সন্তান জন্মদানের পর একজন মায়ের ব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এসময়ে নবজাতকের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি নিজের খেয়াল রাখাটাও জরুরি। প্রসবের পর আপনার নানান ধরনের সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যাগুলো এড়িয়ে চলতে অথবা এসব থেকে রেহাই পেতে আপনার করণীয় কী—তা জেনে রাখা প্রয়োজন। কেননা একজন সুস্থ ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল মা-ই পারেন তার সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে।
হাসপাতালে থাকাকালীন যত্ন
হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি হলে প্রসব-পরবর্তী কয়েক ঘন্টা আপনাকে পোস্ট-অপারেটিভ রুমে রাখা হবে। এরপরে আপনাকে সাধারণ ওয়ার্ডে অথবা কেবিনে পাঠানো হবে। আর কোনো ধরনের এনেস্থিসিয়া ছাড়া যোনিপথে ডেলিভারি হলে এবং আপনার সার্বিক অবস্থা ভালো থাকলে লেবার রুম থেকে সরাসরি আপনাকে সাধারণ ওয়ার্ডে অথবা কেবিনে পাঠানো হবে। শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলে আপনি প্রসবের পর পরই বাচ্চাকে কোলে নিতে পারবেন এবং বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
আপনি ও আপনার শিশু সুস্থ থাকলে নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে সাধারণত কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা এবং সিজারিয়ান সেকশনের পর প্রায় চার দিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে।[১] তবে মা ও শিশুর শারীরিক অবস্থার ভিত্তিতে এই সময়টুকু কম-বেশি হয়। তাই আপনার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে কর্তব্যরত চিকিৎসক আপনাকে নির্দিষ্ট সময় পর হাসপাতাল থেকে ছুটি দিবেন।
হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে আপনার সার্বিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন সেগুলো হলো—
নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকা
সন্তান জন্মের ঠিক পরের সময়টায় সাধারণত ডাক্তার, নার্স, মিডওয়াইফ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্বাস্থকর্মীরা আপনাকে পর্যবেক্ষণে রাখবেন। এসময়ে আপনার রক্তচাপ, পালস, তাপমাত্রা ও প্রস্রাবের পরিমাণ নির্দিষ্ট বিরতিতে মেপে দেখা হবে। পাশাপাশি আপনার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে কি না অথবা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিচ্ছে কি না সেসবও খেয়াল রাখা হবে।
মূলত প্রসব-পরবর্তী কোনো জটিলতা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য আপনাকে কয়েক ঘন্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। বিশেষ করে যদি কোনো ধরনের এনেস্থিসিয়ার (যেমন: স্পাইনাল ব্লক ও এপিডুরাল ব্লক) মাধ্যমে আপনার অপারেশন অথবা যোনিপথে ডেলিভারি হয়ে থাকে, তাহলে কিছুটা বেশি সময় পর্যন্ত আপনাকে পোস্ট-অপারেটিভ রুমে পর্যবেক্ষণে রাখা হতে পারে।
সার্বিক স্বাস্থ্য বিবেচনা করে আপনাকে বিপদমুক্ত বলে মনে হলে, দায়িত্বরত চিকিৎসক আপনাকে হাসপাতালের স্বাভাবিক ওয়ার্ডে অথবা কেবিনে পাঠিয়ে দিবেন।
ব্যথা নিরাময় করা
প্রসবের পর কয়েক দিন আপনার শরীরের নানান স্থানে ব্যথা অনুভব হতে পারে। যেমন: স্তনে, তলপেটে, মলদ্বার ও যোনিপথের মধ্যবর্তী স্থানে এবং সিজারের কাটা স্থানে। কিছু ক্ষেত্রে ঔষধ ছাড়াই ব্যথা কমে যেতে পারে। তবে ব্যথা না কমলে কিংবা অপারেশন হয়ে থাকলে আপনার ও আপনার বুকের দুধ পানকারী নবজাতকের জন্য নিরাপদ ব্যথার ঔষধ বেছে নেওয়া হয়। যেমন—
- প্যারাসিটামল
- নন স্টেরয়ডাল প্রদাহনাশক। যেমন: আইবুপ্রোফেন
- ওপিওয়েড জাতীয় ব্যথানাশক। যেমন: মরফিন, কোডেইন ও ট্রামাডল
