গর্ভাবস্থায় জ্বর

গর্ভাবস্থায় জ্বর আসলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। যেহেতু শরীরে কোনো রোগ বা ইনফেকশন বাসা বাঁধার কারণে জ্বর হতে পারে, তাই মূল কারণ খুঁজে বের করে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

জ্বর আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার এক ধরনের প্রতিক্রিয়া। সাধারণত কোনো রোগ বা ইনফেকশন হলে তার লক্ষণ হিসেবে আমাদের জ্বর আসে। অন্যান্য সময়ের মতো গর্ভাবস্থাতেও জ্বর আসতে পারে।

গর্ভাবস্থায় জ্বর বা অতিরিক্ত তাপমাত্রা গর্ভের শিশুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এসময়ে ঘাবড়ে না গিয়ে জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করা এবং দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

কীভাবে বুঝবেন আপনার জ্বর এসেছে?

গর্ভাবস্থায় জ্বর না আসলেও অনেকের গা গরম লাগতে পারে। গর্ভকালীন হরমোনগুলোর প্রভাবে এবং রক্ত প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে এমন হয়। একারণে জ্বর এসেছে কি না সেটা বুঝে ওঠা কঠিন হতে পারে। তাই জ্বর এসেছে মনে হলে অথবা শরীর খারাপ লাগলে থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখুন।

জ্বর আসলে আপনার—

  • গা গরম লাগতে পারে
  • শরীরে কাঁপুনি হতে পারে
  • হঠাৎ শীত শীত লাগতে পারে
  • ঠান্ডা লাগার কিছুক্ষণ পর আবার গরম লাগতে পারে
  • স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘাম হতে পারে
  • উজ্জ্বল বর্ণের হলে ত্বক লালচে দেখাতে পারে
  • শরীর দুর্বল লাগতে পারে

এ ছাড়া শরীরের কোথাও কোনো ইনফেকশন হলে সেই অনুযায়ী বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে

জ্বর মাপার পদ্ধতি

থার্মোমিটারে তাপমাত্রা ১০০.৪° ফারেনহাইট বা ৩৮° সেলসিয়াস কিংবা তার বেশি দেখালে ধরে নেওয়া হয় জ্বর হয়েছে।[১] তবে জ্বরের ঔষধ (যেমন: প্যারাসিটামল) খাওয়ার পরে তাপমাত্রা মাপলে সঠিক ফলাফল আসার সম্ভাবনা কমে যায়।

জ্বর মাপার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো থার্মোমিটারের সাহায্যে জ্বর মেপে দেখা। হাতের কাছে থার্মোমিটার না থাকলে বুকে অথবা পিঠে হাত দিয়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কি না সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। তাপমাত্রা বেশি মনে হলে অথবা শরীরে কাঁপুনি ওঠার মতো লক্ষণ থাকলে সেটাকে জ্বর ধরে নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ নিন।

আমরা সাধারণত কপালে হাত দিয়ে জ্বর এসেছে কি না সেটা বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু জ্বর মাপার এই পদ্ধতিটি নির্ভরযোগ্য নয়।

গর্ভাবস্থায় জ্বর হলে করণীয়

গর্ভাবস্থায় জ্বর আসলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। যেহেতু শরীরে কোনো রোগ বা ইনফেকশন বাসা বাঁধার কারণে জ্বর হতে পারে, তাই মূল কারণ খুঁজে বের করে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

জ্বর আসার কতক্ষণের মধ্যে ডাক্তার দেখাবেন[২]

  • যদি তাপমাত্রা ১০২° ফারেনহাইট/৩৮.৯° সেলসিয়াস বা এর বেশি হয়, তাহলে দেরি না করে ডাক্তার দেখান
  • যদি তাপমাত্রা ১০২° ফারেনহাইট/৩৮.৯° সেলসিয়াস এর কম হয় এবং ১ দিনের বেশি সময় ধরে জ্বর থাকে, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তারের পরামর্শ নিন

