গর্ভকালীন সময়ে আপনি ও আপনার পরিবার অনেকের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ পাবেন। এসবের মধ্যে কিছু পরামর্শ সঠিক হলেও, আবার কিছু পরামর্শ থাকে যা বিজ্ঞান সম্মত নয়। এমনকি এসবের কোনো কোনোটি মেনে চললে মা ও শিশুর ক্ষতিও হতে পারে। এই আর্টিকেলে গর্ভাবস্থা নিয়ে বহুল প্রচলিত কিছু ধারণার ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে তা তুলে ধরা হয়েছে।
শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ
১. গর্ভবতী মায়ের পেটের আকৃতি দেখে গর্ভের শিশু ছেলে না কি মেয়ে তা বোঝা সম্ভব
গর্ভাবস্থায় পেট নিচের দিকে বড় হলে ছেলে এবং ওপরের দিকে বড় হলে বা উঁচু হলে মেয়ে সন্তান হবে—এমনটা অনেকে বলে থাকেন।
বিজ্ঞান যা বলে: এই ধারণার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। একজন গর্ভবতী নারীর বাড়ন্ত পেট ওপরের দিকে অথবা নিচের দিকে বাড়ার সাথে তার গর্ভের সন্তান মেয়ে কিংবা ছেলে হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রকৃতপক্ষে একজন নারী যতবার গর্ভধারণ করেন, তার পেটের পেশিগুলো তত বেশি প্রসারিত হয়। তাই কেউ প্রথমবারের মতো গর্ভধারণ করলে গর্ভাবস্থায় তার পেট হয়তো খুব বেশি নিচে নামে না। এমনকি উঁচু হয়েও থাকতে পারে। এ ছাড়া কারও পেটের পেশিগুলো অপেক্ষাকৃত শক্ত হলে তার বাড়ন্ত পেট কিছুটা উঁচু হয়ে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে তার গর্ভের শিশু ছেলে অথবা মেয়ে—যে কোনোটিই হতে পারে।
২. গর্ভের শিশুর হার্টরেট গুণে শিশুটি ছেলে না কি মেয়ে তা বোঝা যায়
বিজ্ঞান যা বলে: এই ধারণাটি ভুল। একথা সত্য যে জন্মের পর ছেলে সন্তানের চেয়ে মেয়ে সন্তানের হার্টরেট সাধারণত বেশি হয়। তবে গর্ভে থাকাকালীন সময়ে ছেলে ও মেয়ে শিশুর হার্টরেটে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না।[১] তাই গর্ভের শিশুর হার্টরেট গুণে শিশুটি ছেলে না কি মেয়ে তা বোঝা সম্ভব নয়।
ছেলে কিংবা মেয়ে হোক, গর্ভকালের একেক পর্যায়ে গর্ভের শিশুর হার্টরেট একেক রকম হয়। যেমন, গর্ভাবস্থার পঞ্চম সপ্তাহে গর্ভের শিশুর হার্ট মিনিটে ৮০–৮৫ বার স্পন্দিত হয়। এটা নবম সপ্তাহের প্রথমদিক পর্যন্ত বাড়তে বাড়তে মিনিটে ১৭০–২০০ হার্টবিটে পৌঁছে। এরপর হার্টরেট কমতে শুরু করে। গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি সময়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এটা কমে দাঁড়ায় মিনিটে ১২০–১৬০ হার্টবিট (গড়) পর্যন্ত। প্রসবের সময়ে ছেলে ও মেয়ে শিশু উভয়ের হার্টবিট থাকে মিনিটে ১২০–১৬০।
৩. গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব বেশি হলে গর্ভের শিশু মেয়ে হয়
বিজ্ঞান যা বলে: শুনতে অবাক লাগলেও এই ধারণা সত্য হতে পারে। কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যেসব গর্ভবতী নারীরা গর্ভে মেয়ে শিশু অথবা যমজ শিশু ধারণ করেন, তাদের গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি।[২]
এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়েছে যে, গর্ভে মেয়ে শিশু থাকলে এইচসিজি হরমোনের পরিমাণের তারতম্যের কারণে গর্ভবতী নারীর বমি বমি ভাব বাড়তে পারে।[৩] তবে এই তথ্যটি এখনো শক্তভাবে প্রমাণিত হয়নি।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব
শিশুর গঠন ও বৃদ্ধি
৪. গর্ভাবস্থায় বুকে জ্বালাপোড়া করলে গর্ভের শিশু মাথাভর্তি চুল নিয়ে জন্মাবে
বিজ্ঞান যা বলে: শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও একটি গবেষণায় গর্ভাবস্থায় অধিক পরিমাণে বুক জ্বালাপোড়া করার সাথে শিশুর চুল ঘন হওয়ার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। সেখানে দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় যেসব নারীরা বেশি বুক জ্বালাপোড়া অনুভব করেছেন, তাদের গর্ভের শিশুর তুলনামূলকভাবে বেশি চুল নিয়ে জন্মেছে।
গবেষকরা ধারণা করেন যে, গর্ভাবস্থায় যেসব হরমোনের কারণে বুকে জ্বালাপোড়া বেড়ে যায়, সেই হরমোনগুলোই সম্ভবত গর্ভের শিশুর চুলের বৃদ্ধির পেছনেও কাজ করে।[৪] তবে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় বুক জ্বালাপোড়া
খাবার সংক্রান্ত
৫. গর্ভাবস্থায় দুধ অথবা বাদাম খেলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হয়
বিজ্ঞান যা বলে: গর্ভাবস্থায় কাঁচা বা অপাস্তুরিত দুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। আগুনে ফোটানো বা পাস্তুরিত দুধ খেতে কোনো বাধা নেই।
অতীতে ধারণা করা হতো যে, গর্ভাবস্থায় বাদাম খাওয়া এড়িয়ে চললে গর্ভের শিশুর বাদামের অ্যালার্জি হবে না।[৫] তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই আপনি চাইলে সুষম খাবার তালিকার অংশ হিসেবে বাদাম খেতেই পারেন।[৬]
কিছু ক্ষেত্রে আপনার জন্য দুধ অথবা বাদাম ক্ষতিকর হতে পারে। এমন কিছু কারণ হলো—
- আপনার দুধ অথবা বাদামের প্রতি এলার্জি থাকলে
- গর্ভকালীন সময়ে কোনো নির্দিষ্ট কারণে ডাক্তার আপনাকে দুধ অথবা বাদাম খেতে বারণ করলে
এসব ক্ষেত্রে এধরনের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। পাশাপাশি অন্য কোনো খাবারের বিষয়ে ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা থাকলে সেটাও মেনে চলার চেষ্টা করুন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় কী কী খাওয়া যাবে না
৬. গর্ভাবস্থায় দুইজনের সমপরিমাণ খাবার খেতে হয়
বিজ্ঞান যা বলে: গর্ভাবস্থায় দুইজনের সমপরিমাণ বা স্বাভাবিকের দ্বিগুণ পরিমাণ খাবার খেতে হবে—এই কথার কোনো ভিত্তি নেই। বরং এই পরামর্শ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।[৭]
গর্ভাবস্থায় কতটুকু খাবার বেশি খেতে হবে তা বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করতে পারে। যেমন: আপনার ওজন, আপনার উচ্চতা, আপনি দৈনিক কী পরিমাণ কাজ করছেন অথবা আপনার গর্ভাবস্থার কততম মাস চলছে।
গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসে সাধারণত বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় না। তবে এর পরের মাসগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি খাবার খেতে হবে। এসময়ে একই ধরনের খাবার বেশি পরিমাণে খেয়ে পূরণ না করে বিভিন্ন ধরনের খাবার থেকে মেটানো উচিত। প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় বৈচিত্র্য থাকলে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণ হবে।
পড়ুন: গর্ভাবস্থার কোন মাসে কতটুকু বাড়তি খাবার খেতে হবে?
