যোনিপথে প্রসবের সময় কিছু ক্ষেত্রে প্রসূতির যোনি ও পায়ুর অন্তর্বর্তী অংশটি কাটতে হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটির নাম এপিসিওটমি। এই কাটার ফলে যোনিপথের বাইরের মুখটি বড় হয় এবং সন্তান আরও সহজে বের হয়ে আসতে পারে।
সাধারণত নরমাল ডেলিভারিতে নিয়মিতভাবে এপিসিওটমি করতে নিরুৎসাহিত করা হয়।[১][২] অর্থাৎ আগে থেকে এপিসিওটমি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। এই প্রক্রিয়াটি শুধু বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়লে সেটা প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হওয়া পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সাইড কাটার কারণ
যেসব কারণে এপিসিওটমি করা হয় সেসব হলো—
- যদি সন্তান অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান না পাওয়ার কারণে তার শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া (ফিটাল ডিসট্রেস) শুরু হয়[৩] এবং তাকে তাড়াতাড়ি গর্ভের ভেতর থেকে বের করা আনার প্রয়োজন হয়
- যদি গর্ভের শিশুর ব্রিচ প্রেজেন্টেশন থাকে[৪]
- যদি গর্ভের শিশু আকারে বড় হয়[৫]
- যদি যোনিপথে প্রসবের ক্ষেত্রে ফোরসেপ বা ভেনটুস জাতীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়ে থাকে[৬]
- যদি প্রসবকালে পেরিনিয়াম কিংবা পায়ু ছিঁড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে
সাইড কাটা যেভাবে করা হয়
যদি প্রসবের সময় আপনার এপিসিওটমির দরকার হয় তাহলে প্রথমে আপনার অথবা আপনার পরিবারের কারও থেকে এই ছোটো অপারেশনটি করার জন্য লিখিত সম্মতি নেওয়া হবে।
তারপর কাটার জায়গাটি অবশ করা হবে। যদি প্রসবের জন্য আপনাকে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে অবশ করার বাড়তি কোনো ঔষধের প্রয়োজন নেই।
যোনি ও পায়ুর অন্তর্বর্তী অংশটিকে পেরিনিয়াম বলে। অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহার করা না হলে অথবা অ্যানেস্থেসিয়ার কার্যকারিতা শেষ হয়ে আসলে, আপনার পেরিনিয়াম অবশ করার জন্য ইনজেকশনের মাধ্যমে ঔষধ দেওয়া হবে।
এপিসিওটমির কাটা কয়েকভাবে দেওয়া যায়। সবচেয়ে নিরাপদ উপায়টি হলো আপনার পেরিনিয়ামের উপরের দিকে মধ্যবিন্দু থেকে কোণাকুণি ডানে বা বামে নিচের দিকে কাটা। একে Medio-lateral এপিসিওটমি বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডান দিকে এই কাটা দেওয়া হয়। সাধারণত এই উপায়ে এপিসিওটমি দেওয়ারই পরামর্শ দেওয়া হয়।[৭] এর ফলে কাটা বড় হয়ে গিয়ে পায়ুপথ ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম থাকে।[৮]
এ ছাড়া পেরিনিয়ামে উপর থেকে নিচের দিকে মাঝ বরাবর সোজা করেও কাটা যায়। এরকম আরও কিছু উপায় রয়েছে যেগুলো তুলনামূলক কম নিরাপদ, অর্থাৎ কাটার পর সন্তান প্রসবের সময় ক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সেগুলো সাধারণত করা হয় না।
সন্তান প্রসবের পর পরই এই কাটা সেলাই করে ফেলা হয়। সেলাইয়ের জন্য এমন সুতা ব্যবহার করা হয় যা সেলাই শুকিয়ে গেলে আপনার শরীরের সাথে মিশে যায়। এতে করে সেলাই খোলার জন্য আবার হাসপাতালে যাওয়ার দরকার পড়ে না।
সাইড কাটা সেরে ওঠা
এপিসিওটমির পর ২ থেকে ৩ সপ্তাহ হালকা ব্যথা থাকতে পারে, বিশেষ করে হাঁটা অথবা বসার সময়।[৯] সেলাইয়ের সুতার কারণে কিছুটা অস্বস্তি বোধ হতে পারে, যা স্বাভাবিক। প্রস্রাব করার সময় সেলাই কিছুটা জ্বলতে পারে এবং পায়খানা করার সময় ব্যথা হতে পারে।
