সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্যই বেশ উপকারী। তবে কখনো কখনো বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে শিশুর সমস্যাও হতে পারে। তাই আপনার জেনে নেওয়া প্রয়োজন কোন পরিস্থিতিতে আপনার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত নয়।
মায়ের ইনফেকশন
কিছু কিছু ইনফেকশন আপনার কাছ থেকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে আপনার শিশুতেও ছড়াতে পারে। আপনি এসব ইনফেকশনে আক্রান্ত হলে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন। যেমন—
- এইচআইভি বা এইডস[১]। যদি আপনি HIV এর চিকিৎসা, অর্থাৎ এন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি শুরু না করেন এবং এর ফলে আপনার শরীরের ভাইরাল লোডও না কমে, সেক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে না[২]
- এক্টিভ অবস্থায় থাকা যক্ষ্মা। অর্থাৎ যে সময়টায় আপনার থেকে অন্য ব্যক্তি সংক্রমিত করে হতে পারে[৩]
- চিকেনপক্স। যদি আপনার ডেলিভারির ৫দিন আগে থেকে প্রসবের ২ দিন পরে—এই সময়ের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে থাকেন[৪]
- হার্পিস। যদি এটির সংক্রমণ আপনার স্তনকে আক্রমণ করে[৫]
- হিউমান টি সেল লিম্ফোট্রপিক ভাইরাস[৬][৭]
- ইবোলা ভাইরাস[৮]
এইচআইভি ইনফেকশন বুকের দুধের মাধ্যমে মা থেকে শিশুর শরীরে ছড়াতে পারে। তাই সাধারণত HIV পজিটিভ মায়েদের বুকের দুধ খাওয়াতে নিষেধ করা হয়।
তবে যদি মা ও শিশু এন্টিরেন্ট্রোভাইরাল থেরাপি নিয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে বুকের দুধের মাধ্যমে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে। এসব ক্ষেত্রে জন্মের পর প্রথম ছয় মাস অবশ্যই এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং বা শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।[৯][১০]
খেয়াল করুন: আপনার যক্ষ্মা বা টিবি হওয়ার পর যদি ইতিমধ্যেই আপনি কমপক্ষে ২ সপ্তাহ যক্ষ্মার ঔষধ নিয়ে থাকেন এবং আপনার থেকে এই রোগ ছড়াতে না পারে, অর্থাৎ পর পর তিন বার আপনার কফ পরীক্ষা করে আর যক্ষ্মার জীবাণু পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে আপনি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন কারণ যক্ষ্মার জীবাণু সাধারণত বুকের দুধের মাধ্যমে ছড়ায় না।[১১][১২][১৩]
তবে এক্ষেত্রে সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর আগে আপনি যক্ষ্মার এক্টিভ ইনফেকশন স্টেইজে আছেন কি না তা কফ পরীক্ষার মাধ্যমে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
কখন ইনফেকশন থাকার পরও খাওয়ানো যাবে
কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে ইনফেকশন থাকার পরও আপনি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন—
- হেপাটাইটিস বি ইনফেকশনের ক্ষেত্রে যদি আপনার HBsAg পজিটিভ হয়ে থাকে তবে জন্মের পর যত দ্রুত সম্ভব (১২ ঘন্টার মধ্যেই) আপনার শিশুকে হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া হলে তাকে পরবর্তীতে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে সাধারণত বাধা নেই।[১৪][১৫]
- হেপাটাইটিস সি ইনফেকশন এর ক্ষেত্রে সাধারণত বুকের দুধ খাওয়ানো যায়। তবে এক্ষেত্রে মায়ের স্তনের বোঁটায় ক্ষত থাকলে বা ফাটা থাকলে কিংবা ঐ স্থান থেকে রক্তপাত হলে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।[১৬]
- জেনিটাল হার্পিস বা যৌনাঙ্গের হার্পিস ইনফেকশনের ক্ষেত্রে সেটি যদি আপনার স্তনকে সংক্রমণ না করে এবং সংক্রমিত জায়গাটি ঢেকে রাখা হয়, সেক্ষেত্রে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে বাধা নেই।
- কোরিওএমনিওনাইটিস ইনফেকশন বা গর্ভফুলের আবরণের ইনফেকশন যদি আপনার ডেলিভারির আগে হয়, তবে প্রসবের পর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে বাধা নেই।
