সন্তান গর্ভে ধারণ এবং জন্ম দেওয়ার এই লম্বা সফরে আপনার শরীর ও মনে অনেক রকম পরিবর্তন আসে। এসব কারণে সন্তান জন্মদানের পর আপনি বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন। এই সমস্যাগুলো যেমন দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে, তেমনি এগুলোর সমাধানও ধৈর্য ও সময় নিয়ে করতে হয়। তাই প্রসব-পরবর্তী সমস্যাগুলোকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না।
প্রসব-পরবর্তী যোনিপথে রক্তপাত
প্রসবের পরে কয়েক দিন পর্যন্ত আপনার যোনিপথ দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। মেডিকেলের ভাষায় একে ‘লোকিয়া’ বলা হয়। শুরুর দিকে কিছুটা বেশি পরিমাণে এবং টকটকে লাল রঙের রক্ত যায়। এর সাথে ছোটো ছোটো রক্তের দলা বা চাকাও যেতে পারে। তাই এসময়ে স্যানিটারি প্যাড পরার চেষ্টা করুন। এই প্যাড কমপক্ষে ৪-৬ ঘন্টা পর পর পরিবর্তন করুন। পাশাপাশি প্রত্যেক বার পরিবর্তনের আগে ও পরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।
কতদিন থাকে?
সময়ের সাথে সাথে আপনার মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত অনেকটা কমে যাবে। প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে লোকিয়ার রঙ খয়েরী অথবা গোলাপি হতে শুরু করে। তবে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়ে আপনি মাসিকের রাস্তায় হুট করে পানির স্রোতের মতো ভারী রক্তপাত অনুভব করতে পারেন, যা বেশ গাঢ় লাল রঙের। শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময়ে আপনার জরায়ু সংকোচন হওয়ার কারণে এমনটা হয়। এতে ভয়ের কিছু নেই।
প্রায় দুই সপ্তাহ পর লোকিয়ার রঙ হালকা খয়েরী অথবা হলুদ হতে শুরু করে। সাধারণত প্রায় ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে লোকিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই সময়কাল একেক জনের ক্ষেত্রে কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। এ ছাড়াও এসময়টায় আপনি মাসিকের সময়ের পেট ব্যথার মতো পেটে ব্যথাও অনুভব করতে পারেন।
এই পুরো সময়টায় লোকিয়ার রঙ কিংবা পরিমাণ সহজে বোঝার জন্য আপনি সাদা রঙের তুলার তৈরি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারেন। তবে এই সময়ে মেন্সট্রুয়াল কাপ অথবা ট্যামপুন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এসব ব্যবহারের করলে আপনার ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
বাড়িতে প্রসব হয়ে থাকলে প্রসব-পরবর্তী সময়ে রক্তের সাথে বড় বড় চাকা বা দলা গেলে অবশ্যই জরুরী ভিত্তিতে আপনার নিকটস্থ হাসপাতালে যান। সন্তান জন্মদানের পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে যোনিপথে ভারী, অর্থাৎ ৫০০ মিলিলিটার অথবা তার বেশি রক্তক্ষরণ হলে তাকে প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ বা পোস্টপার্টাম হেমোরেজ বলে।[১] সাধারণত প্রসবের পর জরায়ু ঠিকমতো সংকুচিত না হলে এমন রক্তপাত হতে পারে।[২]
এ ছাড়াও গর্ভফুল পুরোপুরি বের না হলে, গর্ভফুল জরায়ুমুখের দিকে অবস্থান করলে, যোনিপথে আঘাত লাগলে কিংবা রক্তের নানান রোগের কারণেও এই রক্তপাত হতে পারে। এই সমস্যা প্রতিরোধের জন্য প্রসবের পর পরই হাসপাতাল থেকে ডাক্তারের পরামর্শে অক্সিটোসিন ইনজেকশন দেওয়া হয়ে থাকে, যা জরায়ুর সংকোচন বৃদ্ধি করে গর্ভফুল বাইরে বের করে দিতে সাহায্য করে।[৩]
এ ছাড়াও বাড়িতে যাওয়ার পর লোকিয়ায় কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। যেমন—
- ২৪ ঘন্টা কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় পর রক্তপাত কমে যাওয়ার বদলে ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করা
- দুর্গন্ধযুক্ত রক্তপাত হওয়া
ডেলিভারি পরবর্তী যোনিপথের সেলাইয়ের যত্ন
নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চার মাথা বের হওয়ার সময়ে প্রসবের রাস্তায় যে চাপের সৃষ্টি হয় তাতে অনেক সময় যোনিপথ ও মলদ্বারের মাঝের অংশটুকু ছিঁড়ে যায়। একে ‘পেরিনিয়াল টিয়ার’ বলা হয়ে থাকে। অল্প পরিমাণে ছিঁড়ে গেলে লেবার রুমেই এটি সেলাই করে দেওয়া হয়। তবে ছেঁড়া বেশি হলে অথবা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে অপারেশন রুমে নিয়ে সেলাই দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
এই পেরিনিয়াল টিয়ার যাতে না হয় এজন্য অনেকসময়ে যোনিমুখে আগে থেকে কিছুটা কেটে দেওয়া হয়, যাতে বাচ্চার মাথা সহজে বের হয়ে আসতে পারে। এই কেটে দেওয়াকে এপিসিওটমি বা সাইড কাটা বলে।[৪]
কীভাবে যত্ন নিবেন?