চামড়ার কাটা অংশটি শুকাতে প্রসবের পর কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।[১০] এরপর জায়গাটিতে ব্যথা আসতে আসতে কমে আসে।
সাইড কাটার যত্ন
এপিসিওটমির কাটা সুন্দর মতো সেরে ওঠার জন্য কিছু বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। যেমন—
১. পরিচ্ছন্নতা
কাটা স্থানের যত্ন নেওয়ার জন্য এবং ইনফেকশনের আশঙ্কা কমানোর জন্য কাটা জায়গাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য যা করণীয়—
- দিনে একবার গোসল করা অথবা কম পক্ষে কাটা জায়গাটি ধুয়ে পরিষ্কার করা। কাটা জায়গা পরিষ্কার করার জন্য শুধু পানি ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়[১১]
- স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড নিয়মিত বদলানো[১২]
- বাথরুমে যাওয়ার আগে ও পরে প্রতিবার ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া
- প্রতিদিন এক ফাঁকে বিছানার ওপর একটি তোয়ালে বিছিয়ে শরীরের নিচের অংশের কাপড় ও অন্তর্বাস খুলে আরাম করে শুয়ে থাকতে পারেন। এতে করে কাটা অংশে খোলা বাতাস পৌঁছাবে যা কাটা সেরে উঠতে সাহায্য করবে
- প্রস্রাব-পায়খানা করার পর, পানি দিয়ে ধোওয়ার বেলায় সবসময় সামনে থেকে পেছনে পরিষ্কার করার চেষ্টা করতে হবে
২. বিশ্রাম
সেরে ওঠার সময় শরীরকে স্বস্তি ও বিশ্রাম দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবজাতকের যত্ন নেওয়ার মাঝে নিজের যত্ন নেওয়া অনেকসময় গৌণ হয়ে যায়। তবে চেষ্টা করুন নিজের শরীরকেও সমান গুরুত্ব দেওয়ার।
যখন আপনার শিশু ঘুমিয়ে থাকবে তখন আপনিও ঘুমিয়ে নিন। সারাদিনের কাজ ও বিশ্রামের মাঝে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে পরিবারের অন্যদের সাহায্য নিন।
৩. ব্যথা কমানোর উপায়
এপিসিওটমির পর কয়েক সপ্তাহ ব্যথা থাকবে, এমনটাই স্বাভাবিক। তবে ব্যথা কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন। যেমন—
- একটি রুমাল বা তোয়ালের ভেতর বরফ পেঁচিয়ে তা দিয়ে কাটা স্থানে ঠান্ডা সেঁক দিতে পারেন
- কুসুম গরম পানিতে গোসল করতে পারেন এবং টয়লেট করার পর কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে পারেন।[১৩] এর ফলে পেরিনিয়ামের পেশিতে রক্ত সরবরাহ বাড়বে, যা ব্যথা উপশমে সাহায্য করতে পারে
- বসার জন্য বাজারে পাওয়া বিশেষ ধরনের কুশন ব্যবহার করতে পারেন। কুশনটি ডোনাটের আকৃতির হয় এবং বাতাস দিয়ে ফোলানো থাকে। এটি আপনাকে আরাম করে বসতে সাহায্য করবে
- ব্যথার জন্য ব্যথানাশক ঔষধ খেতে পারেন। প্রসবের পর এবং শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহার করা নিরাপদ[১৪]
বিশেষ দ্রষ্টব্য
সন্তানকে বুকের দুধ দিয়ে থাকলে ব্যথানাশক হিসেবে প্যারাসিটামল ব্যবহার করা নিরাপদ।[১৫][১৬] এ ছাড়া এসময় আইবুপ্রোফেন-ও ব্যবহার করা যাবে।[১৭]
তবে সন্তানকে বুকের দুধ দিয়ে থাকলে ব্যথানাশক হিসেবে অ্যাসপিরিন ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়।[১৮] কারণ অ্যাসপিরিন বুকের দুধের সাথে মিশে আপনার সন্তানের শরীরে চলে যেতে পারে। এতে শিশুর শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
৪. প্রস্রাব-পায়খানা করতে অস্বস্তি কমানোর উপায়