অনেকসময় জ্বর নিজে নিজেই চলে যেতে পারে। তারপরেও ডাক্তারের কাছে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। শরীরে কোনো ইনফেকশন থাকলে ডাক্তার প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক অথবা অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।

জ্বর উপশমে ঘরোয়া চিকিৎসা

ঘরোয়া কিছু পরামর্শ আপনাকে জ্বর উপশমে সাহায্য করতে পারে। জ্বর পুরোপুরি সারাতে এসবের পাশাপাশি যে রোগের কারণে জ্বর এসেছে সেটিরও সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে।

জ্বর কমাতে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলুন—

  • পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিন। সম্ভব হলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে বিশ্রাম নিন।
  • প্রচুর পানি ও তরল খাবার খান। এটি পানিশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করবে। এমন পরিমাণে পানি পান করবেন যেন প্রস্রাব স্বচ্ছ ও হালকা হলুদ হয়।
  • পাতলা ও ঢিলেঢালা কাপড় পড়ুন। এতে করে আপনার শরীরে বাতাস চলাচল করবে। যদি ঠান্ডা লাগে বা কাঁপুনি আসে তাহলে পাতলা চাদর গায়ে জড়াতে পারেন।
  • রোদ ও গরম আবহাওয়া থেকে যথাসম্ভব দূরে একটা ঠান্ডা ও আরামদায়ক ঘরে থাকুন। জানালা খুলে দিয়ে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন। ফ্যান হালকা করে ছেড়ে দিন। 
  • যদি সম্ভব হয় হালকা গরম পানিতে গোসল করতে পারেন। তবে বেশি ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল না করাই ভালো। এতে কাঁপুনি হয়ে জ্বর আরও বেড়ে যেতে পারে।
  • এক টুকরা পরিষ্কার কাপড় পানিতে ভেজানোর পর সেটা চিপে কপালে দিতে পারেন। একে অনেকে জলপট্টি বলেন। চাইলে পুরো শরীর, বিশেষ করে ঘাড়, বুক ও বগল জলপট্টি দিয়ে মুছে নিতে পারেন। জ্বরের সময়ে এভাবে গা মুছিয়ে দিলে অনেকে আরাম পান। নিজে জলপট্টি দিতে কষ্ট হলে পরিবারের অন্য কারও সাহায্য নিতে পারেন।

সাধারণ অবস্থায় একজন গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। কাপ অথবা গ্লাসের হিসাবে আপনাকে সারাদিনে কমপক্ষে ৮–১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে। তবে এই বিষয়ে যদি ডাক্তার বিশেষ কোনো পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটিই অনুসরণ করবেন।

ঔষধ

গর্ভাবস্থায় জ্বরের জন্য উপযুক্ত ঔষধ হলো প্যারাসিটামল। এটি জ্বর ও জ্বরের কারণে হওয়া অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে।

প্যারাসিটামল একটি ‘ওভার দা কাউন্টার’ ঔষধ। ওভার দা কাউন্টার ঔষধগুলো ফার্মেসি থেকে কিনে সাথে থাকা নির্দেশিকা অনুযায়ী সেবন করা নিরাপদ। চেষ্টা করবেন আপনার জন্য ন্যূনতম যেই ডোজে কাজ হয়, সেই ডোজটি বেছে নিতে। এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কিংবা আগে থেকে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিতে পারেন।

উল্লেখ্য, প্যারাসিটামল কেনার সময়ে সাথে ক্যাফেইন, কোডেইন অথবা অন্য কোনো উপাদান যোগ করা আছে কি না সেটা দেখে নিন। অনেকসময় এই ধরনের ঔষধের ক্ষেত্রে নামের আগে-পরে ‘এক্সট্রা’ শব্দটা যোগ করা থাকে। গর্ভাবস্থায় এই জাতীয় ঔষধের পরিবর্তে সাধারণ প্যারাসিটামল বেছে নেওয়া উচিত।

