এনাল ফিসার একধরণের পায়ুপথের রোগ। পায়খানা করার সময় খুব বেশি জ্বালাপোড়া হওয়া অথবা ছুরির ধারের মত ব্যথা করা — এটি একটি পরিচিত সমস্যা। কারো কারো ক্ষেত্রে এই ব্যথা এতই তীব্র হয় যে নিয়মিত মলত্যাগ করাই তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এই লক্ষণগুলো সাধারণত এনাল ফিসার রোগের লক্ষণ। বাংলায় এটি গেজ রোগ নামেও পরিচিত।
পায়ুপথের রোগ বলে অনেকেই এই সমস্যায় দীর্ঘদিন ভোগা সত্ত্বেও সহজে ডাক্তার দেখাতে চান না। ফলে দিন দিন গেজ রোগ জটিল আকার ধারণ করে। একপর্যায় অপারেশন করা ছাড়া এই রোগ প্রতিকারের উপায় থাকে না। অথচ প্রাথমিক গেজ রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া গেলে খুব সহজেই এই জটিল পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
এনাল ফিসার কী?
পায়ুপথের পেছনের যেই অংশে মল জমা থাকে তার নাম রেক্টাম বা মলাশয়। মলাশয় থেকে মল বা পায়খানা মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে আসে। মলদ্বারের মুখের চারপাশে যেই মাংসপেশি থাকে তাতে চাপ প্রয়োগ করে পায়খানার রাস্তার মুখ বন্ধ করা এবং খোলা যায়।
মলত্যাগের সময় খুব জোরে চাপ দিলে বা পায়খানা শক্ত হলে মলদ্বারের মুখের চারপাশের চামড়া অনেকসময় ফেটে বা চিড়ে যায়৷ মলদ্বারের এই ক্ষতকে এনাল ফিসার বা গেজ রোগ বলে।
গেজ রোগ হলে মলত্যাগের সময় এই ফাটা বা চিড়ে যাওয়া অংশে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া বা তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব হয়। সেই সাথে পায়ুপথের মাংসপেশি টানটান হয়ে যায়। মাংসপেশি টানটান হলে পায়ুপথের মুখটাও সরু হয়ে আসে বা টাইট হয়ে থাকে। ফলে মলত্যাগের প্রক্রিয়াটি ভীষণ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
চিড়ে যাওয়া স্থানে রক্ত প্রবাহ কমে গেলে ফাটল সারতে দীর্ঘদিন সময় লাগতে পারে। এভাবে অনেকের দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক এনাল ফিসারের সমস্যা দেখা দেয়।
এনাল ফিসারের লক্ষণগুলো কী কী?
১. পায়খানার রাস্তায় তীব্র ও ধারালো ব্যথা হওয়া
এনাল ফিসার বা গেজ রোগের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো মলত্যাগের সময় মলদ্বারে তীব্র ও ধারালো ব্যথা হওয়া। অনেক সময় রোগীদের মনে হয় যেন পায়ুপথ দিয়ে ধারালো কাঁচের টুকরো বের হচ্ছে। এনাল ফিসারের রোগীদের জন্য এই ব্যথাটাই সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক। সাধারণত পায়খানার পর মলদ্বারে এই জ্বালা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে।
২. পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল রঙের রক্ত যাওয়া
পায়খানার গায়ে বা ব্যবহৃত টয়লেট পেপারে তাজা লাল রক্তের ছোপ দেখা যেতে পারে। শুধুমাত্র চামড়ার কিছু অংশ ছিঁড়ে রক্ত যায় বলে এক্ষেত্রে সাধারণত বেশি রক্তপাত হয় না। যেহেতু পায়ুপথের মুখের কাছাকাছিই এই রক্তক্ষরণ হয়, তাই রক্তের রঙ উজ্জ্বল লাল হয়ে থাকে। আরও ভেতর থেকে রক্তক্ষরণ হলে রক্তের রঙ গাঢ় বা কালচে লাল হতো।
৩. পায়ুপথে চুলকানি হওয়া
এনাল ফিসার রোগে পায়খানার রাস্তার মুখে চুলকানি হতে পারে।
এনাল ফিসার কেন হয়?
