুকু সেরে রাখতে পারেন।
কারও কারও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বমি হওয়ার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শিরায় স্যালাইন ও বমির ঔষধ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।[২৩] এতে অফিস থেকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিতে হতে পারে।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব
ক্লান্তি
গর্ভাবস্থায় অনেকে অল্প পরিশ্রমে অধিক ক্লান্ত বোধ করেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, কাজের চাপে তৈরি হওয়া ক্লান্তির সাথে গর্ভবতীর স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে[২৪] তাই আপনার সহ্যক্ষমতা বা ধারণক্ষমতার বেশি পরিশ্রম করতে যাবেন না। এসময়ে ক্লান্ত লাগলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করুন। কাজের বাইরের সময়টায় মাঝে মাঝে পা তুলে বসে আরাম করুন। এ ছাড়া অনেক ক্লান্ত লাগলে কাজের মাঝেও ছোটো ছোটো বিরতি নিয়ে একটু জিরিয়ে নিন।
ক্লান্তি দূর করতে রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনের চেয়ে কম ঘুমালে বা ঠিকমতো না ঘুমালে তা গর্ভের শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।[২৫] এমনকি শিশু আকারে ছোটো হওয়ার ও অকাল প্রসবের মতো জটিলতার সম্ভাবনা থাকে।[২৬] সাধারণত ৭–৯ ঘণ্টার ঘুমকেই আদর্শ বলে ধরা হয়।[২৭][২৮]
গর্ভাবস্থায় ঘরের কাজ করার ক্ষেত্রেও চেষ্টা করুন খুব বেশি চাপ না নিতে। ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। নিজে সুস্থ থেকে যতটুকু কাজ করা যায় ততটুকু কাজ করুন। প্রয়োজনে ঘরের কাজে পরিবারের বাকিদের সাহায্য নিন। সম্ভব হলে কাজে সহায়তা করার জন্য লোক রাখুন৷
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ক্লান্তি
ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ
গর্ভাবস্থায় শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোনের মাত্রার পরিবর্তনের কারণে কিডনির প্রস্রাব তৈরি করার ক্ষমতা অনেকখানি বেড়ে যায়। ফলে কিডনি আরও বেশি করে প্রস্রাব তৈরির কাজ করে।[২৯] এ ছাড়া গর্ভে শিশুর অবস্থানের কারণেও প্রস্রাবের বেগ আগের থেকে বেড়ে যেতে পারে। এজন্য কর্মক্ষেত্রে বারবার প্রস্রাব করতে যেতে হতে পারে।
এই ঘটনা অনেকসময় বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়, তাই কেউ কেউ প্রস্রাব চেপে রাখেন। এই কাজ কখনোই করা উচিত নয়। এতে অস্বস্তি আরও বাড়বে। নিয়মিত এমন করার অভ্যাস থাকলে সেটা মূত্রথলির পেশিগুলোকে দুর্বল করে দিতে পারে৷[৩০] এ ছাড়া প্রস্রাবের ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে৷[৩১] তাই বিরক্তিকর মনে হলেও আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী কাজের ফাঁকে নিয়মিত ছোটো ছোটো বিরতি নিয়ে প্রস্রাব করবেন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব
পিঠে ও কোমরে ব্যথা
গর্ভাবস্থায় পিঠে অথবা কোমরে ব্যথা হওয়া খুব কমন। এ ধরনের ব্যথা প্রতিরোধে—
- কাজের জায়গায় আরামদায়ক জুতা পরার চেষ্টা করুন। যেমন: স্নিকার্স অথবা কেডস।
- কাজ করার সময়ে আপনার দেহভঙ্গি ঠিক আছে কি না তা খেয়াল করুন। অনেকসময় অস্বাস্থ্যকর দেহভঙ্গির, অর্থাৎ এঁকেবেঁকে বসার কারণে পিঠে বা কোমরে ব্যথা হতে পারে৷