এক্ষেত্রে প্রথম সারির ব্যথার ঔষধ হিসেবে প্যারাসিটামল ব্যবহার করা হয়। তবে নন-স্টেরয়ডাল প্রদাহনাশক ও প্যারাসিটামলের সম্মিলিত ব্যবহার প্রসব-পরবর্তী ব্যথার সমস্যায় ভালো কাজ করে।[২]
অপরদিকে ওপিওয়েড গ্রুপের ঔষধ ডাক্তারের পর্যবেক্ষণ ব্যতীত বেশি দিন সেবন করা ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মা এসব ঔষধ সেবন করলে বুকের দুধ পানকারী শিশুর ঝিমুনিভাব, শ্বাসকষ্ট, কোষ্ঠকাঠিন্য ও বুকের দুধ পানে সমস্যা হতে পারে।[৩]
তাই প্রসব-পরবর্তী সময়ে ওপিওয়েড গ্রুপের ঔষধ এড়িয়ে চলা ভালো। তবে ঠিক কোন ব্যথার ঔষধ সেবন করলে আপনি ভালো ফলাফল পেতে পারেন সেটি জানার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
সিজার অথবা এপিডুরাল ব্লকের মাধ্যমে ডেলিভারি হলে প্রথম কয়েকদিন হাসপাতালে ইনজেকশন অথবা ক্যানুলার মাধ্যমে ব্যথার ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে। পরবর্তীতে আপনার শরীর থেকে এনেস্থিসিয়ার প্রভাব কেটে গেলে ইনজেকশনের পরিবর্তে মুখে সেবনের ঔষধ দেওয়া হয়। এসময়ে হট ওয়াটার ব্যাগ অথবা হিটিং প্যাড কিংবা গরম কাপড়ের সেঁক দিলেও আপনি কিছুটা আরাম পেতে পারেন।
মলদ্বার ও যোনিপথের মধ্যবর্তী স্থানের ব্যথা হলে আইসপ্যাক অথবা কাপড়ে মোড়ানো বরফ দিয়েও কিছুটা উপকার পেতে পারেন। হাসপাতাল থেকে চলে আসার সময়েও প্রয়োজন হলে আপনাকে ছাড়পত্রে ব্যথানাশক ওষুধ কতদিন ও কীভাবে গ্রহণ করতে হবে তা লিখে দেওয়া হবে।
কাটা স্থানের যত্ন নেওয়া
আপনার যদি সিজার অথবা এপিসিওটমির মাধ্যমে প্রসব হয়ে থাকে কিংবা ডেলিভারির সময়ে যোনিমুখের আশেপাশে ছিঁড়ে যায় তাহলে কাটা অথবা ছেঁড়া জায়গায় সেলাই করা হবে। এই সেলাইয়ের ওপর একটি ব্যান্ডেজ দেওয়া থাকবে।
ব্যান্ডেজটি কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত রাখা হয়। এরপর প্রয়োজনমতো নিয়মিত বিরতিতে সেলাইয়ের জায়গাটি জীবাণুনাশক দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার (ড্রেসিং) করে দেওয়া হবে। এসময়ে চিকিৎসক আপনার সেলাইয়ের স্থানে কোনো ইনফেকশন হচ্ছে কি না তা চেক করে দেখতে পারেন।
পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা
আপনার ও আপনার সন্তানের কোনো জটিলতা না থাকলে প্রসবের দিন থেকেই আপনি বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। আপনি নিজেও আপনার চাহিদামতো পুষ্টিকর খাবার খেতে এবং পানি পান করতে পারবেন।
তবে এনেস্থিসিয়া দিয়ে সিজার অপারেশন কিংবা যোনিপথে ডেলিভারি হলে আপনি কখন থেকে স্বাভাবিক খাবার খেতে পারবেন তা চিকিৎসক নির্ধারণ করে দিবেন। এর আগ পর্যন্ত আপনাকে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ তরল ও অন্যান্য ঔষধ দেওয়া হবে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া
ডেলিভারির পরে যত দ্রুত সম্ভব আপনি প্রস্রাব করার চেষ্টা করবেন। সিজার হলে আপনার প্রস্রাবের রাস্তায় অন্তত ১২ ঘন্টা একটি ক্যাথেটার বা প্রস্রাবের নল পরানো থাকবে। এরপর থেকে আপনি নিজেই স্বাভাবিকভাবে প্রস্রাব করতে পারবেন।
ডেলিভারির পর পরই আপনার প্রস্রাব করতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তাই ডেলিভারির পর ২৪ ঘন্টা আপনার ঠিকমতো প্রস্রাব হচ্ছে কি না সেটি কর্তব্যরত ডাক্তার অথবা নার্স পর্যবেক্ষণে রাখে।
হাঁটাহাঁটি শুরু করা
আপনার কেবিন বা বিছানায় যাওয়ার পর সুস্থ বোধ করলে যত দ্রুত সম্ভব অল্প অল্প করে হাঁটাচলা করতে শুরু করুন। হাঁটাহাঁটি করলে প্রসব পরবর্তী সময়ে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস নামক রোগের ঝুঁকি কমে যায়। তবে হাঁটতে শুরু করার আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসক অথবা নার্সের সাথে পরামর্শ করে নিন।