- এন্ডোমেট্রাইটিস বা জরায়ুর ইনফেকশন যদি আপনার ডেলিভারির পর হয়, সেক্ষেত্রে তা শিশুর শরীরে ছড়ানোর আর সম্ভাবনা নেই।
- সাধারণত সাইটোমেগালোভাইরাস ইনফেকশন এর ক্ষেত্রে বুকের দুধ খাওয়াতে নিষেধ নেই। তবে এক্ষেত্রে আপনার প্রিটার্ম শিশু হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এরপরই তাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন।
- সাধারণত আপনার জ্বর হলে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করার প্রয়োজন নেই, তবে এক্ষেত্রে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে, বুকের দুধের মাধ্যমে ছড়ায় এমন কোনো অসুখে জ্বর হয়েছে কি না।
অনেক মায়েরই প্রশ্ন থাকে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত অবস্থায় সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে কি না। সাধারণত কোভিড সংক্রমিত অবস্থায়ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো যায়, তবে এক্ষেত্রে কিছু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন—
- আপনি মুখে একটি ফেস মাস্ক পরে নিন বা মুখ ঢেকে নিন
- আপনার শিশুকে বা দুধের বোতল স্পর্শ করার আগে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে নিন
মায়ের ঔষধ সেবন
আপনি যদি নিচের ঔষধ বা দ্রব্যগুলো সেবন করেন, সেক্ষেত্রে আপনার বুকের দুধের মাধ্যমে তা আপনার শিশুর শরীরে চলে যেতে পারে। তাই আপনি নিচের ঔষধগুলো খেলে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন না—
- রক্ত জমাটবাধা প্রতিরোধের ঔষধ অ্যান্টি কোয়াগুলেন্টস: এটি সতর্কতার সাথে অল্প ডোজে দেওয়া যেতে পারে। তবে অধিক মাত্রায় গ্রহণ করলে আপনার শিশুর রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে।[১৭] যেমন: ওয়ারফারিন
- ক্যান্সারের ঔষধ বা সাইটোটক্সিক ড্রাগ: এ ধরনের ঔষধ আপনার শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে এমনকি ক্যান্সারও সৃষ্টি করতে পারে।[১৮] যেমন: মেথোট্রিক্সেট, সাইক্লোস্পোরিন, সাইক্লোফসফামাইড
- বিষণ্ণতা ও মানসিক সমস্যার ঔষধ অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ: এ ধরনের ঔষধ আপনার শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে। পাশাপাশি আপনার শিশুর ঘুম ও খাবার গ্রহণের সমস্যা হতে পারে।[১৯]
মায়ের ক্ষতিকর দ্রব্য সেবন
অনেকসময় মায়েরা আগে থেকেই ক্ষতিকর দ্রব্য গ্রহণ করে থাকেন। এ ধরনের দ্রব্য বুকের দুধের মাধ্যমে সন্তানের শরীরে প্রবেশ করে এবং ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যেমন—
- অ্যালকোহল: মায়ের অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ শিশুর ঘুম ঘুম ভাব, গভীর ঘুম, দুর্বলতা, দৈহিক বৃদ্ধি কমিয়ে ফেলা, অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি করতে পারে[২০]
- কোকেইন: মায়ের কোকেইন গ্রহণের ফলে শিশুর বমি, ডায়রিয়া, কাঁপুনি, খিঁচুনি হতে পারে[২১]
- হিরোইন: মা হিরোইন সেবন করলে সন্তানের কাঁপুনি, অস্থিরতা, খিঁচুনি, খাবারের অনীহা দেখা যায়[২২]
- মারিজুয়ানা: সন্তানের উপর মায়ের মারিজুয়ানা গ্রহণের প্রভাব এখনো জানা যায়নি। তবে এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবের কথা চিন্তা করে মায়েদের মারিজুয়ানা সেবন কিংবা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়
- ফেনসাইক্লিডিন: মায়ের ফেনসাইক্লিডিন গ্রহণে সন্তানের হ্যালুসিনেশন হতে পারে[২৩]
গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ী মায়েদের ক্ষেত্রে বুকের দুধে নিকোটিনের পরিমাণ তাদের রক্তের নিকোটিনের পরিমাণের চেয়েও তিন গুণ বেশি থাকে।[২৪] ধূমপান করলে বুকের দুধ উৎপাদন যেমন কমে যায়, সেই সাথে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়কালও কমে আসে।[২৫] এ ছাড়া ধূমপানের ফলে বুকের দুধের পুষ্টিগুণ-ও ব্যাহত হয়, স্বাভাবিক অবস্থায় দুধের যেই প্রতিরক্ষামূলক বৈশিষ্ট্য থাকে ধূমপান করলে তা কমে যায়।[২৬]