- কাজের মাঝে বিরতি নিয়ে হালকা হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। একটানা একই ভঙ্গিতে বসে থাকলে পিঠ ও কোমর ব্যথা হওয়ার পাশাপাশি পা কামড়ানোর সমস্যা হতে পারে।
- কোমরে ব্যথার জন্য বেল্ট পরতে পারেন। এগুলো ফার্মেসিতে ‘লাম্বার সাপোর্ট’ বা ‘লাম্বার কোরসেট’ নামে পাওয়া যায়। চাইলে গর্ভাবস্থায় পরার জন্য যেসব বিশেষ প্রেগন্যান্সি বেল্ট পাওয়া যায় সেগুলো কিনে নিতে পারেন।
- ব্যথা কমাতে ব্যথার জায়গায় ঠান্ডা বরফ ব্যবহার করতে পারেন। দুই-একদিন পরে গরম সেঁক নিতে পারেন।
এসব উপদেশ ঠিকমতো মেনে চলার পরেও ব্যথা না কমলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় কোমর ব্যথা
বিভিন্ন ধরনের অস্বস্তি
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের পর থেকে শরীরের নানান পরিবর্তনের কারণে বুক জ্বালাপোড়া, গিরায় ব্যথা, পাইলস ও ভেরিকোস ভেইনের মতো বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।[৩২] সেই সাথে বাড়ন্ত গর্ভের কারণে শারীরিক অস্বস্তিও বাড়তে থাকে।
এমন হলে অস্বস্তি কমাতে আপনার সুপারভাইজার বা ম্যানেজারের সাথে কথা বলে দেখুন যে কাজের শিডিউলে কোনো পরিবর্তন আনা যায় কি না। কয়েক ঘণ্টা পরপর কিছুক্ষণের জন্য বিরতি নিন। পাঁচ ঘণ্টা কাজ করার পরে কিছুটা লম্বা সময়ের জন্য বিরতি নিন। এসময়ে একটানা দাঁড়িয়ে থাকা, ভারী জিনিস তোলা ও ঝুঁকে কাজ করা যতটা সম্ভব কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।[৩৩] জিনিস তোলার সময়ে সঠিক নিয়ম মেনে তুলবেন।
ভারী জিনিস তোলা ও বহন করার সময়ে নিচের সতর্কতাগুলো অবলম্বন করুন—
- অন্যের সাহায্য নিয়ে ভালোমতো ধরে ওঠান
- পা ফাঁকা করে নিন। এতে ভার বহনে সুবিধা হবে
- জিনিস শরীরের যতটা সম্ভব কাছাকাছি রেখে এরপর তুলুন
- নিচু হতে কোমর সামনের দিকে না বাঁকিয়ে বরং হাঁটু ভাঁজ করুন
- বহন করার সময়ে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে বহন করুন। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করুন
- কখনও ভারী জিনিস তোলার কিংবা বহন করার সময়ে শরীর বাঁকাবেন না
অবচেতন হয়ে যাওয়া
গর্ভাবস্থায় সচেতনতা বা বোধশক্তি কমে যাওয়ার ঘটনাকে ‘প্রেগন্যান্সি ব্রেইন’ বলা হয়। ৭০০ জনের বেশি গর্ভবতী নারীর ওপরে করা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, প্রায় ৮০ শতাংশ নারীই গর্ভাবস্থায় এই ধরনের লক্ষণ অনুভব করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে কমন লক্ষণ হলো ভুলে যাওয়া।[৩৪] একারণে মন-মেজাজের ওপরে প্রভাব পড়তে পারে। এসব বিষয় আপনার কাজের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে এ নিয়ে বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। প্রেগন্যান্সি ব্রেইন ঠিক প্রতিরোধ করা না গেলেও এটি সাধারণত গুরুতর কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হলে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন। নিজেকে যতটা সম্ভব উৎফুল্ল রাখবেন।
ঘন ঘন পিপাসা
গর্ভাবস্থায় বাকি সবকিছুর মতো আপনার শরীরে পানির চাহিদাও বেড়ে যায়৷ তাই এসময়ে ঘন ঘন পিপাসা পেতে থাকে। এই সমস্যার সহজ সমাধান হলো আপনার কাজের জায়গায় বা ডেস্কে সবসময় একটি পানির বোতল রাখা৷ এতে করে পিপাসা পেলে বারবার কাজ থেকে ওঠার প্রয়োজন পড়বে না।
গর্ভাবস্থায় কখন কাজ করা বন্ধ করতে হবে?