এপিসিওটমি অথবা ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য আপনার যোনিপথ ও মলদ্বারের মাঝের অংশে সেলাই দেওয়া হলে তা সারতে কেমন সময় লাগবে—সেটি নির্ভর করে কতটুকু ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে অথবা কতটুকু কাটা হয়েছে তার ওপর।
তবে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর এই সেলাইয়ের স্থানে আপনার নিজেরও যত্ন নিতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি যা যা করতে পারেন—
১. সেলাইয়ের স্থান পরিষ্কার রাখুন: সেলাইয়ের স্থানে যাতে সংক্রমণ বা ইনফেকশন না হয় সেজন্য জায়গাটি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। এজন্য আপনি প্রতিদিন একবার কুসুম গরম পানি ও সাবান দিয়ে জায়গাটি ধুয়ে ফেলুন। তারপর শুকনো ও পরিষ্কার কাপড় দিয়ে আলতোভাবে চাপ দিয়ে মুছে ফেলুন। সেলাইয়ের স্থানে ঘষাঘষি কিংবা চাপাচাপি করবেন না।
২. ব্যথা কমাতে ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ সেবন করুন: সেলাইয়ের স্থানে ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক। সাধারণত হাসপাতাল থেকে এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যথানাশক ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। আপনার শিশুকে বুকের দুধ পান করালে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ‘ওভার দ্যা কাউন্টার’ ব্যথানাশক (যেমন: প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন) সেবন করতে পারেন।
তবে কোন ধরনের ব্যথানাশক ঔষধ আপনার জন্য ভালো কার্যকর হবে, তা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিন। এ ছাড়াও কিছুটা আরামবোধের জন্য ঠাণ্ডা পানির প্যাক অথবা পরিষ্কার কাপড়ে বরফ পেঁচিয়ে ক্ষতস্থানে লাগাতে পারেন।
৩. প্রস্রাব-পায়খানার পর ক্ষতস্থানটি ভালোমতো পরিষ্কার করুন: প্রস্রাব-পায়খানার সময়ে সেলাইয়ের জায়গায় জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। তাই প্রতিবার পায়খানা-প্রস্রাব করার পর সেলাইয়ের স্থানটি ভালোমতো কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে টিস্যু অথবা একটা পরিষ্কার শুকনো কাপড় দিয়ে আলতোভাবে চাপ দিয়ে মুছে নিন।
এ ছাড়াও আপনি নিয়মিত ‘সিজ বাথ’ নিতে পারেন। এজন্য একটি গামলায় পরিষ্কার গরম পানি নিয়ে গামলাটি একটি প্লাস্টিকের টয়লেট চেয়ারের নিচে রাখতে পারেন। এরপর সেই চেয়ারে বসলে গরম পানির ভাপ আপনার ক্ষতস্থানে পৌঁছুবে। এতে আপনি কিছুটা আরামবোধ করতে পারেন।
৪. পায়খানা নরম রাখার চেষ্টা করুন: পায়খানা শক্ত হলে পায়খানা করার সময়ে সেলাইয়ের জায়গায় চাপ লেগে সেলাই খুলে যেতে পারে। তাই আপনার পায়খানা যাতে নরম থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। এক্ষেত্রে বাড়িতে ফেরার সময়ে ডাক্তারের পরামর্শ মতো পায়খানা নরম রাখার ঔষধ সেবন করতে পারেন। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন এবং নিয়মিত শাক-সবজি খান।
এ ছাড়াও প্রস্রাব-পায়খানার চাপ আসলে তা আটকে রাখার অভ্যাস থাকলে, সেটি বাদ দিয়ে দিন। চাপ আসলে সাথে সাথেই প্রস্রাব-পায়খানা করে ফেলুন।
৫. আরামদায়ক অবস্থানে বিশ্রাম নিবেন: সেলাইয়ের ক্ষতের জন্য সোজা হয়ে বসতে অসুবিধা হতে পারে। সেক্ষেত্রে একটি নরম বালিশের ওপরে বসতে পারেন। এতে কিছুটা আরাম পেতে পারেন। আবার সোজা হয়ে বসে শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময়ে আপনার সেলাইয়ের স্থানে অসুবিধা হতে পারে। এজন্য এক কাত হয়ে শুয়ে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন। এতে করে সেলাইয়ের স্থানে চাপ কম লাগবে।