প্রথম বারে হাঁটার সময়ে অন্য কাউকে ধরে অথবা কারও সাহায্য নিয়ে হাঁটুন। কেননা তখনো আপনার শরীর বেশ দুর্বল থাকতে পারে। প্রথম দিকে গোসলে যাওয়ার সময়েও কারও সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করুন।
হাসপাতালে নির্ধারিত সময় কাটানোর পর চেকআপ অনুযায়ী সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে চিকিৎসক আপনাকে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও উপদেশসহ একটি প্রেসক্রিপশন দিবেন—যা সাধারণত ছাড়পত্র নামে পরিচিত। এরপর আপনি আপনার সন্তানসহ বাড়ি ফিরতে পারবেন।
বাড়ি ফেরার আগে খেয়াল রাখুন
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার আগে কিছু বিষয় সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো। এতে করে বাড়িতে যেয়ে আপনার ও শিশুর যত্ন নিতে আপনার কিছুটা সুবিধা হবে। তাই বাড়ি ফেরার আগে যেসব বিষয় সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন সেগুলো হলো—
- আপনার ও আপনার সন্তানের কীভাবে যত্ন নিতে হবে তা জেনে নিন
- শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর নিয়ম জেনে নিন এবং এক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
- কোন লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং কোনগুলোর ক্ষেত্রে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হবে তা আপনার চিকিৎসকের কাছে জেনে নিন
- পরবর্তীতে চেকআপের জন্য কবে হাসপাতালে আসতে হবে তা জেনে নিন। যেমন: সেলাই কাটার তারিখ, শিশুকে টিকা দেওয়ার তারিখগুলো এবং প্রসব-পরবর্তী চেকআপের তারিখগুলো জেনে নিন
- নবজাতক শিশুকে সাধারণত জন্মের পর পরই হাসপাতাল থেকে ভিটামিন-কে এবং বিসিজি টিকা দেওয়া হয়, এটি আপনার শিশু পেয়েছে কি না তা খেয়াল করুন[৪][৫]
- প্রসবের পর ব্যথা কমানোর জন্য ছাড়পত্রের বাইরে কোনো ওষুধ নিতে পারবেন কি না সেটি চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করে নিন
- ছাড়পত্রে পরবর্তী ওষুধ ও পরামর্শ লেখা আছে কি না তা দেখে ও বুঝে নিন। এই সংক্রান্ত অথবা এর বাইরেও যদি কোনো প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে তা চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করে নিন
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
সিজার কিংবা নরমাল ডেলিভারি উভয় ক্ষেত্রে প্রসব-পরবর্তী সময়ে আপনি কিছু জটিলতায় ভুগতে পারেন। তাই আগে থেকে জেনে রাখা প্রয়োজন যে, কোন ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে তা পরবর্তীতে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। এতে করে দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে বেশ কিছু সমস্যার তীব্রতা কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
যেসব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে সেগুলো হলো—
- জ্বর আসা ও তলপেটে প্রচুর ব্যথা হওয়া
- প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, অর্থাৎ লিক হওয়া এবং প্রস্রাবের সময়ে ব্যথা হওয়া
- যোনিপথে হঠাৎ করে অথবা প্রচুর পরিমাণে রক্ত যাওয়া। সাথে পালস বা নাড়ির গতি দ্রুত বেড়ে যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাশে সাদা হওয়া
- ক্ষতস্থান অতিরিক্ত লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া অথবা ব্যথা অনুভব করা এবং ক্ষতস্থান থেকে পুঁজ ও দুর্গন্ধ বের হওয়া
- কাশি, বুকে ব্যথা অথবা শ্বাসকষ্ট হওয়া
- পায়ের রানের পেছনের মাংসপেশি ফুলে লাল হয়ে যাওয়া এবং প্রচণ্ড ব্যথা