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাইরে কাজ করলে গর্ভাবস্থার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আপনার ডাক্তার আপনাকে বাইরে কাজ করতে নিষেধ করতে কিংবা কাজের পরিধি ও সময় কমিয়ে আনার পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন—
- আপনার যদি নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে সন্তান জন্মদানের বা অকাল প্রসবের সম্ভাবনা থাকে।
- আপনি যদি গর্ভে যমজ অথবা দুই এর অধিক সন্তান ধারণ করেন।
- আপনার যদি অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকে অথবা প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি থাকে।
- গর্ভের শিশু যদি সময়ের সাথে সাথে ঠিকমতো না বাড়ে। একে ডাক্তারি ভাষায় ‘ইন্ট্রাইউটেরাইন গ্রোথ রিটার্ডেশন’ বা সংক্ষেপে IUGR বলা হয়।
- আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে যদি দেখা যায় যে আপনার প্লাসেন্টা প্রিভিয়া রয়েছে। অর্থাৎ গর্ভফুল বা প্লাসেন্টা যদি তার জায়গায় না থেকে নিচে নেমে আসে।
- আপনার যদি ইতোপূর্বে অকাল প্রসব, গর্ভপাত অথবা মৃত বাচ্চা প্রসবের ঘটনা ঘটে থাকে।
আপনার গর্ভাবস্থায় এসব জটিলতা থাকলে ডাক্তার আপনাকে কাজ করার পরিবর্তে বিশ্রাম করার পরামর্শ দিতে পারেন। আপনার অবস্থা ঠিক কতটা গুরুতর বা জটিল তার ওপর ভিত্তি করে আপনাকে পুরোপুরি বা আংশিক বেড রেস্টে থাকার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। উল্লেখ্য, এসব ক্ষেত্রে যে সবসময়ই কাজ করা কমিয়ে অথবা বন্ধ করে দিতে হবে তা নয়। তাই ডাক্তারের সাথে বিস্তারিত পরামর্শ করে এরপর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
এটি নির্ভর করছে আপনি গার্মেন্টস এ ঠিক কী ধরনের কাজ করছেন তার ওপর। যদি আপনার কাজটি এমন হয় যাতে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা লাগে, সেক্ষেত্রে বসে কাজ করা যায় এমন কোনো কাজ করা সম্ভব কি না তা চেষ্টা করে দেখুন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় (বিশেষ করে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে) অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এমন কাজ করলে প্রিটার্ম ডেলিভারি, অর্থাৎ সময়ের আগে সন্তান প্রসব হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।[৩৫]
তা ছাড়া আপনার যদি ভারী জিনিস ওঠানামা করার কাজ করতে হয়, তাহলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।[৩৬] তাই গর্ভাবস্থায়, বিশেষ করে প্রথম কয়েক মাস বেশি ভারী জিনিস ওঠানামার কাজ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। এসব ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনে আপনার ম্যানেজার বা সুপারভাইজারের সাথে কাজের ধরনে সাময়িক পরিবর্তন আনা যায় কি না সেই বিষয়ে আলোচনা করে নিন।
গর্ভাবস্থায় দূরে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে এসময়ে প্রতিদিন বাসা থেকে দূরে গিয়ে কাজ করলে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন: রাস্তায় অথবা যানবাহনে অনেক সময় লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে গাড়িতে বসে থাকার কারণে আপনার কোমরে ব্যথা ও বমি বমি ভাব বেড়ে যেতে পারে, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পেয়ে সমস্যা হতে পারে। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে গাড়ির ঝাঁকুনি ও বাইরের গরমে আপনার ও গর্ভের শিশুর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
তাই দূরের কাজ করতে যাওয়ার সময়ে যাত্রাপথে কিছুক্ষণ পরপর পা নাড়াচাড়া করুন। সম্ভব হলে গর্ভাবস্থায় সাময়িকভাবে দূরে গিয়ে কাজ করা বন্ধ রাখা যায় কি না তা ভেবে দেখতে পারেন। প্রয়োজনে আপনার অফিস থেকে এই বিষয়ে সাহায্য চাইতে পারেন।
এর কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অনেকে শেষ তিন মাস বাইরে কাজ করা থেকে বিরত থাকেন। আবার অনেকে শেষ মাসে কাজ থেকে ছুটি নেন। আপনার কাজের ধরন, আপনি যেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে নিয়ম, আপনার গর্ভাবস্থায় কোনো জটিলতা দেখা দিচ্ছে কি না —এসব বিষয় বিবেচনা করে এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আপনার গর্ভাবস্থায় যদি এমন কোনো জটিলতা বা স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে যে কারণে ডাক্তার আপনাকে পুরোপুরি বেড রেস্টে বা বিশ্রামে থাকতে বলেন, সেক্ষেত্রে সব ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তাই ডাক্তারের সাথে বেড রেস্টের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে নিন।