এসব সেলাইয়ে সাধারণত এমন সুতো ব্যবহার করা হয় যা ক্ষতস্থান সেরে ওঠার সাথে সাথে আপনা-আপনি শরীরের সাথে মিশে যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তা আলাদা করে কাটার দরকার হতে পারে।[৫] তাই সেলাই দেওয়ার পর আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে এই বিষয়ে জেনে নিন। প্রয়োজন হলে আপনি নিকটস্থ যেকোনো হাসপাতালে গিয়ে সেলাই কাটাতে পারেন।
যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সেলাইয়ের স্থানে কোনো অস্বস্তি হলে, অর্থাৎ জায়গাটি ফুলে গেলে, পুঁজ কিংবা রক্ত বের হলে অথবা সেলাই খুলে গেলে অবশ্যই জরুরী ভিত্তিতে আপনার চিকিৎসককে জানান।
সিজারের পর ক্ষতস্থানের যত্ন
আপনি হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ার সময়ে ছাড়পত্র অথবা প্রেসক্রিপশনে আপনাকে পেটের সেলাইয়ের ও ক্ষতস্থানের যত্ন কীভাবে নিতে হবে তা বলে দেওয়া হবে। যদি কোনো কারণে তা বলে দেওয়া না হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় আপনার চিকিৎসককে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারেন। এ ছাড়াও ঘরে বসে আপনি সাধারণত যেভাবে ক্ষতস্থানের যত্ন নিতে পারেন সেগুলো হলো—
- ক্ষতস্থানটি প্রতিদিন সাবান ও পানি দিয়ে আলতোভাবে পরিষ্কার করে শুকনো ও পরিষ্কার কাপড় দিয়ে করে মুছে ফেলুন। তবে সেলাইয়ের স্থানে জোরে ঘষাঘষি করা যাবে না।
- যতদূর সম্ভব ঢিলাঢালা, আরামদায়ক ও সুতির কাপড় পরার চেষ্টা করুন।
- ক্ষতস্থানে ব্যথা হলে আপনি ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রেও হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ার সময়ের ছাড়পত্র অনুযায়ী ব্যথার ঔষধ সেবন করুন। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
ক্ষতস্থান স্বাভাবিক থাকলে এই সেলাইয়ের সুতোগুলো সাধারণত ৫–৭ দিন পর নিকটস্থ যেকোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলে অপসারণ করে দেওয়া হয়। ক্ষতস্থানের অবস্থার ভিত্তিতে এই সময় কম-বেশি হতে পারে। এই ব্যাপারেও আপনার ছাড়পত্রে নির্দেশনা দেওয়া থাকবে।
সেলাই খোলার পর ধীরে ধীরে আপনার ক্ষতস্থানটি একটি দাগের মতো হয়ে থেকে যাবে। এটি সাধারণত তলপেটের ঠিক নিচে আড়াআড়িভাবে বা ভূমির সাথে সমান্তরালভাবে থাকে। দৈর্ঘ্যে ১০-২০ সেমি হয়ে থাকে। তবে খুব বিরল কিছু ক্ষেত্রে (যেমন: গর্ভকালীন জটিলতায়) লম্বালম্বি করে কাটা হতে পারে।[৬] শুরুর দিকে ক্ষতচিহ্নটি লালচে থাকে, যা পরবর্তীতে বাদামী অথবা সাদাটে রঙ ধারণ করতে পারে।
পড়ুন: সিজারের পর সেরে ওঠা
সেলাইয়ের স্থানে ইনফেকশন
সেলাইয়ের স্থানে ইনফেকশন হলে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। কেননা সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা না হলে তা পরবর্তীতে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করে। ইনফেকশন হলে যেভাবে বুঝবেন—
- সেলাইয়ের জায়গায় অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যাবে
- সেলাইয়ের আশেপাশে অতিরিক্ত লাল হয়ে যাবে অথবা অস্বাভাবিক রঙ ধারণ করবে
- সেলাইয়ের স্থান থেকে পুঁজ ও দুর্গন্ধ বের হবে
- সেলাই কাটার পরও কাটা স্থানের চামড়া ঠিকমতো জোড়া লাগবে না
স্তনের সমস্যা
প্রসবের পর ২–৪ দিনের মধ্যে সাধারণত আপনার বুকে দুধ চলে আসতে শুরু করবে। শুরুর দিকে দুধের রঙ কিছুটা হলুদাভ হয়। একে ‘শালদুধ’ বলে। এসময়ে আপনার স্তনে ব্যথা, ফোলা, ভারী ভাব, শক্ত হয়ে যাওয়া কিংবা অস্বস্তি অনুভব হতে পারে। শিশুকে নিয়মিত সঠিক নিয়মে বুকের দুধ খাওয়াতে শুরু করলে এই সমস্যাগুলো নিজে থেকেই ধীরে ধীরে সেরে যায়।
এজন্য আপনি আপনার চিকিৎসক, নার্স অথবা নিকটস্থ স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে সঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর পদ্ধতি শিখে নিতে পারেন। তবে আপনার স্তন অতিরিক্ত শক্ত হয়ে যাওয়ায় যদি শিশু ঠিকমতো বুকের দুধ পান করতে না পারে কিংবা সময়মতো আপনার বুকে দুধ না আসে অথবা কম আসে অথবা অন্যান্য কোনো সমস্যার কারণে শিশু বুকের দুধ খেতে না পারে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
তবে কোনো কারণে আপনি বুকের দুধ খাওয়াতে না চাইলে অথবা না পারলে ধীরে ধীরে দুধ উৎপাদন কমে আসবে। দুধ উৎপাদন কমে আসার সাথে সাথে ৭-১০ দিনের মধ্যে স্তনের ব্যথা কিংবা ফোলাভাবও সাধারণত সেরে যায়। এই সময়টায় আপনি স্তনে বরফ অথবা ঠাণ্ডা পানির প্যাক দিলে ফোলা ও ব্যথা কিছুটা কমে আসতে পারে।
নরম কাপড়ের তৈরি ভালো সাপোর্টযুক্ত ব্রা পরার চেষ্টা করুন। ব্যথা বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ সেবন করতে পারেন। তবে ব্যথা কমানোর জন্য পাম্প করে দুধ ফেলে দিবেন না। এতে করে আপনার শরীর নতুন করে আরও দুধ উৎপাদনের জন্য উদ্দীপনা পায়।
তলপেটের যত্ন
গর্ভাবস্থায় আপনার তলপেটের চামড়া এবং পেশীগুলি প্রসারিত হয়ে যায়, যেটা আগের অবস্থায় ফিরতে সময় দরকার। এজন্য প্রসবের পরও আপনার তলপেট অনেকটাই বড় থেকে যেতে পারে।
এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য আপনার দরকার একটি সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং সাথে পরিমিত ব্যায়াম। শরীরের অবস্থা অনুযায়ী ঠিক কোন ধরনের ব্যায়াম আপনার জন্য উপযোগী হবে—তা জানতে প্রসব-পরবর্তী চেকআপের সময়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
প্রসবের পর স্বাস্থ্যকর ওজন ধরে রেখে পেট কমানোর সম্ভাবনা বাড়াতে পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খাওয়ার পাশাপাশি সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে সেটাও ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে।[৭] তবে অবশ্যই এমন কোনো ডায়েট অনুসরণ করা উচিত নয় যা আপনার বুকের দুধ কমিয়ে দেয় কিংবা আপনার দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পড়ুন: ডেলিভারির পর পেট কমানোর উপায়
মল-মূত্র ত্যাগজনিত সমস্যা
নরমাল ডেলিভারির পর স্বাভাবিকভাবেই প্রস্রাব করতে গেলে ব্যথা বা জ্বালা হতে পারে। এক্ষেত্রে বেশি বেশি পানি পান করলে প্রস্রাবের ঘনত্ব কমে যায়, তখন কিছুটা কম জ্বালা হতে পারে। আপনার প্রস্রাব করতে বেশি সমস্যা হলে, খুব বেশি ব্যথা হলে অথবা জ্বালা ধরলে কিংবা প্রস্রাবে দুর্গন্ধ হলে আপনার চিকিৎসককে জানান।
অনেকের নরমাল ডেলিভারির পর পাইলস বা অর্শরোগ হতে পারে। এটি হলে মলদ্বারের বাইরে কিছুটা মাংসপিণ্ড ঝুলে পড়ে। যার জন্য মলত্যাগের সময় ব্যথা হয় এবং কখনো কখনো রক্ত যায়। এটি বেশির ভাগ সময়েই কিছুদিন পর আপনা-আপনি চলে যায়।
চিকিৎসককে জানালে তিনি আপনাকে একটি ব্যথানাশক মলম দিবেন যেটা আপনাকে মলত্যাগের সময় কিছুটা আরাম দেবে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য বেশি বেশি ফল, শাক সবজি, সালাদ এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারেন। সাথে প্রচুর পানি পান করতে হবে।
