হৃৎপিণ্ড বা হার্ট আমাদের শরীরে রক্ত সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। কাজটি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে রক্তনালীর মাধ্যমে হার্টের নিজস্ব রক্ত সরবরাহও নিরবচ্ছিন্নভাবে বজায় থাকতে হয়।
কোনো কারণে হার্টের এই নিজস্ব রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে গেলে অথবা রক্তনালীর ভেতরে ব্লক বা বাধা সৃষ্টি হলে হার্টের রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এই অবস্থাকে হার্ট অ্যাটাক বলা হয়। হার্ট অ্যাটাককে মেডিকেলের ভাষায় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (এমআই) বলা হয়।
হার্ট অ্যাটাক একটি ইমারজেন্সি অবস্থা। আপনার অথবা আপনার আশেপাশের কারও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
হার্টে রক্ত সরবরাহ বন্ধ থাকলে সেটি হার্টের পেশীগুলোর মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এর ফলে রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
হার্ট অ্যাটাকের কিছু লক্ষণ হলো—
১. বুকে ব্যথা: বুকের মাঝখানে চাপ ধরার মতো ব্যথা হতে পারে। এছাড়া রোগীর বুকের মধ্যে কিছু চেপে বসে আছে অথবা কিছু আটকে (টাইট হয়ে) আসছে এমন অনুভূত হতে পারে
২. শরীরের অন্য জায়গায় ব্যথা: এই ব্যথা বুক থেকে হাতে চলে আসছে এমন মনে হতে পারে। সাধারণত বাম হাতে এমন ব্যথা হয়। তবে এই ব্যথা উভয় হাতেই যেতে পারে। হাতের পাশাপাশি চোয়াল, ঘাড়, পিঠ ও পেটে ব্যথা যেতে পারে।
৩. মাথা ঘুরানো অথবা মাথা ঝিমঝিম করা
৪. শরীরের ঘেমে যাওয়া
৫. শ্বাসকষ্ট
৬. বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া
৭. প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া: রোগী অস্বাভাবিক অস্থিরতা অনুভব করবেন (প্যানিক অ্যাটাক) অথবা তিনি মারা যাচ্ছেন এমন মনে হবে।
মনে রাখতে হবে, হার্ট অ্যাটাক হলেই সবার বুকে তীব্র ব্যথা হবে—এমনটি নয়। কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যথাটি বদহজম অথবা গ্যাস্ট্রিকের ব্যথার মতো সামান্য বা মৃদু হতে পারে। কেউ কেউ আবার একেবারেই ব্যথা অনুভব করেন না। বিশেষত অনেক নারী রোগীর ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায়।
এসব ক্ষেত্রে রোগীর আসলেই হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে কি না তা বুক ব্যথার তীব্রতার ওপর নয়, বরং আনুষঙ্গিক লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হয়।
হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে মনে হলে দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে। লক্ষণগুলো নিয়ে সন্দেহ থাকলেও চিকিৎসা নিতে দ্বিধা করা ঠিক নয়। কারণ অন্য কোনো রোগের কারণে লক্ষণগুলো দেখা দিলে হাসপাতালে সেটিরও চিকিৎসা করা সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে যদি সঠিক চিকিৎসা না নেওয়া হয় তাহলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ: কিছু ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক হলে হার্ট রক্ত পাম্প করা একেবারে বন্ধ করে দিয়ে স্থবির হয়ে যেতে পারে। এই ঘটনাকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলা হয়ে থাকে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- রোগী শ্বাস নিচ্ছে না বলে মনে হওয়া
- রোগীর সব ধরনের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া
- রোগীর সাথে কথা বললে বা তার গায়ে সজোরে ধাক্কা দিলেও কোনো সাড়া না পাওয়া
যদি কারও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হচ্ছে বলে মনে হয় তাহলে সাথে সাথে রোগীকে সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) দিতে হবে। একই সাথে অন্যদের সাহায্য নিয়ে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সিপিআর দিয়ে আপনি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের রোগীর জীবন বাঁচাতে পারেন। অ্যাম্বুলেন্স আসার আগে কীভাবে সিপিআর দিয়ে রোগীর জীবন বাঁচাতে পারেন জানতে নিচের ভিডিওটি দেখুন।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ আর্টিকেলে সিপিআর দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বিস্তারিত পড়ুন: হার্ট অ্যাটাক শনাক্তকরণ
হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা
রোগীর হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে মনে হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হার্টের ওপরে চাপ কমাতে হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বের সময়টুকুতে রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
হাতের কাছে অ্যাসপিরিন (৩০০ মিলিগ্রাম) ট্যাবলেট থাকলে এবং রোগীর অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধে কোনো অ্যালার্জি না থাকলে হাসপাতালে পৌঁছানো পর্যন্ত আস্তে আস্তে চিবিয়ে ট্যাবলেটটি খেতে পারে।
অ্যাসপিরিন রক্ত পাতলা করে এবং হার্টে রক্ত সরবরাহ বাড়াতে সাহায্য করে।
হার্ট অ্যাটাক কতটা গুরতর সেটির ওপর নির্ভর করে হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়। প্রধান দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি হলো—
- জমাট বাঁধা রক্ত ভাঙতে ঔষধ দেওয়া
- হার্টের রক্ত সরবরাহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অপারেশন করা
বিস্তারিত পড়ুন: হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা
হার্ট অ্যাটাকের কারণ
হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ হলো রক্তনালী সম্পর্কিত হৃদরোগ বা করোনারি হার্ট ডিজিজ।
হার্টে রক্ত সরবরাহকারী প্রধান রক্তনালীগুলোকে করোনারি আর্টারি বা ধমনী বলা হয়। করোনারি হার্ট ডিজিজে এসব ধমনীর ভেতরে কোলেস্টেরল জমা হয়ে রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। জমাট বাঁধা এসব কোলেস্টেরলকে প্ল্যাক বলা হয়।
হার্ট অ্যাটাকের আগে এমন একটি কোলেস্টেরল প্ল্যাক ফেটে যায়। ফলে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধে। এই জমাট বাঁধা রক্ত হার্টে রক্ত সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে।
কিছু বিষয়ের কারণে করোনারি হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন—
- ধূমপান করা
- উচ্চ রক্তচাপ
- রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল থাকা
- খাদ্যে অস্বাস্থ্যকর চর্বিবহুল খাবার রাখা
- নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
- অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হওয়া
- ডায়াবেটিস
এছাড়া আপনার বাবা অথবা ভাই ৫৫ বছর বয়সের আগে কিংবা আপনার মা অথবা বোন ৬৫ বছর বয়সের আগে হার্ট অ্যাটাক অথবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকলে, আপনারও করোনারি হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
বিস্তারিত পড়ুন: হার্ট অ্যাটাকের কারণ ও প্রতিরোধ
হার্ট অ্যাটাকের পরে সুস্থতা লাভ
হার্ট অ্যাটাকের পরে আরোগ্য লাভ করতে কতটুকু সময় লাগবে তা নির্ভর করে হার্টের পেশীগুলো কী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটির ওপর।
বেশীরভাগ রোগীই হার্ট অ্যাটাকের পরে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে পারেন। কেউ কেউ ২ সপ্তাহ পরেই কাজে যোগ দিতে পারেন। আবার অন্যদের সুস্থ হয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। একজন রোগী কত দ্রুত কাজে ফিরতে পারবেন সেটি নির্ভর করে তার স্বাস্থ্য, হার্টের অবস্থা ও কাজের ধরনের ওপর।
আরোগ্য লাভের প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো—
১. জীবনধারায় বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর পরিবর্তনের সমন্বয় ঘটিয়ে (যেমন: স্বাস্থ্যকর ও সুষম ডায়েট) এবং রক্তের কোলেস্টেরল কমানোর ঔষধ (যেমন: স্ট্যাটিন গ্রুপের ঔষধ) সেবনের মাধ্যমে পুনরায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনা।
২. ধীরে ধীরে শারীরিক সুস্থতা বা ফিটনেস ফিরিয়ে আনা যেন রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। এই প্রক্রিয়াকে কার্ডিয়াক পুনর্বাসন বলা হয়।
হার্ট অ্যাটাক-পরবর্তী স্বাস্থ্য জটিলতা
হার্ট অ্যাটাকের ফলে সৃষ্ট জটিলতাগুলো গুরুতর—এমনকি প্রাণঘাতী হতে পারে। এসব জটিলতার মধ্যে রয়েছে—
- অ্যারিদমিয়া: সহজ ভাষায় অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন বা হার্টবিটকে অ্যারিদমিয়া বলা হয়। এক ধরনের অ্যারিদমিয়াতে হার্ট প্রথমে খুব দ্রুত স্পন্দন বা পাম্প করতে শুরু করে। এরপর হঠাৎ হার্টে খিঁচুনির মতো অবস্থা শুরু হয়ে যায় এবং হার্ট কাজ করা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয় (কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট)
- কার্ডিওজেনিক শক: এক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের পরে হার্টের পেশীগুলো এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে হার্ট স্বাভাবিক শারীরিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেহে যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত সঞ্চালন করতে ব্যর্থ হয়
- হার্ট রাপচার: এই অবস্থায় হার্টের পেশী, দেয়াল অথবা ভেতরের ভালভগুলোর যেকোনোটি ছিঁড়ে বা ফেটে যেতে পারে
এসব জটিলতা হার্ট অ্যাটাকের অল্প সময়ের মাঝেই দেখা দিতে পারে। এগুলো হার্ট অ্যাটাক জনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ। এসব জটিলতা থেকে অনেকে হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বে কিংবা হার্ট অ্যাটাক হওয়ার এক মাসের মধ্যে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে পারেন।
একজন রোগীর মধ্যে এসব জটিলতা কতটুকু প্রভাব ফেলবে সেটি কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন—
- বয়স বাড়ার সাথে বিভিন্ন গুরুতর জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়
- হার্ট অ্যাটাকের ধরনটি কতটা গুরুতর এবং অ্যাটাকের ফলে হার্টের পেশীগুলো কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ওপর জটিলতার তীব্রতা নির্ভর করে
এ ছাড়া লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে চিকিৎসা শুরু করতে যতটুকু সময় লাগে সেটি বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনার ওপর প্রভাব ফেলে।
বিস্তারিত পড়ুন: হার্ট অ্যাটাকের জটিলতা
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের উপায়
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করার পাঁচটি প্রধান উপায় এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এমন ব্যক্তিও এই পাঁচটি উপদেশ মেনে চলার মাধ্যমে পুনরায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারবেন। উপায়গুলো হলো—
১. ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সেটি ছেড়ে দিতে হবে।
https://www.youtube.com/watch?v=CP5PJ_jFx00
২. শরীরের ওজন বেশি হলে সেটি কমিয়ে ফেলতে হবে।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের সপ্তাহে কমপক্ষে আড়াই ঘণ্টা মাঝারি ধরনের ব্যায়াম করা উচিত। প্রথমবারের মতো ব্যায়াম করা শুরু করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৪. খাবারে ফ্যাটের পরিমাণ কমিয়ে পূর্ণশস্য (যেমন: ঢেঁকিছাটা চাল বা লাল চাল ও লাল আটার রুটি) সহ ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। এছাড়া প্রতিদিনের খাবার তালিকায় প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে হবে।
৫. মদপানের অভ্যাস থাকলে সেটি ছেড়ে দিতে হবে
বিস্তারিত পড়ুন: হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের উপায়