- বমি হওয়া, মাথা ব্যথা করা এবং চোখে ঝাপসা দেখা
- ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা করা
দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে আপনার করণীয়
দীর্ঘদিন ধরে আরেকটি প্রাণকে নিজের শরীরে ধারণ করা এবং এর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু জোগান দেওয়া সহজ নয়। এই লম্বা সফরে আপনার শরীরেও ছোটো-বড়ো অসংখ্য পরিবর্তন আসবে। এই পরিবর্তন আসতে যেমন সময় লাগে, তেমনি পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতেও যথেষ্ট সময় লাগবে।
তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কিংবা বিষণ্ণতায় ভুগবেন না। সুষম খাবার এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আপনি আগের স্বাস্থ্য ফিরে পেতে পারেন। তবে কখনোই তাড়াহুড়ো করে ফিট হওয়ার জন্য চেষ্টা করা যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নিজের ও সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এসময়ে আপনি যা যা করতে পারেন—
১. পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খান
আপনার ও আপনার শিশুর পরিপূর্ণ পুষ্টি বজায় রাখার জন্য আপনার সুষম খাবার খাওয়া জরুরি। কেননা শিশুর প্রথম ছয় মাসের পুষ্টি আপনার বুকের দুধের ওপর নির্ভরশীল। তাই আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণে আমিষ, শর্করা, ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ লবণযুক্ত খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। খাবার তালিকায় সবসময় বেশি করে টাটকা ফল ও শাকসবজি রাখুন।
তবে এসময়ে আপনি বাড়তি ওজন নিয়ে হতাশায় ভুগতে পারেন। প্রসবের কিছুদিন পর সাধারণত ওজন নিজে থেকেই অনেকটা কমে যায়। বিশেষ করে আপনি যদি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান তাহলে ধীরে ধীরে আপনার ওজন কমে যেতে পারে। লম্বা সময় ধরে ধীরে ধীরে ওজন কমানো নিরাপদ। কেননা এতে আপনার বুকের দুধ উৎপাদন কমার ভয় থাকে না।
স্বাভাবিক নিয়মে যদি আপনার ওজন না কমে তাহলে কিছু খাবার খাওয়া বাদ দিতে পারেন। যেমন: কোমল পানীয়, মিষ্টি খাবার, ভাজাপোড়া এবং অতিরিক্ত তেল সমৃদ্ধ খাবার। এসব খাবারের তেমন কোনো পুষ্টিগুণ নেই।
তবে যেকোনো রকম অস্বাস্থ্যকর ডায়েট এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে একজন পুষ্টিবিদের কাছ থেকে আপনার জন্য উপযুক্ত একটি খাদ্যতালিকা তৈরি করে নিতে পারেন।
২. নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম করুন
প্রসবের পর যত তাড়াতাড়ি আপনি হাঁটাহাঁটি শুরু করতে পারবেন ততই আপনার জন্য ভালো। এতে আপনার শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে। তাই বিছানায় যাওয়ার পর সুস্থবোধ করলে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিন। তবে নিজেকে অতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে জোর করে হাঁটা যাবে না। বেশি সমস্যা হলে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
বাড়িতে গিয়ে আপনি নিয়মিত ব্যায়াম শুরু করতে পারেন। সাধারণত প্রসবের পর প্রথম ৬ থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত হালকা ধাঁচের ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে আপনি আগে থেকেই ভারী ব্যায়ামে অভ্যস্ত থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সেটিও ধীরে ধীরে শুরু করতে পারেন।
তলপেটের কিছু ব্যায়াম করে আপনি পেটের মেদ কমাতে পারেন। তবে এ ধরনের ব্যায়াম শুরু করার আগে চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে নেওয়া দরকার। ডেলিভারির ৬ সপ্তাহ পর আপনি যখন চিকিৎসকের কাছে চেকআপের জন্য যাবেন, তখন আপনার শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ব্যায়াম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে নিতে পারেন। এ ছাড়াও ব্যায়াম করা কালীন প্রস্রাব লিক করলে তা চিকিৎসককে জানাবেন।