গেজ রোগের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো কষা পায়খানা বা কোষ্ঠকাঠিন্য। পায়খানা শক্ত হলে অনেকে টয়লেটে যেতে চায় না, কারণ তখন মলত্যাগ করতে কিছুটা কষ্ট হয়। কিন্তু পেটের ভেতর পায়খানা জমিয়ে রাখলে সেটা দিন দিন আরও শক্ত থাকে। একসময় সেই শক্ত পায়খানা বের করতে গেলে পায়ুপথের চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে দেখা দেয় এনাল ফিসার।
গর্ভবতী অবস্থায়, বিশেষ করে শেষ তিন মাসে ও নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে বাচ্চা হওয়ার পরে এনাল ফিসার দেখা দিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে গেজ রোগ হওয়ার পদ্ধতি একটু ভিন্ন।
কখনও কখনও ডায়রিয়ার কারণেও গেজ রোগ হতে পারে। আরও কিছু অসুখ বা ওষুধের কারণেও এনাল ফিসার হতে পারে। যে সব রোগের কারণে এনাল ফিসার দেখা দিতে পারে—
- পরিপাকতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ বা ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (IBD)
- কোলোরেক্টাল বা পায়ুপথের ক্যান্সার
- যৌনরোগ, যেমন, এইচআইভি, সিফিলিস ও হার্পিস সিমপ্লেক্স
- সোরিয়াসিস নামক ত্বকের প্রদাহজনিত রোগ
- Pruritus ani নামের পায়ুপথের মুখের চুলকানি রোগ
- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস সংঘটিত চর্মরোগ
যেসব ওষুধ সেবন করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এনাল ফিসার দেখা দিতে পারে—
- Angina-জাতীয় বুকের ব্যথায় ব্যবহৃত নিকোরান্ডিল
- কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত কিছু ওষুধ
- আফিমজাতীয় ব্যথার ওষুধ (Opioids), যেমন ট্রামাডল, টাপেন্টাডল, মরফিন ও পেথিডিন
মলদ্বারের ব্যথা কমানোর উপায়
১. মলত্যাগের পর গরম পানির সেঁক নেয়া
একটি বোলে বা ডিশে কুসুম গরম পানি নিয়ে সেটাতে কিছুক্ষণ বসতে পারেন, যাতে কোমর থেকে মলদ্বার পর্যন্ত পানির নিচে থাকে। কুসুম গরম পানি মলদ্বারের মাংসপেশিকে রিল্যাক্স বা শিথিল করতে সাহায্য করে, ফলে ব্যথা কমে আসে। একে ইংরেজিতে সিটজ ব্যাথ (Sitz bath) বলে।
শুধু মলত্যাগ করার পরেই এটি নেওয়া করা যাবে, বিষয়টা এমন নয়। দিনে ২ থেকে ৩ বার গরম পানির সেঁক নেওয়া যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছে গেজ রোগে তারা বেশ স্বস্তি পেয়েছে।
২. প্যারাসিটামল সেবন করা
এনাল ফিসার এর ব্যথা কমানোর ঔষধ হিসেব প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। প্যারাসিটামল সাধারণত ৫০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট হিসেবে পাওয়া যায়। ব্যথা হলে ২টি ট্যাবলেট, অর্থাৎ, ১০০০ মিলিগ্রাম প্যারাসিটামল একেবারে সেবন করতে পারেন। এভাবে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা পরপর ঔষধ খাওয়া যায়।
তবে দিনে যাতে ৮টা ট্যাবলেট, অর্থাৎ, ঔষধের পরিমাণ ৪০০০ মিলিগ্রামের বেশি না হয় সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। উল্লেখ্য, এই হিসাবটি একজন অন্যথায় সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য, যার ওজন ৫০ কেজির বেশি। আপনার শারীরিক অবস্থা এমনটা না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্যারাসিটামলের সঠিক ডোজ জেনে নিতে হবে।
প্রয়োজন পড়লে ব্যথার জন্য আইবুপ্রোফেন খাওয়া যায়। তবে রক্তক্ষরণ হলে আইবুপ্রফেন এড়িয়ে চলাই ভালো, কারণ এটি রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
তবে ট্রামাডল ও টাপেন্টাডল জাতীয় ব্যথানাশক এড়িয়ে চলতে হবে। ট্রামাডল-টাপেন্টাডল সেবন করলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। ইতোমধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে এই জাতীয় ব্যথানাশক সেবনে এই সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে৷
৩. মলদ্বারের মুখে পেট্রোলিয়াম জেলি-জাতীয় পিচ্ছিল করার পদার্থ প্রয়োগ
পেট্রোলিয়াম জেলি বা অন্যান্য পিচ্ছিলকারী পদার্থ মলদ্বারের মুখে ব্যবহার করা যায়। এতে মলত্যাগের সময় ছেঁড়া জায়গায় ঘর্ষণের মাধ্যমে ব্যথা অনুভব হওয়ার তীব্রতা কমবে।