তাই আপনার ও আপনার শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে উপকারী হলো ধূমপান সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা। আপনি ধূমপান করলে সেটি আপনার শিশুর সেকেন্ডারি স্মোকিং হিসেবে গণ্য হবে, যা শিশুর শরীরে হাঁপানি ও অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের অসুখসহ নানান জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।[২৭]
এমনকি ধূমপানের ফলে শিশুর SIDS বা সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিক মৃত্যু হওয়ার ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে।[২৮]
মায়ের টিকা বা ভ্যাক্সিন
মা ও মায়ের পাশাপাশি সন্তানের জন্য টিকা বা ভ্যাক্সিন দেওয়া প্রয়োজনীয়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্মল পক্স এবং ইয়েলো ফিভার—এই দুইটি রোগের টিকা ছাড়া অন্য যেকোনো ভ্যাক্সিন (যেমন: হেপাটাইটিস, টিটেনাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, র্যাবিস, টাইফয়েড কিংবা অন্যান্য) নেওয়ার পরও মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।[২৯]
স্মল পক্সের টিকা দেওয়ার পর সন্তানের ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার ইয়েলো ফিভারের ভ্যাক্সিন গ্রহণের পর সন্তানের বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেকে মনে করেন যেসব লাইভ ভ্যাক্সিন আছে সেসব টিকা নিলে সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। তবে পরীক্ষার মাধ্যমে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৩০]
সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের টিকা নেওয়া যাবে।[৩১][৩২] এতে মা বা শিশুর ক্ষতি হওয়ার কোনো ধরনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৩৩][৩৪]
সন্তানের সমস্যা
আপনার শিশুর যদি গ্যালাক্টোসেমিয়া নামের অসুখ থেকে থাকে তাহলে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো একেবারেই উচিত নয়।[৩৫][৩৬] এটি এক ধরনের জেনেটিক অসুখ। এর ফলে সন্তান বুকের দুধের মধ্যে থাকা গ্যালাকটোজ হজমে সমস্যা হয়ে থাকে।
স্ক্রিনিং করানোর মাধ্যমে শিশুর গ্যালাক্টোসেমিয়া নির্ণয় করা যায়। এতে করে খুব দ্রুত এ সমস্যার চিকিৎসাও শুরু করা যায়।
যদি এ সমস্যা নির্ণয় না হয় এবং সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় সেক্ষেত্রে সন্তানের লিভারের সমস্যা, বুদ্ধিমত্তার সমস্যা ও বৃদ্ধিজনিত ত্রুটি হতে পারে, এমনকি আপনার সন্তান শকেও চলে যেতে পারে।[৩৭]
অনেক শিশুর জন্মের সময় জন্ডিস, হাইপারবিলিরুবিনেমিয়ার সমস্যা হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে আপনি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
পরিমিত পরিমাণে (প্রতিদিন ২০০ মিলিগ্রাম) সেবন করলে ক্যাফেইন আপনার শিশুর তেমন ক্ষতি করে না। তবে নবজাতক ও প্রিটার্ম শিশুরা ক্যাফেইনের প্রতি বেশ সংবেদনশীল হয়। তাই ডেলিভারির পর প্রথম কয়েকদিন এবং আপনার প্রিটার্ম শিশু হলে ক্যাফেইন গ্রহণের হার কমিয়ে আনুন।[৩৮]
আপনি যদি নির্দিষ্ট কোনো উপলক্ষে হঠাৎ করেই অ্যালকোহল সেবন করে থাকেন, সেক্ষেত্রে দুধ খাওয়ানোর আগে অন্তত দুই ঘন্টা অপেক্ষা করুন।[৩৯] এ সময়ের মধ্যে অ্যালকোহল আপনার রক্ত ও দুধ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে তাই আলাদা করে দুধ এক্সপ্রেস করে ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
তবে আপনি নিয়মিতভাবে দিনে দুইবারের বেশি অ্যালকোহল সেবন করলে আপনার শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এতে করে আপনার শিশুর মাথা ঘুরানো, দুর্বল লাগা ও অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির মতো সমস্যা হতে পারে।[৪০] তাই আপনি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ালে অবশ্যই অ্যালকোহল সেবন এড়িয়ে চলুন।