৭. গর্ভাবস্থায় পেঁপে ও আনারস খেলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে
বিজ্ঞান যা বলে: গর্ভাবস্থায় সাধারণত বেশি বেশি ফলমূল খেতে উৎসাহিত করা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। যেমন, গর্ভাবস্থায় কাঁচা অথবা আধাকাঁচা পেঁপে না খাওয়াই ভালো। কাঁচা পেঁপেতে উচ্চমাত্রায় ল্যাটেক্স থাকে। ইঁদুরের ওপর করা গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ল্যাটেক্স জরায়ুর শক্তিশালী সংকোচন করে থাকে।[৮] তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, কাঁচা পেঁপে খেলে সেটি গর্ভের শিশুর জন্য নিরাপদ না-ও হতে পারে। তবে পাকা পেঁপে খেতে কোনো সমস্যা নেই। পাকা পেঁপে ভিটামিন সি-সহ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদানের একটি ভালো উৎস।
অনেকে হয়তো শুনে থাকবেন যে আনারস খেলে গর্ভপাত হয়। এই ধারণার পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৯]
গর্ভাবস্থায় সাধারণত আনারস খাওয়া নিরাপদ। আনারসে প্রচুর পানি থাকে। সেই সাথে থাকে অনেকখানি ভিটামিন বি৬ ও ভিটামিন সি। ভিটামিন বি৬ ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে, আর ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধে এবং হাড় ও মাংস শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।[১০] তবে একেবারে অনেক বেশি আনারস না খাওয়াই ভালো, নাহলে বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে।
৮. গর্ভাবস্থায় খাসির মাংস খেলে বাচ্চার শরীর থেকে বাজে গন্ধ বের হবে
বিজ্ঞান যা বলে: খাসির মাংস খাওয়ার সাথে শিশুর শরীর থেকে বাজে গন্ধ বের হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। খাসির মাংস প্রোটিন ও আয়রনের উৎকৃষ্ট একটি উৎস। এসবের চাহিদা মেটাতে গর্ভবতী মায়েদের ভালোমতো সিদ্ধ করা খাসির মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
তবে গরু, খাসি ও ছাগলের মাংসে তুলনামূলকভাবে বেশি চর্বি থাকে। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেলে মায়ের অস্বাস্থ্যকর ওজন বাড়ার পাশাপাশি হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই গরু-খাসির মাংস অনেক বেশি না খেয়ে পরিমিত পরিমাণে খাবেন। খাওয়ার সময়ে চর্বি ছাড়া মাংসের টুকরা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
উল্লেখ্য, প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে খাসির মাংসের পাশাপাশি মাছ, ডিম, ডাল ও মুরগির মাংস বেছে নিতে পারেন।
৯. গর্ভাবস্থায় যমজ কলা খেলে যমজ সন্তান হবে
বিজ্ঞান যা বলে: গর্ভাবস্থায় যমজ কলা অথবা অন্য কোনো ফল খেলে যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়—এমন ধারণা প্রচলিত আছে। তবে এর সপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে যে, কিছু বিষয় যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে কিংবা কমাতে পারে। যেমন, ৩৫ বছরের পরে গর্ভধারণ করলে যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[১১] কৃত্রিমভাবে গর্ভধারণের ক্ষেত্রেও যমজ সন্তান হওয়ার ঘটনা বেশি দেখা যায়। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসের সাথেও যমজ সন্তান হওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে।[১২] বিশেষ করে যারা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার বেশি খান, তাদের মাঝে যমজ সন্তান হওয়ার ঘটনা বেশি দেখা গেছে।[১৩] এ ছাড়া উচ্চতা, ওজন ও জেনেটিক কারণেও যমজ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে কিংবা কমতে পারে।
মায়ের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা
১০. গর্ভাবস্থায় গরম পানি দিয়ে গোসল করা উচিত নয়
বিজ্ঞান যা বলে: গর্ভাবস্থায় কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করতে কোনো সমস্যা নেই। তবে গর্ভাবস্থায় খুব বেশি তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এতে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।[১৪]
১১. গর্ভাবস্থায় চুলে রঙ করা যাবে না
