বেশ কিছু কারণেই সন্তান জন্মদানের পর স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরতে নতুন মা-বাবা কিছুটা সময় নেন। বেশিরভাগ সময়ই সন্তান জন্মদানের পর পরই নবজাতককে নিয়ে ব্যস্ততার কারণেই হয়তো আপনার মনে সহবাস নিয়ে তেমন চিন্তা আসে না।
তবে এসময় আপনার সঙ্গীর সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার বিষয়েও কিছুটা পরিকল্পনা করা উচিত। নয়তো পরবর্তীতে কষ্টদায়ক ও আনন্দহীন সহবাস আপনার ও আপনার সঙ্গীর মাঝে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
কতদিন পর থেকে শুরু করবেন
সন্তান জন্মদানের পর ঠিক কখন থেকে সহবাস করতে হবে এর কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। তবে সাধারণত ডেলিভারির পর ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সহবাস থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।[১] অধিকাংশ দম্পতি ডেলিভারির আট সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় সহবাস শুরু করেন।[২] তবে আপনি চাইলে চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর পরই সহবাস শুরু করতে পারেন।
সন্তান জন্মদানের পর কখন আপনি মনে করবেন আপনি সহবাসের জন্য তৈরি এটি অনেকটাই আপনার উপর নির্ভর করছে। সদ্য নবজাতকের যত্ন নিয়ে আপনার ক্লান্তিবোধ হতে পারে। ক্লান্তির ফলে অনেকসময় সহবাসের ইচ্ছে আসে না আর। এক্ষেত্রে আপনার শরীর গর্ভধারণ ও ডেলিভারিজনিত পরিবর্তন থেকে সেরে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
সহবাসের ওপর সন্তান জন্মদানের প্রভাব
প্রথমবার সন্তান জন্মদানের তিনমাস পর্যন্ত সহবাস করতে গেলে আপনার বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।[৩] তবে সময়ের সাথে সাথে সব ঠিকও হয়ে যায়। প্রায় ছয় মাসের মধ্যেই সব সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। ডেলিভারির পর পর সহবাস করতে গেলে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন—
১. যোনিপথ বা যৌনাঙ্গ শুষ্ক হয়ে যাওয়া
ডেলিভারির পর হরমোনের তারতম্যের কারণে আপনার যৌনাঙ্গ বা যোনিপথ বেশ শুষ্ক অনুভূত হতে পারে। যোনিপথ বা যৌনাঙ্গ শুষ্ক হয়ে যাওয়ায় সহবাসের সময় আপনার ব্যথা হতে পারে। বিশেষ করে যেসব মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান তাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাটি বেশি হতে পারে।[৪][৫] কারণ তাদের ক্ষেত্রে মেয়েদের সেক্স হরমোন ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ অনেক কমে যায়। এ ইস্ট্রোজেন হরমোনই যোনিপথের প্রাকৃতিক লুব্রিকেন্ট নির্গত করতে কাজ করে।[৬]
২. যোনিপথের ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া
সিজারিয়ান সেকশনের ফলে এবং হরমোনাল কারণে আপনার যোনিপথের ত্বক পাতলা হয়ে যেতে পারে। এর ফলে সহবাসের সময় আপনার যোনিপথ ছিঁড়ে যাওয়ার প্রবণতা হতে পারে।
৩. যোনিপথের পেশীর স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়া
আপনার যদি নরমাল, অর্থাৎ ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি হয়, সেক্ষেত্রে আপনার ডেলিভারির সময় যোনিপথের পেশিগুলো অনেক প্রসারিত হয়ে যায়। এসব পেশির স্থিতিস্থাপকতা কমে আসে। এতে করেও আপনার সহবাসের সময় অস্বস্তি হতে পারে।
৪. দুর্বল লাগা ও যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া
সন্তান জন্মদানের পর নবজাতকের যত্ন করতে গিয়ে অনেক মা সঠিকভাবে ঘুমানো এবং বিশ্রামের সুযোগ পান না। এতে করে ক্লান্তি থেকে আপনার দুর্বল লাগতে পারে এবং এটি আপনার যৌন ইচ্ছাকেও প্রভাবিত করতে পারে।
৫. এপিসিওটমি ও সিজারের ফলে কাটাছেঁড়া থেকে ব্যথা হওয়া
আপনার এপিসিওটমি অথবা সিজারিয়ান সেকশন করা হলে ক্ষতস্থানের ব্যথার কারণে সহবাসের প্রতি ভীতি তৈরি হতে পারে। আবার নরমাল ডেলিভারি হলে আপনার যৌনাঙ্গ ও যোনিপথে ক্ষত থাকতে পারে। এটিও আপনার সহবাসকে প্রভাবিত করতে পারে।[৭]
৬. পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন
সন্তান জন্মদানের পর আপনার শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। ডেলিভারির পর পরই গর্ভাবস্থার আগের সময়ের মতো শারীরিক গঠন পুরোপুরি ফিরে আসেনা। এমনকি ফিরে আসলেও সেটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অনেক মা মনে করে থাকেন তার সঙ্গীর হয়তো তাকে আর আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না। এর ফলে অনেকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগেন। এটিও আপনার সহবাসকে প্রভাবিত করতে পারে।
আপনার পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের কারণে নিচের লক্ষণগুলো দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন—
- ভয়াবহ মুড সুইং
- খাবারে অরুচি
- অনেক বেশি ক্লান্তি
- নিজের বা সন্তানের ক্ষতি করার চিন্তা ও প্রবণতা
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
ডেলিভারির পর সহবাস করার সময় আপনার যে বিষয়টি নিয়ে না ভাবলেই নয়, সেটি হলো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।
সন্তান জন্মদানের পর পরই আপনি পুনরায় গর্ভধারণ করে ফেলতে পারেন। এক্ষেত্রে দুই সন্তানের মাঝের বিরতি ১৮ মাসের কম বা ৫৯ মাসের বেশি হলে আপনার গর্ভধারণজনিত বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।[৮] তাই বিশেষজ্ঞ মতে, একবার প্রসবের পর পুনরায় গর্ভধারণের আগে কমপক্ষে ১৮ মাস অপেক্ষা করা উচিত।[৯]
কাজেই দুই সন্তানের মাঝে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় নিন এবং সন্তান জন্মদানের পর প্রতিবার সহবাসের সময় যেকোনো একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করুন।
পড়ুন: ডেলিভারির পর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
পরামর্শ
পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহজ কিছু উপায় অবলম্বন করে ডেলিভারির পর পর নতুন করে সহবাস আপনার ও আপনার সঙ্গীর জন্য আনন্দদায়ক করতে পারেন। এজন্য নিচের পরামর্শগুলো অবলম্বন করুন—
১. ধীরে ধীরে এগোন: সন্তান জন্মদানের সাথে সাথেই আপনার শরীর আবার আগের মতো হয়ে উঠে না। কাজেই সময় নিন। সহবাসের আগে অন্তরঙ্গভাবে সময় কাটান। একে অপরকে স্পর্শ করুন।
২. ফোরপ্লে বাড়ান: কৃত্রিম কিছু ব্যবহারের আগে আপনার নিজের শরীরকে প্রাকৃতিক লুব্রিকেন্ট তৈরি করতে দিন। ফোর প্লে করুন।
৩. লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করুন: ডেলিভারির পর কিছুদিনের মধ্যেই আপনার শরীরের হরমোন আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তারপরও লুব্রিকেন্ট কিছুটা সাহায্য করতে পারে। এক্ষেত্রে তেল ভিত্তিক লুব্রিকেন্ট এড়িয়ে চলুন। এটি কনডমের ক্ষতি করতে পারে।[১০] এর পাশাপাশি এটি যৌনাঙ্গর সংবেদনশীল জায়গায় অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। এসময় পানিজাতীয় বা ওয়াটার বেইসড লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করতে পারেন।[১১]
৪. নিজেদের জন্য সময় বের করুন: সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে হয়তো আপনারা নিজেদের জন্য সময় করতে পারেন না। এক্ষেত্রে নিজেদের জন্য একান্ত সময় বের করুন। যেমন, বাচ্চা যখন ঘুমিয়ে পড়ে বা ঘুমানো শুরু করে সেসময় নিজেদের সময় দিন। এসময় তাড়াহুড়ো থেকে বিরত থাকুন।
৫. আপনার সঙ্গীর সাথে কথা বলুন: সহবাস নিয়ে আপনার কোনো সমস্যা হলে প্রথমেই সঙ্গীর সাথে খোলামেলা কথা বলুন। আপনি কেমন বোধ করছেন, কেমন বোধ করছেন না—সবটাই বলুন। পাশাপাশি আপনি যেন কোনো ধরনের ব্যথা না পান সেদিকেও লক্ষ রাখুন।
৬. পেলভিক ফ্লোরের ব্যায়াম করুন: পেলভিক ফ্লোরের ব্যায়াম আপনার যোনিপথের মাংসপেশির টোন বা স্থিতিস্থাপকতা আবার আগের মতো করতে সহায়তা করে। পাশাপাশি আপনার সেরে উঠতেও সাহায্য করে। তাই আপনার চিকিৎসক আপনাকে পেলভিক ফ্লোরের ব্যায়ামের পরামর্শ দিলে, ব্যায়াম করুন।
৭. প্রয়োজনে ব্যথার ঔষধ ব্যবহার করুন: সহবাসের সময় অস্বস্তি বা ব্যথা এড়াতে শুরুতেই প্রস্রাব করে নিন। সহবাসের আগে গরম পানিতে গোসলও করে নিতে পারেন। এ ছাড়াও যোনিপথে ব্যথা হলে নাপা বা প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করতে পারেন। সহবাসের পর অনেকের যোনিপথে জ্বালাপোড়া হতে পারে। আপনার যোনিপথ বা যৌনাঙ্গে জ্বালা হলে বরফ বা ঠান্ডা কিছুর সেঁক নিতে পারেন।
৮. নিজের যত্ন নিন: সন্তানের যত্ন নেওয়া বেশ ক্লান্তিকর একটা কাজ। কাজেই এসময় সন্তানের পাশাপাশি নিজেরও যত্ন নিন। এসময় আপনিও পুষ্টিকর খাবার খান এবং নিজে পর্যাপ্ত ঘুমান ও বিশ্রাম নিন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের ফলে আপনার শরীরের বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। আপনার শরীরের আবার আগের অবস্থায় আসতে কিছুটা সময় লাগে। আপনার যদি ভ্যাজাইনাল বা নরমাল ডেলিভারি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আপনার শরীর সেরে ওঠার জন্য চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। এসময় পুনরায় সহবাস করার আগে শরীরকে সেরে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।
সন্তান ধারণের নয় মাস ও পরবর্তীতে প্রসবের পর সন্তানের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকে হয়তো আপনার যৌন ইচ্ছা নাও আসতে পারে। আপনি একা নন। অনেক মায়েরই এমন সমস্যা হয়ে থাকে। অধিকাংশ মায়েরই সন্তান জন্মদানের পর যৌন ইচ্ছা আসতে প্রায় ছয় মাস থেকে নয় মাস সময় লাগতে পারে।[১২]
সন্তান জন্মদানের কিছুদিনের মধ্যেই আপনি আবার গর্ভধারণ করতে পারেন। আপনি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ালেও এমন হতে পারে। আবার আপনার পিরিয়ড ফিরে আসার আগেও এমন হতে পারে। তাই যখন থেকেই আপনি সহবাস শুরু করবেন তখন থেকেই যেকোনো একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করুন।
নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে আপনি চাইলে চার থেকে ছয় সপ্তাহ পরই সহবাস শুরু করতে পারেন। আপনার যদি সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান ডেলিভারি হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে অন্তত ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করুন অথবা আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সন্তান জন্মদানের পর সহবাসের ক্ষেত্রে নিচের সতর্কতা অবলম্বন করুন—
– কখনোই তাড়াহুড়ো করবেন না
– সহবাসের সময় যদি আপনার কোনো ধরনের ব্যথা বা অস্বস্তি হয়, সাথে সাথে আপনার সঙ্গীকে জানান এবং থামিয়ে দিন
– সিজারিয়ান সেকশন বা সি-সেকশনের ক্ষেত্রে সহবাসের সময় এমন পজিশন অবলম্বন করুন যেখানে আপনার পেটের উপর কোনো চাপ পড়ে না
নরমাল ডেলিভারির সময় কখনো কখনো আপনার যোনিপথকে আরেকটু প্রশস্ত করতে সার্জারি করে সাইড কাটতে হয়। এটিকে মেডিকেলের ভাষায় এপিসিওটমি বলা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডেলিভারির সময় এপিসিওটোমি দেওয়া হলে,পেরিনিয়ামে ক্ষত হলে কিংবা ফোরসেপ-ভেনটুস ব্যবহারের প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে সহবাসের সময় বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।[১৩][১৪][১৫]
তাই এসব ক্ষেত্রে পরবর্তীতে নারীরা সহবাসের ক্ষেত্রে বেশিদিন অপেক্ষা করে থাকেন।[১৬] এক্ষেত্রে কাটা সম্পূর্ণ সেরে উঠলে এবং রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেলে সহবাস শুরু করতে কোনো বাধা নেই। তবে কাটা পুরোপুরি সেরে ওঠার আগেই সহবাস করলে ক্ষতস্থানে রক্তপাত বা ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
আপনার এপিসিওটমির জায়গায় ইনফেকশন এড়িয়ে চলতে ঐ ক্ষত জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন এবং বেশ কিছু দিন সহবাস এড়িয়ে চলুন। তবে ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মাঝেই এপিসিওটমি সেরে উঠলে আপনি সহবাস শুরু করতে পারেন।
বিভিন্ন অসুখের কারণে (যেমন: হরমোনের সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যা, ডায়াবেটিস, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল ও লিভারের অসুখের কারণে) আপনার যৌন ইচ্ছা কমে যেতে পারে। আপনার এ সমস্যাগুলোর কারণে সহবাসে সমস্যা হলে, চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব রোগের ঔষধ দিতে পারেন। তবে আপনি যদি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান, যেকোনো ধরনের ঔষধ সেবনের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।