৩. প্রসব-পরবর্তী চেকআপে যান
প্রসবের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১ম প্রসব-পরবর্তী চেকআপের পর হাসপাতাল থেকে ছুটি নিলে পরবর্তীতে কমপক্ষে আরও তিনবার চেকআপের জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।[৬] চেকআপের সময়গুলো হলো—
- ২য় চেকআপ: প্রসব-পরবর্তী ৩য় দিনে
- ৩য় চেকআপ: প্রসব-পরবর্তী ৭ম-১৪তম দিনে
- ৪র্থ চেকআপ: প্রসব-পরবর্তী ৬ষ্ঠ সপ্তাহে
এই চেকআপগুলোয় আপনার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় টিকা এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর নিয়মসহ আরও নানান বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হবে।
৪. প্রসবের পর সহবাস সম্পর্কে জানুন
সাধারণত আপনার যোনিপথের রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেলে এবং ক্ষত সেরে গেলে আপনি নিরাপদে সহবাস করতে পারবেন। তবে সন্তান প্রসবের পর আপনার যোনিপথে অথবা পেটের সেলাইয়ে ব্যথা থাকতে পারে। পাশাপাশি আপনি মানসিকভাবেও প্রস্তুত না-ও থাকতে পারে। তাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় নিয়ে আগানোই ভালো। চেষ্টা করুন আপনার সঙ্গীর সাথে এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করার।
এ ছাড়া হরমোনাল বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে আপনার যোনিপথ শুষ্ক থাকতে পারে। সহবাসের সময় কোনো অস্বস্তিবোধ হলে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
সন্তান জন্মদানের পর বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় ওজন কমানো যাবে। এমনিতেও বুকের দুধ খাওয়ালে কিছু পরিমাণ ক্যালরি খরচ হয়৷ এতেও ওজন কিছুটা কমতে পারে। তবে হুট করে অল্প সময়ের মধ্যে ওজন কমানো ঠিক হবে না। লম্বা সময় ধরে ধীরে ধীরে ওজন কমানোই নিরাপদ।
ওজন কমানোর জন্য কোনো ডায়েট করতে চাইলে খেয়াল রাখবেন যেন আপনার খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার থাকে। কেননা এতে আপনার বুকের দুধ উৎপাদন কমার ভয় থাকবে না।
সাধারণত প্রসব-পরবর্তী ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ভারী কাজ বা ভারী ব্যায়াম না করাই ভালো। নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে আপনি নিজে যখন থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক বোধ করবেন তখন থেকেই হাঁটাহাঁটি ও হালকা ব্যায়াম শুরু করতে পারেন।
তবে সিজার অপারেশনের মাধ্যমে ডেলিভারি হয়ে থাকলে অথবা গর্ভকালীন কোনো জটিলতা থাকলে অবশ্যই যেকোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। আপনি গর্ভাবস্থার আগে থেকেই ভারী ব্যায়ামে অভ্যস্ত থাকলে অন্যদের তুলনায় কিছুটা আগে থেকেই ডাক্তারের পরামর্শে ভারী ব্যায়াম শুরু করতে পারেন।
সন্তান জন্মদানের পর বিপদচিহ্নগুলো হচ্ছে—
– জ্বর আসা ও তলপেটে প্রচুর ব্যথা হওয়া
– প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, অর্থাৎ লিক হওয়া এবং প্রস্রাবের সময়ে ব্যথা হওয়া
– যোনিপথে হঠাৎ করে অথবা প্রচুর পরিমাণে রক্ত যাওয়া। সাথে পালস বা নাড়ির গতি দ্রুত বেড়ে যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে – – – যাওয়া এবং মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাশে সাদা হওয়া
– ক্ষতস্থান অতিরিক্ত লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া অথবা ব্যথা অনুভব করা এবং ক্ষতস্থান থেকে পুঁজ ও দুর্গন্ধ বের হওয়া