বিজ্ঞান যা বলে: সব ধরনের চুলের রঙেই কেমিক্যাল থাকে। অধিকাংশ গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, চুলের রঙে যে অল্প পরিমাণ কেমিক্যাল থাকে তা গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর নয়।[১৫] তবে এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় চুলে রঙ করতে চাইলে আপনি গর্ভাবস্থার প্রথম ১২ সপ্তাহের পরের সময়টা বেছে নিতে পারেন। কারণ গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে কেমিক্যালের কারণে শিশুর যে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা ১২ সপ্তাহের পর অনেক কমে যায়। চুলে রঙ করার সময়ে কোনো ধরনের ক্ষতির ঝুঁকি আরও কমাতে নিচের উপদেশগুলো মেনে চলুন—
- ভালোমতো আলো-বাতাস চলাচল করে এমন একটি ঘর বেছে নিন
- হাতে গ্লাভস পরে নিন
- চুলে রঙ লাগানোর পরে যত অল্প সময় রাখবেন ততই ভালো
- পুরো প্রক্রিয়া শেষে মাথার ত্বক ভালোমতো ধুয়ে ফেলুন
- রঙ লাগানোর সময়ে মাথার ত্বকের পরিবর্তে কয়েক গুচ্ছ চুল হাইলাইট করতে পারেন। এতে চুলই কেমিক্যাল শোষণ করে নেয়। মাথার ত্বক কিংবা রক্তপ্রবাহে কেমিক্যাল প্রবেশ করার সম্ভাবনা কম থাকে।
আপনি গর্ভাবস্থায় চুলে রঙ করতে চাইলে সেমি-পার্মানেন্ট পিওর ভেজিটেবল ডাই (যেমন: মেহেদি) ব্যবহার করতে পারেন। এটা চুলে রঙ করার একটা নিরাপদ বিকল্প উপায়।
১২. গর্ভাবস্থায় এক্সারসাইজ করা উচিত নয়
বিজ্ঞান যা বলে: গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম করা নিরাপদ।[১৬] গর্ভাবস্থায় শরীরচর্চা করলে সেটি আপনার ও গর্ভের শিশুর জন্য উপকারী হতে পারে।[১৭][১৮] তাই আপনার বিশেষ কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা না থাকলে গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম করা চালিয়ে যান।
আপনার পছন্দের অনেক ব্যায়াম এসময়ে নিরাপদে চালিয়ে যেতে পারবেন। যেমন: দ্রুত হাঁটা, সাইক্লিং, ইয়োগা ও সাঁতার। এ ছাড়া আগে থেকে ভারী ব্যায়াম করার অভ্যাস থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সেটাও চালিয়ে যেতে পারেন।
তবে এসময়ে নতুন করে ভারী ধরনের কোনো ব্যায়াম শুরু না করাই ভালো। সেই সাথে যেসব এক্সারসাইজ করলে আপনার পড়ে যাওয়ার অথবা আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি থাকে (যেমন: বক্সিং, ব্যাডমিন্টন ও কারাতে) সেগুলো এসময়ে এড়িয়ে চলবেন। গর্ভাবস্থায় ঠিক কোন ধরনের এক্সারসাইজগুলো আপনার জন্য নিরাপদ হবে তা আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলে নির্ধারণ করে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।
১৩. মর্নিং সিকনেস শুধুমাত্র সকালেই হয়
বিজ্ঞান যা বলে: ‘মর্নিং সিকনেস’ বলতে গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব ও বমি হওয়াকে বোঝায়। নামের মধ্যে ‘মর্নিং’ থাকলেও এটা যে শুধুমাত্র সকালেই হবে তা নয়। দিনের যেকোনো সময়েই বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।[১৯]
গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মর্নিং সিকনেস দেখা দেয়। সাধারণত গর্ভাবস্থার একদম প্রথম দিকেই (৪ থেকে ৭ সপ্তাহের ভেতর) এই সমস্যা দেখা দেয়।[২০] অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে বমি বমি ভাব নিজে থেকেই কমে আসে।[২১] তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এই সময়ের পরেও—এমনকি পুরো গর্ভকাল জুড়ে বমি বমি ভাব অথবা বমি হতে পারে।
মনে রাখবেন, গর্ভাবস্থায় খুব বেশি বমি বমি ভাব অথবা বমি হলে তা মর্নিং সিকনেস নয়, বরং হাইপারএমেসিস গ্রাভিডেরাম রোগের লক্ষণ হতে পারে। এমন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
মায়ের জীবনযাত্রা
১৪. গর্ভাবস্থায় প্লেনে ওঠা যাবে না
বিজ্ঞান যা বলে: সুস্থ গর্ভবতী নারীদের জন্য সীমিত সংখ্যকবার প্লেনে ভ্রমণ করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাপদ।[২২][২৩] প্রায় সকল এয়ারলাইন গর্ভাবস্থার ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভবতী নারীদের প্লেনে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করে না। তবে ভ্রমণের পূর্বে জেনে নিন আপনার এয়ারলাইন কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করছে কি না। আপনার যদি এমন কোন স্বাস্থ্য সমস্যা বা গর্ভকালীন জটিলতা থাকে যা প্লেনে ভ্রমণের কারণে খারাপের দিকে যেতে পারে, তাহলে প্লেনে ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকুন।
প্লেনে এয়ার প্রেশার কম থাকার কারণে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কিছুটা কমে যেতে পারে। তবে এতে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ আমাদের শরীর এই পরিবর্তনের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে।[২৪] এ ছাড়া প্লেনে জার্নির সময় আমরা অনেক উঁচুতে উঠি, যেখানে রেডিয়েশনের সাথে সংস্পর্শ বাড়ে। তবে এতে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। উঁচুতে ওঠার কারণে রেডিয়েশনের সাথে সংস্পর্শ যতটুকু বাড়ে তা গর্ভবতী নারীদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ নয়।[২৫] আপনি যদি ঘন ঘন প্লেনে যাতায়াত করেন তাহলে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে জেনে নিন, কতটুকু প্লেনে যাতায়াত আপনার জন্য নিরাপদ।
প্লেনে যাতায়াতের সময় নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলুন—
- মাঝে মাঝেই পা ও পায়ের আঙ্গুল নাড়াচাড়া করুন। সম্ভব হলে উঠে দাঁড়ান। লম্বা ফ্লাইট হলে কয়েকবার হাঁটাচলা করার চেষ্টা করুন।
- সম্ভব হলে আইল সিট বেছে নিন। এতে দীর্ঘ ফ্লাইট এর সময় উঠে দাঁড়িয়ে পা সোজা ও হাঁটতে সুবিধা হবে।
- গ্যাস হয় এমন খাবার ও কার্বনেটেড ড্রিঙ্কস (যেমন: কোক ও পেপসি) খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। এতে করে প্লেনে জার্নির সময় পেটে অতিরিক্ত গ্যাস হয়ে অস্বস্তি লাগতে পারে।[২৬]
সবশেষে, গর্ভাবস্থার একদম শেষ দিকে অথবা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সন্তান প্রসব হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলে, মায়েদের প্লেনে ওঠার অথবা দূরের ভ্রমণ এড়িয়ে চলা উচিত।
১৫. গর্ভাবস্থায় সহবাস করা যাবে না
বিজ্ঞান যা বলে: গর্ভাবস্থায় সহবাস করা নিরাপদ কিনা সে ব্যাপারে অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে। বিশেষ করে গর্ভবতীর প্রথম তিন মাস এবং শেষের তিন মাসে সহবাস করলে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হতে পারে বলে অনেকে আশংকা করে থাকেন। তবে এই ধারণাটি সঠিক নয়।
গর্ভকালীন সময়ে আপনার যদি কোনো জটিলতা না থাকে এবং ডাক্তার যদি আপনাকে এসময়ে সহবাস করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ না দিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় সহবাস করা আপনার জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। এতে সাধারণত গর্ভের সন্তানের কোনো ধরনের আঘাত পাওয়ার অথবা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে (যেমন: জরায়ুমুখে দুর্বলতা থাকলে) ডাক্তার আপনাকে গর্ভাবস্থায় সহবাস এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিতে পারেন। সেসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে সহবাস করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হলেও সহবাস থেকে বিরত থাকবেন এবং রক্তপাতের বিষয়ে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। যোনিপথে রক্তপাত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে আবারও নিরাপদে সহবাস করতে পারবেন।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় সহবাস
১৬. চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হলে গর্ভবতী নারীদের বাইরে যাওয়া ও খাওয়া নিষেধ
বিজ্ঞান যা বলে: অনেকেই মনে করেন যে, চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী মায়েরা বাইরে গেলে, ধারালো কিছু নিয়ে কাজ করলে অথবা খাওয়াদাওয়া করলে গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়। এগুলো বহুল প্রচলিত ধারণা। তবে এসবের পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।[২৭]
তাই সূর্যগ্রহণ অথবা চন্দ্রগ্রহণ হলেই গর্ভবতী মায়েদের খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও বাইরে যেতে অথবা ধারালো কিছু নিয়ে কাজ করতে অসুবিধা নেই। তবে ধারালো জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবসময়ের মতো গর্ভাবস্থাতেও সতর্ক থাকতে হবে।
এ কথা সঠিক যে, সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের দিকে সরাসরি তাকালে চোখের ক্ষতি হওয়ার ক্ষুদ্র সম্ভাবনা আছে।[২৮] তাই এসময়ে সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো থেকে বিরত থাকা উচিত।
বাচ্চা প্রসব
১৭. গর্ভাবস্থায় দৌড়ালে সময়ের আগেই বাচ্চা হয়ে যায়