গর্ভাবস্থায় জ্বর কমাতে যে ধরনের ঔষধ সেবন করা যাবে না

কিছু ঔষধ সাধারণ সময়ে জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হলেও গর্ভাবস্থায় সেগুলো এড়িয়ে চলবেন। যেমন: আইবুপ্রোফেন ও অ্যাসপিরিন। এগুলো ব্যথার ঔষধ বা নন-স্টেরয়ডাল প্রদাহনাশক হিসেবে পরিচিত।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে—

  • গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে এ ধরনের ঔষধ সেবনের ফলে গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। এমনকি গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।[৩]
  • গর্ভধারণের ২০তম সপ্তাহ বা তারপরে এই ঔষধ সেবন করলে আপনার অনাগত শিশুর কিডনিতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।[৪]
  • এ ছাড়া গর্ভের শিশুর হার্টের সমস্যা হতে পারে।[৫]
  • এমনকি দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে মায়ের আইবুপ্রোফেন সেবন করার সাথে শিশুর জন্মের পরে (১৮ মাস বয়সে) হাঁপানি বা অ্যাজমা হওয়ার সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।[৬]

তাই ডাক্তারের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ছাড়া গর্ভাবস্থায় এই জাতীয় ঔষধ সেবন করবেন না।

গর্ভাবস্থায় জ্বরের কারণ

সাধারণ কারণ

সাধারণ সময়ে যেসব কারণে জ্বর আসে, গর্ভাবস্থাতেও সেই কারণগুলোতে আপনার জ্বর আসতে পারে।  এর মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন। যেমন—

১. প্রস্রাবের ইনফেকশন: গর্ভাবস্থায় জ্বর আসার অন্যতম কারণ হলো প্রস্রাবের ইনফেকশন।[৭] প্রস্রাবের ইনফেকশন হলে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়াসহ কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

গর্ভাবস্থায় নারীদের প্রস্রাবের ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[৮] সঠিক চিকিৎসা না করলে এটি কিডনির ইনফেকশনসহ বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার কারণে হতে পারে। ফলে প্রসব সংক্রান্ত জটিলতা বাড়তে পারে।[৯]

২. পেটের অসুখ: ফুড পয়জনিং কিংবা এ জাতীয় পেটের অসুখ থেকেও আপনার গর্ভাবস্থায় জ্বর আসতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত জ্বরের পাশাপাশি বমি, পাতলা পায়খানা ও পেট কামড়ানোর মতো লক্ষণ দেখা দেয়।

৩. সাধারণ সর্দি-জ্বর: এটি সাধারণত ভাইরাল ইনফেকশনের কারণে হয় এবং খুব একটা গুরুতর হয় না। এতে হালকা জ্বরের সাথে সর্দি ও গলা ব্যথা থাকতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি নিজ থেকেই ভালো হয়ে যায়।

৪. ফ্লু: ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে হঠাৎ করেই তীব্র জ্বর আসতে পারে। এর পাশাপাশি গায়ে কাঁপুনি ও কাশির মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো গায়ে ব্যথাও থাকতে পারে। গর্ভবতী মা ও তাদের শিশুদের ফ্লু জনিত জটিলতায় ভোগার ঝুঁকি বেশি।[১০] তাই এসময়ে ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে।

পড়ুন: ফ্লু না কি সাধারণ সর্দি হয়েছে তা বোঝার উপায়

৫. কোভিড-১৯: করোনা হলেও গর্ভাবস্থায় জ্বর আসতে পারে। জ্বরের সাথে গলাব্যথা, কাশি, অস্বাভাবিক স্বাদ-গন্ধ পাওয়া কিংবা স্বাদ ও ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলার মতো উপসর্গ দেখা দিলে তা কোভিডের লক্ষণ হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সম্ভব হলে করোনা পরীক্ষা করিয়ে ফেলুন। 

ওপরের কারণগুলোর পাশাপাশি নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, যক্ষ্মা ও হেপাটাইটিসের মতো ইনফেকশনের কারণে গর্ভাবস্থায় জ্বর আসতে পারে।

