আয়রনের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা

‘অ্যানিমিয়া’ অর্থ রক্তশূন্যতা। শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে আয়রনের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া (Iron Deficiency Anaemia) হয়। সাধারণত গর্ভবতী অবস্থায় ও অন্য বিভিন্ন কারণে রক্তক্ষরণের ফলে দেহে আয়রনের ঘাটতি হয়। বেশি বেশি আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার মাধ্যমে আয়রনের অভাব পূরণ করা যায়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট সেবনের মাধ্যমে আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার চিকিৎসা করা সম্ভব।

আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার লক্ষণ

আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার পাঁচটি অন্যতম লক্ষণ হলো—

  1. ক্লান্ত অনুভব করা
  2. শরীরের শক্তি কমে যাওয়া অথবা দুর্বল লাগা
  3. শ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা
  4. বুক ধড়ফড় করা
  5. ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া

আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার আরও কিছু লক্ষণ রয়েছে। তবে এসব লক্ষণ উপরের পাঁচটি লক্ষণের মতো সচরাচর দেখা যায় না এবং গর্ভাবস্থার সাথে এসব লক্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব লক্ষণগুলো হলো—

  • মাথাব্যথা
  • মাথা বা কানের ভেতরে চিনচিনে, ভনভনে বা হিস্ হিস্ আওয়াজ হওয়া (Tinnitus)
  • খাবারের স্বাদ উদ্ভট লাগা
  • শরীর চুলকানো
  • জিহ্বায় ঘা হওয়া
  • চুল পড়ে যাওয়া
  • অখাদ্য জিনিস খাওয়ার ইচ্ছে হওয়া। যেমন: কাগজ, পোড়ামাটির বাসন ও বরফের মতো কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হওয়া অথবা খেয়ে ফেলা। এই লক্ষণকে ‘পিকা’ (Pica) বলা হয়।
  • ঢোক গিলতে কষ্ট হওয়া
  •  মুখের কোনায় যন্ত্রণাদায়ক ঘা বা আলসার হওয়া
  • নখের আকৃতি চা-চামচের মতো হয়ে যাওয়া
  • রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম (Restless Legs Syndrome)—এটি স্নায়ুতন্ত্রের এমন একটি রোগ যা পা দুটিকে নাড়ানোর অনিবার্য তাড়না সৃষ্টি করে।
ছবি: চা-চামচের মত ভেতরের দিকে গর্ত হয়ে যাওয়া নখ। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কয়লোনিকিয়া (Koilonychia), যা আয়রনের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার লক্ষণ হতে পারে। কৃতজ্ঞতা: https://assets.nhs.uk/

আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। আপনি রক্তশূন্যতায় ভুগছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষাই যথেষ্ট।

আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা কেন হয়

গর্ভাবস্থায় আয়রনের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া খুব কমন। বেশিরভাগ গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডায়েটে যদি আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় কম থাকে, তাহলে সেটাই রক্তশূন্যতার পেছনে দায়ী।

পিরিয়ড বা মাসিকের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা হওয়াও বেশ কমন। নির্দিষ্ট ঔষধ সেবনের মাধ্যমে মাসিকের সময়ের ভারী রক্তপাতের চিকিৎসা করা যায়।

পুরুষ ও মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের ক্ষেত্রে আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা পাকস্থলী বা অন্ত্রে রক্তপাত হওয়ার একটি লক্ষণ হতে পারে। এ ধরনের রক্তপাতের অন্যতম কারণগুলো হলো—

  • নন স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs) সেবন। যেমন: আইবুপ্রোফেন ও অ্যাসপিরিন ঔষধ।
  • গ্যাস্ট্রিক আলসার
  • প্রদাহের কারণে বৃহদান্ত্র তথা কোলন ফুলে যাওয়া (Colitis)
  • খাদ্যনালীর প্রদাহ (Esophagitis)
  • পাইলস বা অর্শ
  • পাকস্থলী বা অন্ত্রের ক্যান্সার (তুলনামূলকভাবে বিরল)

অন্য যেকোনো কারণে শরীর থেকে রক্তপাত হলে তা থেকেও শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।

আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা সনাক্ত করা

আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা সনাক্ত করতে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরে তিনি রোগীর জীবনধারা ও রোগ-বালাইয়ের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করবেন। রক্তশূন্যতার পেছনের কারণ স্পষ্ট না হলে তিনি কিছু পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। এসব পরীক্ষার উদ্দেশ্য লক্ষণগুলোর কারণ নির্ণয় করা। প্রয়োজনে রোগীকে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করা হতে পারে।