৪. মলত্যাগের সময় জোরে চাপ দেয়া থেকে বিরত থাকা
পায়খানা করার সময় জোরে চাপাচাপি করলে গেজ রোগের জায়গাটি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যথা তীব্র হয়ে যেতে পারে।
গেজ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে এনাল ফিসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। এগুলো হলো—
১. পায়খানার বেগ আসলে তা আটকে রাখা যাবে না। এতে পায়খানা শক্ত হয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। পরবর্তীতে চাপ দিয়ে পায়খানা করতে গেলে সেখান থেকে এনাল ফিসার দেখা দিতে পারে। পায়খানা খুব শক্ত হলে এনাল ফিসার সারতেও দেরি হয়। তাই পায়খানার চাপ আসলে দেরি না করে টয়লেটে চলে যেতে হবে।
তবে এনাল ফিসারের রোগীদের জন্য পায়খানা করার সময় হওয়া প্রচণ্ড ব্যথাটাই সবচেয়ে কষ্টদায়ক। তাই যথাসময়ে মলত্যাগ করার উপদেশ দেওয়া হলেও তা মেনে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য পায়খানা নরম রাখতে হবে, এবং উপরের ব্যথা কমানোর উপদেশগুলো মেনে চলতে হবে।
২. এনাল ফিসার প্রতিরোধে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই৷ এজন্য কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি। যেমন—
- পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ আছে এমন খাবার খেতে হবে। যেমন – সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, লাল আটা, লাল চাল ইত্যাদি। কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে দৈনিক প্রায় ৩০ গ্রাম ফাইবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। তবে খাবারের তালিকায় ফাইবারের পরিমাণ হুট করে না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। বেশি বেশি ফাইবার এর সাথে পরিমাণ মত পানি না খেলে নানান স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিলে ইসবগুলের ভুসি খেতে পারেন। ভুসি খাওয়ার উপকারিতা ও নিয়ম সম্পর্কে জানতে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ইসবগুলের ভুসি লেখাটি পড়তে পারেন।
- নিয়মিত শরীরচর্চা বা হালকা ব্যায়াম করতে পারেন।
পড়ুন: কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার উপায়
৩. পায়ুপথ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকনো রাখতে হবে। মলত্যাগের পর জোরে ঘষাঘষি না করে আলতোভাবে জায়গাটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। এর ফলে গেজ রোগ হলেও তা দ্রুত সেরে উঠবে, এবং ইনফেকশন বা পুঁজ জমে ঘা হওয়ার মতো জটিলতা এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন?
যদি মনে হয় আপনার পায়ুপথে কোনো ফাটল রয়েছে, বা গেজ রোগের কোনো লক্ষণ রয়েছে, তাহলে দেরি না করে ডাক্তার দেখানো উচিত। অনেকে কবিরাজি বা ভেষজ ওষুধ কিংবা এনাল ফিসার এর হোমিও চিকিৎসা দিয়ে এগুলো সারানোর চেষ্টা করতে করতে অনেক দেরি করে ফেলেন, ফলে রোগটি আরও জটিল আকার ধারণ করে। তাই এগুলোর পেছনে সময় ও অর্থ নষ্ট করে নিজের ক্ষতি করবেন না।
বিব্রত বা সংকোচ বোধ করে ডাক্তার দেখানো থেকে বিরত থাকবেন না। এনাল ফিসার একটি কমন সমস্যা৷ ডাক্তাররা প্রতিনিয়তই এমন অসংখ্য রোগীর চিকিৎসা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এনাল ফিসার চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। তবে ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি একই ধরনের উপসর্গযুক্ত অন্য কোনো সমস্যা (যেমন: পাইলস) আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পারবেন।
এছাড়াও যেসব নিয়ম মেনে চললে আপনার এনাল ফিসারের লক্ষণগুলো উপশম হবে এবং পুনরায় গেজ রোগ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, সে ব্যাপারেও তিনি পরামর্শ দিবেন। আমাদের আর্টিকেলে তুলে ধরা পরামর্শগুলোর পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে দ্রুত গেজ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
এনাল ফিসার ও পাইলস-এর মধ্যে কিভাবে পার্থক্য করবেন?
এনাল ফিসার ও পাইলসের লক্ষণগুলোর মধ্যে কিছুটা মিল থাকলেও এই দুইটি পৃথক দুইটি রোগ। দুটি রোগেই পায়ুপথে চুলকানি হতে পারে এবং টাটকা লাল রক্ত যেতে পারে। তবে এনাল ফিসারে রক্ত খুব অল্প পরিমাণে যায়। পাইলস এবং এনাল ফিসার এই দুইটির মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে—
পাইলস হলে পায়ুপথে নরম গোটার মত দেখা দেয়। গোটাগুলো সাধারণত মলত্যাগের পরে বের হয়ে আসে, আবার কিছু সময় পর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায় অথবা আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢোকাতে হয়। এছাড়া পাইলস হলে পায়ুপথে শ্লেষ্মার মতো দেখতে পিচ্ছিল কিছু পদার্থ বের হতে পারে।
এনাল ফিসার বা গেজ রোগের ক্ষেত্রে সাধারণত এসব লক্ষণ দেখা যায় না। আর এক্ষেত্রে প্রতিবার মলত্যাগের সময়ই তীব্র ব্যথা হয়। পাইলসে সাধারণত ব্যথা হয় না।
পাইলস বা অর্শ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে আমাদের আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
গেজ রোগের অন্যান্য চিকিৎসা
ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে এনাল ফিসার প্রতিরোধের পরামর্শগুলো মেনে চললে প্রায় অর্ধেক রোগীর এনাল ফিসার ভালো হয়ে যায়। বাকিদের আরও চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। প্রথমে কিছু ওষুধ সেবন এবং মলম লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এতেও কাজ না হলে এনাল ফিসার অপারেশনের প্রয়োজন হয়।
গেজ রোগ প্রতিরোধের পরামর্শগুলো সঠিকভাবে মেনে চললে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপারেশনের প্রয়োজন পড়বে না। অভ্যাসে স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনা কঠিন মনে হতে পারে। যেমন প্রতিবার খাওয়ার সময়ে চিন্তা করতে হবে খাবারে ফাইবার কতটুকু আছে, তার চেয়ে একটি ওষুধ খেয়ে বা অপারেশন করে সমস্যা দূর হয়ে যাওয়া অনেকের কাছেই সহজতর মনে হতে পারে।
কিন্তু এই রোগ যাতে আবার না হয়, সেজন্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা জরুরী। অপারেশন করার পরেও ডাক্তার আপনাকে ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিবে। অন্যথায় কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে আবারও গেজ রোগ দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ, ঔষধ সেবন ও অপারেশন করলেও, গেজ রোগ বা এনাল ফিসারের স্থায়ী সমাধানে, অভ্যাস পাল্টে সুস্থ জীবনধারা বেছে নেওয়ার বিকল্প নেই।
এনাল ফিসারের ঔষধ
এনাল ফিসারের চিকিৎসায় ডাক্তার অনেক ধরনের ওষুধ সেবনের এবং মলম ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। ওষুধগুলো কেবল চিকিৎসকের পরামর্শক্রমেই সেবন করা উচিত, তা না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। গেজ রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকর ওষুধগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১. জোলাপ বা ল্যাক্সেটিভ: এগুলো সিরাপ, ট্যাবলেট বা বড়ি হিসেবে পাওয়া যায়। এই ওষুধগুলো পায়খানায় পানির পরিমাণ ধরে রেখে তা নরম রাখে ও পায়খানা শক্ত হওয়া প্রতিরোধ করে। একেক বয়সের মানুষের বিভিন্ন সমস্যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। আপনার জন্য উপযুক্ত ওষুধটি বেছে নিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