– কাশি, বুকে ব্যথা অথবা শ্বাসকষ্ট হওয়া
– পায়ের রানের পেছনের মাংসপেশি ফুলে লাল হয়ে যাওয়া এবং প্রচণ্ড ব্যথা
– বমি হওয়া, মাথা ব্যথা করা এবং চোখে ঝাপসা দেখা
– ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা করা
আপনার এসব লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে যান।
সন্তান জন্মদানের পর নির্দিষ্ট কোনো খাবার এড়িয়ে চলার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যেমন: কোমল পানীয়, মিষ্টি খাবার, ভাজাপোড়া এবং অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার।
হাসপাতালে থাকাকালীন আপনার ব্যথার ধরনের ওপর ভিত্তি করে আপনাকে মুখে অথবা শিরাপথে ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হবে। হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার সময়েও প্রয়োজন হলে ব্যথানাশক ওষুধ কতদিন ও কীভাবে গ্রহণ করতে হবে তা ছাড়পত্রে লিখে দেওয়া হবে। সাধারণত প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ এক্ষেত্রে নিরাপদ। তবে প্রেসক্রিপশনের বাইরে কোনো ওষুধ সেবন করতে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
গর্ভধারণের পর ঠিক কতদিন পর থেকে আপনার মাসিক শুরু হবে, তা বলা কঠিন। কেননা একেকজনের ক্ষেত্রে এই সময়কাল একেক রকম। আপনি যদি শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ান তাহলে যতদিন পর্যন্ত শুধুই বুকের দুধ খাওয়াবেন ততদিন পর্যন্ত সাধারণত আপনার মাসিক শুরু হওয়ার কথা না। এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ না করা পর্যন্ত মাসিক শুরু হয় না।
৬ মাস পর বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার খাওয়ানো শুরু করলে এবং বুকের দুধ খাওয়ানো ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেললে সেই সময়ে আপনার মাসিক শুরু হতে পারে। তবে আপনি যদি প্রসবের পর থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি শিশুকে ফর্মুলা খাওয়ান, তাহলে ৫ থেকে ৬ সপ্তাহ পরই মাসিক শুরু হয়ে যেতে পারে।
আপনি যদি শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ান অথবা আপনার মাসিক যদি এখনো শুরু না হয়ে থাকে, তবুও আপনি সন্তান জন্মদানের ৩ সপ্তাহ পরেই পুনরায় গর্ভধারণ করতে পারেন।
তাই আপনার দ্রুত আরেকটি সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা না থাকলে এসময়ে একজন গাইনী অথবা পরিবার পরিকল্পনাকারী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।
তবে একবার সন্তান জন্মদানের পর পুনরায় গর্ভধারণের জন্য কমপক্ষে ১৮ মাস অপেক্ষা করলে ভালো হয়। এতে করে আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালোমতো প্রস্তুত থাকতে পারবেন। এসময়ের মধ্যে আপনার শরীর পূর্ববর্তী গর্ভকালীন ধকল সামলিয়ে উঠতে পারে।
সাধারণত আপনার যোনিপথের রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেলে এবং ক্ষত সেরে গেলে আপনি নিরাপদে সহবাস করতে পারবেন। তবে সন্তান প্রসবের পর আপনার যোনিপথে বা পেটের সেলাইয়ে ব্যথা থাকতে পারে।
পাশাপাশি আপনি মানসিকভাবেও প্রস্তুত না-ও থাকতে পারে। তাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় নিয়ে আগানোই ভালো। চেষ্টা করুন আপনার সঙ্গীর সাথে এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করার। এ ছাড়া হরমোনাল বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে আপনার যোনিপথ শুষ্ক থাকতে পারে। সহবাসের সময় কোনো অস্বস্তিবোধ হলে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
তবে কতদিন পর স্বাভাবিকভাবে সহবাস করতে পারবেন—তা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে।