শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে গেলে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। পানিশূন্যতা হলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। সময়মতো চিকিৎসা না করা হলে এটি গুরুতর পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এমনকি মাত্রাতিরিক্ত পানিশূন্যতা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
শিশু ও বয়স্কদের পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাই এদের ক্ষেত্রে বেশী সতর্ক থাকতে হবে।
পানিশূন্যতার লক্ষণসমূহ
শরীরে পানির অভাব দেখা দিলে বিভিন্ন কাজের ব্যাঘাত ঘটে। তখন সাধারণত নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়—
- পিপাসা লাগা
- গাঢ় হলুদ ও তীব্র গন্ধযুক্ত প্রস্রাব হওয়া
- মাথা ঘুরানো বা হালকা হালকা লাগা
- ক্লান্ত বোধ করা
- চোখ, ঠোঁট ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া
- প্রস্রাব কমে যাওয়া—সারাদিনে চারবারের চেয়েও কম প্রস্রাব হওয়া
শিশুদের ক্ষেত্রে আরও কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে—
- মুখ ও জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া
- কান্নার সময়ে চোখ দিয়ে পানি না পড়া
- চোখ বসে যাওয়া
- খিটখিটে হয়ে যাওয়া
- তীব্র জ্বর আসা
- ঝিমিয়ে পড়া কিংবা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুমানো
যে লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে—
- অতিরিক্ত ক্লান্তি
- মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা ও বিভ্রান্তি
- সারাদিনে প্রস্রাব না হওয়া
- দাঁড়ালেও যদি মাথা ঘুরানো না যায়
- দ্রুত শ্বাস নেওয়া
- পালস (নাড়ির গতি) অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া অথবা দুর্বল হয়ে পড়া
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- খিঁচুনি হওয়া
- শরীর ঘাম দিয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া এবং একটু পর পর হাই তুলতে থাকা
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিপদচিহ্ন দেখা যায়। যেমন—
- ঝিমিয়ে পড়া
- কান্নার সময়ে চোখে জল না থাকা
- মাথার উপরিভাগের নরম অংশটি কিছুটা বসে যাওয়া
- মুখ শুকিয়ে যাওয়া
- গাঢ় হলুদ প্রস্রাব অথবা গত ১২ ঘন্টার মধ্যে কোনো প্রস্রাব না হওয়া
- হাত-পা ঠান্ডা ও ছোপ ছোপ হয়ে যাওয়া
পানিশূন্যতার চিকিৎসা
পানিশূন্যতার জরুরি লক্ষণসমূহ না দেখা গেলে ঘরোয়াভাবেই এর চিকিৎসা করা যায়।
পানিশূন্যতার চিকিৎসা হলো শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া পানি ও লবণের ঘাটতি পূরণ করা। পানিশূন্যতা দেখা দিলে তাই প্রচুর পানি, খাওয়ার স্যালাইন (ওরস্যালাইন) ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তরল খাবারের মধ্যে রয়েছে চিড়া পানি, ডাবের পানি, ভাতের মাড় ও স্যুপ। এ ছাড়া ফলের রসে বিশুদ্ধ পানি মিশিয়ে পাতলা করে খাওয়া যেতে পারে। এসব খাবারের পাশাপাশি স্বাভাবিক খাবার খাওয়া চালিয়ে যেতে হবে।
হাতের কাছে প্যাকেটজাত খাবার স্যালাইন না থাকলে ঘরোয়াভাবে খাবার স্যালাইন বানিয়ে নিতে পারেন।
মারাত্মক পানিশূন্যতা হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে শিরার মাধ্যমে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা
শিশুদের পানিশূন্যতার চিকিৎসা শেষে পুনরায় পানির ঘাটতি প্রতিরোধে শিশুকে পর্যাপ্ত তরল খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ। এই সংক্রান্ত কিছু পরামর্শ হলো—
যা করবেন
- শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যান। কোনো কারণে ফর্মুলা বা কৌটার দুধ খাওয়াতে হলে সেটিও চালিয়ে যেতে হবে। এই সময়ে শিশুকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। অল্প অল্প করে বারবার খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।
- যেসব ছোটো শিশু ফর্মুলা অথবা শক্ত খাবার খায় তাদের অল্প অল্প করে বেশি পরিমাণে পানি খাওয়ান।
- শিশুদের স্বাভাবিক খাবার খাওয়ানো চালিয়ে যান। একেবারে অনেক বেশি খাবার না দিয়ে বারবার অল্প অল্প করে খাওয়ানোই শ্রেয়।
- শরীরে লবণ, পানি ও চিনির ঘাটতি পূরণের জন্য শিশুকে ওরস্যালাইন এর মতো খাওয়ার স্যালাইন দিন।
যা করবেন না
- ফর্মুলা পাতলা করে বানিয়ে শিশুকে খাওয়াবেন না। ফর্মুলার কৌটার গায়ে লেখা কিংবা সাথে থাকা কাগজের নির্দেশনা অনুযায়ী বানিয়ে খাওয়াতে হবে।
- ছোটো শিশুদের বাজার থেকে কেনা ফলের জুস ও কোমল পানীয় খাওয়ানো থেকে বিরত থাকবেন। এগুলো শিশুর ডায়রিয়া ও বমির সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।
পানিশূন্যতার কারণ
যেসব কারণে সহজেই পানিশূন্যতা হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে—
- বমি ও ডায়রিয়া
- প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম পানি পান করা
- অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া
- দীর্ঘ সময় রোদে থাকা
- বেশি বেশি প্রস্রাব অথবা ঘাম হয়—এমন দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত হওয়া। যেমন: ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ
- শরীরের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর চেয়ে বেড়ে যাওয়া
- শরীর থেকে পানি বের করে দেওয়ার ঔষধ সেবন করা। যেমন: ডাইইউরেটিক্স জাতীয় ঔষধ
- অতিরিক্ত মদপান করা
শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
পানিশূন্যতা প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়
পানিশূন্যতা প্রতিরোধের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর উপায় হলো পানিশূন্যতার কোনো লক্ষণ অনুভব করলে সাথে সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি অথবা তরল খাবার খাওয়া।
- যদি একবারে বেশি পানি পান করতে কষ্ট হয় কিংবা বমি বমি লাগে, তাহলে অল্প পরিমাণে বারবার পানি পান করতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে পানি ও তরল খাবার চামচ দিয়ে খাওয়ালে গিলতে সুবিধা হতে পারে।
- চেষ্টা করুন দিনের বেলা যত বেশি সম্ভব পানি পান করতে, যতক্ষণ না আপনার প্রস্রাবের রঙ স্বচ্ছ ও হালকা হলুদ, অর্থাৎ স্বাভাবিক হয়।
- অতিরিক্ত গরম অথবা কড়া রোদে বেশিক্ষণ কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এমন কাজ এড়ানো সম্ভব না হলে এসময়ে যত বেশি সম্ভব পানি পান করার চেষ্টা করুন। কাজে যাওয়ার সময়ে সাথে করে পানির বোতল নিয়ে যেতে পারেন।
- ডায়রিয়া, বমি ও অতিরিক্ত ঘামার কারণে পানিশূন্যতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে বেশি করে পানি ও তরল খাবার খান।
- অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার, পানীয় ও ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন। চা-কফিতে ক্যাফেইন থাকে। মদপান থেকে বিরত থাকুন।
সারাদিনে কতটুকু পানি পান করা হচ্ছে সেই সম্পর্কে ধারণা নেই—এমন ব্যক্তিদের দেখাশোনা করার সময়ে কিছু বিষয়ে লক্ষ রাখতে পারেন। যেমন—
- প্রত্যেকবার খাবার খাওয়ার সময়ে ব্যক্তিটি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখা
- বেশি পানি ধারণ করে এমন খাবার খেতে দিন। যেমন: স্যুপ, তরমুজ ও ডাবের পানি
- পানি পান করার বিষয়টি সবাই একসাথে বসে চা খাওয়ার মতো একটি সামাজিক অভ্যাস হিসেবে উপস্থাপন করা