২. গ্লিসারাইল ট্রাইনাইট্রেট ও ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার মলম: এগুলো মলদ্বারের ভেতরের ও আশেপাশের পেশি ও রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে। এর ফলে ফাটলের স্থানে রক্ত সরবরাহ বাড়ে ও তা দ্রুত সেরে ওঠে। সেই সাথে পায়ুপথের ভেতরে চাপ কমে যাওয়ার ফলে ব্যথাও কমে যায়।
মলম দুটি বেশ কার্যকর। সঠিক উপায়ে ব্যবহার করলে প্রতি ১০ জন ক্রনিক ফিসারের রোগীর মধ্যে ৭ জনের ফাটল দেরে যায়। এগুলো সাধারণত কমপক্ষে ৬ সপ্তাহ বা ফাটল সম্পূর্ণরূপে সেরে না ওঠা পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়।
তবে মলমগুলোর বেশ কয়েকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা একেবারেই ঠিক নয়। এছাড়া শিশু, গর্ভবতী মা বা মাথাব্যথার সমস্যা আছে এমন কারও ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া এসব মলম ব্যবহার করা ঠিক নয়।
৩. টপিক্যাল অ্যানেস্থেটিক
এগুলো শরীরের বহির্ভাগে ব্যবহার করার চেতনানাশক মলম বা জেল হিসেবে পাওয়া যায়। অসহনীয় ব্যথা হলে এটি ব্যবহার করা হয়। এতে ফাটল সারে না, তবে ব্যথা উপশম হয়।
এনাল ফিসারের চিকিৎসায় ডাক্তারের সাথে নিয়মিত ফলো-আপে থাকতে হয়। ৮ সপ্তাহের মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে সবকিছু বিবেচনা করে ডাক্তার আপনাকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ কোলোরেক্টাল সার্জনের কাছে রেফার করতে পারেন।
এনাল ফিসার অপারেশন
গেজ রোগ অন্য কোনো চিকিৎসায় সারানো না গেলে অপারেশনের পরামর্শ দেয়া হয়। সার্জারিকে সাধারণত এনাল ফিসারের সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা হিসেবে গণ্য হয়। এক্ষেত্রে ৯০%-এর বেশি রোগী দীর্ঘমেয়াদি সুফল লাভ করে থাকেন। তবে এর থেকে নানান জটিলতা সৃষ্টিরও ঝুঁকি থাকে।
এনাল ফিসারের চিকিৎসায় অনেক ধরনের অপারেশন করা যায়। এগুলো খুব জটিল অপারেশন না, সাধারণত রোগী সেদিনই বাড়ি ফিরে যেতে পারে। এনাল ফিসার অপারেশন এর মধ্যে বহুল প্রচলিত দুটি পদ্ধতি হলো—
১. ল্যাটারাল স্ফিংকটারেকটোমি
এ পদ্ধতিতে পায়ুপথের ভেতরের দিকের মাংসপেশি অপারেশনের ছুরি দিয়ে একটু ছাড়িয়ে দেয়া হয়। এতে করে মাংসপেশি রিলাক্স হয় আর পায়ুপথের ভেতরের চাপ কমে আসে। এটি এনাল ফিসার সারাতে সাহায্য করে এবং নতুন ফাটল সৃষ্টি প্রতিরোধ করে।
২. অ্যাডভান্সমেন্ট অ্যানাল ফ্ল্যাপ
এই পদ্ধতিতে শরীরের অন্য কোন স্থান থেকে একটি সুস্থ টিস্যু নিয়ে তা এনাল ফিসারের ফাটল মেরামতের কাজে ব্যবহার করা হয় এবং ক্ষত স্থানের রক্ত সরবারাহ সুগম করা হয়। এই পদ্ধতি সাধারণত গর্ভাবস্থা বা মলদ্বারে আঘাত থেকে সৃষ্ট দীর্ঘস্থায়ী ফিসার সারাতে ব্যবহৃত হয়।