মলত্যাগের সময় আপনার যোনিপথের সেলাই থাকলে তা খুলে যাওয়ার অথবা ক্ষত বেড়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই।[৮] তবে মলত্যাগের সময় সেলাইয়ের উপর পরিষ্কার কাপড় অথবা টিস্যু ধরে রাখলে আরাম পাবেন। মলত্যাগের সময় কোনোভাবেই বেশি চাপ দেওয়া যাবে না।
যদি কোষ্ঠকাঠিন্য বেশি হয়ে থাকে তাহলে আপনার চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। এ ছাড়া যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে পায়খানা বের হয়ে যেতে থাকে তাহলেও চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
সন্তান জন্মদানের পর প্রস্রাব লিক করা একটি কমন সমস্যা। অনেকসময় হাসলে, কাশি দিলে অথবা নড়াচড়া করলেও কিছুটা প্রস্রাব লিক করতে পারে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই তবে পরবর্তী চেকআপে ডাক্তারকে জানিয়ে রাখাই ভালো। পেলভিক ফ্লোরের ব্যায়াম বা কেগেল ব্যায়াম করুন—এটা প্রস্রাব ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে।[৯]
চুল পড়া
সন্তান জন্মদানের পর চুল পড়া বেড়ে যাওয়া বেশ কমন সমস্যা। সাধারণত প্রসবের তিন মাসের পর এই সমস্যা দেখা দেয়।[১০] একে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘টেলোজেন এফ্লুভিয়াম’। প্রসবের সময়ে আপনার শরীর একধরনের শকের মধ্যে দিয়ে যায়, এই শক বা ঝটকার কারণে আপনার চুল নির্ধারিত সময়ের আগেই ঝরে পড়তে থাকে।
সাধারণত এই সমস্যাটি সাময়িক এবং এর জন্য আলাদা করে কোনো চিকিৎসার দরকার হয় না। ৩ থেকে ৬ মাস পর নিজে থেকেই চুল পড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং নতুন চুল গজাতে থাকে[১১]। পুষ্টিকর, আয়রন ও আমিষ সমৃদ্ধ খাবার এবং ফল ও শাক-সবজি খেতে পারেন। এ ছাড়া বেশি করে পানি পান করুন। এতে আপনার শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে এবং চুলও স্বাস্থ্যকর থাকবে।
অনেক বেশি চুল পড়লে অথবা অনেকদিন পরও চুল পড়া বন্ধ না হলে চিকিৎসককে জানান। চিকিৎসক আপনাকে ভিটামিন জাতীয় ওষুধ দিতে পারেন এবং আপনার শরীরে আয়রন ও থাইরয়েডের পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
প্রসব-পরবর্তী চেকআপ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রসবের পরে কমপক্ষে চারবার প্রসব-পরবর্তী চেকআপের প্রয়োজন আছে।[১২] এই চারটি চেকআপ যখন করাতে হবে তার সময় হলো—
১ম চেকআপ | হাসপাতালে প্রসব হলে প্রসব-পরবর্তী প্রথম ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত হাসপাতালে থেকে প্রথম চেকআপ নিশ্চিত করতে হবেবাড়িতে প্রসব হলে প্রসব-পরবর্তী প্রথম ২৪ ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই হাসপাতালে এসে প্রথম চেকআপ নিশ্চিত করতে হবে |
২য় চেকআপ | প্রসব-পরবর্তী ৪৮-৭২ ঘন্টা, অর্থাৎ প্রসবের ২য় অথবা ৩য় দিনে |
৩য় চেকআপ | প্রসব-পরবর্তী ৭ম-১৪তম দিনের মধ্যে |
৪র্থ চেকআপ | প্রসব-পরবর্তী ৬ষ্ঠ সপ্তাহ, অর্থাৎ দেড় মাস পরে |
এই প্রসব-পরবর্তী চেকআপে আপনার ও শিশুর সুস্থতা পর্যবেক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি আপনার ও আপনার শিশুর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নানান বিষয়ে আলোচনা করা হয়। প্রসব-পরবর্তী চেকআপে সাধারণত যা যা অন্তর্ভুক্ত থাকে—
- রুটিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা: আপনার রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওজন পরিমাপসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। বিশেষ করে যদি গর্ভাবস্থায় আপনার এই ধরনের সমস্যা থেকে থাকে।
- জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি: আপনি শীঘ্রই আরেকটি সন্তান না নিতে চাইলে আপনার জন্য উপযুক্ত এবং সুবিধাজনক জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতিটি সম্পর্কে আপনাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হবে।
- গর্ভ ও প্রসব কালীন জটিলতা: আপনার যদি গর্ভকালীন অথবা প্রসবকালীন কোনো জটিলতা থেকে থাকে তাহলে তা প্রসব-পরবর্তী সময়ে আপনার স্বাস্থ্যের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। পাশাপাশি কোনো জটিলতার প্রভাব এখনো রয়ে গেলে তার উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া হবে।
- প্রসব পরবর্তী ডিপ্রেশন: আপনার প্রসব পরবর্তী কোনো মানসিক অবসাদ দেখা দিচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। প্রয়োজন হলে মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হবে।
- টিকা: আপনার ও আপনার সন্তানের পরবর্তী কী কী টিকা দেওয়া প্রয়োজন তা জানিয়ে দেওয়া হবে।
- বুকের দুধ: আপনি শিশুকে সঠিক উপায়ে বুকের দুধ দিতে পারছেন কি না ও শিশু যথেষ্ট পরিমাণে বুকের দুধ পাচ্ছে কি না তা দেখা হবে এবং এ সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়া হবে।
এসব ছাড়াও আপনার ও আপনার শিশুর স্বাস্থ্য ও সুস্থতা সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্ন থাকলে এসময়ে তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
সন্তান জন্মদানের পর পেটের দাগ একেবারে দূর করা সম্ভব নয়। তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে দাগ ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসতে পারে।
পড়ুন: গর্ভাবস্থায় স্ট্রেচ মার্ক
সন্তান জন্মদানের পর চুল পড়া বেড়ে যাওয়া বেশ কমন সমস্যা। সাধারণত প্রসবের তিন মাস পর এই সমস্যা দেখা দেয়[১৩]। একে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘টেলোজেন এফ্লুভিয়াম’।
সাধারণত এই সমস্যাটি সাময়িক এবং এর জন্য আলাদা করে কোনো চিকিৎসা দরকার হয় না। ৩ থেকে ৬ মাস পর নিজে থেকেই চুল পড়া বন্ধ হয়ে যায়। পুষ্টিকর, আয়রন ও আমিষ সমৃদ্ধ খাবার এবং ফল ও শাক-সবজি খেতে পারেন। এ ছাড়া বেশি করে পানি পান করুন। এতে আপনার শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে এবং চুলও স্বাস্থ্যকর থাকবে।
ডেলিভারির সময়ে আপনার শরীরের, বিশেষ করে প্রসবের রাস্তার ওপর অনেক ধকল যায়। তবে সন্তান জন্মদানের পর ধীরে ধীরে যোনি এবং তার আশপাশ পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ধৈর্যের সাথে যোনিপথের যত্ন নিতে হবে। হাসপাতালে ডেলিভারি হলে আপনার ছুটির কাগজে বা ছাড়পত্রে এই সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া থাকবে। সেগুলো মেনে চলতে হবে।
পড়ুন: ডেলিভারির পর প্রসবের রাস্তার যত্ন
খাওয়ার পাশাপাশি সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে সেটাও ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে।
পড়ুন: ডেলিভারির পর পেট কমানোর উপায়
প্রসবের পরে সাধারণত যোনিপথ দিয়ে রক্তপাত হয়ে থাকে। মেডিকেলের ভাষায় এটিকে ‘লোকিয়া’ বলা হয়। লোকিয়া স্বাভাবিক হলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ২৪ ঘন্টায় ৫০০ মিলি বা তার বেশি হলে এটি স্বাভাবিক নয়। এটিকে তখন ‘পোস্টপার্টাম হেমোরেজ’ বলে যা একটি মেডিকেল ইমারজেন্সি।