বিশেষ কারণ

১. কোরিওঅ্যামনিওনাইটিস: গর্ভাবস্থায় আপনার গর্ভের শিশুকে কিছু আবরণ বা পর্দা ঘিরে রাখে। এমন দুটি পর্দা হলো কোরিওন ও অ্যামনিওন। এই দুটি পর্দায় প্রদাহ বা জ্বালাপোড়া হলে তাকে ডাক্তারি ভাষায় ‘কোরিওঅ্যামনিওনাইটিস’ বলা হয়।

মূলত কোনো কারণে গর্ভথলি ছিঁড়ে গেলে যোনিপথে থাকা জীবাণু এই পর্দাগুলোতে ইনফেকশন ঘটায়। তখন এই সমস্যা দেখা দেয়। এসময় জ্বর আসে। জ্বরের পাশাপাশি সাধারণত নিচের লক্ষণগুলো দেখা দেয়[১১]

  • পেটে ব্যথা
  • তলপেটের নিচের দিকে চাপ দিলে ব্যথা পাওয়া
  • যোনিপথে ঘন, দুর্গন্ধযুক্ত তরল বেরিয়ে আসা
  • হার্টবিট বেড়ে যাওয়া। হার্টবিট বেড়ে গেলে আপনার বুক ধড়ফড় করতে পারে
  • এ ছাড়া শরীরে কাঁপুনি ও ঘাম হতে পারে

২. গর্ভপাতজনিত ইনফেকশন: জরায়ুতে জীবাণু সংক্রমণের কারণে গর্ভপাত হলে কিংবা গর্ভপাত করাতে গিয়ে জরায়ুতে জীবাণু সংক্রমিত হলে তাকে ডাক্তারি ভাষায় ‘সেপটিক অ্যাবরশন’ বলে। সাধারণত প্রথম ত্রৈমাসিকে এই সমস্যা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সাধারণত গায়ে কাঁপুনি দিয়ে তীব্র জ্বর আসতে পারে। জ্বরের পাশাপাশি সাধারণত নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়[১২]

  • তীব্র পেট ব্যথা
  • তলপেটে চাপ দিলে ব্যথা
  • যোনিপথে ঘন দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব অথবা রক্ত যাওয়া

৩. লিস্টেরিয়া ইনফেকশন: দূষিত খাবার ও পানি থেকে গর্ভাবস্থায় লিস্টেরিয়া নামক ইনফেকশন হতে পারে। এই রোগটি বিরল হলেও সাধারণ মানুষের তুলনায় গর্ভবতীদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ১০ গুণ বেশি।[১৩] এটি পানিশূন্যতা, গর্ভপাত, মৃত শিশু প্রসব ও অকাল প্রসবের মতো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এই রোগে জ্বরের পাশাপাশি নিচের লক্ষণগুলো থাকতে পারে[১৪]

  • গায়ে কাঁপুনি দেওয়া
  • মাংসপেশির ব্যথা
  • বমি বমি ভাব
  • ডায়রিয়া
  • ঘাড় ব্যথা
  • মাথা ব্যথা
  • ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
  • বিভ্রান্তি

প্রতিরোধ

গর্ভাবস্থায় মূলত বিভিন্ন ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে পারলে আপনি জ্বর আসার ঝুঁকি কমাতে পারবেন। গর্ভকালীন সময়ে ইনফেকশন বা সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য নিচের নিয়মগুলো মেনে চলুন—

১. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলুন: গর্ভাবস্থায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা বিশেষভাবে জরুরি। এসময়ে বার বার সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিবেন।

যেসব ক্ষেত্রে হাত ধুতেই হবে[১৫]

  • খাবার তৈরি এবং খাওয়ার আগে ও পরে
  • টয়লেট ব্যবহারের পরে
  • শিশুর যত্ন নেওয়া, তার সাথে খেলা করা ও ডায়পার পাল্টানোর পরে
  • কাঁচা মাছ, মাংস, ডিম ও বাইরে থেকে আনা শাকসবজি ধরলে
  • পোষা প্রাণী ধরলে
  • বাগান করার কিংবা মাটি বা ময়লা ছুঁলে
  • হাতে লালা বা থুথু লাগলে
  • অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলে
  • অন্যদের ব্যবহার্য কিছু ধরলে। যেমন: দরজার হাতল, লিফটের বাটন ও টাকা

পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ইনফেকশন প্রতিরোধের উপায়

২. ভিড় ও অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন: গর্ভাবস্থায় আপনার রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এসময় যেকোনো ধরনের অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন। ভিড় ও জনসমাগম পূর্ণ জায়গায় যাওয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকুন। প্রয়োজনে মাস্ক পড়ুন। বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন।

৩. খাবারের ব্যাপারে সতর্ক হোন: খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলুন—

  • জ্বরের কারণে আপনার গর্ভের শিশুর ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা হতে পারে। ডাক্তারি ভাষায় একে  নিউরাল টিউব ডিফেক্ট বলে। ফলিক এসিড এই জটিলতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।[১৬] তাই গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার খান। এর পাশাপাশি ফলিক এসিড ট্যাবলেট অথবা ক্যাপসুল সেবন করুন।

পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিডের ডোজ

  • কাঁচা বা অর্ধ সিদ্ধ খাবার থেকে বিভিন্ন রোগজীবাণু ছড়াতে পারে। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে—
    • গরু, ছাগল ও ভেড়ার অপাস্তুরিত দুধ
    • অপাস্তুরিত দুধ দিয়ে তৈরি সব ধরনের খাবার
    • কাঁচা অথবা ভালোভাবে সিদ্ধ না হওয়া মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ
    • কলিজা ও কলিজা দিয়ে তৈরি যেকোনো খাবার
    • কাঁচা অথবা অর্ধসিদ্ধ সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি খাবার। যেমন: সুশি
    • ভালোভাবে সিদ্ধ না হওয়া ফ্রোজেন বা প্রক্রিয়াজাত মাংস। যেমন: সসেজ, সালামি ও পেপারনি
  • তাই গর্ভাবস্থায় যেকোনো খাবার ভালো করে সিদ্ধ করে খাবেন। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারের ক্ষেত্রে আগুনে ফুটানো অথবা পাস্তুরিত পণ্য বেছে নিবেন।[১৭]

৪. টিকা নিন: গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শে টিকা নিন। টিকা বিভিন্ন ইনফেকশন প্রতিরোধ করার মাধ্যমে আপনাকে ও গর্ভের শিশুকে নানান মারাত্মক জটিলতা থেকে রক্ষা করবে।

  • গর্ভবতী মা ও ভবিষ্যৎ নবজাতককে মারাত্মক টিটেনাস রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখতে টিডি টিকা দেওয়া হয়। এই টিকায় ডিপথেরিয়া প্রতিরোধেও সহায়তা করে।

সরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে এই টিকা দেওয়া হয়। সাধারণত গর্ভকালীন ৪র্থ ও ৮ম মাসে কিংবা ৫ম মাসের পর ৪ সপ্তাহ বিরতিতে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গর্ভকালীন চেকআপের সময়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।

  • ইতোমধ্যে করোনা টিকা দেওয়া না থাকলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে করোনা টিকা নিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও যুক্তরাষ্ট্রের গর্ভবতী ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান (এসিওজি)-সহ বিশেষজ্ঞদের মতে গর্ভাবস্থায় করোনা টিকা নেওয়া নিরাপদ।[১৮][১৯][২০]
  • এ ছাড়া ডাক্তারের সাথে কথা বলে প্রয়োজন অনুযায়ী নিচের টিকাগুলো নিতে পারেন—
  • ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন
  • হুপিং কাশি বা পারটাসিস ভ্যাকসিন
  • হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন
  • হেপাটাইটিস এ ভ্যাকসিন, নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন ও মেনিঙ্গোকক্কাল (B ও ACWY) ভ্যাকসিন

গর্ভাবস্থায় জ্বর কি গর্ভের শিশুর ক্ষতি করতে পারে?

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় জ্বর হলে তা মা ও গর্ভের শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে—

  • কিছু গবেষণা থেকে দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় জ্বর হলে তা গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।[২১] অবশ্য সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় গর্ভাবস্থার ১৬তম সপ্তাহ পর্যন্ত জ্বর হওয়ার সাথে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।[২২] এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
  • গর্ভাবস্থার প্রথমদিকে জ্বর আসার সাথে গর্ভের শিশুর কিছু জন্মগত ত্রুটির সম্পর্ক কিছুটা বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।[২৩][২৪] এসব ত্রুটির মধ্যে রয়েছে হার্টের রোগ, ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, ঠোঁট কাটা, মুখের তালু কাটা ও নাড়িভুঁড়ির সমস্যা।[২৫]
  • গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে জ্বর হলে এটি জন্মের পরে শিশুকে অমনোযোগিতার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।[২৬]
  • গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বা ১২তম সপ্তাহের পর জ্বর আসলে গর্ভের শিশুর অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।[২৭] গর্ভাবস্থার এই সময়ের পর তিনবার বা তার বেশি জ্বর আসলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যেতে পারে।

সব গবেষণায় গর্ভাবস্থায় জ্বরের সাথে এসব জটিলতার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।[২৮] এ বিষয়ে আরও গবেষণার অবকাশ রয়েছে। যেকোনো ক্ষেত্রেই জ্বর আসলে তা কমানোর ব্যবস্থা করা ও সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

সাধারণ জিজ্ঞাসা

গর্ভাবস্থায় জ্বর হলে কি প্যারাসিটামল খাওয়া যায়?

গর্ভাবস্থায় জ্বর কমাতে নির্দিষ্ট ডোজ অনুযায়ী প্যারাসিটামল খাওয়া যায়। এটি একটি ‘ওভার দা কাউন্টার’ ঔষধ। ফার্মেসি থেকে কিনে এনে এর সাথে থাকা নির্দেশিকা অনুযায়ী এটি সেবন করতে পারবেন। এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কিংবা আগে থেকে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিতে পারেন।
উল্লেখ্য, প্যারাসিটামল কেনার সময়ে সাথে ক্যাফেইন, কোডেইন অথবা অন্য কোনো উপাদান যোগ করা আছে কি না সেটা দেখে নিন। অনেকসময় এই ধরনের ঔষধের ক্ষেত্রে নামের আগে-পরে ‘এক্সট্রা’ শব্দটা যোগ করা থাকে। গর্ভাবস্থায় এই জাতীয় ঔষধের পরিবর্তে সাধারণ প্যারাসিটামল বেছে নেওয়া উচিত।

ডিজিটাল থার্মোমিটারে কীভাবে জ্বর মাপে?

নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে ডিজিটাল থার্মোমিটারের সাহায্যে তাপমাত্রা মাপতে পারেন—
১. থার্মোমিটারের সামনের অংশ ভালোমতো সাবান ও ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে নিন।
২. নির্দেশিকা অনুযায়ী থার্মোমিটার অন করুন।
৩. থার্মোমিটারের সামনের অংশ জিহ্বার নিচে ও মুখের যতটা সম্ভব ভেতরের দিকে ঢোকান।
৪. এবার মুখ ভালোমতো বন্ধ করুন। এমনভাবে বন্ধ করবেন যেন দুই ঠোঁট দিয়ে থার্মোমিটার সম্পূর্ণ চেপে থাকে।
৫. থার্মোমিটারের ‘বিপ’ বা নির্দিষ্ট শব্দ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
৬. শব্দ শোনার পর থার্মোমিটার মুখ থেকে বের করে তাপমাত্রা একটা ডায়েরিতে লিখে রাখুন। সাথে তারিখ ও সময় লিখে রাখতে পারলে ভালো হয়।
৭. থার্মোমিটার বগলে দিয়েও তাপমাত্রা মাপতে পারেন। সেক্ষেত্রে এমনভাবে বগল ভাঁজ করবেন যেন থার্মোমিটার বগলে আঁটসাঁট হয়ে থাকে।