কাটার কারণে প্রস্রাব পায়খানা করতে যেয়ে জ্বালাপোড়া অথবা ব্যথা হতে পারে। এটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আপনি যা যা করতে পারেন—
- স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম খাবার খাবেন। যেসব খাবার খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকি কমে সেগুলো নিয়মিত খাবেন। এর মধ্যে রয়েছে ফলমূল, শাকসবজি ও লাল চাল কিংবা লাল আটার মতো হোল গ্রেইন বা গোটা শস্যদানা
- বেশি বেশি পানি ও পানীয় পান করবেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ২ লিটার পানি পান করবেন। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকি কমবে[১৯]
- যদি পায়খানা কষা হয় এবং পায়খানা করতে বেশি কষ্ট হয়, সে ক্ষেত্রে ল্যাক্সেটিভ, অর্থাৎ পায়খানা নরম করার ঔষধ ব্যবহার করতে পারেন
- প্রস্রাব করার সময় যোনি ও এর চারপাশে কুসুম গরম পানি ঢালতে থাকুন। এতে করে জ্বালাপোড়া কম হতে পারে
- পায়খানা করার সময় একটি পরিষ্কার প্যাড দিয়ে হালকা করে পেরিনিয়াম চেপে ধরে রাখতে পারেন। এতে করে কাটা স্থানে কিছুটা কম চাপ পড়বে
৫. তলপেটের পেশির ব্যায়াম
জন্মদানের পর যত দ্রুত পারবেন তলপেটের ব্যায়াম করা শুরু করে দিবেন। এগুলো পেশিকে শক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করে যার ফলে কাটা স্থানে কম চাপ পরে।
তলপেটের পেশির ব্যায়ামের জন্য আপনার যোনি ও পায়ুর চারপাশের পেশিতে চাপ সৃষ্টি করবেন, যেন আপনি প্রস্রাব বা পায়খানা আটকানোর চেষ্টা করছেন। ১০ থেকে ১৫ বার এমন করুন। এই ব্যায়ামটিকে ‘কেগেল ব্যায়াম’ বলা হয়।
প্রতিদিন এভাবে তলপেটের ব্যায়াম করতে থাকলে আপনার প্রস্রাব-পায়খানা ধরে রাখার সমস্যা অথবা যৌন মিলনে সমস্যা কমে আসবে।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন: পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ
সাইড কাটার জটিলতা
সাধারণত এপিসিওটমি নিরাপদ একটি অপারেশন। তবে কখনও কখনও মায়েরা কিছু জটিলতার মুখোমুখি হন।
১. ইনফেকশন: যেহেতু এটি একটি কাটা অংশ, তাই এখানে সহজেই ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ইনফেকশন হলে যে লক্ষণগুলো দেখতে পাবেন—
- কাটার আশেপাশের ত্বক লাল লাল হয়ে যাবে এবং ফোলা ফোলা ভাব থাকবে
- সারাক্ষণই ব্যথা করবে
- কাটা জায়গায় দুর্গন্ধ হবে, যা সাধারণত হয় না
- কাটা জায়গা থেকে পুঁজ বের হবে
ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
২. কাটা দাগের জটিলতা: যেকোনো কাটা শুকানোর সাথে এই জটিলতা তৈরি হওয়ার একটি ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকে। কাটার তুলনায় শুকানোর পর এর দাগ অনেক বড় হতে পারে। আবার কাটা দাগ ত্বকের চেয়ে উঁচু হয়ে থাকতে পারে, অথবা দাগের ওপর চুলকানি হতে পারে।
৩. যৌন মিলনের সময় ব্যথা পাওয়া: এপিসিওটমির পর যৌন মিলনে ব্যথা হওয়াটা স্বাভাবিক। এমনকি অনেক মা প্রসবের কয়েক মাস পর পর্যন্ত যৌন মিলনে ব্যথা বা অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। তবে সময়ের সাথে সাথে এটি ঠিক হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে ধৈর্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন, যদি—[২০]
- সেলাইয়ের জায়গায় ব্যথা হয়
- সেলাইয়ে দুর্গন্ধ হয়
- কাটা জায়গা সময় মতো না শুকায়
- প্রস্রাব-পায়খানা ধরে রাখতে সমস্যা হয়
- অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা থেকে থাকে