রক্তশূন্যতা সনাক্তের জন্য দেওয়া কিছু রক্ত পরীক্ষা

ডাক্তার আপনাকে প্রথমে ‘ফুল ব্লাড কাউন্ট’/’কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট’ নামের পরীক্ষা করাতে দিবেন; এটি সিবিসি নামে অধিক পরিচিত। এই পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার রক্তে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ স্বাভাবিক কি না তা জানা যাবে। পরীক্ষাটি করানোর আগে আপনার কোনো বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

সব ধরনের রক্তশূন্যতার মধ্যে আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতাই সবচেয়ে কমন। অন্য কোনো কারণে (যেমন: ভিটামিন বি ১২ অথবা ফোলেট এর অভাবে) রক্তশূন্যতা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্যও সিবিসি পরীক্ষাটি বেশ কার্যকর।

আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা দূর করার উপায়

রক্তশূন্যতার কারণ সনাক্ত হওয়ার পরে ডাক্তার কারণ অনুযায়ী রক্তশূন্যতা দূর করার সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণ করবেন।

রক্তশূন্যতার ঔষধ

পরীক্ষার রিপোর্টে যদি লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম আসে, তাহলে ডাক্তার শরীরের আয়রনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য আয়রন ট্যাবলেট বা বড়ি সেবনের পরামর্শ দিবেন এবং আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার নিয়ম বলে দিবেন।

এই ঔষধগুলো আপনাকে প্রায় ৬ মাস সেবন করতে হবে। ঔষধ খাওয়ার পরপর কমলালেবুর রস বা লেবুর সরবত খেলে তা আপনার শরীরকে আয়রন শোষণে সহায়তা করতে পারে।

আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ফলে কারো কারো ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে হতে পারে। যেমন—

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য, আয়রন ট্যাবলেট খাবারের সাথে অথবা খাওয়ার ঠিক পরপরই সেবন করার চেষ্টা করুন। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও এই ঔষধ সেবন করা চালিয়ে যাওয়া খুব জরুরি।

চিকিৎসার মাধ্যমে রক্তে আয়রনের পরিমাণ স্বাভাবিকে ফেরত আসছে কি না জানতে, ডাক্তার চিকিৎসা শুরু হওয়ার পরবর্তী কয়েক মাসে পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। 

আয়রন ট্যাবলেট সংরক্ষণে সতর্কতা

আয়রন ট্যাবলেট শিশুদের হাতের নাগালের বাইরে রাখুন। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ঔষধের ওভারডোজ হলে, অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ট্যাবলেট সেবন করে ফেললে—তা জীবনঘাতী হতে পারে।

রক্তশূন্যতার ঘরোয়া চিকিৎসা ও খাবার

যদি খাবারের তালিকায় আয়রনযুক্ত খাবারের অভাব রক্তশূন্যতার পেছনে আংশিকভাবে দায়ী থাকে, তাহলে ডাক্তার আয়রনসমৃদ্ধ কিছু খাবার বেশি করে খাওয়ার পরামর্শ দিবেন।

রক্তশূন্যতা দূর করার জন্য যেসব খাবার বেশী পরিমাণে খেতে হবে

  • গাঢ় সবুজ শাকসবজি। যেমন: পালংশাক, কচুশাক, করলা, পটল ও কাঁচকলা।
  • অধিক আয়রনযুক্ত শস্যদানা, ফর্টিফাইড‌ সিরিয়াল (Cereals) ও পাউরুটি
  • মাংস
  • ডাল জাতীয় খাবার (শিম, মটরশুঁটি ও বিভিন্ন ধরনের ডাল)

রক্তশূন্যতা দূর করতে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে

নিচের তালিকায় খাবার ও পানীয়গুলো বেশি খেলে এগুলো শরীরের আয়রন শোষণের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়—

  • চা ও কফি
  • দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
  • ফাইটিক এসিড (Phytic Acid) সমৃদ্ধ খাবার। যেমন: গোটা বা হোলগ্রেইন খাদ্যশস্য (Wholegrain Cereals)। এগুলো অন্যান্য খাবার ও ঔষধ থেকে শরীরের আয়রন শোষণের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

প্রতিদিনকার খাবারের তালিকায় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

রক্তশূন্যতার চিকিৎসার অভাবে সৃষ্ট জটিলতা

সময়মতো আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার সঠিক চিকিৎসা না নিলে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন—

  • আয়রন কমে যাওয়ার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এ কারণে বিভিন্ন রোগ ও ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
  • হার্ট ও ফুসফুসের বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন: অস্বাভাবিক দ্রুত হৃৎস্পন্দন (Tachycardia) অথবা হার্ট ফেইলিউর (Heart Failure)।
  • গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের আগে ও পরে নানান ধরনের জটিলতা হবার সম্ভাবনা বহুগুনে বেড়ে যায়।