বিজ্ঞান যা বলে: গর্ভাবস্থায় দৌড়ালে নির্দিষ্ট সময়ের আগে সন্তান প্রসব হয়ে যাওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[২৯] বরং গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত শরীরচর্চা করলে তা মায়ের ও গর্ভের শিশুর জন্য উপকারী।
নিয়মিত শরীরচর্চা করলে নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং সিজারিয়ান অপারেশনসহ প্রসবকালীন জটিলতার সম্ভাবনা কমে।[৩০] তাই আপনার আগে থেকেই নিয়মিত দৌড়ানোর অভ্যাস থাকলে গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে গর্ভাবস্থাতেও তা চালিয়ে যেতে পারেন।
তবে মনে রাখতে হবে, গর্ভকাল বাড়ার সাথে সাথে আপনার সহ্যক্ষমতা কমে আসবে। তাই দৌড়ানোসহ যেকোনো ব্যায়ামের ক্ষেত্রে আপনার জন্য যা সহনীয় সেটাই চালিয়ে যান। সহ্যসীমার অতিরিক্ত চাপ নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
উল্লেখ্য, গর্ভকালীন সময়ে আপনি কোনো জটিলতায় ভুগলে অথবা ডাক্তার আপনাকে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকলে সেই পরামর্শ মেনে চলুন।
১৮. মসলাযুক্ত খাবার খেলে প্রসববেদনা তাড়াতাড়ি ওঠে
বিজ্ঞান যা বলে: মসলাযুক্ত খাবার খেলে প্রসববেদনা তাড়াতাড়ি ওঠে—এই কথাটি অনেকে বিশ্বাস করেন।[৩১] তবে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাড়াতাড়ি প্রসববেদনা ওঠাতে অনেকে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেন। কিছু ক্ষেত্রে এসব শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া প্রয়োজন।[৩২]
উল্লেখ্য, বেশি ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার খেলে আপনার বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা হতে পারে। তাই গর্ভকালীন সময়ে অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।
১৯. প্রথম সন্তান সিজারের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করলে পরের সন্তান জন্মানোর সময়েও সিজার বাধ্যতামূলক
বিজ্ঞান যা বলে: সিজারিয়ান অপারেশন বা সিজারের মাধ্যমে প্রথম সন্তানের ডেলিভারি হয়ে থাকলে পরবর্তী সন্তানের ডেলিভারির সময়ে সিজার করাতেই হবে—এই ধারণাটি সঠিক নয়। সবকিছু ঠিক থাকলে প্রথম সন্তান সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি হলেও পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে আপনি নরমাল ডেলিভারি করাতে পারবেন।[৩৩]
পরবর্তী শিশু নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে প্রসব করানো নিরাপদ হবে কি না তা বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।[৩৪] যেমন: প্রথম সন্তানের সময়ে গর্ভধারণ ও প্রসব সংক্রান্ত কোনো জটিলতা ছিল কি না, পরবর্তী গর্ভাবস্থায় মা ও গর্ভের শিশুর শারীরিক অবস্থা কেমন থাকে, এবং মায়ের প্রসবের রাস্তা, অর্থাৎ জরায়ু থেকে যোনিপথ নরমাল ডেলিভারির জন্য উপযুক্ত কি না।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিন। তিনি আপনার ও শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জিজ্ঞেস করবেন এবং সেই অনুযায়ী পরামর্শ দিবেন যে পরবর্তী শিশুর নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হবে কি না।[৩৫]
বাসাবাড়ি ও পশুপালন
২০. গর্ভাবস্থায় ঘরে বিড়াল অথবা অন্য কোনো পোষা প্রাণী রাখা যাবে না।
বিজ্ঞান যা বলে: গর্ভাবস্থায় ঘরে বিড়াল অথবা অন্য পোষা প্রাণী একেবারেই রাখা যাবে না—এমনটি নয়। তবে রাখলে অবশ্যই কিছু সতর্কতা মেনে চলা প্রয়োজন। কারণ এসব প্রাণী থেকে অনেকসময় রোগজীবাণু ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে, যা গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যেমন, বিড়ালের পায়খানা থেকে ‘টক্সোপ্লাজমা’ নামক জীবাণু ছড়িয়ে ‘টক্সোপ্লাজমোসিস’ নামক একটি রোগ হতে পারে—যা গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।[৩৬]
কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন তা জানতে একজন ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিন।[৩৭] তিনি আপনাকে পোষা প্রাণীর মল গর্ভাবস্থায় নিজে নিজে পরিষ্কার করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতে পারেন। পোষা প্রাণীকে কিছু টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। এ ছাড়াও হাতে গ্লাভস ব্যবহার করা ও পোষা প্রাণী স্পর্শ করার পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার পরামর্শ দিতে পারেন।